খুঁজে ফিরি আমার আমিকে মানুষের মানবীয় গুণাবলীর মধ্যে আবেগ অন্যতম,
মানুষ মাত্রই আবেগ থাকতে হবে, আবেগ বিহীন মানুষ কল্পনাই করা যায় না, তবু এই আবেগ প্রকাশের মাত্রা একটা সহনীয় পর্যায়ে থাকা চাই,না হয় সেই আবেগ অন্য কারোর জন্য অসহনীয় যন্ত্রণা হতে বাধ্য, অথবা এই আবেগকে ব্যবহার করে স্বার্থান্বেষী কেউ সহজেই তার ফায়দা লুটতে পারে।
কথাগুলি বলছিলাম বর্তমান বিশ্ব তোলপাড় করা মুভি Innocence of Muslim কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা চলমান আন্দোলন নিয়ে।
প্রসঙ্গক্রমে একটা ছোট্ট ঘটনা বলতে চাই, বছর দুই আগের কথা, পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে ক্রিকেট খেলা চলছে, এই দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের খেলা মানেই ব্যাপক উত্তেজনা আর সেটা মাঠ, খেলোয়াড় ছাড়িয়ে দর্শক-সমর্থক সর্বোপরি দুই দেশের মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে নিমিষেই। আমিও সুযোগ থাকলে মিস করি না এই খেলাগুলি,তবে সেদিন কাজ পড়ে যাওয়ায় বেরুতে হোল বাসা থেকে, ফেরার পথে দেখলাম, একটা ইলেকট্রনিক্স দোকানে বিশাল এলসিডি টিভিতে খেলা লাগানো, রাস্তার দিকে মুখ করে আর অনেকেই বাইরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে,আমিও একটু আপডেট জানার জন্য দাঁড়ালাম, দর্শকের মধ্যে পাকিস্তানীই বেশি, কিছু ভারতীয় আর আমি ছাড়া ৪/৫ জন বাংলাদেশী, ওই মুহূর্তে খেলায় পাকিস্তানের অবস্থান ছিল বেশ শক্ত, আমি গিয়ে দাঁড়ানোর মিনিট দুয়েক পরেই ভারতের আরেকটা উইকেট চলে যায়, আর ঠিক তখন ভিড়ের ভেতর থেকে এক পাকিস্তানী বেশ উঁচু গলায় ভারতের খেলোয়াড়,তাদের সরকার এবং সমস্ত ভারতীয়দের বিশ্রী ভাষায় গালাগাল দিতে থাকে, সবাই বিব্রত হয়ে গেল তার আচরণে, এমনকি উপস্থিত পাকিস্তানীরাও তাকে চুপ করানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কিসের কি, সে যতটা বিশ্রী ভাষা ব্যবহার করা যায় তার পুরোটাই করল, আবার এও বলতে থাকলো সাহস থাকে তো এখানে থাকা কোন ভারতীয়ও আসুক না আমার সাথে লাগতে। তার এই কথা শুনে, একদম পিছনে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাংলাদেশী তার পাশের ভারতীয় কে নিচু গলায় টিপ্পনী কাটল, কিরে তোদের এতো গালাগাল দিচ্ছে,কোন প্রতিবাদ করলি না?? উত্তরে ভারতীয় লোকটি হিন্দিতে এইভাবে উত্তর দিল, উসকা দিমাগ নেহি হ্যাঁয়, লেকিন মেরা হ্যাঁয়।
খেলা দেখা শেষ করে বাসায় চলে আসলাম, আর ভাবলাম ওই লোকটার চিন্তাধারা কত উন্নত, সেও যদি ওই পাকিস্তানীর মত সস্তা আবেগে ভেসে গিয়ে তার গালাগালির প্রতিবাদ করতে যেত, তবে সেখানে ভালো ঝামেলাই বাঁধত।
এখন কথা হচ্ছে, আমাদের ইসলাম ধর্মকে অবমাননা করে কেউ একজন একটা ভিডিও চিত্র নির্মাণ করলো, আমি একে সিনেমা বলতে রাজি নই কিছুতেই, কারন নির্মাণশৈলীতে সিনেমা হওয়ার মত কোন কিছুই আমি খুঁজে পাইনি, সেখানে দেখানো হোল মুসলিমরা বরাবরই রক্তারক্তি পছন্দ করে, এই ধর্মকে ক্যান্সারের সাথে তুলনা করে, মুহাম্মদ (সাঃ) কে একজন যুদ্ধবাজ হিসেবে প্রমাণিত করার চেষ্টা করা হোল। এটা বের হওয়ার সাথে সাথেই কিন্তু কেউ এটার খবর পেল না, মাস দুই পর ইউটিউব –ফেসবুক এবং অপরাপর অনলাইন মিডিয়ার মাধ্যমে এই সিনেমার খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলিতে, লক্ষণীয় সিনেমাটি নয় তার খবরমাত্র। প্রতিবাদে মুখর হোল বেশ কিছু দেশের মুসলিমরা, প্রতিবাদের ভাষা ছিল কেমন??? তারা রাজপথে ব্যাপক ভাংচুর করল, দোকানপাটে আগুন দিল, এবং নির্মাণে আমেরিকা ও ইসরাইলকে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের পতকা পোড়ানো সেই সাথে তাদের রাষ্ট্রদূতকে হত্যা করা হোল,প্রতিদিনই এই প্রতিবাদ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে আর ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। বিপুল সংখ্যক মুসলিম এই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে, যদিও আমার ধারণা তাদের মধ্যকার ৮৫ ভাগই এই সিনেমাটি একবারের জন্যেও দেখেনি।
আমাদের দেশেও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রাস্তায় নেমে এসেছেন, যার যার মত করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, মার্কিনী পতাকা পোড়াচ্ছেন, তবে সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য বোমা ফাটানো বা কোন বিধর্মী হত্যার মত কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না, যদিও আমি নিশ্চিত এই কাজ করতে অনেকেরই হাত নিশপিশ করছে। ফেসবুকে দেখলাম এই আন্দোলনের ফটো শেয়ার করা হচ্ছে নানা পেইজে, আর সেটা অন্যদেরও শেয়ার করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, কেউ বলছে এটা শেয়ার করা প্রতিটি মুমিন-মুসলমানের কর্তব্য। আর সুযোগ পেলেই পর্ণ দেখে অভ্যস্ত মুমিনরা সেটা শেয়ারও করতে থাকলেন, সাথে ফটোর নিচে তাদের কমেন্ট গুলিও দেখলাম বেশ জ্বালাময়ী, সেখানে শুধু কোপাও, মারো, উড়িয়ে দাও, জ্বালিয়ে দাও, আর লক্ষ কোটি লানতই চোখে পড়লো, অবশ্য আমি এই ছবিগুলি শেয়ার করতে পারলাম না, কীভাবে করবো?? এখানে লাঠি হাতে ভাংচুর করার দৃশ্য আছে, ধারালো অস্ত্র হাতে টুপি মাথায় মুমিনের ছবি আছে,হিংসা বিদ্বেষ আর মারমুখী মনোভাবের স্পষ্ট ছাপ আছে আন্দলনরত মানুষগুলির চোখে মুখে, মন বলল এটা শেয়ার করা মানে তো ওই সিনেমাকেই প্রমোট করা, সিনেমাতে মুসলিমদের যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এদের দেখি সেই রূপ, এই ছবি শেয়ার করে যদি ক্যাপশন দেই যে “ইসলাম শান্তির ধর্ম, আমরা মুসলিমরা সন্ত্রাসের পক্ষে না শান্তির পক্ষে, আমাদের নবিজী আজীবন শান্তির অগ্রদূত হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন” তবে সেটা বড্ড বেমানান দেখাবে।
ইয়াহু নিউজে আন্দোলনরত মুসলিমদের জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচীর ফটোর নিচে ভিন্ন ধর্মালম্বিদের লিখতে দেখলাম, এটাই শান্তির ধর্ম ইসলামের আসল রূপ, ওই দেখো নিষ্পাপ মুসলমানদের যারা কিনা একটা বস্তাপচা ভিডিওকে কেন্দ্র করে নিরীহ মানুষ হত্যা করছে। আমরা কিছুতেই বুঝতেছি না এই আন্দোলন ইসলাম বিরোধীদের আরও উস্কে দিচ্ছে এমন কাজ করতে, আমি মোটেও অবাক হবো না এরপর এমন আরও আরও ভিডিও প্রকাশ পেলে এবং সেটা আরও ব্যাপক পরিসরে, কারন এই করে খুব সহজেই আলোচনাতে আসা যাবে।
বাংলাদেশের কতিপয় ধর্মীয় নেতাদের বলতে শুনলাম, নেতা না বলে ধর্ম ব্যবসায়ী বললে উপযুক্ত হয়, যে সংসদে এই নিয়ে নিন্দা প্রস্তাব আনতে হবে, আমেরিকাকে প্রতিবাদ জানিয়ে চিঠি দিতে হবে, তাদেরকে ক্ষমা চাইতে হবে।
মজার বিষয় হলও, তেনারা সবকিছুতে যে সৌদি আরবকে অনুকরণ করার কথা বলেন, তাদের মত করে ইসলামী শরিয়া আইনের কথা বলেন, তারা কিন্তু সুন্দর নাকে তেল দিয়ে গুমাচ্ছেন, তারা কি প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছেন সরকারের তরফ থেকে আমেরিকাতে?? কেউ কেউ আবার আমাদের পর রাষ্ট্র মন্ত্রীকে দুয়ো দিচ্ছেন তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূত হত্যায় দুঃখ প্রকাশ করে তাদের শাস্তির দাবী জানিয়ে আমেরিকার সরকারকে চিঠি দেয়াতে, আরে এটাতো তার রোজকার কাজ গুলির মধ্যেই পড়ে। নাকি ওই রাষ্ট্রদূত মারা যাওয়াটা আমাদের জন্য অতি আনন্দের কোন সংবাদ?? পরিশেষে এই টুক বুঝি, আমরা যে শান্তির পক্ষে সেটা আমাদের শান্ত থেকেই প্রমাণ করতে হবে, টুইন টাওয়ার গুঁড়িয়ে দিয়ে নয়,আত্মঘাতী বোমা হামলা করে নয়, মাথা কাটার মত শাস্তি আরোপ করেও নয় নিশ্চয়। যেই নবীকে ব্যাঙ্গ করার প্রতিবাদে আপনারা নিরীহ মানুষ মারার মত কাজ করছেন, সেই নবীই কিন্তু সবাইকে ক্ষমা, সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়ে গেছেন, আমরা তার শিক্ষাকে অবমাননা করে তার সম্মান কিভাবে প্রতিষ্ঠা করছি সেটা আমার বোধগম্য না।
নিশ্চিত করে বলতে পারি দেশে বিদেশে এই আন্দোলনকে পয়সা কড়ি দিয়ে তরান্বিত করছে ইসলাম বিরোধীরাই, তারা সারা বিশ্বে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে সন্ত্রাসের স্বপক্ষের শক্তি হিসাবে দেখাতে চায় ,ব্যাবহার জঙ্গিবাদের নিয়ামক হিসেবে, আর তারা যে ভালোই সফল হয়েছে সেটা মানতেই হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।