বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে সাত সকালে রওনা হয়ে চান্দের গাড়ি যখন মাসালং বাজারে থামল তখন বেলা এগারোটা। পাহাড়ি বাজারটা কেন যেন থমথম করছিল। লোকজনও তেমন নেই।
কী ব্যাপার? নাফিসের ভুরু কুঁচকে যায়। চান্দের গাড়ির ড্রাইভারের নাম ওসমান। তারও মুখ কালো।
নাফিস গাড়ি থেকে নেমে এল। চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে।
মাসালং বাজারটি বেশ বড় । দোকানে ম্যালেরিয়ার ওষুধের বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি পাহাড়ি কলা ঝুলছিল। চায়ের দোকানের বাইরে সিঙারা-পেঁয়াজু ভেজে রেখেছে। দোকানের সামনে এক আদিবাসী মহিলা সিগারেট টানছিল। নাদিয়া ওর লাল রঙের সনি সাইবার শটে ক্লিক করে।
এখানে কিছু খেয়ে নিতে হবে। মাসালং বাজারের পর সজেক অবধি আর বাজার-টাজার নেই। নাদিয়া বলেছে, সাজেকে নাকি চায়ের দোকানও নেই। সামনে বাঁশের খুঁটির ওপর একটি টিনের ছাউনি । চারদিকটা খোলা।
ওখানে একটি বেঞ্চ রয়েছে। সেই বেঞ্চে বসে নাদিয়া বলল, উফঃ যা গরম।
আশিক বলল, সেপ্টেম্বর মাস। গরম তো লাগবেই ভাদ্রমাসে তাল পাকে।
আশিক লেখালেখি করে।
সেজন্য হয়তো ও বাংলা মাসের খোঁজখবর রাখে। সিগারেটের জন্য তানিমকে চোখের ইঙ্গিত করে আশিক । তানিম খুব সিরিয়াস মুখ করে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতেই নাদিয়া ধমক দিয়ে ওঠে, অ্যাই তানিম! সিগারেট ধরাবি না বললাম। ধমক খেয়ে তানিমের মুখটা দেখার মতো হল।
নাদিয়া আর তানিম পিঠেপিঠি ভাইবোন।
এ কারণেই হয়তো ছোটখাটো ব্যাপারে ওদের দু’জনের ঝগড়া লেগেই আছে। তানিম দেখতে শ্যামলা মতন; চোখে চশমা। একমাথা কোঁকড়া চুল। বুয়েটের (ইলেকট্রিকালের) তুখোর ছাত্র ও। আশিক আর তানিম -এই দু’জন শ্রেণিবন্ধু অর্থাৎ, ক্লাসমেট।
আশিক দেখতে কিছুটা থলথলে। পাতলা একটি হলুদ রঙের গেঞ্জি পরে আছে। ওর গায়ের রং শ্যামলা । নাদিয়া অবশ্য বেশ ফরসা। তবে ইদানীং কিছুটা মুটিয়ে গেছে ও।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এনথ্রপোলজি তে পড়ছে নাদিয়া । ওর এদিকটা মোটামুটি চেনা। ওর ডিপার্টমেন্ট থেকে বছর দুয়েক আগে এদিকটায় এসেছিল ও। নাদিয়া আর তানিমের কাজিন নাফিস । ইংল্যান্ডে জেনেটিক্স আর বায়োফিজিক্স নিয়ে পড়ছে ও।
আসলে ওর জন্যই এই মেঘরাজ্য সাজেক-এ বেড়াতে আসা।
ওরা বেঞ্চির ওপর বসে চা-সিঙারা খাচ্ছে। লাঠিতে ভর দিয়ে একজন বুড়ো মতন স্থানীয় অধিবাসীকে আসতে দেখা গেল। বুড়োর পরনে খয়েরি লুঙ্গি আর গায়ে একটা ময়লা চাদর জড়ানো। বৃদ্ধটি খনখনে কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, আপনারা কই যাইবেন?
সাজেক।
আশিক বলল। বলে এক মুখ ধোঁওয়া ছাড়ল।
অ। তয় সাজেক না গেলে হয় না?
কেন? নাদিয়া তীক্ষ্ম গলায় জিজ্ঞেস করে।
বৃদ্ধটি চুপ করে থাকে।
আর কোনও কথা বলল না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে চলে যায়। নাদিয়াকে কিছুটা হতভম্ভ মনে হল। তানিম কাঁধ ঝাঁকালো। আশিক চায়ে চুমুক দেয়।
নাফিস বুড়োর চলে যাওয়া দেখছিল। চান্দের গাড়ির ড্রাইভার ওসমানও আজ সাজেক আসতে চাইছিল না। কেন? তাকে তিনহাজার টাকার জায়গায় পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে রাজি করাতে হয়েছে। এখন এই বৃদ্ধও সাজেক যেতে নিষেধ করছে। কেন? নাফিসের ভুরু কুঁচকে যায়।
মাসালং আর্মি ক্যাম্পে ছাড়পত্র নেওয়ার সময় তো তারা সাজেক যাওয়ার ব্যাপারে সাবধান করেনি। আশিকের বড় মামা ব্রিগেডিয়ার জাফর হায়দার। তাঁর চিঠি দেখিয়েছিল। সে জন্যই হয়তো। কিংবা আর্মিরা বিপদ-আপদ তেমন পাত্তা দেয় না।
কিন্তু এই বুড়ো সাজেক যেতে নিষেধ করছে কেন? আসলেই কি কোনও বিপদ ঘটেছে?
ওরা চা-টা খেয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসল। ওসমান টার্ন নিয়ে চান্দের গাড়ির রাস্তায় উঠে এল। নাফিস ওর নোটবুকটা খুলে সাজেক সম্বন্ধে তথ্যগুলি আরেকবার দেখে নিচ্ছিল। নেক্সট উইকে লন্ডন ফিরে গিয়ে সাজেক-এর ওপর একটি ছবিব্লগ পোস্ট করবে। এরই মধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ন তথ্য পেয়েছে ও।
যা ও আগে জানত না। রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলাটিই বাংলাদের সবচে বড় উপজেলা। সাজেক বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। সাজেকই বাংলাদের সবচে বড় ইউনিয়ন (এত বড় ইউনিয়ন যে বাংলাদেশের মেহেরপুর জেলার তিনগুন)। রাঙামাটি থেকে সাজেক যাওয়ার পথটি দূর্গম বলেই খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে সাজেক যেতে হয় ।
দীঘিনালা থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটারের মতন। সাজেক সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ১৮০০ ফুট উঁচু বলে নাদিয়া সাজেকের নাম দিয়েছে: মেঘরাজ্য। সাজেকজুড়ে ত্রিপুরা, খাসিয়া এবং চাকমারা বসবাস করলেও লুসাই এবং পাঙ্খোয়া জনগোষ্ঠীই নাকি বেশি। সাজেক এর পুবে ভারতের মিজোরাম রাজ্য।
চান্দের গাড়ির সামনের সিটে বসেছিল আশিক।
ও দেখতে পেল একটু দূরে রাস্তার বাঁ পাশে আর্মির একটি জিপ থেমে আছে। জিপটা নষ্ট মনে হল। সামরিক উর্দি পরা একজন অফিসার জিপের বনেট খুলে কী যেন দেখছিলেন। তাঁর পাশে একজন গাট্টাগোট্টা চেহারার বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে । বৃদ্ধের রোদে-পোড়া তামাটে গায়ের রং।
বৃদ্ধ হাত তুলে চান্দের গাড়ি থামাতে বললেন। ওসমান কে গাড়ি থামাতে বলল আশিক। বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন। বৃদ্ধ আশিককে জিজ্ঞেস করলেন, তোমারা কি সাজেক যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
আমার সাজেক যেতে হবে।
ভেরি আর্জেন্ট। আমাকে লিফট দিতে হবে।
ময়লা পোশাকের ধুলোমাখা অপরিচিত বৃদ্ধকে দেখে আশিক বলল, কিন্তু, এটা তো রির্জাভ গাড়ি।
বুঝলাম। শোন, আমার নাম ডক্টর আবিদ আলী।
আমি একজন জুলজিস্ট। আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণি নিয়ে রিসার্চ করছি।
নাফিস পিছনে বসে ছিল। বলল, ওহ, স্যার। আসুন।
উঠে আসুন। প্লিজ।
ডক্টর আবিদ আলী চান্দের গাড়ির পিছনে উঠে বসতেই চান্দের গাড়ির হেল্পার মিন্টু ‘যান যান ওস্তাদ’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। ঝাঁকি দিয়ে চান্দের গাড়ি চলতে শুরু করল।
নাফিস উলটো দিকে বসে থাকা বৃদ্ধ প্রাণিবিজ্ঞানী কে ভালো করে দেখছে ।
মাথায় সাদা রঙের ক্যাপ, তবে টাক আছে বোঝা যায়। মুখ ভরতি পাকা দাড়ি । চোখে রোদ-চশমা। গলায় বাইনুকুলার ঝুলছে। বৃদ্ধের পরনে সবুজ রঙের ছোট একটি ডায়ানোসরের ছবি আঁকা সাদা গেঞ্জি।
আর জিন্সের প্যান্ট। পায়ে কেডস। বৃদ্ধ প্রাণিবিজ্ঞানী কে কেমন অস্থির দেখাচ্ছিল। ভীষণ ঘেমে গেছেন। তিনি একটি চুরুট ধরালেন।
নাদিয়ার তামাকে এলার্জি আছে। তবে ও চুপ করে রইল। হাজার হলেও বৃদ্ধ একজন প্রাণিবিজ্ঞানী।
নাফিস জিজ্ঞেস করে, স্যার, আপনি কি নিয়ে রিসার্চ করছেন?
এক মুখ ধোঁওয়া ছেড়ে ডক্টর আবিদ আলী বললেন, ইঁদুর।
ইঁদুর?
হ্যাঁ, ইঁদুর।
ওই দেখ বাঁশবন। বলে ডক্টর আবিদ আলী দূরের বাঁশবন দেখালেন। তারপর বললেন, জান তো ইঁদুর বাঁশফুল খায় ?
হ্যাঁ। সেরকম শুনেছি।
বাঁশফুল খেলে ইঁদুরের প্রজনন ক্ষমতা সাঙ্ঘাতিক রকমের বেড়ে যায় বুঝলে।
যার ফলে লক্ষ লক্ষ ইঁদুর জন্মায়। ইঁদুরগুলো পার্বত্য অধিবাসীদের জুমের ফসল নষ্ট করে। এতে দুর্ভিক্ষের মতন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় । কী ভাবে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় তা নিয়েই আমি অনেক দিন ধরে গবেষনা করছি।
নাফিস জিজ্ঞেস করে, স্যার, আপনি কি কোনও কনক্লুজনে পৌঁছতে পেরেছেন?
উত্তর না দিয়ে ডক্টর আবিদ আলী বললেন, তা তোমারা কি সাজেক বেড়াতে এসেছ?
জ্বী, স্যার।
তোমাদের কি আজ সাজেক থাকার ইচ্ছে আছে? বলে নাদিয়ার দিকে তাকালেন। নাদিয়া বলল, জ্বী, স্যার। আজ আর ফিরব না। আজ অনেক জার্নি হয়েছে। সেই সকাল সাতটায় দীঘিনালা থেকে রওনা দিয়েছি।
ডক্টর আবিদ আলী বললেন, তাহলে শোন। এই অঞ্চলের গ্রামকে বলে পাড়া। সাজেকের প্রথম পাড়ার নাম রুইলুই পাড়া। ওখানকার গ্রামপ্রধান বা হেডম্যান -এর নাম চৌ মিং থাং লুসাই। তাকে অনুরোধ করে তোমরা তার বাড়িতে আজ রাতটা থাকতে পার।
তার আগে অবশ্য বিজিবির পারমিশন নিতে হবে।
তানিম বলল, স্যার, আমাদের কাছে বাংলাদেশ আর্মির পারমিশন আছে।
গুড।
আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথটি ক্রমেই উঠছে। পথে অসম্ভব ধুলি।
বাতাসে পোড়া ডিজেলের গন্ধ। আর বেশ গরম। দূরে দু-একটি বাড়িঘর চোখে পড়ে। সব ক’টা বাড়ির নীচেই বাঁশের খুঁটি। মাঝেমধ্যে চান্দের গাড়ি ছোট ব্রিজ পেরিয়ে যাচ্ছে ।
নীচে শীর্ণ পাহাড়ি নদী। রাস্তার এক পাশে গভীর খাদ- ওই খাদই সাজেক উপত্যকা। উপত্যকায় ঘন বাঁশবন, পাহাড়ি উদ্ভিদ। এসব ছাড়াও রয়েছে পাহাড়ি কলার গাছ। বাঁশপাতায়, কলাপাতায় রোদ ঝকঝক করছিল।
পাহাড়ি পথে একজন কি দু’জন স্থানীয় অধিবাসী। উলটো দিক থেকে আর্মির একটা হাফট্রাক আসছিল।
ঝাঁকি খেতে খেতে চান্দের গাড়ি রুইলুই পাড়া অতিক্রম করে। বিজিবি ক্যাম্প থেকে ছাড়পত্র নিয়ে হবে। ক্যাম্পটা রুইলুই পাড়া ছাড়িয়ে কিছুটা সামনে।
চান্দের গাড়ি বিজিবি ক্যাম্পের সামনে এসে থামল। ডক্টর আবিদ আলী বললেন, লিফট দেওয়ার জন্য তোমাদের ধন্যবাদ। আমার ল্যাব কংলাক পাড়ায়। জায়গাটা এখান থেকে ২ কিলো। বলে চান্দের গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন।
বৃদ্ধ প্রাণিবিজ্ঞানীকে কেমন অস্থির আর খাপছাড়া মনে হল নাদিয়ার।
আশিকের বড় মামা ব্রিগেডিয়ার জাফর হায়দার এর চিঠি থাকায় বিজিবির পারমিশন নিতে সময় লাগল না। তবে বিজিবি ক্যাম্পে কেমন যুদ্ধাবস্থা। জোয়ানদের কেমন অ্যালার্ট মনে হল। কাছেই ইন্ডিয়ার বর্ডার।
কোনও ঝামেলা হল না তো। নাফিসের ভুরু কুঁচকে যায়। আকাশে হেলিকপ্টারের রোটরের আওয়াজ শুনতে পেল ও।
বিজিবি ক্যাম্পের কাছে ছোট্ট একটি টিলা। তার ওপর হেলিপ্যাড।
ওপরে ওঠার সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলে বড় একটি মাঠ। মাঝখানে সিমেন্ট বাঁধানো একটি বৃত্তারকার জায়গায় ইংরেজি ‘এইচ’ অক্ষরটি লেখা। কয়েকটি হেলিকপ্টার থেমে আছে। কয়েকজন সামরিক অফিসারকেও দেখা গেল।
কী ব্যাপার? হেলিপ্যাডের শেষ মাথায় ঢাল। ঢালের কিনারটা গড়িয়ে নেমে গেছে সাজেক উপত্যকায়। যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। ওরা ওখানে দাঁড়াতেই মুগ্ধ হয়ে গেল। নাদিয়া চিৎকার করে বলল, ওহ! কী অপরূপ এই মেঘরাজ্য।
হাত তুলে বলল, ওই যে ... ওদিকটা হল ইন্ডিয়ার মিজোরাম।
আশিক বলল, ভাবলেই কেমন লাগে সমতল থেকে ১৮০০ ফুট ওপরে আছি।
নাফিসের হাতে ছোট্ট একটি বাইনুকুলার। ওটা চোখে লাগিয়ে দেখছিল। দূরে একটি লোকালয়ের টিনের চালা রোদে ঝলসে উঠছে।
অসাম! ওর মুখ থেকে বেড়িয়ে এল।
রুইলুই পাড়ার মেইন রোডটি ইট বিছানো। দু’পাশে মাটি থেকে সামান্য উঁচু কাঠের বাড়ি। এই অঞ্চলে বাঁশের ব্যবহার বেশি। উঠানে মেয়েরা বসে কাপড় বুনছে।
তাঁতটিও বাঁশের তৈরি। তবে রুইলুই পাড়াটি কেমন থমথম করছিল।
রুইলুই পাড়ার হেডম্যান- এর হেডম্যানের কাঠের তৈরি বাড়িটি মাটি থেকে খানিকটা উঁচু। ছাদে সোলার প্যানেল। টিভি অ্যান্টেনা।
হেডম্যান- এর নাম চৌ মিং থাং লুসাই। ছোটখাটো গড়নের দেখতে মাঝবয়েসি হেডম্যানের মাথায় একটি নীল রঙের ক্যাপ। পরনে হলুদ টি-শার্ট আর কালো রঙের প্যান্ট। মঙ্গোলয়েড চেহারা। নাদিয়া ‘লুসাই’ শব্দের অর্থ জানে ।
‘লু’ মানে মাথা আর ‘সাই’ মানে লম্বা। লুসাইরা নাকি এককালে লম্বা মাথার মানুষ ছিল। সেজন্য এই নাম। আসলে ভারতের মিজোরাই বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে লুসাই নামে পরিচিত।
ওরা আজ রাতটা রুইলুই পাড়ায় থাকতে চায় শুনে চৌ মিং থাং লুসাই রাজি হলেন।
তবে বিজিবির অনুমতি নিতে হবে বললেন। আশিক বলল, আমাদের পারমিশন আছে আঙ্কেল।
কথাটা শুনে হেডম্যান আশ্বস্ত হলেন মনে হল। হেডম্যানের ছেলের নাম টুসিটা। বয়েসে কিশোর ।
ভারি মিষ্টি মঙ্গোলয়েড চেহারা। বাংলা মোটামুটি জানে। ও কীভাবে যেন টের পেল ওদের গোছল করা দরকার। টুসিটা বলল, কাছেই পুকুর। আপনারা স্নান করতে পারেন।
বলে কী! ১৮০০ ফুট ওপরে পুকুর!
ওরা লাফাতে লাফাতে পুকুরে এল।
টুসিটাই পথ দেখিয়ে নিয়ে এল।
ছোট পুকুর। পানির রং শ্যাওলা সবুজ। চারধারে গাছপালার গভীর ছায়া।
তানিম জিজ্ঞেস করে, এই পুকুর কে কাটল?
কেউ না। টুসিটা বলল।
কেউ না মানে?
এই পুকুর হইছে গাছের শিকড়ের পানির থন ।
ওয়াও। চিৎকার করে বলে আশিক।
গেঞ্জি আগেই খুলে ফেলেছিল। এবার থ্রিকোয়াটার্স পরেই ঝাঁপিয়ে পড়ল।
হেডম্যান- এর বাড়ির ভিতরটা বেশ বড়। কাঠের মেঝে আর বেড়ার পার্টিশান। কাঠের সোফাসেট।
জানালায় লাল পর্দা। বেড়ার দেওয়ালে ওয়াল ক্লক, ক্যালেন্ডার, যিশু খ্রিস্টের ছবি । লুসাইরা খ্রিস্টান। বেশ কয়েকটা বেড়াল চোখে পড়ল ওদের। ইঁদুরের উপদ্রপ ঠেকাতে এরা বেড়াল পোষে।
মেঝের ওপর খাবার সাজিয়ে দিয়েছেন হেডম্যান- এর স্ত্রী। মহিলা কম কথা বলেন। তিনি গরম ভাত, বাঁশ কোরল, আর ডিম-আলুর তরকারি রেঁধেছেন। গোছল সেরে এসে ওরা বসে খেতে বসল। ড্রাইভার ওসমান ও চান্দের গাড়ির হেল্পার মিন্টুও খেতে বসেছে।
টুসিটার মায়ের রান্নার হাত চমৎকার । সবচে বড় কথা এই লুসাই পরিবারটি বড় আন্তরিক। খাবারের আয়োজন সামান্য। চৌ মিং থাং লুসাই বারবার সে কথা বললেন।
খেতে খেতে নাফিস জিজ্ঞেস করে, আপনাদের এখানে চাষবাসের কী অবস্থা?
চৌ মিং থাং লুসাইয়ের মুখটি কেমন কালো হয়ে উঠল।
তিনি বললেন, কী আর বলব। জুমচাষ বন্ধ।
বন্ধ? কেন? নাফিস মুখ তুলে তাকালো।
পাহাড়ি ইন্দুর জুমের ফসল সব খেয়ে ফেলছে।
ইন্দুর? মানে ইঁদুর?
হ।
ইন্দুর।
ডক্টর আবিদ আলীর কথাগুলি মনে পড়ে গেল নাফিসের।
এক একটা ইন্দুর দৈত্যর সমান।
দৈত্যর সমান?বলেন কী!
হ। দৈত্যের সমান ইন্দুরের ভয়ে জুমচাষ বন্ধ।
এরপর কথাবার্তা আর তেমন হল না।
খাওয়া-দাওয়ার পর ওরা বেরুল। কংলাক পাড়া যাবে। চান্দের গাড়ি নিয়েই গেল। যতটা যাওয়া যায়।
মাটির রাস্তা। অত্যন্ত সরুপথ। ওসমান সাবধানে চালাচ্ছে। মনে হয় না এই রাস্তা জিপের জন্য তৈরি হয়েছে।
হঠাৎ যান্ত্রিক শব্দে চমকে উঠে ওরা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালো।
বাংলাদেশ আর্মির অনেকগুলো হেলিকপ্টার সারিবদ্ধভাবে উড়ে যাচ্ছে। অন্তত দশ থেকে বারোটা তো হবেই। অনেক নীচু দিয়ে উড়ে গেল। মেশিনগানের সামনে বসে থাকা গানম্যান চোখে পড়ল স্পস্ট। কী ব্যাপার?
কংলাক পাড়াটি বেশ উঁচু।
ধুলোমাখা উৎরাই পথ উঠে গেছে। তারপর মাটি কেটে তৈরি করা সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। কংলাক পাড়ার নীচে জিপ থামাল ওসমান। ওরা জিপ থেকে নেমে হাঁটতে থাকে। এখানে-ওখানে কমলা গাছ চোখে পড়ে।
কমলা ছাড়াও আগর ও কফিগাছও আছে সাজেকে। নাদিয়া বলল।
কংলাক পাড়াটি বেশ বড়; আর ছড়ানো ছিটানো। কাঠ আর বেড়ার ঘরবাড়ি ছাড়াও টিনের বাড়ি চোখে পড়ে। লোকজন অবশ্য তেমন চোখে পড়ল না।
অনেকে বাড়ির ভিতর থেকে উঁকি দিয়ে ওদের দেখছে। কী ব্যাপার? নাফিসের ভুরু কুঁচকে যায়। কোনও কোনও বাড়ির বারান্দায় টি-শার্ট আর জিন্স পরা কয়েকটি স্মার্ট ফর্সা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের দেখে আশিক আর তানিম অবাক। নাদিয়া বলল, খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের রাস্তা ইদানীং হয়েছে।
এখান থেকে মিজোরাম কাছে বলে এখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে মিজোরামের যোগাযোগ বেশি।
এদিকে একটি গির্জা। গির্জাটি ছোট । কাঠের তৈরি। ওরা গির্জার পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে।
ওদিকটায় ঢাল। ঢালের কিনারা সাজেক উপত্যকায় নেমে গেছে। একটি কমলা গাছের পাশে ডক্টর আবিদ আলী দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাইনুকুলার দিয়ে কী যেন দেখছেন। ওদের খেয়াল করেননি।
বৃদ্ধকে চিন্তিত মনে হল। বৃদ্ধ হঠাৎ বাইনুকুলার নামিয়ে চকিতে ফিরে তাকিয়ে বললে, ওহ্ । তোমরা?
নাদিয়া বলল, জ্বী স্যার। আমরা রুইলুই পাড়ার হেডম্যানের বাড়িতে খেয়ে এদিকটা ঘুরেফিরে দেখছি।
নাফিস আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছিল না।
ও জিজ্ঞেস করল, স্যার, রুইলুই পাড়া আর কংলাক পাড়ার লোকজন দেখলাম ভীষণ প্যানিকড। কেন স্যার?
ডক্টর আবিদ আলী ছোট্ট শ্বাস ফেললেন। তারপর কপালের ঘাম মুছে বললেন, বলছি। শোন। অনেকটা আকস্মিকভাবেই কিছুকাল ধরে সাজেক উপত্যকার বাঁশফুলের জেনেটিক কোডের পরিবর্তন ঘটেছে।
সম্ভবত জলবায়ূ পরিবর্তনের ফলেই এমনটা হয়েছে। সেই বাঁশফুল খেয়ে পাহাড়ি ইঁদুরের সাইজে অনেক বড় হয়ে গেছে।
তানিম জিজ্ঞেস করে, কত বড় স্যার?
এই ধর, একেকটা হাতির সমান।
কি! হাতির সমান? নাদিয়া প্রায় চিৎকার করে উঠে মুখের ওপর হাত চাপা দিল।
হুমম, হাতির সমান ।
ব্যাপারটা বেশ আতঙ্কজনক। ঘটনাটা আমি প্রশাসনকে যথাসময়েই জানিয়েছি। বাংলাদেশ গর্ভমেন্ট মিজোরাম কর্তৃপক্ষকেও জানিয়েছে ব্যাপারটা। আমি সব সময় বিজিবি-র রাঙামাটি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুশফিক আজম- এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। আজ সকালেও খাগড়াছড়ি সেনানিবাসে গিয়েছিলাম।
ফেরার পথে তোমাদের সঙ্গে দেখা।
নাদিয়া কেমন বিষন্ন বোধ করে। এই অপরূপ মেঘরাজ্যের শান্ত শিষ্ট নিরীহ অধিবাসীরা কত অল্প প্রাকৃতিক সম্পদ ভোগ বেঁচে আছে। এদের তেমন নাগরিক সুযোগসুবিধা নেই। অথচ এদের জীবনেও জলবায়ূ পরিবর্তন গভীর সঙ্কট তৈরি করেছে।
ও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। ভবিষ্যতের দক্ষিণ এশিয়ার কথা ভেবে শিউরে ওঠে।
ডক্টর আবিদ আলী বললেন, সবচে খারাপ যেটা- সেটা হল ইঁদুরগুলো এই মুহূর্তে খাদ্যসঙ্কটে ভুগছে। কারণ ওদের শরীরের তুলনায় জুমের ফসল নগন্য। ওরা যে কোনও সময় রুইলুই পাড়া আর কংলাক পাড়া অ্যাটাক করতে পারে।
বিজিবি চেষ্টা করেছে এখানকার লোকজনকে সরিয়ে ফেলতে। ওরা যেতে রাজি না। আসলে মাটির মানুষ তো। মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে চায়।
ডক্টর আবিদ আলীর কথা শেষ হল না।
মাথার ওপর দিয়ে খুব নীচু দিয়ে সারিবদ্ধভাবে দশবারোটি হেলিকপ্টার উড়ে গেল। রোটরের শব্দে কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম।
বাংলাদেশ আর্মি! ডক্টর আবিদ আলী বললেন চিৎকার করে বললেন।
একটু পর হেলিকপ্টার থেকে মেশিনগানের একটানা আওয়াজ শোনা গেল।
ওরা কাকে গুলি করছে? নাদিয়ার কন্ঠস্বর কাঁপছিল।
একটু পর দেখতে পাবে। ডক্টর আবিদ আলী বললেন।
নাদিয়ার চোখ নীচের উপত্যকায় ঘুরছে। হঠাৎ ইঁদুর চোখে পড়ল। হাজার হাজার।
একেকটা প্রায় হাতির সমান। ইঁদুরগুলোর কালচে পিঠ রোদে চকচকে করছে। ইঁদুরগুলো কলাগাছ বাঁশঝাড় তছনছ করে ওপরে উঠে আসছে। হেলিকপ্টার থেকে মুর্হূমুহূ মেশিনগান গর্জে উঠছে। অবিকল ভিয়েতনাম যুদ্ধের দৃশ্য যেন ।
নাদিয়া পিছন ফিরে দেখল কংলাকপাড়ার এসে লোকজন জড়ো হয়েছে। সবাইকে ভীষণ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। ড্রাইভার ওসমান আর হেল্পার মিন্টুকেও দেখা গেল ভিড়ের মধ্যে।
একটু পর নীচের উপত্যকা থেকে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। পায়ের নীচের মাটি থরথর করে কাঁপতে লাগল।
নাদিয়া চমকে ওঠে বলল, কিসের শব্দ ওগুলো?
ডক্টর আবিদ আলী বললেন, গত ক’দিন ধরে বাংলাদেশ আর্মি উপত্যকায় ল্যান্ড মাইন পুঁতে মাইনফিল্ড তৈরি করেছে । আর্মি হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে ইঁদুরগুলিতে মাইন-ফিল্ডে তাড়িয়ে এনেছে।
ওহ্।
আরও কিছুক্ষণ বিস্ফোরনের পর নীচের উপত্যকতা জুড়ে নিরবতা নামল। নীচ থেকে ঘন ধোঁওয়া উঠে আসছিল।
বাতাসে বিশ্রী গন্ধ ছড়িয়েছে। মৃতইঁদুরের মাংস পোড়া গন্ধ? নাদিয়ার গা গুলিয়ে উঠছে।
কংলাকপাড়ার অধিবাসীরা চিৎকার করে উঠল। তারা হেলিকপ্টার উদ্দেশ্য করে হাত নাড়ছে। হেলিকপ্টার থেকে গানম্যান ওদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন।
ডক্টর আবিদ আলী ওদিকে তাকিয়ে বললেন, এ যাত্রায় বেঁচে গেল ওরা। তানিম বলল, আশ্চর্য! বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকার এই নিরীহ মানুষগুলো পরিবেশ দূষনের জন্য দায়ি নয়। অথচ ...অথচ এরাই জলবায়ূ পরিবর্তনের কুফল ভোগ করছে। ভাবলে অবাক লাগে।
ডক্টর আবিদ আলী বললেন, হুমম।
দেখ, তোমরা আজ রুইলুই পাড়ার হেডম্যান বাড়িতে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করলে। রাতে তারাই আশ্রয় দেবেন । ভেবে দেখ, উন্নত বিশ্বের ভোগবাদী মানুষ এত সহজে তোমাদের ওদের বাড়িতে ঢুকতে দেবে? খেতে দেবে? রাতে থাকতে দেবে?
নাফিস কয়েক বছর ধরে লন্ডন শহরে তিক্ত জীবনসংগ্রাম করছে। ও তিক্ত স্বরে বলল, না।
একে কী বলে?
একে কী বলে মানে? নাদিয়া জিজ্ঞেস করে।
ডক্টর আবিদ আলী হেসে বললেন, এই যে তোমাদের আজ একটি লুসাই পরিবার খেতে দিল, রাতে থাকতেও দেবে। একে কী বলে?
ওরা চুপ করে থাকে।
একে বলে লাভ। এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি। ভোগবাদের কারণে উন্নত বিশ্বের মানুষ যে অনুভূতি দিনদিন হারিয়ে ফেলছে।
ভেবে দেখ উন্নত বিশ্বের ভোগবাদের কারণেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে গিয়ে জলবায়ূর পরিবর্তন ঘটছে। যার পরিণাম হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রকৃতিঘনিষ্ট মানুষ। এমন কী চৌ মিং থাং লুসাইরাও জলবায়ূর পরিবর্তনের অশুভ প্রভাব থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
তানিম বলল, উন্নত বিশ্ব বাংলাদেশ সরকার কে ক্ষতিপূরণ দেবে বলে বলছে।
আশিক তিক্তস্বরে বলল, দিচ্ছে না।
নানান টালবাহানা করছে।
নাফিস দৃঢ়স্বরে বলল, যে করেই হোক ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করতেই হবে।
অবশ্যই। নাদিয়া চিৎকার করে উঠল।
দরকার হলে আমরা যুদ্ধ করব।
হ্যাঁ, আমরা যুদ্ধ করব!
এই পড়ন্ত বিকেলে ওদের এই প্রতিজ্ঞা বাক্যটি মনোরম এই সাজেক উপত্যকার মেঘরাজ্যে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ...
স্বীকার করছি ... এই গল্পটি লেখার সময় আমাকে ‘বাংলার পথের’ বিখ্যাত পর্যটক টিঙ্কু ট্রাভেলারের সাজেক- এর ওপর নির্মিত দু পর্বের চমৎকার প্রামাণ্যচিত্রটি বারবার দেখতে হয়েছে। তাঁকে আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।