ঘেটুগান লোকদের মনরঞ্জনের জন্য এক ধরণের বিনোদনের মাধ্যম। আজ থেকে প্রায় দেড়শত বছর আগে ময়মনসিংহ, সিলেট, ও হবিগঞ্জ জেলায় এ গানের প্রবর্তন হয়। ঘেটুগান সাধারণত এমন সময় গাওয়া হয়; যখন কৃষকদের হাতে তেমন কোনো কাজ থাকে না। তখন তাদেরকে নিধারূন অর্থকষ্ট ও অন্নকষ্টের সম্মুখিন হতে হতো। দারিদ্র্যের কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি তারা তখন হয়ে উঠে অসহায়।
ঘেটু দলের প্রধানকে ’সরকার’ বা মূল গায়েক এবং সহকর্মীদেরকে বায়েন বলা হয়ে থাকে। প্রত্যেক দলে ১০থেকে ২০ বছরের এক বা একাধিক কিশোর সুশ্রী বালক থাকতো। গান শুরুর আগে ঐ তরুণকে আকর্ষণীয় ভাবে সাজানো হতো এবং নাচের কায়দা-কানুন শিখিয়ে দেয়া হতো। তখন সুদর্শন সেই তরুণকে অনিন্দ্য সুন্দরী তরুণী বলেই মনে হতো। তখন তরুণীরূপী সেই বালক আসরে কোমর দুলিয়ে নেচে গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিতো।
মানুষ এর বিণিময়ে তাদেরকে টাকা পয়সা দিতো।
ঘেটু গানের বিষয় হিন্দু পৌরাণিক রাধাকৃষ্ণের লৌকিকপ্রেম বা বাস্তব জীবনের প্রেমকাহিনী। এ গানে ঢোল, মন্দিরা, বাঁশী ও সারিন্দা ব্যবহৃত হয়। সুশ্রী বলকরা নেচে-গেয়ে মানুষকে আনন্দ দিত। তাদের নাচ দেখে দর্শক তাদেরকে কামনা করতো।
শষ্যা সঙ্গী হিসেবে ফেতে চাইত। যার বিণিময়ে তাদেরকে বিশেষ টাকা পয়সা দিয়ে সম্মানিত করা হতো। পুরো দলকে মাসের পর মাস থাকতে দেয়া হতো। বিশেষ করে তৎকালীন বড়লোক জমিদাররা ঘেটুপুত্রকে তাদের স্ত্রীর মতো ব্যবহার করতো। জমিদারদের স্ত্রীরা ঘেটু পুত্রদেরকে তাদের সতীন হিসেবে মনে করতো।
এবং কি সেই সতীনরূপী ঘেটু ছেলেকে মারার জন্যও ফন্দি করতো। অনেক ঘেটুপুত্রকে সেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জীবন দিতে হতো। ঘেটুগান তৎকালীন রক্ষণশীল লোক সমাজের বিনোদনের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হিসেবে পরিগনিত হয়। এরপর সময় গড়িয়েছে অনেক বছর। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর বুকে প্রবাহিত হয়েছে অনেক পানি।
সময়ের ব্যবধানে এই অমানবিক কাজ বন্ধ হয়েছে। ঘেটুগান আর ঘেটুপুত্র এখন কেবলই স্মৃতি আর স্মৃতি।
হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণ এক প্রতিভার নাম। তীক্ষè মেধা ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন চমৎকার মনের এক মানুষ। তিনি তার সমগ্র জীবনই সৃষ্টিশীল কাজে ব্যয় করেছেন।
তার মত এমন বিচক্ষণ সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে আর একজন কখন আসে কে জানে। তিনি হলেন সংলাপ প্রধান, বাংলা সহজ-সরল গদ্যের জনক। তিনি তার মেধা-মনন আর সৃষ্টিশীল কর্মের দ্বারা বিশাল এক ক্ষেত্র তৈরী করেছেন। স্থান করে নিয়েছেন মানুষের মনের একেবারে ভেতরের ছোট্ট কুটিরে। মাত্র ৬৪ বছরের জীবনে প্রায় দুইশত উপন্যাস লিখেছেন।
নাটক করেছেন, গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন। ছবি তৈরী করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ এমন এক সময়ে ছবি বানালেন যখন বাংলা চলচ্চিত্রের আকাল অবস্থা। হল বিমুখ দর্শকদেরকে তিনি আবার হলে নিয়ে গেছেন হ্যামিলনের বাশিওয়ালার মতো করে।
তিনি একে একে তৈরী করলেন-আগুনের পরশমণি (১৯৯৫), শ্রাবণ মেঘের দিন (২০০০), দুই দুয়ারী (২০০০), চন্দ্রকথা (২০০৩), শ্যামল ছায়া, নয় নম্বর বিপদ সংকেত, চক্ষে আমার তৃষ্ণা (অসমাপ্ত), আমার আছে জল এবং সর্বশেষ ঘেটুপুত্র কমলা।
এখানে আমি অন্য কোন ছবির আলোচনা করবো না। শুধুমাত্র ’ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবিটি সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করবার চেষ্টা করবো। আমাদের বর্তমান সমাজের সচেতন নাগরিক হুমায়ূন আহমেদ এমন এক সময়ে ’ঘেটুপুত্র কমলা’ তৈরী করেছেন; যে সময় চলচ্চিত্রে একমাত্র অশ্লীলতা, যুবক-যুবতীর প্রেম ভালবাসাকেই পুঁজি করে ছবি তৈরী করছে পরিচালকরা। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ তেমনটাই করেন নি। কিভাবেই বা করবেন তিনি যে হুমায়ূন আহমেদ।
তার দৃষ্টিশক্তি যে প্রখর। চিন্তা যে গভীর। হুমায়ূন আহমেদ আজ থেকে দেড়শত বছরের আগের একটি সামাজিক অনাচারকে উপলক্ষ করে ছবি নির্মাণ করলেন। আমার ভাবতেই আশ্চর্য লাগে। ছবিতে হুমায়ূন আহমেদ অত্যন্ত মুন্সিয়ানা এবং দরদের সাথে কাহিনী, সংলাপ, চিত্রনাট্য নির্মাণ করেছেন।
তৎকালীন সমাজের নির্মম সত্যকে তিনি তুলে ধরেছেন। যা সত্যিই প্রশংসার দাবী রাখে। ছবিতে ’কমলা’ চরিত্রে অভিনয় করেছে-মামুন। সে সত্যিই অসাধারণ অভিনয় করেছে। আর জমিদার রূপে অভিনয় করেছেন শক্তিমান অভিনেতা তারিক আনাম, সরকারের এবং ঘেটুপুত্রের বাবা চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশিষ্ট অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, এ ছাড়া আরো অভিনয় করেছে প্রাণ রায়, আগুন, ফারুক আহমেদ, কুদ্দুস বয়াতী সহ অনেকে।
ঘেটুপুত্র কমলা ছবিটি দেখার পর আমার মধ্যে দুটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে তার একটি পজেটিভ অপরটি নেগেটিভ।
পজেটিভ: আজ থেকে দেড়শত বছর আগের কাহিনী নিয়ে ছবি করা একমাত্র হুমায়ূন আহমেদের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। তিনি যে কতবেশি প্রখর চিন্তাশক্তি ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন তা ছবিটি নির্মাণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এবং সমাজের অমানবিক একটা নির্মম বিষয়কে চোখে আঙুল দিয়ে আমাদেরকে দেখিয়ে দিয়েছেন।
নেগেটিভ: বিষয়টি যেহেতু খারাপ ভালো কোন বিষয় নয়; কারণ খারাপ বিষয়গুলোকে যতবেশি এড়িয়ে যাওয়া যায় এবং ভুলে থাকা যায় ততবেশি সমাজ আর দেশের জন্য মঙ্গল।
তাই তিনি বিষয়টি উল্লেখ না করলেও পারতেন। এটা হচ্ছে আমার একান্ত নিজস্ব মত।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ’ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবিটি নিঃসন্দেহে বিবেকবান মানুষের হৃদয় নাড়া দিবে। চোখ দিয়ে অশ্র“ নির্গত হবে। ছবিতে কমলার মৃত্যুর পর আমার চোখ দিয়েও পানি বের হয়েছিল।
মানুষ নিজ স্বার্থের জন্য কতটা নিষ্ঠুর, নির্মম, অমানবিক, নির্দয়, অকৃতজ্ঞ হয় তা আমরা আরেকবার ’ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবিতে দেখলাম। ছবিতে ড্যান্স মাস্টার হিসেবে প্রাণ রায়ের ভূমিকা ভালো লেগেছে। প্রাণ রায় যে এতটা ভালো নাচতে পারে তা কখনো দেখিনি জানতামও না। এ ছবিতে প্রাণ রায় দর্শকদেরকে আনন্দ দিয়েছে বলা যায়। জমিদারের মেয়ের ভূমিকায় যে ছোট্ট বোনটি অভিনয় করেছে তা অসাধারণ হয়েছে।
যখন মেয়েটিকে হুজুর কায়দা পড়াচ্ছে তখন ঘেটুপুত্র সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয়। তখন হুজুর ঘেটুকে অপবিত্র বলে প্রহার করেছিল। তার প্রতিবাদ হিসেবে মেয়েটি হুজুরের প্রতিবাদ করে। পড়া ছেড়ে উঠে চলে যায়। এবং হুজুরের মাথায় দুধ ঢেলে বলে ’আমি আপনার কাছে পড়ব না, আপনি খারাপ মানুষ’।
এখানে ঘেটুপুত্রের জন্য শিশু মেয়েটির ভালবাসা নির্মল ভালাবাসা ফুটে উঠেছে। আর শিল্পীর ভূমিকায় অভিনয়কারী আগুন ঘেটুপুত্র’কে সত্যিকার অর্থে ছোট ভাইয়ের মতো ভালবাসে তার প্রমাণ পাই তার বানানো পুতুল আর ছবি উপহার দেয়ার মাধ্যমে। এগুলো নিখাদ ও পবিত্র ভালবাসার অংশই বলা চলে। ঘেটুপুত্র’কে স্কুলে ভর্তি হবার কথা বলে সে সত্যিকার দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। অপরদিকে তার ঘেটুপুত্র’কে মারার সময় সেই একমাত্র স্বাক্ষী থাকে।
তবুও সে কেন জানি সে তা মুখ ফুটে বলতে পারে না। সে এক রহস্য ঘেরা। ঘেটুপুত্র’রা যে তৎকালীন সময়ে মানুষের কামনার বস্তু ছিল তা ফুটে উঠেছে জমিদারের ঘোড়া পালক ফারুক আহমেদ এর অভিনয়ের মাধ্যমে। সে বললো টাকা থাকলে সেও ঘেটুপুত্র রাখতো। ছবিটির মধ্যে পেটের ক্ষুধা যে কত বড় নির্মম সত্য তা দেখা গেছে।
১০/১২ বছরের ঘেটুপুত্র’কে (যার আসল নাম জহির) তার মা কেঁদে কেঁদে বিদায় দিয়েছে শুধুমাত্র দারিদ্র্যের কারণে। ঘেটুপুত্র জমিদার বাড়িতে থাকাকালে একদিন আকাশের বুক থেকে নেমে এলো তুমুল বৃষ্টি তখন ঘেটুপুত্রের মনে পড়ে তার ছোট বোনকে। যার সাথে বৃষ্টির সময় সে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতো। কিন্তু এখন তার পাশে আদরের বোনটি নেই। সে এখন সমাজের নির্মম, নিষ্ঠুর নিয়মের শিকার।
অক্টোপাসের মতো সে বন্দি হয়ে আছে ক্ষমতাবান লোকের হাতে।
একদিন সবকিছু ফেলে রেখে নৌকা করে জহিরের মা ছেলেকে দেখতে আসে জমিদার বাড়িতে। কিন্তু ছেলেকে না দেখে অশ্র“সিক্ত নয়তে তাকে ফিরে যেতে হলো। এখানে ছেলের জন্য মায়ের চির কালের আকুতি ফুটে উঠেছে। জহিরের বোন সঙ্গে করে ভাইয়ের জন্য বাতাসা আনে।
এখানে ভাই-বোনের মধুর সম্পর্কটা আমরা আবার দেখতে পেলাম। কোথাও পড়েছিলাম পৃথিবীতে ভাই-বোনের সম্পর্কই হচ্ছে সবচেয়ে মধুর, সবচেয়ে পবিত্র, সবচেয়ে নির্মল।
ছবির গানগুলো অত্যন্ত স্ন্দুর এবং হৃদয় কাড়া যা দর্শকদের মনে দোলা দিয়ে যায়। গানগুলো হলো-
*বাজে বংশী রাজহংসী নাচে দুলিয়া দুলিয়া
নাচে পেখমও মেলিয়া
ঝুমুর ঝুমুর ঝুমুর ঝুমুর
ঝুমুর ঝুমুর ঝুম্
রাজহংসীর চোখ কালো
তারে দেখে লাগলো ভালো
সে বিহনে জগৎ কালো সবই অন্ধকার
তার নাচে ভূবণ নাচে আহা! কি বাহার।
*শুয়া উড়িল উড়িল জীবেরও জীবন..
*বাইসাব রে তুই জলে ভাসা সাবান আইনা দিলে না..
*আমার যমুনা জল দেখতে কালো
সান করিতে লাগে ভালো
যৌবন বসিয়া গেলো
জ.. য়.. লে।
ছবিতে ঘেটুপুত্র কমলা চরিত্রে অভিনয়কারী শিশুশিল্পী মামুন এক কথায় অসাধারণ অভিনয় করেছে। সে এক সাক্ষাৎকারে বলেছে তাকে নাকি বন্ধুরা এখন ঘেটুপুত্র কমলা নামে ডাকে। সেই ছোট ভাইটির জন্য রইল আমার অনেক অনেক ভালবাসা ও হৃদয় নিংড়ানো শুভেচ্ছা।
পরিশেষে, ঘেটুপুত্র কমলা শুধু বাংলা চলচ্চিত্র জগতে নয়; বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতেও সাড়া জাগাতে সক্ষম হবে। ছবিটি হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ ছবি তো অবশ্যই বাংলা ছবির জগতেও প্রথম সারির একটি ছবি।
হুমায়ূন আহমেদের আতœার মাগফেরাত কামনা করছি। এক কথায় ঘেটুপুত্র কমলা বাংলা ছবির জগতে এক বিস্ময়কর নাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।