আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাচীন বাংলায় দ্রাবিড় জাতি

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ বাঙালি মিশ্ররক্তের অধিকারী বর্ণশঙ্কর জাতি। সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রাচীন বাংলার অধিবাসীদের দেহে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর রক্তধারার সংমিশ্রণ ঘটেছিল বলেই কালক্রমে বাঙালি একটি বর্ণশঙ্কর জাতিতে পরিনত হয়েছে। বাঙালি তার অবয়বে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্যচিহ্ন বহন করে চলেছে বলেই বাঙালিদের মধ্যে আর্য-সুলভ গৌড়বর্ণ যেমন দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি নিগ্রোয়েড-সুলভ মোটা কোঁকড়া চুল ও পুরু ঠোঁটও দেখা যায়।

পন্ডিতদের মতে, অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়রাই বাংলার প্রাচীনতম জাতি । অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের আদিবাসীদের সঙ্গে অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়দের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ও ভাষার মিল রয়েছে বলেই ওই নাম। তবে এরা যে কেবল মাত্র বাংলায় ছিল তা কিন্তু নয়। প্রায় তিরিশ হাজার বছর আগেই অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়া ভারতীয় উপমহাদেশে ছড়িয়েছিল। প্রাচীন বাংলায় (বা বলা ভালো: প্রাগৈতিহাসিক বাংলায়) অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়দের আরও এক নিকটতম প্রতিবেশি ছিল।

এরা কিরাত নামে পরিচিত। কিরাতরা ছিল মঙ্গোলয়েড জনগোষ্ঠীর মানুষ। এবং এরাও প্রাচীন বাংলায় অস্ট্রিকভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়দের পাশাপাশি অরণ্যচারী জীবন যাপন করত। পরবর্তীকালে আর্যরা তাদের বৈদিক সাহিত্যে অস্ট্রিক ও কিরাতদের অনেকটা ঘৃনাসূচক ‘নিষাদ’ বলে অবহিত করেছিল। তবে প্রকৃতিপ্রেমি বাঙালি আজও নিজেদের ‘নিষাদ’ বলে পরিচয় দিতে তীব্র আকর্ষন বোধ করে।

সে যাই হোক। অস্ট্রিক ও কিরাতদের পর, তার মানে নিষাদজাতির পর, দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠী প্রাচীন বাংলায় এসেছিল । বাংলার ভাষা ও সভ্যতায় এই দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠীর গভীর অবদান রয়েছে। এই পোস্টে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ভাবে তারই পর্যালোচনা করা হয়েছে । এবারে আমরা দেখব দ্রাবিড় শব্দের মানে কী।

দ্রাবিড় শব্দের দুটি অর্থ হয়। একটি তার সংকীর্ণ অর্থ; অন্যটি তার প্রসারিত অর্থ। সংকীর্ণ অর্থে - তামিল শব্দ দিয়ে দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কার তামিল ভাষা ও জাতিকে বোঝানো হয়। বৃহত্তর বা প্রসারিত অর্থে- তামিল শব্দ দিয়ে দক্ষিণ ও মধ্য এবং পশ্চিম ভারতে অবস্থিত একটি বিশাল ভাষাগোষ্ঠী ও সেই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে বোঝানো হয়। আর্যরা ভারতবর্ষে আসার আগেই ভারতীয় উপমহাদেশ দ্রাবিড়-অধ্যুষিত ছিল।

আর্যরা-পন্ডিতদের মতে- ইরান থেকে প্রাচীন ভারতে এসেছিল ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে। আর্যরা যে ধর্মগ্রন্থ রচনা করেছিল তাইই ‘বেদ’ নামে পরিচিত। বেদ চারটি। যেমন: ঋক, যজু, সাম ও অর্থব। এর মধ্যে ঋকবেদই প্রাচীনতম।

ঋকবেদ এর রচনাকাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দশম শতাব্দী। (দ্র: ড. আর এম দেবনাথ; সিন্ধু থেকে হিন্দু) কিন্তু, বেদ নিয়ে এত কথা বলার কারণ হল এই যে- ঋকবেদ এর যুগ থেকে ভারতে দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠীর প্রমান পাওয়া যায়। যে কারণে বলছিলাম যে আর্যরা ভারতবর্ষে আসার আগেই ভারতীয় উপমহাদেশ দ্রাবিড়অধ্যুষিত ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, বেদভিত্তিক বৈদিক সাহিত্যে দ্রাবিড় শব্দটি সংকীর্ণ অর্থে বোঝানো হয়েছে। তার মানে, আর্যরা দ্রাবিড় বলতে দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কার তামিল ভাষা ও জাতিকে বুঝত।

বহিরাগত আর্যদের তুলনায় দ্রাবিড় সভ্যতা ছিল উন্নত। ঐতিহাসিক শ্রীনিবাস আয়েঙ্গার লিখেছেন, ‘প্রাচীন দ্রাবিড়গণ বৈদিক আর্যদের অপেক্ষা সভ্যতায় কোনও অংশে হীন ছিল না। বরং বিষয়াবিশেষে আর্যগণ অপেক্ষা তাহারা অধিকতর উন্নত ছিল । বিজ্ঞানে, শিল্পে, যুদ্ধবিদ্যা ও বুদ্ধি কৌশলে তাহারা আর্যদের সম্যক প্রতিদ্বন্দী ছিল। ’ (দ্র. লাইফ ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া।

) এখন প্রশ্ন হল-দাবিড়রা কি ভারতবর্ষে সব সময়ই ছিল? নাকি তারাও কোনও এক সময়ে আর্যদের মতোই বাইরে থেকে ভারতবর্ষে এসেছিল? এই প্রশ্নে পন্ডিতেরা দু ভাগে বিভক্ত। (ক) একদল পন্ডিত মনে করেন যে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসেছে । এদের আদি বাসভূমি ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল। (খ) আরেক দল পন্ডিত মনে করেন- দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষের আদি অধিবাসী। তবে প্রথম মতটিই অধিকতরো গ্রহনযোগ্য।

অবশ্য এর যথার্থ কারণও আছে। দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর বর্তমান বাসস্থান দক্ষিণ ভারত। সেখানকার সমাধিক্ষেত্রে যে কঙ্কাল পাওয়া গেছে তার সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় নরগোষ্ঠীর (ডিএনএ ইত্যাদির) মিল রয়েছে । তাছাড়া মিশরীয়দের সঙ্গেও দ্রাবিড়দের নৃতাত্ত্বিক মিল রয়েছে। এসব কারণে দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠী কে ভূমধ্যসাগরীয় নরগোষ্ঠীর মানুষ বলে মনে করা হয়।

নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্টের দিক থেকে দ্রাবিড়রা দীর্ঘমুন্ড ( নৃতত্ত্বের পরিভাষায় বলে ডলিকোসেফালিক!) নাক চওড়া ও মোটা; ঠোঁট পুরু; মুখ চওড়া ও মাংসল; শারীরিক গঠনে তেমন সমন্বয় নেই; গায়ের রং বলাবাহুল্য যে কৃষ্ণকায়। এই দ্রাবিড়রাই প্রাচীন বাংলায় এসেছিল। কখন? সেটা আজ হিসেব কষে বলা মুশকিল। তবে সে সময় প্রাচীন বাংলায় বাস করত অস্ট্রিক-ভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় এবং কিরাতগণ। কিরাতগণ অরণ্যক জীবন যাপন করলেও (আজও তারা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পাহাড়ে এক রকম অরণ্যক জীবন যাপনই করছে!) অস্ট্রিক-ভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়রা প্রাচীন বাংলায় গড়ে তুলেছিল গ্রাম।

যে কারণে আজও বাঙালির জীবনে অত্যন্ত গভীর অস্ট্রিক-প্রভাব অনুভূত হয়। কারণ প্রাচীন বাংলায় কৃষিকাজের সূচনা এই অস্ট্রিক-ভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়রাই করেছিল। কৃষিকাজের জন্য যে লাঙ্গল-এর দরকার হয়, এবং যে লাঙ্গল আজও বাংলার কৃষকের প্রতীক- সেটি ওই অস্ট্রিকরাই তৈরি করেছিল। কৃষিকাজের পাশাপাশি তারা মাছ ধরত। নদী কিংবা খাল-বিল পাড় হত ডোঙা, ডিঙা কিংবা ভেলায় চড়ে ।

তবে পাশাপাশি এদেরই একাংশ অরণ্যচারী জীবন যাপন করত। তারা কিরাতদের মতোই তীরধনুক দিয়ে অরণ্যের পশুপাখি শিকার করত । প্রাচীন বাংলায় অস্ট্রিক-ভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়দের অবদান যেমন গ্রামীণ সভ্যতা- তেমনি প্রাচীন বাংলায় দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠীর অবদান হল- নগরসভ্যতা। কেননা, দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠীই প্রাচীন ভারতবর্ষে নগরসভ্যতার সূত্রপাত করেছিল। দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠী ছিল অস্ট্রিকদের তুলনায় সভ্য এবং তাদের সাংগঠনিক শক্তিও ছিল বেশি ।

যে কারণে নগরকে কেন্দ্র করে দ্রাবিড় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। আসলে মিশর থেকে ভূমধ্যসাগর অবধি দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠীর সভ্যতায় নরগকেন্দ্রিক উপাদানই বেশি। বিশিষ্ট বাঙালি ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘নব্যপ্রস্তরযুগের এই দ্রাবিড়ভাষাভাষী লোকেরাই ভারতবর্ষের নগর সভ্যতার সৃষ্টিকর্তা। ’ ( বাঙালির ইতিহাস। আদিপর্ব।

পৃষ্ঠা; ৭৫) বহিরাগত আর্যরা ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বে সিন্ধুসভ্যতার যে সব উন্নত নগরসমূহ ধ্বংস করেছিল সে সসব নগরের নির্মাতা ছিল দ্রাবিড়গণ। তবে নগর জীবনের পাশাপাশি দ্রাবিড়রা বাংলায় কৃষি কাজও করত। সংস্কত ভাষায় ‘ব্রীহি’ ও ‘তন্ডুল’ শব্দ দুটি দিয়ে ধান্য (ধান) বোঝায়। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে- এই দুটি শব্দে মূলে রয়েছে দ্রাবিড় ভাষা। এতে বোঝা যায়-প্রাচীন বাংলায় দ্রাবিড়রা ধান চাষ করত।

ধান ছাড়াও দ্রাবিড়রা গম ও যব এর আবাদও করত। দ্রাবিড়রা অস্ট্রিক-ভাষী আদি-অস্ট্রেলীয়দের মতোই মাছ খেত। মাছ ধরা ছাড়াও তারা নদীতে কিংবা সমুদ্রের ধারে মুক্তা ও প্রবাল আরোহন করত । সংস্কৃত ভাষায় মুক্তা, নীর (পানি), মীন (মাছ) এসব শব্দের মূলে রয়েছে দ্রাবিড় শব্দ। বাঙালি সনাতনধর্মাবলম্বী হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মে দ্রাবিড়দের রয়েছে গভীর প্রভাব।

শিব, উমা, বিষ্ণু, শ্রী- প্রমূখ দেবদেবী প্রাচীন বাংলায় দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর দ্বারা পূজিত হতেন। এ ছাড়া দ্রাবিড়দের ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে গঙ্গাপূজা, লিঙ্গপূজা, জগন্নাথ পূজা, শক্তিপূজা, বৃক্ষপূজা, শীতলা, বাসুদেব ও যুগলমূর্তির পূজার ধারণা এসেছে । দ্রাবিড়রা ছিল গভীর আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন এবং মিস্টিক। দ্রাবিড়দের সাধনমার্গ ছিল যোগসাধন পদ্ধতি । বলা যায় বাঙালি তার মরমি ভাবনা লাভ করেছে দ্রাবিড়দের কাছ থেকেই।

তবে দ্রাবিড়দের ধর্মীয় কৃত্যে নরবলির প্রথা ছিল বলে অনেক পন্ডিত অনুমান করেন। তবে দ্রাবিড়দের সবচে বড় অবদান হল বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে। বাংলা ব্যকরণ অনেক নিয়ম দ্রাবিড় ভাষাতত্ত্বের ওপর গড়ে উঠেছে । তা ছাড়া দ্রাবিড় ভাষার প্রচুর শব্দ বাংলা শব্দ ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। একটা সময় ছিল যখন- ভারতীয় উপমহাদেশে দ্রাবিড়ভাষাই ছিল সর্বসাধারণের ভাষা।

এ কারণেই প্রাচীন বাংলার অধিবাসীদের ভাষায় দ্রাবিড় ভাষার প্রভাব পড়াই ছিল স্বাভাবিক । দ্রাবিড় ভাষা থেকে এসেছে বাংলা ভাষায় এমন কিছু শব্দ হল: অণু, অরণি, অগুরু, অনল, কাল (সময়), কলা, পুষ্প, মুকুল, মল্লিকা, পূজা, গণ, কোণ, নীল, পন্ডিত, শব, অর্ক, অলস, ফল, বীজ, উলু, রাত্রি, অটবী, আড়ম্বর, তন্ডুল, খড়গ, কুন্ড, চন্দন, দন্ড, খাল, বিল, ময়ূর, কাক, কাজল, কোদাল, কেয়া, বালা, পল্লী, বেল, তাল, চিকণ, চুম্বন, কুটির, খাট, ঘূণ, কুটুম্ব ...ইত্যাদি। শব্দই তো তুলে ধরে জীবন কে। আজও এরকম অনেক দেশি শব্দ তুলে ধরে প্রাচীন বাংলার দ্রাবিড়জীবন ... তথ্যসূত্র: কাবেদুল ইসলাম; প্রাচীন বাংলার জনপদ ও জনজাতিগোষ্ঠী আহমেদ শরীফ; বাঙলা বাঙালী ও বাঙালীত্ব ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।