আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পরাজয়

চোখের শেষ সীমানাটুকু পর্যন্ত শুধু পানি আর পানি ! উত্তরে বস্তাল,দক্ষিনে শাড়িরভিটা। মাঝে পাঁচকাঠির বিল। ফাল্গুন-চৈত্রে পানির লেশ মাত্র থাকেনা ! শুধু ধূ-ধূ ফসলের খোলা প্রান্তর এবং সেই আল বরাবর দুটি গ্রামের চলাচলের রাস্তা, অ্যাইরা পথ। বর্ষায় কিন্তু পাঁচকাঠির ভীষন রুপ ! পদ্মা থেকে ধেয়ে আসা পানির তোড়ে তার দেহ ফুঁলে-ফেঁপে ওঠে। তখন পাঁচকাঠিকে শুধু আমনের শীষই টেক্কা দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।

আরও একজন পারে,কিন্তু তার জন্মের কোন গাছ-পাথর নাই ! একটা প্রকান্ড বিভৎস শিমুল গাছ। বস্তাল ও শাড়িরভিটা মিলিয়ে সবচেয়ে বয়োজৈষ্ঠ্য হরি খুড়ো তার ছেলেবেলা ঘেঁটে কোনমতে মনে করতে পারেন,একবার ঝড়ের রাতে বজ্রপাতে গাছটির একাংশ পুড়ে যায়। তারপর থেকে পাঁচকাঠির বিলে আধন্যাঁড়া নিশান হয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে শিমুল গাছটি। ফাল্গুনে তার মাথায় লাল ফুলের হাট বসে। চৈত্র শেষে পেঁজা তুলো।

আর এখন,এই মাঝবর্ষায় তার মাথায় উঁকুনের মতো বাসা বেঁধেছে শকুনের দঙ্গল। পাঁচকাঠির বাতাসের হু হু কান্না আর ক্ষুদার্ত শকুনগুলোর ডানা ঝাপটানির আওয়াজে রাহেলার বুকটা কেমন ধুকপুক করে উঠলো। ভাইকে তাগাদা দিয়ে বললো-'বৈঠা মার,আনার। সকালে শাড়ির ভিটা থেকে ছোটভাই তাকে নিতে এসেছে। বাবার নাকি খুব অসুখ ! খবরটা রাহেলার মনে ফাল হয়ে বিঁধেছে ।

অন্ধ বাচ্চা মেয়েটা নিয়ে তার ঝুঁটঝাঁট হীন সংসার। স্বামীটা লাঠিয়ালদের হাতে মরেছে গেল বছর। সোমত্ত মেয়ে হয়েও যৌবনকে দীর্ঘঃশ্বাসে চাপা দিয়ে রাহেলা পড়ে আছে, মৃত স্বামীর ভিটে-মাটি আঁকড়ে। অরক্ষিত বরই গাছ প্রতিনিয়ত যেমন ঢিলের চোটে রক্তাক্ত হয়,রাহেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। ঢিলটা রজব মুন্সীই বেশি ছুঁড়ে থাকে।

দেখা-শোনা করার ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু রাহেলা কান করে না। আজ সকালেই তো, রাহেলা তার ছোট ভাইকে নিয়ে বের হওয়ার সময় রজবমুন্সী দুয়ারে হাজির-কই যাও রাহেলা ? -ক্যান ? তা শুইন্যা আপনার কাম কি ? -এইডা তুমি কিও কও রাহেলা ? সবই তো বোঝ। -বুঝার ইচ্ছা নাই। পথ ছাড়েন ? বাজানের অসুখ ? - তা তো যাইবাই।

তয়,এত গরম দেহাও ক্যান ? আর দেহাইতেই যদি চাও তাইলে আমি সব ব্যবস্থা করি। রাহেলা গর্জে ওঠে-‌'দুর হন অ্যান থেইক্কা,বদ ব্যাটাছাওয়াল কনকার। ' -'তর ওই গতর থাকবো নারে,রাহেলা। ভালয় ভালয়,আমার কতায় রাজি হইয়া যা, তুই স্বামী খাওয়া মাইয়া মানুষ,কপালে খারাবি আছে,কইয়া রাখলাম। ' শাড়িরভিটার পাড়ে ডিঙ্গির নাক ছোঁয়ার আগ পর্যন্ত রাহেলার মন থেকে রজব মুন্সীর শাসানি দুর হয় না।

এটা তার বাবার ভিটেমাটি। এই পাড়েই বাদ্যি-বাজনা বাজিয়ে মজিদ তার বিয়ের বজরা ভিড়িয়েছিল। লালটুকটুকে বউ সেজে রাহেলার পা পড়েছিল সেই বজরায় । তিনবছর পর এখন সেই পাড় দিয়েই রাহেলা বাড়ি ফিরছে। এবার তার সঙ্গে মজিদ নেই।

মেয়েটা আর পরনের সাদা কাপড়খানিই রাহেলার সঙ্গী। বাড়ির উঠোনে বাবাকে খ্যার মলতে দেখে রাহেলা ছুটে যায়-'জার শরীর নিয়্যা বাজান এসব কি করতাছেন ?' -গায় জার নাই রে মা। তরে,মিছা কতা কয়া আনছি। রাহেলা চমকে যায়। -ক্যান বাপজান ? -মা'রে. ঘরে চল।

রাহেলা তার বাবাকে নিয়ে ঘরে যায়। পিড়ি পেতে বসে তার বাবা বলেন,‌'মারে,মজিদের ভিটায় একলা থাকস,তর ডর করে না ? রাহেলা ধৈর্যহারা হয়ে বলে-ডর করবো ক্যান,বাপজান ? কি কইবা কও তো ? রাহেলার বাবা আমতা আমতা করে বলে-'তর আবার বিয়া ঠিক করছি মা। ' নিজের বোকামিতে রাহেলার নিজের ওপরই রাগ হয়। বাড়িতে পা দিয়েই তার সবকিছু বোঝা উচিত ছিল। চড়া কন্ঠে জবাব দেয়-'বাজান,আমি আবার বিয়া করবার পারুম না।

বস্তালই আমার শেষ মাটি। থাহেন যাই। ' রাহেলার বাবা শশব্যস্ত হয়ে পড়েন। -'ওহনি যাবি মা ? একটু জিরাইয়া ল। চাইড্যা ভাত খা।

দে, টেপিরে আমার কাছে দে। ' সুর্য মাঝআকাশে আগুন বিলোচ্ছে। নিচে রাহেলার হৃদয় পুড়ে ছাই হচ্ছে। বেড়াহীন ক্ষেতের দখল নিতে চায় সবাই,মজিদ গত হওয়ার পর এই একবছরে, রাহেলা তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ব্যাপারটি আঁচ করেই তার বাবা হয়তো আবারও বিয়ে ঠিক করেছে।

কিন্তু এই তিনবছরে মজিদের সংসারের শেকড় রাহেলার শিরা-উপশিরা বেয়ে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে গেছে। যৌবনের খাঁই যে নেই,তা নয় । ফুটফুটে টেপির মুখে তাকিয়েই তো ওসব ক্ষিধে ভুলে থাকা যায়। হঠাৎ রজব মুন্সীর কথা মাথায় ঘাই মারতেই রাহেলার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সে ভাবে-এই একবছর সে যদি টিকে থাকতে পারে,তাহলে বাকি জীবনটাও পারবে।

সমাজ-জামাত বলে তো কিছু আছে, নাকি ? তাই ভয় কি ? এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাহেলা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে,টের পায়নি। ঘুম ভাঙ্গলো আসরের আযানে। হতচকিত হয়ে উঠে সে বিরবির করে বললো-'ইস,দেরী হইয়্যা গেল। মুন্সীর বাচ্চাডা বাড়িত্ যে কি করতাছে,আল্লাই জানে !' রাহেলার বাবা বারণ করেছিল। ছোটভাইটাকে সঙ্গে দিতে চেয়েছিল।

না পেরে,তিনি নিজে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাহেলার একগুঁয়ে জবাব-'আমি একাই যাবার পারমু। কুনু ব্যাডা ছাওয়ালের দরকার নাই। ' বস্তুত,মজিদ মরার পর এই একবছরে সংসারের নানা ভাঁজে হোঁচট খেয়ে রাহেলা সত্যিই বেশ শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছে। তাই ওর বাবা যখন ঘর থেকে সুতোর বুননে 'ঈশ্বর' লেখা একটি রুমাল রাহেলার হাতে দিয়ে বললো-মারে এই রুমালডা তোর দাদীর হাতের।

দোয়া-দুরুদ পইড়া বন্ধ করা আছে। ওই শিমুল গাছের আশপাশটা ভালা না। একটু দেইখা যাস আর আমার কথাডা একটু ভাবিস',জবাবে রাহেলা-'আমার কতা তুমাগরে ভাবনের দরকার নাই' বলে ডিঙ্গি ভাসালো। পুড়ে লাল হয়ে যাওয়া বিকেলের সুর্যের সোনালী আলো পাঁচকাঠির বুকে গোঁত্তা খেয়ে ঝিকিমিকি করছে। বৈঠার ঘায়ে সেই পানি কেটে অনেকক্ষন এগিয়ে চললো রাহেলা।

পথ যেন ফুরোচ্ছে না। সাঁঝকে দেখার ভয়ে সুর্যটা কিছুক্ষন পরই টুপ করে পশ্চিমাকাশে ডুবে মরলো। কিন্তু পাঁচকাঠির বুকে অন্ধকার জুড়ে বসতে পারলো না। ফিনিক জোসনায় গোটা বিলটার রুপ-রস যেন চুঁইয়ে পড়তে শুরু করলো ! রাহেলা তবুও কুপি জ্বালালো। শিমুল গাছটার তলে আসতেই সে কুপিটা এক হাতে উঁচিয়ে আরেক হাতে টেপিকে শক্ত করে বুকে সেঁটে ধরলো।

হঠাৎ শকুনের দল ডেকে উঠলো। রাহেলা চুপ। ডিঙ্গির পেছনে কলকল শব্দ হতেই সে ঘুরে তাকালো। আরেকটি নৌকা ! এক হাতে বৈঠা আরেক হাতে ছুরি নিয়ে খিকখিক করে হেসে উঠলো রজব মুন্সী ! মজিদের মরায় রাহেলা শুধু কষ্টই পেয়েছে। কখনো ভয় লাগেনি।

কিন্তু ওই জনমানবহীন পাঁচকাঠির তরল মরুভূমির মাঝে অতল বিপদে পড়ে রাহেলা ভয়ে সিঁটকে উঠলো। মিনতি ভরা কন্ঠে বললো-'দয়া কইরা আমার ক্ষতি কইরেন না। ' -'তাই তো চাইছিল্যাম। কিন্তু তুই তো ওই জাতের না। বেবাক দিনডা তোর অপেক্ষায় এহানে কাটাইছি' এই বলে রজব মুন্সী রাহেলার ডিঙ্গিতে উঠে এলো।

-খবরদার মুন্সী। বৈঠা দিয়া তুমার মাথা ছেঁইচ্যা দিমু কিন্তু। -আরে রাখ মাগী। হঠাৎ রাহেলার ডিঙ্গির দুই পাশ থেকে ভুস করে দুটি মাথা বেরিয়ে আসে। তাদের হাত রাহেলার পা শক্ত করে চেপে ধরে।

টাল সামলাতে না পেরে রাহেলার হাত থেকে টেপি ফসকে পড়ে যায় পানিতে। মেয়েকে বাঁচাতে রাহেলাও ঝাঁপ দেয়। বোবা কান্নায় দুলে ওঠে পানি। মেয়েকে উদ্ধার করা তার আর হয় না ! শিমুল গাছের খোন্দলে নৌকা ঠেকিয়ে তারওপর রাহেলাকে চিত করে শোয়ায় মুন্সীর দুই স্যাঙাৎ। হাত-পা পাঁড়া দিয়ে ধরে রেখেছে তারা।

ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে রাহেলা শুধু একবার ডুঁকরে বলে-'টেপিরে...আমার টেপি। 'বিলের নির্জনতা রাহেলার আর্তনাদকে গ্রাস করে নিল। আকাশে জ্বলতে থাকা ঈশ্বরের কুপির আলোয় রজব মুন্সী তার বহুদিনের লালসা পাঁচকাঠির নিরেট বুকে ওপর চরিতার্থ করে নিল। শিমুল গাছটার মাথায় বসে শকুনের দল সবকিছু দেখলো। পরদিন সকালে বিলে মাছ মারতে গিয়ে বস্তালের এক মাঝি দেখে,শিমুল গাছটার ডালে রাহেলার লাশ ঝুলছে।

আর,পানির মধ্যে শকুনের দল ভুরিভোজ সারছে। তাদের ডানা ঝাপটানোর চোটে টেপির দেহের বিচ্ছিন্ন টুকরোগুলো এখানে-সেখানে ছিটকে পড়ছে, আর নৌকার গলুইতে ঝুলে থেকে তাই দেখছেন 'ঈশ্বর' ! - ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।