নিজের সম্পর্কে কিছুই লিখার নাই। ঘুমাতে এসেছি ঘণ্টা পেরিয়েছে কিন্তু একদম ঘুম আসছে না। আপুর নড়াচড়া বুঝিয়ে দিচ্ছে সেও জেগে আছে আমার মতো। বেচারির জন্যে মায়াই হচ্ছে সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর এতো দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে। প্রথমত আমরা দুই জনেই যারযার পরিবারের একমাত্র।
আর তাই আপন না হয়েও দুজনেই অনেক আপন, কেউ কাউকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারিনা। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও না ঘুমাতে পেরে বলেই ফেলল এই ল্যাম্পটা জালিয়ে দে, ঘুম আসছে না। উঠে ল্যাম্প জালিয়ে দিলাম। আর ল্যাম্পের মৃদু আলোয় ঘরটা দেখতে লাগলাম। পুরো ঘরটাই কাঠের তৈরী, আলকাতরা দিয়ে মাখিয়ে নিয়েছে, আর তারপরেও যে জিনিসটা নজর কাড়ে সেটা হচ্ছে ঘরের আসবাব গুলো।
আমরা যে খাটে এখন শুয়ে আছি সেটা নির্ঘাত অ্যান্টিক, এছাড়াও দেয়াল আলমারিটা আর একটা সিলভারের প্রলেপ দেয়া আয়না। কি হলো কে জানে আপু উঠে বসলো আর দেখতে লাগলো আয়নাটা, ততক্ষণে আমিও উঠে বসলাম। দুজনেই একটা জিনিস ভাবছি আমরা গতরাতে এই ঘরে ছিলাম না। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইলাম যদিও ভয় করছে না কেন জানি। আর ছোটবেলা থেকেই আমাদের দুই বোনের প্রচুর সাহস, মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিস্থিতি কতবার যে নিজেদের অনুকূলে এনেছি।
কিন্তু এখন অস্বস্তি হচ্ছে খুব। আপু তো বলেই ফেলল পুনি চল এখান থেকে চলে যাই আমরা, সুবিধের ঠেকছে না আমার। ভালো করেই জানি কি বললে আপুর এই চলে যাবার ইচ্ছা সুইচ অফ করার মতো সহজেই অফ করে দেয়া যায়, আর তাই সেটাই বললাম। তুমি কি ভয় পেয়েছো আপু? আপুর মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো, সেও বুঝতে পেরেছে কথাটা উদ্দ্যেশ্যমূলক। কিন্তু চুপ করে গেলো।
একটু পরেই আপু আবার শুয়ে পরলো আর আমি উঠে এসে বাক্স সমেত তরবারিটা আবার বের করলাম। তরবারিটার দুই পাশেই তীক্ষ্ণতা, মারাত্মক ধার। চকচক করছে ওটার বাট। সেই বাটে আবার রুপা এবং স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া আর ছোট ছোট লাল চুনি পাথর। বাক্সের গায়ে অদ্ভুত কিছু লেখা আছে।
শব্দ গুলো একদম পরিচিত নয়। অদ্ভুতভাবে লিখেছে কেউ। কোন ভাষা তা বুঝতে পারছি না, মনে হচ্ছে একজন ভাষাবিদের সাহায্য লাগবে। কিন্তু যেটা সব থেকে বেশি অবাক করেছে সেটা হচ্ছে আমি ঐ অদ্ভুত ভাষাটা পড়তে পারছিলাম। ওখানে কয়েক ছত্র পদ্য লেখাঃ আমি অনুবাদ নিচে তুলে দিচ্ছি
জীবনের মোড়ে ফিরে আসবে তুমি
আর তখন তোমার পাশে এই তরবারী থাকুক
লালচে দুশমনের ভয় হয়ে
প্রতিটি পথেই তুমি পাবে তিনজন সঙ্গী
একজন তোমায় ছায়া দেবে
একজন দেবে তোমায় সঙ্গ
একজন হবে তোমার বার্তাবাহক
তবে শেষ লড়াইটা শুধু তোমার একার হবে।
এই কবিতাটুকুর সম্পর্কে কিছুই বলিনি আপুকে। ওহ এই কবিতার কি অর্থ কিছুই বুঝতে পারছিনা, যত ভাবছি তত জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সারাদিনের অদ্ভুত ঘটনাবলি আর এই অদ্ভুত ভাষা পাঠের সক্ষমতা আমাকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে। ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দুটো বেজে গেছে। আপুও ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরেছে।
আর আমারো অনেক ঘুম পাচ্ছে হটাৎ। ল্যাম্প নিভিয়ে দিয়ে এসে আপুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লাম। খুব দ্রুতই ঘুম নেমে এলো ক্লান্ত দুই চোখে। আর ঝিঝি পোকার ডাক, বুনো নিশাচর পশুপাখির ডাক যেন ঘুমপাড়ানি গানের মতো প্রভাবক হয়ে উঠলো।
আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো, নিজেকে খুব ঝরঝরে লাগছে কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এইমাত্র ঘুমাতে গিয়েছিলাম।
নিজের সারা শরীরে এক টুকরো লিনেনের কাপড় আবিস্কার করে লজ্জা পেয়ে গেলাম। একি অবস্থা কাল রাতে তো আমি পুরো দস্তুর ভিন্ন পোশাকে ছিলাম। বিছানা থেকে নামতে গিয়েই দেখলাম আমার চার পাশে দশ বারো জন অল্প বয়স্কা, স্বল্প বসনা মেয়ে দাড়িয়ে আছে নানা জিনিস নিয়ে, কারো হাতে পানির পাত্র, কারো হাতে ধূমায়িত খাবার, কারো হাতে আমার জন্যে লিনেনের পোশাক। একজন এসে পানির পাত্র এগিয়ে দিলো, আমি কোন কথা না বলে সম্পূর্ণ বিস্ময় চেপে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরপর একইভাবে কাপড় বদলে খাবার খেতে শুরু করলাম।
খেয়েদেয়ে যখন জিজ্ঞেস করতে যাবো ওরা কারা? আমি কোথায়? আর এরকম অদ্ভুত একটা ঘরে কিভাবে এলাম তখনি মনে হল আমার চোখের সামনে থেকে ওরা হারিয়ে গেলো। নিজেকে আবিস্কার করলাম একটা গুহার মাঝে। এটা মুলত একটা আগ্নেয়গিরি। একদল মানুষ সেখানে কাজ করছে একটা মন্দিরের মতো কিছু গড়ার জন্যে। ঘুরে ঘুরে দেখছি কিন্তু কেউ আমার দিকে তাকাচ্ছে না, কারো পাশে গিয়ে দাড়ালেই সে কাজ থামিয়ে মাটিতে গড় হয়ে প্রনাম করছে।
তাই এসব বাদ দিয়ে আমি ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলাম। ওরা পাহাড়ের উপরে নিচে খাজ কেটে কেটে ধাপ বানাচ্ছে আর বিভিন্ন রকম পাথর দিয়ে সেই জায়গাগুলো পূর্ণ করে চলেছে। সে এক বিশাল কর্ম যজ্ঞ। হটাৎ করে আবারো দৃশ্যগুলো বদলে গেলো। আমি একটা রক্ষা বুহ্যের উপরে দাঁড়িয়ে আছি, আর নিচে সুবিশাল যুদ্ধের ময়দান, তবে সেখানে কোন যুদ্ধ হচ্ছে না।
নানান রকম খেলা হচ্ছে, কেউ কেউ তরবারির খেলা দেখাচ্ছে, কেউ নানা শারীরিক কসরত প্রদর্শন করছে তবে একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম, সবাই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। ওদের কারো কারো হাস্যকর অবস্থা দেখে এতো হাসি পেলো যে আমি আর সামলাতে পারিনি, হেসেই ফেললাম। আর এদিকে চটাস চটাস শব্দ। ধড়মড় করে উঠে বসলাম, গালে ব্যাথা নিয়ে। আপু তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
এই তুই ঘুমের মধ্যে অমন জোরে জোরে হাসছিলি কেন? আমি মাথা নিচের দিকে দিয়ে বললাম স্বপ্ন, কিন্তু কি স্বপ্ন সেটা বলে আর আপুর মাথা খারাপ করলাম না। আপুই মনে করিয়ে দিলো আজ আমাকে এক অদ্ভুত মন্দিরে নিয়ে যাবে।
আমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিলাম। কোনমতে খাবার খাওয়া শেষ করেই ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম, আর তরবারীটা বাক্স থেকে বের করে ব্যাগে নিলাম। এর সব কিছুই আপুর অজান্তে করলাম।
কারন জানতে পারলে এটা নিতে দিতো না। বাহিরে বের হবার সাথে সাথে দেখলাম চমৎকার একটা ব্ল্যাক টিশার্ট পড়ে দাড়িয়ে আছেন ডঃ শিধু আর আপু-ভাইয়া আগেই রওনা দিয়েছে। হটাৎ করেই কালি এসে হাজির হলো, সেও আমার সঙ্গী হতে চায়। ডঃ এখানে কোন আপত্তি করলেন না, কারন কালি সাথে গেলে আমাদের উপকারই হবে। আমার ব্যাগ কালি নিজের কাধে নিয়ে নিলো, সে চায় না আমার কোন কষ্ট হোক।
পথে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছুই হয়নি তবে এর মাঝে দুবার ঢালু পথে পা পিছলে গিয়েছে আমার। দোষটা আমারই অবশ্য অন্যমনস্ক থাকার কারনে এমন হয়েছে। কালি প্রত্যকেবার পিছন থেকে আমাকে ধরেছে তা না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেও ঘটতে পারতো। সে যাই হোক একসময় পৌঁছে গেলাম মন্দিরের সিঁড়ির নিচের ধাপে। এতক্ষন পরিশ্রম করার পরে এমনিতেই হাঁপিয়ে গিয়েছি কিন্তু মন্দিরের প্যাচনো সিড়ি যা কিনা এই ছোটখাটো পর্বতের চুড়ায় গিয়ে মিশেছে সেখানে কিভাবে যাবো ভাবতেই বুকের জল হিম হয়ে আসছে।
শেষে অনেক কষ্টে অর্ধেক পথ হেটে এবং বাকী অর্ধেক কালীর কাধে চড়েই উঠলাম। কালির এই অস্বাভাবিক শক্তি দেখে আমরা সবাই হতবাক কিন্তু ও নিজেই ছিলো নির্বিকার। উপরে উঠে দেখি আপু আর ভাইয়া আগেই এসে বসে আছে। আপুর দুই চোখে তখন রাজ্যের উদ্বেগ। কি হয়েছে জানতে চাইলাম, আপু বলল এই মন্দিরের ভিতরের দিকে ছোট্ট একটা আলাদা ঘর আছে সেখানেই দেবীর একটা মূর্তি আছে মানুষের সাইজের ওটা দেখে আয়।
ডঃ শিধু আর কালি আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ডঃ আমাকে বললেন, দেখো মা পৃথিবীতে অনেক অদ্ভুত কিছুই আছে, হয়তো তার একটি নমুনা তুমি একটু পরেই দেখতে পারবে কিন্তু ভয় পেয়ো না। আমরা তোমার সাথেই আছি। বুঝলাম এখানেই আছে রহস্যের মীমাংসা। আমি মন্দিরের ভিতরের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম।
চমৎকার পাথরের একটা মন্দির, এমনভাবে তৈরি যে সবসময় বাতাস আসছে, পর্যাপ্ত আলো আসছে তবে বেশ ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করেছে আমার, নিঃশ্বাসও কিছুটা ভারী হয়ে এসেছে। এটা উচ্চতা জনিত নাকি উদ্বেগ বুঝতে পারছি না। একটু পরেই মন্দিরের নির্দেশিত অংশে চলে এলাম, কেন জানিনা মন্দিরটা আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে এই মন্দিরের প্রতিটা পাথর আমার চেনা। অবশেষে কাঙ্খিত রুমে চলে এলাম।
আর দেখতে পেলাম অল্প বয়স্কা এক মেয়ের আবক্ষ মূর্তি।
আমি নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম, আমার কথা বন্ধ হয়ে গেলো, আমার ভাবনা থেমে গেলো, চিন্তা রহিত হলো। ঐ মূর্তিটা ছিলো স্বয়ং আমার নিজের।
অ টঃ সোমাবার অনিবার্য কারনে পোস্ট দিতে পারিনি, তবে পরের অংশ বৃহস্পতিবার দেয়া হবে আবার। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন সবাই।
আর লেখার যেকোনো সমালোচনা পজিটিভ যেন হয়। আরো একটা জিনিস পরিস্কার করি এটা আমার নিজের লাইফ হিস্টরী না, এটা শুধুই একটা সাধারন গল্প মাত্র। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।