বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ রাঙামাটির লংগদু উপজেলার মাইনি নদীর তীরে দূর্গম এক পাহাড়ের গুহার দেওয়ালে ডাইনোসরের ছবি দেখে মেহনাজ অবাক হয়ে যায় । ও ঘুরে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বলে, এই মাহমুদ।
মাহমুদ একটু দূরে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একটা চকমকি পাথরের বর্শাফলক দেখছিল।
অন্যমনস্কভাবে বলল, কি, বলো?
জলদি এদিকে এসো। দ্যাখো, কারা যেন ডায়ানোসর এর ছবি এঁকে রেখেছে।
মাহমুদ খানিকটা বিস্মিত হয়ে দ্রুত পা বাড়ায়। দেওয়ালের ওপর ফ্ল্যাশ লাইটের জোরালো আলো ফেলেছিল মেহনাজ। দেওয়ালে তাকিয়েই টাইরানোসোরাস রেক্স প্রজাতির ডায়ানোসরটা চিনতে পারল।
টাইরানোসোরাস রেক্স অবশ্য টি রেক্স নামেই পরিচিত । ৪৫ ফুট লম্বা ছিল টি রেক্স। টি রেক্স - এর পাশে কয়েকজন মানুষ। মানুষগুলোকে ভীষণ খুদে দেখাচ্ছে। আর একটা গোল মতন কী যেন।
ডিম মনে হল। ডিমের আকার মানুষের অনেক ছোট। মাহমুদ বলল, আশ্চর্য! এ ছবি কারা এঁকেছে? আদিম মানুষ এ ছবি আঁকলে তাদের তো ডায়ানোসর সম্বন্ধে জানার কথা না।
মেহনাজ বলল, আর ডায়ানোসরদের যুগের মানুষ নিশ্চয়ই আঁকেনি।
মাহমুদ বলল, আরে না।
সে সময় তো পৃথিবীতে মানুষই ছিল না।
হুমম। মেহনাজ জানে আজ থেকে সাড়ে ছ কোটি বছর আগে পৃথিবী থেকে ডায়ানোসররা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। একটা বিরাট গ্রহাণু পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছিল। তার পর।
সে সময়কার সেই প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীতে মানুষ ছিল না। মাহমুদ ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বলল, ডায়ানোসর এর ছবিটা অনেক পরে আঁকা হয়েছে।
কারা এঁকেছে?
মাহমুদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, এটা তো মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন।
মেহনাজ-এর গলায় একটা ক্যানন ইওএস সেভেন ডি ঝুলছে। ও ঝটপট বেশ ক’টা ছবি তুলে নিল।
টি রেক্সের ছবিটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছিল ও । হঠাৎ বলল, তোমার হাতে ওটা কী?
মাহমুদ বলল, ওহ! এটা একটা স্পিয়াহেড। এখানেই পেলাম।
দেখি। বলে হাত বাড়াল মেহনাজ।
মাহমুদ ওকে বর্শাফলকটি দেয়। মেহনাজ ছোট্ট জিনিসটা খুঁটিয়ে দেখল। তারপর জিজ্ঞেস করে, এটা কত পুরনো বলে মনে হয় তোমার?
রেডিওকার্বন টেস্ট না করে এক্সজ্যাট টাইম বলা বলা সম্ভব নয়। তারপরও মনে হয় স্টোন এজ এর ।
তার মানে আজ থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার বছর আগেকার? বলে বর্শাফলকটি ফিরিয়ে দিল মাহমুদকে।
মেই বি। বলে কাঁধ ঝাঁকালো মাহমুদ। চারিদিকে তাকালো। সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। গুহার ভিতরে আলো কমে গিয়েছিল।
গুহামুখের বাইরে পাখিরা তারস্বরে ডাকছিল। মাহমুদ বর্শাফলকটি ব্যাকপ্যাকে ভরে নিয়ে বলল, এসো। আজ যাই। কাল আবার আসব। টি রেক্সের ওই ছবির ওপর ডিটেইস রির্পোট তৈরি করতে হবে।
বলে গুহামুখের দিকে হাঁটতে থাকে মাহমুদ।
মেহনাজ শেষ একটা স্ন্যাপ নিয়ে ওর পিছন পিছন গুহার বাইরে বেড়িয়ে এল। আকাশে একটি চাঁদ। তবে হালকা মেঘ আছে। মাইনি নদীর তীর থেকে ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছিল।
মেহেনাজ জিজ্ঞেস করল, তোমার মনে আছে মাহমুদ গতবছর পাবলাবন গেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার চঙদে আমাদের কি বলেছিল ?
হ্যাঁ। আমিও সে কথাই ভাবছি।
চঙদে-র মিথটা নিয়ে আরও ডিটেইলস জানতে হবে। মেহেনাজ বলল।
হ্যাঁ।
দেখি এরই মধ্যে সময় করে একবার পাবলাবন ঘুরে আসব।
কথা বলতে বলতে ওরা ঝোপঝার পেরিয়ে মাইনি নদীর পাড়ে চলে এল। পাড়ে একটি ছোট সাম্পান। বৈঠা হাতে গলুইয়ের ওপর বসে ছিল মাইম্রা। একুশ-বাইশ বছরের স্থানীয় আদিবাসী তরুণ।
বাংলা তেমন জানে না। তবে ওদের তেমন অসুবিধে হয় না। ওরা সাম্পানে উঠে এলে মাইম্রা বৈঠা বাইতে থাকে। এখান থেকে আরও কিছুটা দক্ষিণে ওদের বর্তমান আস্তানা। মাইনিমুখ বাজারের কাছে।
এই দূর্গম পার্বত্য জায়গাটির নাম আর্দ্রক ছড়া। মাইনিমুখ বাজার এখানে থেকে বেশ খানিকটা দক্ষিণে। আর আরও পুবে বাঘাইছড়ি উপজেলা।
নদীর পাড় ঘেঁষে গাছপালা ঘেরা একটি একতলা টিনসেড। এই গবেষক দম্পতির অস্থায়ী আস্তানা।
টিনসেডের পিছনে নিবিড় অরণ্য। ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসছিল। পাতলা জ্যোস্না ছড়িয়ে আছে বনভূমিতে। নামহীন বনফুলের গন্ধ ছড়িয়েছে।
বছর খানেক আগে মেহনাজ আর মাহমুদ রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলায় এসেছে।
অবশ্য আর্দ্রক ছড়ার এই আস্তানায় এসেছে মাসখানেক হল । মেহনাজ পড়েছে নৃবিজ্ঞানে আর মাহমুদ প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়িয়ে কিংবা চাকরি-বাকরি না করে ওরা বাংলাদেশের অনাবিস্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক এবং প্রাগৈতিহাসিক স্থানগুলিতে গবেষনা করছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। যতই ওরা প্রাগৈতিহাসিক কালের বাংলাদেশ দেখছে, ওরা ততই বিস্মিত হচ্ছে।
এ বাড়ির ছাদে একটি সোলার প্যানেল রয়েছে। রাত নটা অবধি আলো জ্বলে। ওরা পোশাক বদলে হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারে বসল। মুখোমুখি । মেহনাজ কালো রঙের একটা জামদানী শাড়ি পরেছে।
মাহমুদ ঘিয়ে রঙের সিলকের পাঞ্জাবি। সন্ধ্যার পর জ্যোস্না আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। উতল বাতাস বন কেয়ার গন্ধ ছড়িয়েছে। আজ ওদের বিবাহ বার্ষিকী। মোমবাতি নেই।
কেক নেই। গহীন অরণ্যে নিরবে স্মরণ করছে জীবনের সর্বশ্রেষ্ট দিনটি। মেহনাজ মাহমুদের হাতে হাত রাখে। ঠিক তখনই মাটি ভয়ানক কেঁপে উঠল।
ভূমিকম্প! বলে ছিটকে উঠে দাঁড়াল মেহনাজ।
অরণ্যে কাকপাখিরা চিৎকার করে ডাকছে। কম্পন এখন অবশ্য থেমে গেছে। তবে দুলুনিটা ভয়ানক ছিল। বারান্দার ময়নার খাঁচাটা এখনও দুলছে।
মাহমুদ বলল, প্রোবাবলি সিলেটের ডাউকি ফল্ট।
মেহনাজ এর মুখে উদ্বেগের ঘন ছায়া ফুটে উঠেছে। ও জানে, গত একশ বছরে বাংলাদেশে বা এর আশেপাশের অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়নি। এ সময়ে ভূগর্ভের টেকটনিক প্লেরটের সীমানায় প্রচুর শক্তির সঞ্চয় করেছে। এই শক্তি যখন ভূ-স্তর ধরে রাখার ক্ষমতা হারাবে তখন বড় ধরণের ভূমিকম্প হতে পারে। মেহনাজ জিজ্ঞেস করল, তোমার কী মনে হয়, রিখটার স্কেলে কত হতে পারে?
ছয় এর ওপর।
মাহমুদের কন্ঠস্বর কেমন গম্ভীর শোনালো।
মাইম্রা আজ বুনো আলু দিয়ে ঝাল ঝাল করে বনমোরগের মাংস রেঁধেছে। মাইম্রার রান্নার হাত চমৎকার। ওরা বনেজঙ্গলে ঘুরে বেড়ালে ঘরসংসার তো ওই সামলে রাখে। মেহনাজ কে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা করে মাইম্রা ।
খেতে খেতে মেহনাজ- এর লংগদুর পাবলাবন গেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার চঙদের কথা মনে পড়ল। গত বছর এক শীতের রাতে গেস্ট হাউজের বারান্দায় চাদরমুড়ি দিয়ে বসে চঙদে একটা উপকথা শুনিয়েছিল ... ওদের পূর্বপুরুষ নাকি অতিকায় এক জীবের ডিম ফেটে বেড়িয়েছিল। আশ্চর্য! আজ গুহার ডাইনোসর এর ছবি দেখল। চঙদে-র উপকথা আর আর্দ্রক ছড়া গুহার ডাইনোসর - এর ছবির মধ্যে কি কোনও সর্ম্পক আছে?
মাইম্রা লেবু কেটে এনে খাবার টেবিলে রাখল । মেহনাজ ওকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, মাইম্রা।
তোমরা এই পৃথিবীতে কোথা থেকে এসেছ?
মাইম্রা কথাটার মানে বুঝতে পারে না। ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মাহমুদ ওকে বুঝিয়ে দিল। এরপর মাইম্রা যা বলল-তার মানে হল-আমরা পৃথিবীতে ডিম ফেটে বেড়িয়েছি।
মেহনাজ খানিকটা বিস্মিত হল।
বাংলাদেশের এইসব প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলে এই ধরনের কত যে বিস্ময়কর মিথ ছড়িয়ে রয়েছে। ও জিজ্ঞেস করে, ডিম থেকে মানে?
মাইম্রা বলল, আমাদের গ্রামের থাইয়া বুড়ো বলে অনেক দিন আগে পাহাড় থেকে এক বিরাট জন্তু নেমে এসেছিল। সে একটা ডিম পেড়েছিল। আমরা সে ডিম ফেটে বেড়িয়েছি।
ওহ!।
মেহনাজের প্লেটে তুলে রাজহাঁসের সেদ্ধ ডিম তুলে দিয়ে মাইম্রা বলল, সে ডিম আছে।
সে ডিম আছে মানে? কোথায় আছে? রহস্যের গন্ধ পেয়ে মেহনাজ এর কন্ঠস্বর কাঁপছিল। মাহমুদকেও কেমন বিমূঢ় দেখালো।
আমাদের গ্রামের পিছনে আদমগিরি পাহাড়।
মেহনাজ মুখ তুলে মাহমুদের মুখের দিকে তাকালো।
মাহমুদের শ্যামলা মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে ... মেহনাজ মাইম্রা কে দেখছিল। ওদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় সম্বন্ধে মেহনাজ এখনও নিশ্চিত হয়নি। মাইম্রার মুখটি মঙ্গোলয়েড ধরনের তবে অন্যদের চেয়ে কোথায় যেন আলাদা। চুলের রং ঈষৎ লালচে । গায়ের রং ঠিক হলদে নয়- কেমন মাজা -মাজা, আর তামাটে।
চোখের মনির রং ঈষৎ পীত। কারা এরা? যারা বিরাট জন্তুর ডিম ফেটে বেড়িয়েছি। আজ গুহায় ডাইনোসর এর ছবি দেখলাম। সব মিলিয়ে কী দাঁড়ায়? আর্দ্রক ছড়া একটি বিচ্ছিন্ন এলাকা। এখানে যে কত রহস্য যে লুকিয়ে রয়েছে ...
পরদিন ভোরে ওরা মাইম্রাদের গ্রামের উদ্দেশে রওনা দিল।
সে গ্রামে পৌঁছতে একটা ঝিরিপথ, ঘন বেতবন আর ছোট একটি টিলা পেরোতে হল। ঝিরির দু’পাশে ঘন গাছগাছালি। হরিতকি আর অর্জন গাছই বেশি। গতকাল শেষ রাতে এদিকটায় ঝুম বৃষ্টি হয়ে গেছে। ঝিরির পানি তাই বেশি।
তবে ঝিরির পাড় ঘেঁষে চলতে তেমন অসুবিধে হচ্ছিল না।
মাহমুদ এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছিল। ওর পরনে নীল গেঞ্জি টি-র্শাট আর ঘিয়ে রঙের থ্রিকোয়ার্টাস; পায়ে নাইকি, পিঠে ব্যাকপ্যাক। শ্যামল সুঠাম চেহারা ওর; ছ’ফুট লম্বা বলিষ্ট গড়ন। মেহনাজ-এর পরনে সবুজ ট্র্যাকসুট।
পায়ে কালো রঙের পুমা কেডস। কোঁকড়া চুল টানটান করে বেঁধেছে। গলায় ক্যানন ক্যানন ইওএস সেভেন ডিটা ঝুলছে। দূর্দান্ত ছবি তোলে মেহনাজ। বঙ্গপোসাগরের ‘সোয়াচ অভ নো রির্টান’ এর ওপর ছবি তুলে নেপালে অনুষ্ঠিত একটি আর্ন্তজাতিক প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেয়েছে ও।
মাইম্রাদের গ্রামের নাম: উনছিপ্রাং। ঘন গাছপালার ভিতর খোলা জায়গায় ছড়ানো-ছিটানো মাটি থেকে বেশ ওপরে বেশ কয়েকটি বাঁশ আর ছনের তৈরি টংঘর । টংঘরের নীচে বাঁশের তৈরি খোয়ার। খোয়ারে সাদাকালো রঙের শূকর। প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামটি আড়মোড়া ভাঙছে।
ওরা গ্রামের পাশ দিয়ে আদমগিরি পাহাড়ের দিকে হাঁটতে থাকে । হাঁটতে হাঁটতে মাহমুদ ম্যাপ বার করে দেখল ... আদমগিরি পাহাড়ের পিছনেই কাপ্তাই লেক ... অনেকটা ইনল্যান্ডে ঢুকে যাওয়ার কথা। বোঝাই যায় জায়গাটা রাঙ্গামাটির অত্যন্ত প্রত্যন্ত এবং দূর্গম এলাকা।
সূর্য উঠে গেছে। মেঘহীন আকাশ থেকে ফুটফুটে নির্মল আলো ঝরছে ।
ভাদ্র মাসের সকালে ঝলমলে রোদ ছড়িয়ে আছে। ওরা আদমগিরি পাহাড়ের পাদদেশে চলে এল। যে দিকে চোখ যায় বুনো সূর্যমূখি ফুল ফুটে আছে। হলদে কার্পেট যেন!তারই মাঝখান দিয়ে রুক্ষ পাথর আর লতাগুল্ম ভরা সংকীর্ণ পথ উঠে গেছে।
মাটি থেকে প্রায় শ’ খানের ফুট ওপরে একটি শৈলগুহা।
গুহামুখের কাছে কয়েকটি ইউক্যালিপ্টাস গাছ। শৈলগুহার দেওয়ালে বড় একটা ফাটল। গত সন্ধ্যার ভূমিকম্পের ফল বলে মনে হল মাহমুদের। গুহামুখটি বেশ বড়। ভিতরে অনেকটা রোদ ঢুকেছে দেখা গেল।
অমসৃণ রুক্ষ মেঝে। দেওয়ালও অমৃণ। চুনাপাথরের গন্ধ পেল মেহনাজ। ওর তৃষ্ণা পেয়েছে। ঘামছিল।
ব্যাকপ্যাক থেকে প্লাস্টিকের বোতল বের করে এক ঢোক পানি খেল ও। হঠাৎ দেওয়ালের ওপর চোখ পড়তেই থমকে গেল। গুহার দেওয়ালে কারা যেন ডায়ানোসরের ছবি এঁকে রেখেছে। অবিকল গতকাল দেখা টি রেক্স ডায়ানোসরের ছবির মতন। মেহনাজ অবাক হয়ে যায় ।
ও চাপা স্বরে বলে, এই মাহমুদ। ওই দেখ। বলে হাত তুলে দেখালো।
মাহমুদ দেওয়ালের কাছে গিয়ে ছবি দেখে। অস্ফুট স্বরে বলে, স্ট্রেঞ্জ।
মাইম্রা হাত তুলে ইঙ্গিতে বলে, ওই যে ডিম।
গুহার মাঝখানে একটি বড় পাথর। মেহনাজ দ্রুত সেদিকে যায়। পাথরের ঠিক মাঝখানে গোল মতন জিনিসটা দেখে মেহনাজ চমকে ওঠে। আকারে
পনেরো -ষোল ইঞ্চির বেশি না।
হলদে হয়ে ওঠা খোলসে চির ধরেনি।
আশ্চর্য! এটা তো ডাইনোসর এর ডিম!
মাহমুদ স্তম্ভিত। অভিভূত কন্ঠে বলল, আশ্চর্য! ডাইনোসর এর ডিম এখানে এল কোত্থেকে?
ডিমটার একটা স্ন্যাপ নিয়ে মেহনাজ বলল, আমিও তো তাই ভাবছি। ডাইনোসরের ডিমের ফসিল সর্বপ্রথম পাওয়া যায় ফ্রান্সে। ১৮৬৯ সালে।
হ্যাঁ। তাই বলে রাঙ্গামাটিতে। ভেরি স্ট্রেঞ্জ ইনডিড!
চারিদিকে তাকিয়ে মেহনাজ বলল, গুহাটা ভালো করে দেখা দরকার।
চল।
মাইম্রা পাথরের সামনে নতজানু হয়ে বিড়বিড় কী বলছিল।
ঠিক তখনই ম্রাইমা উঠে দাঁড়ায়। দু’হাত মেলে ওদের পথ আটকে দাঁড়ায়।
কী হল? মেহনাজ এর কন্ঠে বিরক্তি।
ওদিকে যাবেন না। আমাদের গ্রামের থাইয়া বুড়ো বলছে যে ওদিকে যাওয়া বারণ।
হ্যাঁ।
কেন? কী আছে ওদিকে?
জানি না। তয় বিপদ হোবো।
এর আগে তুমি কখনও গিয়েছ ওদিকে?
না।
তাহলে? তাহলে কী করে জানলে যে ওদিকে গেলে বিপদ হোবো?
মাইম্রা চুপ করে থাকে।
সর! মেহনাজ ধমকে ওঠে।
মাইম্রা সরে যায়। গুহার ভিতরটা ক্রমে সরু হয়ে গেছে। সরু করিডোর দিয়ে ওরা হাঁটতে থাকে। ওদের পায়ের নীচে পানি।
ছোট ছোট নুড়ি পাথর। ওদের পিছনে মাইম্রা। ওর চোখমুখে কেমন একটা ঘোর। বিড়বিড় করে কী যেন বলছিল সে।
এদিকে আরেকটি গুহামুখ।
কয়েক’শ ফুট নীচে নেমে গেছে। নীচে একটি গভীর খাদ। পরিত্যক্ত আগ্নেয়গিরি জ্বালামুখ মনে হল। মেহনাজ ভালো করে তাকিয়ে দেখল, অনেক নীচে সবুজ উপত্যকা। টলটলে পানির একটি হ্রদও আছে ।
হ্রদের পারে উঁচু উঁচু ছুঁচলো সবুজ পাতার কনিফার গাছ।
হঠাৎ মেহনাজ এর শরীরের রক্ত জমে যায়। হ্রদের পাড়ে অতিকায় একটা প্রাণি লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। এক এক লাফে কম করে ১৫ ফুট দূরত্ব অতিক্রম করছে। লম্বায় প্রায় ৪৫ ফুট হবে।
ওর মুখ থেকে ছিটকে বেরুলো, ডাইনোসর!
হ্যাঁ। টি রেক্স। দ্রুত ব্যাকপ্যাক থেকে বাইনুকুলার বের করে চোখে ঠেকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল মাহমুদ।
জুরাসিক যুগের অতিকায় প্রাণিটির দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে
মেহনাজ বলল, আশ্চর্য! এখানে টি রেক্স ! কিন্তু,কিন্তু, কীভাবে সম্ভব?
গড নোজ। বলে কাঁধ ঝাঁকালো মাহমুদ।
উত্তেজনায় ওর বুক কাঁপছিল।
কিন্তু,কিন্তু, জিওলজিস্টরা তো বলছেন বাংলাদেশের সবচে পুরনো ভূমি তৈরি হয়েছে আজ থেকে বড় জোড় ২৫ লাখ বছর আগে। অথচ ... অথচ ডাইনোসরা তো বেঁচে ছিল আজ থেকে ছ কোটি বছর আগে।
মাহমুদ বলল, এর উত্তর সোজা।
কী? মেহনাজকে কেমন বিমূঢ় দেখালো।
জিওলজিস্টরা এই জ্বালামুখে নেমে সয়েল টেস্ট করেননি। বলে হাসল।
ওহ! মেহনাজ ক্যাননটা তুলে নিয়ে জুম করে। ঝটপট প্রাগৈতিহাসিক প্রানিটার ছবি তুলতে থাকে। ওর বুক ভীষণ কাঁপছে।
ও জানে ইন্ডিয়ার গুজরাটে জুরাসিক যুগের গাছের ফসিল পাওয়া গেছে। ও জিজ্ঞেস করে, আমরা কি জুরাসিক যুগের দৃশ্য দেখছি মাহমুদ ?
অফকোর্স। তবে ওই দৃশ্যটা ক্রিটেশিয়াস পিরিয়ডেরও হতে পারে।
মেহনাজ জানে, ডাইনোসররা ক্রিটেশিয়াস যুগের শেষ অবধি টিকে ছিল। ওরা ১৬ কোটি বছর পৃথিবী শাসন করেছিল।
কিন্তু... কিন্তু ... ডাইনোসর এই রাঙ্গামাটিতে এল কীভাবে? ও জিজ্ঞেস করে, তোমার কি মনে হয় মাহমুদ নীচে ওই হ্রদে ডানক্লেওসটিয়াস মাছ থাকতে পারে?
লেটস চেক ইট আউট।
ওয়ান্ট টু গো ডাউন?
অফকোর্স। বলে মাহমুদ ঝুঁকে দেখল। পাহাড় খাড়া হলেও সাবধানে নামা যাবে। দু’শো ফুট নীচে বড় একটা পাথরের তাক আছে।
তারপরে জায়গাটা অনেকটাই ঢালু। ব্যাকপ্যাকে ক্লাইম্বিং রোপ আছে। দড়ি বেয়ে নেমে যাওয়া কঠিন হবে না। মাহমুদ বলল, মেহনাজ?
বল।
ভেবে দেখ, ডাইনোসরটা ওপরে এসে ডিম পেড়ে যায়নি।
ডিমটা কেউ ওপরে এনেছে। হয়তো মাইম্রাদের কোনও পূর্বপুরুষ।
তার মানে নীচে নামার পথ আছে? মেহনাজ নীচে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
অফকোর্স।
তাহলে চল নামা যাক।
অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মেহনাজ এর শরীরের রক্ত চমমন করে উঠল। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠেছে। এই অবিস্কারের সংবাদ যখন বিশ্বের বিজ্ঞানীরা জানবে ...তখন ... তখন ... ভাবতে ভাবতে শিউরে উঠল মেহনাজ।
সমস্যা হল মাইম্রা কিছুতেই ওদের নীচে যেতে দেবে না। ওরা ওকে বোঝাল।
মাইম্রা বারবার বলতে লাগল, আমাদের গ্রামের থাইয়া বুড়ো বলছে ওদিকে যাওয়া বারণ। হ্যাঁ। ওদিকে যাওয়া বারণ আছে।
মেহনাজ এবার রুক্ষস্বরে বলল, দেখ মাহমুদ! ভন্ড পুরোহিতরা কীভাবে সহজ-সরল মানুষের মগজ ধোলাই করেছে। স্বাভাবিক একটি ঘটনাকে তারা রং চড়িয়ে কেমন ধোঁয়াটে অবসকিউর করে তুলেছে।
মেহনাজ রেগে গেছে বলে মাথা নীচু চুপ করে রইল মাইম্রা ।
ওরা দড়ি বেয়ে নীচে নামতে লাগল। দু জনেরই ট্রেকিং করার অভ্যেস আছে। ইউনিভারসিটি লাইফে বান্দরবান-তিন্দু দাপিয়ে বেড়িয়েছে। তাকের ওপর নেমে আসছে অসুবিধে হল না।
এখানেও একটি গুহা। তবে ভিতরে ঢোকার সময় নেই। নীচে নামার জন্য ওরা ভীষণ অস্থির বোধ করছিল। বাতাসে কেমন গন্ধকের গন্ধ। বাতাসও বেশ খানিকটা উষ্ণ।
দরদর করে ঘামছিল দু’জন। পাথরের বড় বড় বোল্ডার এড়িয়ে ওরা সাবধানে নীচে নেমে এল। মুখ তুলে ওপরে তাকাল মেহনাজ। জ্বালামুখের ওপরে ভাদ্রের ফিরোজা রঙের আকাশ। পাথুরে দেয়ালের ওপর রোদ পড়েছে।
উপত্যকার একপাশে ঘন ছায়া। পায়ের নীচে পাথর। পাথরের ফাঁকে সবুজ উদ্ভিদ। ঘাস কিনা কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
চারিদিকে তাকিয়ে মাহমুদ বলল, প্রি-হিসটোরিক এজে সম্ভবত অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল।
এই ধর আজ থেকে দশ কোটি বছর আগে। তারপর আর হয়নি মনে হয়। কোনওভাবে জুরাসিক যুগের যুগের পরিবেশ টিকে আছে এখানে। যে কারণে আজও ডাইনোসরা টিকে রয়েছে।
মেহনাজ বলল, অবিকল স্যার আর্থার কোনান ডয়েল-এর দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড উপন্যাসের মতন।
প্রাগৈতিহাসিক আগ্নেয় গহব্বরটি ভীষণ স্তব্দ হয়ে আছে । হ্রদ খানিকটা দূরে । হ্রদের পাড়ে কনিফার গাছের সারি । টি রেক্সটা এখান থেকে অনেকটাই দূরে। ওরা দেখতে পেলেও ওদের দেখতে পায়নি ওটা।
ওরা হাঁটতে থাকে। কনিফার গাছের গভীর ছায়ায় ঢাকা হ্রদের পাথুরে পাড়ে শুকনো পাতার স্তুপ । হ্রদটি বিশাল । স্বচ্ছ জল টলটল করছে। আকাশের ছায়া পড়েছে।
বাকিটা ছায়ায় ঢাকা। হঠাৎ হ্রদের জলে কাঁপন ওঠে। মেহেনাজ স্বচ্ছ জলের নীচে পরিস্কার একটা বিদঘুটে জলজ প্রাণি দেখতে পেল। প্রাণিটা লম্বায় প্রায় ১৫ ফুট। নীচের চোয়ালে বৃত্তাকার করাতের মতন অনেক দাঁত।
মেহনাজ ফিসফিস করে বলে, হেলিকোপ্রিয়ন!
মাহমুদ বলল, হুমম। এদের খুব ফসিল পাওয়া যায়নি। হাঙ্গরের জ্ঞাতি ভাই।
মেহনাজ ওই কুৎসিতদর্শ প্রাণিটা ছবি তোলে। ঠিক তখনই হেলিকোপ্রিয়নটা পানির ওপর ভেসে উঠল।
তারপর আবার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। উপত্যকার নির্জনে জলতরঙ্গের শব্দ ছড়িয়ে পড়ে। টি রেক্সটা মুখ ঘুরিয়ে এদিকে তাকাল। ওদের দেখতে পেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে আসতে থাকে ।
ওহ মাই গড! মেহনাজ চিৎকার করে উঠল।
মাহমুদ চিৎকার করে ওঠে, রান! মেহনাজ রান! মেহনাজ ঘুরে দাঁড়িয়ে দৌড়াতে থাকে। ওর ঠিক সামনে মাহমুদ। পিছনে থপ থপ থপ শব্দ হচ্ছে। ঢালের কাছাকাছি পৌঁছতেই পায়ের তলার মাটি থরথর করে কেঁপে উঠল। চারপাশের পাহাড় থেকে বড় বড় পাথর ঝরে ঝরে পড়তে লাগল।
মাহমুদ চিৎকার করে উঠল, ভূমিকম্প! কুইক! রান!
প্রাণপন দৌড়ে ওরা ঢালের কাছে পৌঁছে যায়। তারপর পাথরের ফাঁকফোঁকড় দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে। তারপর কখন যে তাকের ওপর পৌঁছে গেল ওরা। দু’জনে একসঙ্গে দড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাইম্রা ওপর থেকে দড়ি ধরে টানতে লাগল।
ওরা গুহার উঠে আসতেই নীচের তাকটা ভয়ঙ্কর শব্দে ধ্বসে পড়ল। দৌড়াতে দৌড়াতে ওরা গুহা পেরিয়ে গুহামুখের বাইরে চলে আসে। ঠিক তখনই প্রচন্ড শব্দে গুহাটা পাথরে বুজে গেল। পাথরের ঘর্ষনের আগুন ধরেছিল। গুহামুখ সাদা ধোঁওয়ায় ভরে উঠল।
বাতাসে গন্ধকের গন্ধ ছড়ালো।
ইউক্যালিপ্টাস গাছের নীচে বড় একটা পাথর। তার ওপর বসল ওরা । তিনজনই প্রচন্ড হাঁপাচ্ছিল। ব্যাকপ্যাক থেকে পানির বোতল বার করল মাহমুদ।
মাইম্রা বলল, বললাম না, বিপদ হবে।
মাহমুদ হেসে বলল, দূর বোকা, বিপদ কই। এর আগে ভূমিকম্প দেখিনসি?
ডাউকি ফল্ট? মেহনাজ জিজ্ঞেস করল।
প্রোবাবলি।
মেহনাজ বলল, ইস !
কী হল?
ডাইনোসরের ডিমটা আনা উচিত ছিল।
ওট না দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না রাঙ্গামাটিতে ডাইনোসর আছে।
মাহমুদ এক ঢোক পানি খেয়ে বলল, কেন তখন ছবি তুললে না? সবাইকে সে ছবি দেখালেই তো চলবে।
ওহ! তাই তো। বলে মেহনাজ খেয়াল করে দেখল ক্যামেরা নেই। কোন ফাঁকে পড়ে গেছে।
ইস! ডাইনোসর দেখতে গিয়ে আমার সখের ক্যামেরাটাও হারিয়েছি।
মাহমুদ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, কী আর করা। বলে এক ঢোক পানি খেল ও।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।