এটা আমার জন্য অনেক সুখকর যে, আমি এখন ব্লগ ও ফেইসবুক থেকে নিজেকে আসক্তিমুক্ত রাখতে পারছি। পরিবার ও পেশাগত জীবনের কর্মব্যস্ততা অনেক আনন্দের। ১
সন্ধ্যা হলেই সারা বাড়ি ভরে লুকোচুরি খেলার ধুম পড়ে যেতো। পিয়ারীবুবু আমার ছোট্ট শরীরের সবটুকু তার বুকের ভেতর লেপ্টে পেলব হাতে আমার চোখ বাঁধতেন। পোলাপানেরা দৌড়ে কোণাকাঞ্চিতে লুকিয়ে চিকন ও লম্বা ‘টুউউউ’ শব্দ করলে বুবু আমাকে কোল থেকে ঠেলে দিয়ে বলতেন- ‘যা, ছু’।
হাওয়ার বেগে ভোঁ ভোঁ ছুটে গিয়ে যে কাউকে ছুতে পারলেই সে ‘গাভী’।
পিয়ারীবুবুর বিয়ে হয়ে গেলে অনেকদিন অমন মজা করে লুকোচুরি খেলা হলো না। পিয়ারীবুবুর বিরহে আমার খুব কান্না পেতো।
যুদ্ধের সময়ে পাখিবুবুরা গ্রামে চলে এলেন। আমাদের তখন কী অস্থির সময়; কিছু বুঝি, অনেকখানিই বুঝি না।
কিছুদিন পর আবারও আমাদের সন্ধ্যাগুলো মুখর হলো। আঁধার নামলেই তড়িঘড়ি জড়ো হই। পিয়ারীবুবুদের সেই ঘরের দাওয়ায়, যেখানে বুবু আমাকে খুব ঘনিষ্ঠ করে কোলে চেপে বসতেন, পাখিবুবুও বসেন। বুবুর কাছে দৌড়ে ছুটে যাই 'গাভি' হবো বলে; কিন্তু তাঁর কৃপানজরে পড়ি না, ‘গাভি’ও হতে পারি না; ‘গাভি’ হতে কোনো গর্ব নেই, সবচেয়ে নিঃস্ব, অপারগ ও ছাপোষা পোলাপানই ‘গাভি’ হবার যোগ্যতা রাখে। ‘গাভি’ হবার যন্ত্রণা, কষ্ট ও বিড়ম্বনা সবচেয়ে বেশি; ‘গাভি’র কোনো আনন্দ নেই; ‘গাভি’কে সবাই খাবলে খামচে ঘা করে দেয়; আমি পিয়ারীবুবুর কোল থেকে লাফিয়ে নেমে এক দৌড়ে সবাইকে তাড়া করেও কাউকে ছুতে পারি নি; আমি সারাজীবন খামচিখাওয়া ‘গাভি’ই হতে চেয়েছি।
একদিন ‘গাভি’ হবার বাসনায় পাখিবুবুর কোলে বসতে উদ্যত হতেই বুবু ভর্ত্সনা করে বলেছিলেন, ‘বুইড়া পোলা...., যা সর্। ’
পিয়ারীবুবুর জন্য আমি অনেক কেঁদেছি। পাখিবুবুর জন্যও গোপনে গোপনে কেঁদেছি অনেকদিন। আমি ‘বুড়ো’ হতে হতে অনেক বড় হয়ে গেছি, বুবুরা আমাকে মনে রাখেন নি; আমিও তাঁদের ঠিকানা জানি না।
যে মেয়েটি আমাকে জীবনে প্রথম ফুল দিয়েছিল, আর অপূর্ব কিছু হাসি, ভাঙা কয়েকটি শব্দে একটা চিঠি, আর বলেছিল আমাকে তার ভালো লাগে, আমি তাকে সুদীর্ঘ কিছু চিঠি লিখে কৃতজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলাম।
অনেক অনেক দিন পর ধলেশ্বরী নদীর তীর ধরে ধু-ধু দূরে একটা মেয়েকে হেঁটে যেতে দেখে মনে হয়েছিল- ওর নামই হতে পারে আফরোজা।
পারুলআপা একদিন এ্যালবাম ঘেঁটে আমার সবচেয়ে ফুটফুটে ছবিটা হাতে নিয়ে বললেন, ‘এটা আমি নিলাম। ঘরে ঝুলিয়ে রাখবো, বুঝলে খোকা?’ আর আদর করে আমার নাক টিপেছিলেন। আমি তিনদিন চুরি করে পারুল আপার ঘরে ঢুকেছিলাম। আমার বুক আজও পুড়ে যায়।
পারুল আপা আমায় ফাঁকি দিয়েছিলেন।
আরও একটা ঘটনা জীবনে প্রথম ঘটলো, এই সেদিন, এই অর্ধ প্রৌঢ়ে এসে। মহীয়সী বললেন, ‘আপনি চিরকালই আমার মন জুড়ে থাকবেন। ’ ........... তারপর তিনিও তাঁর কথা রাখতে পারেন নি।
২
নূরপুর মাঠে পৌষসংক্রান্তির মেলা।
সারা বছরের সমস্ত সাধ জমা করে রাখি, কবে আসবে পৌষসংক্রান্তির দিন। তুমুল ঘোড়দৌড়, পাগলা ষাঁড়ের তেঁজ, মুরলি-চানাচুর- কী যে নেশা।
মেলার দিন ভোর হতেই অস্থির হয়ে উঠি। পাড়ার সাথীরা মিলে জটলা করি, সময় কাটে না কখন বিকেল হবে।
আবুল, নুরু, জসিম, আরও অনেকে।
আমি দুপুর হতে না হতেই প্রস্তুত হয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করি।
‘নু, যাবি না?’ আমি, আবুল আর নুরুকে তাড়া দিই।
নুরুদের গরুগুলো তখনও চকের ক্ষেতে ঘাস খায়; আবুলেরও দেরি হয়ে যায় কী কারণে জানি না। আমি ওদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। দুয়ারে অস্থির পায়চারি।
আবুল আর নুরু, ... ওরা কখন আমাকে ফেলে মেলায় চলে যায়, আমাকে ডাকেও না।
৩
ছোটো খালা আমাকে খুব আদর করতো ছোট্টবেলায়। কোঁচড়ভর্তি মোয়া আর রঙ্গিন নেবুনচুষ নিয়ে আসতো আমার জন্য, প্রতিবারই আমাদের বাড়িতে আসবার কালে। নানাবাড়িতে গেলে সারাদিন আমাকে নিয়েই মেতে থাকতো ছোটো খালা। আমি ছোটো খালার কলজের টুকরো ছিলাম।
ছোটো খালার বিয়ে হয়ে গেলে বেশি সময় আমি খালাদের বাসায়ই থাকতাম। খালা আমাকে কতো আদর করতো!
আমার খালাতো ভাইবোনেরা বড় হতে হতে খালার আদর কমতে থাকলো না।
একদিন খালা আমাকে খুব কষ্ট দিল। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ে গেলো। খালা তা বুঝলো না বলে আমার বুক ফেটে যেতে থাকলো।
খালু সেদিন বাজার থেকে অনেক বড় একটা ইলিশ মাছ এনেছিল। ইলিশটার পেট ভর্তি ছিল ডিমে। ডিম আমার অনেক ভালো লাগে। সব ভাইবোন মিলে খেতে বসলাম। খালা দু টুকরো ডিম দু খালাতো ভাইবোনের পাতে তুলে দিয়ে আমাকে দিল পিঠের কাঁটাঅলা মাছটা।
আমি মনে মনে খুব কেঁদেছিলাম। আমি তো খালার হাতের ডিমের টুকরো চাই নি, খালা আমার কথা আর আগের মতো ভাবে না- কেবল এটাই আমার বুকে তোলপাড় ঢেউ তুলতে লাগলো।
এরপর খালার আদর ভুলে যেতে থাকলাম।
৪
গালিমপুরে আমার এক ধর্মবোন থাকতো। পাখির মতো তার কণ্ঠে ‘ভাইয়া’ ডাকটি কী যে ভালো লাগতো! আমার জন্য সে জান দিত।
একদিন বিকেলে না বলে-কয়ে হীরাদের বাড়িতে গিয়ে দেখি মহাধুমধাম। হীরার ছেলের মুসলমানি। অনেক আত্মীয়স্বজন। আমাকে দেখে হীরা যে বেজার হলো তা নয়, তবে আন্দাজ করলাম সে বিব্রত হয়েছে; এমন একটা উপলক্ষে আমাকে দাওয়াত করে নি, হয়তো সেজন্য।
খেতে বসে আমাকে দেখে কেউ একজন ‘এই কুটুমকে ঠিক চিনতে পারলাম না’ বললে হীরা শুকনো স্বরে যখন জানালো, ‘উনাদের বাড়ি পদ্মার পাড়ে’, আমি তখন খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সে এখনই বলবে, ‘উনি আমার অতি প্রিয় বড় ভাইয়া’।
আমি আরও ভাবছিলাম, এই বুঝি হীরা অন্তত ‘ভাইয়া’টুকু সম্বোধনে ডেকে উঠে সবাইকে বুঝিয়ে দেবে, আমি এ বাড়িতে অতি সম্মানীয় একজন, নিদেনপক্ষে অপ্রত্যাশিত কেউ নই।
ধর্মবোনের কথাও আমাকে ভুলে যেতে হয়েছে।
৫
ছায়ার ও-পাশে আরেকটা ছায়ার ভেতর গোপন উদ্ভাস
অনায়াস অদূরে নিশ্বাসের ঘ্রাণ
অদিতির এক ফুল অপরূপ কলা হয়ে ফোটে
কবিতার মতো
কবিতাকে মনে পড়ে
কবিতাকে মনে পড়ে ঠিক তার কবিতার মতো
কবিতার কী জানি কী হয়েছিল কোনো এক শরতের ভোরে
আকাশ ছিল না মেঘলা, তার বুকে প্রেমিকের গন্ধ ছিল না
চোখ দুটো উদাস ছিল না, কী জানি কী হয়েছিল কেউ তা জানে না
কবিতাকে মনে পড়ে
তারপর কবিতাকে ছুঁতে গিয়ে ভিখারি হয়েছি, আঙুলগুলো একে একে খসে গেছে,
বর্ণমালারা বিকলাঙ্গ পিঁপড়ের মতো মুষড়ে পড়ে ক্রন্দন করেছে
দূরবর্তিনী প্রেমিকার মতো কবিতা ক্রমশ লাস্যময়ী হয়ে উঠেছে
কবিতা, সত্যিকারেই তুমি জানো না, কখন কবিতা হয়ে ওঠো;
অবশ্য আমারও অনেক অজানা থেকে যায়, কীভাবে তোমার পায়ের ছাপ
থোকা থোকা ফুল হয়ে হেসে ওঠে, তোমার বাহুস্পর্শ শরীরে আগুন জ্বালে,
কীভাবে নীরবে আমার চারপাশে কবিতার বীজ বুনে যাও, মনোরম বৃক্ষের মতো
তারপর সুদৃশ্য কবিতা হয়ে ওঠো!
৬
‘অদ্ভুত সুন্দর লেখো তুমি’। আমার বক্ষে বারুদ উসকে দিয়ে
ঘুড়ির মতো আকাশে উড়তো কবিতা। রাতভর কবিতা লিখে পাতার উপর
অদৃশ্য ছবি আঁকতাম - তারপর ঘোরের মতো ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে আমিও শূন্যে উড়াল দিতাম।
একদিন শাহনাজকে বলেই ফেললো কবিতা, ‘এসব কী লেখে ও? কিচ্ছু হয় না; কবিতা খুব অন্য জিনিস’!
দুঃখের ভেতর কবিতাকে মনে পড়ে
কবিতাকে অহরহ মনে পড়ে
কবিতাকে ভুলে যেতে যেতে মনে পড়ে
৭
পউষের শেষে প্রথম পাতারা ঝরে যায় যেমনি, তেমনি সরে গেছে পুরোনো বন্ধুরা
নতুন বছরের আগের রাতে
ওরা কতো সুগন্ধি ছড়াতো, হর্ষনদীর ফোয়ারা ফোটাতো
শংসাকাহিনী শোনাতো মুখর সকালদুপুরে
তারপর হেসেখেলে যেতে যেতে বলেছে কেবল ওদের কথাই
আমার কথাটি মনেও পড়ে নি
আমার কথাটি মনেও রাখে নি
২৮ এপ্রিল ২০১০/ ৭ সেপ্টেম্বর ২০১০/১ জানুয়ারি ২০১০ রাত ৮:৩১/৯ জুন ২০১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।