আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

“আমরার কাম নাই তাই নাদার গীত গাই”

ভাটির দেশে উপরের কথাটি খুব প্রচলিত। এই কথার মাজেজা হল আউল ফাউল কাজ করার জন্য বেকার লোকদের হাতে অফুরন্ত সময় আছে। সমস্যা হল অর্থনৈতিক ব্যাবস্থা, সরকার ও ভূপ্রাকৃতিক কারনে হাওর এলাকায় কাজের ক্ষেত্রের পরিমান খুবই কম। “কথায় আছে বর্ষায় নাও আর হেমন্তে পাও” বছরের ৯ মাসই কেটে যায় পানিবন্দি থেকে আর বাকি ৩ মাস চলাফেরার জন্য পাই সম্বল। এরজন্যই মনে হয় এই এলাকায় আউল-বাউলের এত আধিক্য, কাজ না থাকলে গান গেয়ে অন্তত মনের খোরাকের যোগান হয় এই আরকি।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ কিন্তু প্রকৃত হিসাবে এর সংখ্যা আরও বেশি। অর্থনীতিবিদদের মতে বেকারত্ব একটি বিরাট সমস্যা। বেকারত্বের হার দেখেই অর্থনীতির ডাক্তারেরা বলে দিতে পারেন কোন দেশ কতটা সবল। বেকার লোকেরা যে শুধু অর্থনীতির জন্য সমস্যা তা না, সমাজের জন্যও এক বোঝা স্বরুপ। এই লেখায় ভ্রমন বৃত্তান্তের মাধ্যমে বেকার সমস্যা আর স্থানীয় বেকারদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণের চেষ্টা করব।

পারিবারিক কাজে যাচ্ছি সিলেট শহর, কুমারগাও বাসস্ট্যান্ডে থামা মাত্রও একদল লোক গাড়ি ঘিরে ধরল! উনারা গাড়ি দেখছেন, পানের পিক ফেলতে ফেলতে কেউবা আবার আঞ্চলিক ভাষায় খিস্তি খেঁউড় ছাড়ছেন, উনারা আল্লার মাল বেকার, হাতে কাম নাই তাই বেহুদা আতি উতি করছেন। সকাল ১১:৫৮ মিনিটে সুবানিঘাটস্ত সিলেটের যে ব্যাংকে গেলাম সেখানে ব্যাস্ততা নেই বললেই চলে, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল বলে অফিস সাপোর্ট স্টাফদের কাজ বেড়ে গেছে। কেউ ভিতরে ঢুকলেই পরিষ্কারী লাঠি নিয়ে ঝাপিয়ে পরছে এক ফোঁটা কাদা মাটি না রাখার পণ নিয়ে। যার কাছে গেলাম তিনি আমাকে দূরে বসতে বললেন, সামনের গ্রাহককে বিদায় করে কিছুক্ষণ গা মুড়ামুড়ি করলেন পাশের এক পেটলা সহকর্মীর সাথে ইয়ার্কি ফাজলামো করলেন একটু হাঁটলেন একটু বসলেন এই করে আধা ঘণ্টা পার করে আমার কাছে এসে খাস সিলটি লাবজে অপেক্ষা করিয়ে রাখার জন্য ক্ষমা চাইলেন। মনে হল আধা ঘণ্টা বসিয়ে রাখার ব্যাপারটা কোন সমস্যাই না! শুনেছি এইসব আতেল মার্কা নব্য ব্যাংকারদের নাকি বিবাহের বাজারে হেব্বি কদর, আমি বেকার তার উপর অবিবাহিত আমাকে মাত্র আধাঘণ্টা বসিয়ে রেখেছেন বুঝতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলাম।

আমার সাথে প্রাথমিক কাজ শেষে তিনি আমাকে দুতলায় আরেকজনের কাছে নিয়ে গেলেন। দুপুর ১টা বাজতে চলল, তিনি আমাকে ১ ঘণ্টা বাইরে ঘুরে আসতে বললেন, আমি বললাম সিলেটে আমার কোন ইয়ার-বান্ধবী নাই যার সাথে আজাইরা ঘুশুর ফুশুর করব, ও আচ্ছা তিনি ইতিমধ্যে জেনে নিয়েছিলেন যে আমি কি করি। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লাস্টিকের খেছর খেছর শব্দে মেজাজ আরও চড়ে গেল, ব্যাংকাররা সবাই অজু আর লুটা-মুটা নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন এই করতে করতে ২টা, ২টা ১০এ গেলাম আবার উনার কাছে এইবার উনি বললেন আজকে কাজ হবে না কাল আসতে হবে, আমি বললাম আমি সুনামগঞ্জ থেকে এসেছি কাল আবার সুনামগঞ্জ থেকে আসতে বলছেন? আমি তাকে বললাম কাল আসতে পারবনা এক্কেবারে রবিবার আসব। কাজ হবে না সেটা জানলে আমাকে বসিয়ে রাখার মানে কি? কারন আমি বেকার, বেকারদের সময়ের দাম নাই? সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে যারা চলাফেরা করেছেন তারাই বলতে পারবেন আমি কেন পরদিন যেতে চাইছিলাম না আর বেহুদা কোমরটারে বেকায়দায় ফালাইয়া নিকট ভবিষ্যতের বিবাহিত জীবনকে সংকটে ফেলতে চাইনি সেটাও একটা কারন বটে। সুনামগঞ্জ ফেরার পথে আরও চমকপ্রদ কিছু দৃশ্য দেখলাম।

ইদানিং বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজন সুস্থ সবল দামি ষ্টীলের পিলারগুলি তুলে সিমেন্টের পিলার বসাচ্ছেন। সাদা চোখে দেখলে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে বোঝা যাবে কিন্তু ঠিকাদার লসে কেন এই পিলার পুনঃস্থাপনের কাজ নিলেন? কারন আর কিছুই না, স্ক্র্যাপ হিসাবে যে ষ্টীলের পিলার পাওয়া যাবে তা বেঁচে বিশাল মুনাফা করার হাতছানি। সে চুরি বাটপারির অন্য কিচ্ছা এখন আসি মূল বিষয়ে, বিদ্যুৎ কর্মীরা নিভিন্ন কসরতে সিমেন্টের বড় বড় পিলারগুলি সোজা করার চেষ্টা করছেন আর ডজন ডজন লোক হা করে তাদের কাজ দেখছে কারন আর কিছুই না তাদের হাতে কাজ নাই তাই নাদার গীত গাওয়া। সামনে একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম বিশাল দেহের এক ক্রেন, এমন দশাসই সাইজের যন্ত্র এই তালুকের কোন লোক মনে হয় দেখে নাই তাই প্রায় শখানেক লোক তা মুগ্ধ নয়নে দেখছে কারন তাদের হাতে রয়েছে অফুরন্ত সময়। ৬০ কিঃমিঃ‘র রাস্তা দুই ঘণ্টা জার্নির পর শেষ হল, যেন এক আজাব থেকে মুক্তি পেলাম।

শহরের ভিতরে ঢোকার পর দেখলাম কালীবাড়ির একপ্রান্তে সন্ধ্যাকালীন মাছের পসরা বসেছে। স্বভাবতই বিক্রেতার চেয়ে ক্রেতা অনেক বেশি কিন্তু তারচেয়েও বেশি দর্শকের সংখ্যা। নব্য ভুমিদস্যু, সুদখোর আর ঘুসখোরদের দখলে এই তরতাজা বিল থেকে আনা মাছের বাজারটি। সাধারণ বাদাইম্মা মানুষজন শুধু মাছের দিকে তাকিয়েই চোখের ক্ষুধা মেটাচ্ছে। পরদিন একটি টেলিফোন সংযোগের জন্য গেলাম টিএন্ডটি অফিসে প্রসঙ্গত এর আগের দিন আব্বা সেখানে গিয়ে ব্যার্থ মনোরথে ফিরে এসেছিলেন আমি গেলাম নতুন উদ্যম নিয়ে।

কেরানী গোছের ম্যাডাম প্রথমেই আমাকে আগা গোড়া মেপে নিলেন, কাগজপত্র অনেক বিরক্তির ভঙ্গিতে নাড়াচাড়া করে বললেন আপনার কাগজপত্রত এটাস্টেড করা নাই, এটাস্টেড করে নিয়ে আসেন। আমি বললাম সব কাগজ পত্র অরিজিনাল কপি আমার সাথেই আছে আপনারা আপনাদের বিসিএস ক্যাডার স্যারকে দিয়ে করে নেন বা আমাকে তার সাথে দেখা করতে দেন। তারা তাতে রাজি না, আমি বললাম এখন কি আমি শহরে বিসিএস ক্যাডার খুঁজতে বের হব? আমার কথা শুনে কেরানী ম্যাডাম বললেন দেখি কি করা যায় বলে স্যারের কাছে কাগজপত্র নিয়ে গেলেন, কিছুক্ষণ পরে এসে বললেন, স্যার নিজেই এটাস্টেড করে দিবেন, শোনে আমার প্রানে পানি আসল। সরকার আসার পর সারা দেশব্যাপী ২০ লাখ নতুন সংযোগ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল যার পরিনতি আপনারা বুঝতেই পারছেন কি হয়েছে, এখন পর্যন্ত মাত্র ২ লাখের মত সংযোগ দেয়া গেছে! অফিসে এইরূপ কেরানী আর বিসিএস ক্যাডারেরা থাকলে ঘোষণা শুধু ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। অনেকেই সরকারি চাকরি করলেও তারা বেকার তারা কাজ করতে চান না তারা সেবা দিতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক, এইসব হেন লোকদের কিরুপ বেকার হিসাবে আখ্যা দেয়া যায় বলুনত? বাড়ির সামনেই সরকারি প্রাইমারি স্কুল।

বাচ্চারা সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ট ট করে ঘুরে বেড়ায়, এর বাসায় ঢুকে তার বাসায় যায় এই রকম করেই তাদের শিক্ষাদান চলছে। সেদিন বারান্দা থেকে দেখলাম কে যেন রাস্তা থেকে টেনে টেনে উঁচু ডাল থেকে লাল রক্তজবাগুলি ছিঁড়ছে, হাক দিলাম, কোন কাজ হল না ছিঁড়াছিঁড়ি চলছেই। গেইট খুলে রাস্তায় বের হয়ে দেখলাম স্কুলের ছেলেরা আর এক মহিলা এই কাণ্ড করছে। বাচ্চাদের ধমক দিলাম তারা দৌড়ে পালালো আর ঐ মহিলা তার কাজ করেই যাচ্ছে। তিনি এই স্কুলেরই শিক্ষিকা ভগবানকে খুশি করতে ফুলগুলি হৃদয়হীনের মত ছিঁড়ছেন।

বললাম, কাউকে না বলে কিছু নেয়া কিন্তু চুরির সমতুল্য আপনি কিন্তু তাই করছেন এবং এই কোমলমতি বাচ্চাদেরও শেখাচ্ছেন! তার কোনও ভাবলেশ নেই, বিরক্ত হয়ে গেইট বন্ধ করে দিলাম। জেলা শহরে যদি এই হয় শিক্ষকদের অবস্থা তাইলে মফস্বলে কি হয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এইসব গুণহীন শিক্ষকরা একটা গুণহীন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছেন, এরাই একদিন হয়ত আমাদের কালো বিড়ালের গল্প শোনাবে। অনেক গুনী অফিসারদের রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে ওএসডি করে রাখা হয়েছে, তাদেরকে বসিয়ে কোটি কোটি টাকা বেতন ভাতা দেয়া হচ্ছে, সরকারগুলির ভাবখানা এমন যে শতিনেক অফিসার বেকার বসে খাচ্ছে তাতে দেশের কি আর এমন ক্ষতি?! আবার অনেক শিক্ষিত বেকার মাথা কুড়ে মরছে অথচ মানহীন আর মেয়াদ উত্তীর্ণ লোকদের বসিয়ে বসিয়ে টাকা গেলানো হচ্ছে, ভাবতেই চোখে জল চলে আসে। কি আর করা, আমি আরেকজন বেকার আমার কথার কোন দাম ছিলনা, নেই আর ভবিষ্যতেও থাকবেনা কিন্তু এটাই কি হওয়ার কথা ছিল? আপনাদের কাছে প্রশ্ন রইল? ধন্যবাদ, সবাই ভালো থাকবেনঃ) সুনামগঞ্জ, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১২ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।