আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আসামে মুসলিমরা সঙ্কটে

চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি আসামের কোকরাঝার এলাকা ও সংলগ্ন অঞ্চলে উদ্বেগজনক জাতিদাঙ্গার ঘটনায় এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ জন মারা গেছেন, গৃহহারা হয়েছেন ৪ লক্ষেরও বেশি। ১৯ জুলাই থেকেই দীর্ঘদিন ধরে তিরতির করে বয়ে চলা উত্তেজনা জাতিদাঙ্গার চেহারা নিতে শুরু করে। এর আগেই অবশ্য কোকরাঝার এলাকায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করেছিল, যখন জুলাইয়ের প্রথম দিকে দুজন বাঙালি মুসলমান ওই এলাকায় খুন হন। ১৯ জুলাই আরো দুজন মারা যান। ২০ জুলাই বোড়ো লিবারেশন টাইগার এর চার প্রাক্তন সদস্য খুন হন।

এর প্রতিক্রিয়ায় বোড়োরা বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় প্রত্যাঘাত করলে দাঙ্গা শুরু হয়। ১৯৭১ সালের আগে, বাংলাদেশ গঠনের আগেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান থেকে আসা বাঙালি মুসলিম অভিবাসীদের সঙ্গে বোড়ো আদিবাসীদের এই সংঘর্ষর প্রাথমিক কারণ জমি ও জীবিকার অধিকার নিয়ে বিরোধ। বোড়োদের পক্ষ থেকে প্রচারে বলা হয় ৯০ এর দশক পর্যন্ত কোকরাঝার এবং চিরাং এ বোড়ো আদিবাসীদের সংখ্যাই ছিল বেশি। কিন্তু গত দুদশকে এখানে অভিবাসী মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েছে, যারা মূলত ক্ষেতমজুর এবং দিনমজুর। বিশেষত গোঁসাইগাঁও মহকুমার বিভিন্ন গ্রামে অভিবাসী মুসলিম জনসংখ্যার তুলনায় বোড়োরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন।

ধীরে ধীরে কোকরাঝার শহর এলাকাতেও অভিবাসী মুসলিমদের একাংশের প্রবেশ ঘটেছে। অন্যদিকে ‘বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী ঢুকে পড়ায় এখানকার জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে’ – এই জনপ্রিয় প্রচারের বিরুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন জানিয়েছেন ১৮৫০ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকেই তারা এখানে আসা শুরু করেন। বস্তুতপক্ষে ব্রিটিশদের আগ্রহেই ব্রক্ষ্মপুত্রের তীর বরাবর অভিবাসনের এই প্রক্রিয়াটি চলে। ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকার জমি অত্যন্ত উর্বর, কিন্তু বন্যার জন্য সে জমিতে চাষাবাদের জন্য বিশেষ দক্ষতা দরকার ছিল। জলের মধ্যে চাষের প্রযুক্তি ময়মনসিংহ অঞ্চলের চাষিদের আয়ত্তে ছিল।

ব্রিটিশ শাসকরা ওই এলাকাকে রাজস্ব আদায়ের যোগ্য করে তোলার জন্য ময়মনসিংহ ও অন্যান্য জেলা থেকে মুসলমান চাষিদের নিয়ে আসে। বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে এই অভিবাসনের মাত্রা আরও বাড়ে। আজকের অসমে ব্রহ্মপুত্রের চর এলাকায় কৃষি-সমৃদ্ধির পেছনে এই মুসলমান চাষিদের অবদান অসামান্য। এদেরই একটা অংশকে আবার বন্যার কারণে উত্তরে-দক্ষিণে অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় সরে যেতেও হয়েছে। ফলে রেল লাইনের উত্তরেও কিছু মুসলমান বসতি গড়ে উঠেছে।

এটা নিয়ে বোড়োরা আপত্তি জানিয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে পৃথক বোড়োরাজ্যের দাবী নিয়ে বোড়ো লিবারেশন টাইগার নামক বোড়োদের জঙ্গী সংগঠনের নেতৃত্বে চলা বোড়ো আন্দোলনের সঙ্গে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের সমঝোতা সূত্র হিসেবে ২০০৩ সালে বোড়োল্যাণ্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল (বিটিসি) তৈরি হয়। আসামের চারটি জেলা, কোকরাঝার, চিরাং, বকসা এবং উদালগুরু এর অন্তর্ভূক্ত হয়। সে সময়েই সংশ্লিষ্ট এলাকার অ-বোড়ো মানুষজন বিটিসি তৈরির বিরোধিতা করে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিল এর ফলে এই এলাকায় অবোড়োদের নানা সমস্যর মুখোমুখি হতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ওই এলাকায় বোড়ো ও অন্যান্য তফসিলি উপজাতির কিছু মানুষ মিলিয়ে উপজাতিদের মোট সংখ্যা ছিল ১৮ শতাংশ।

বাকি ৮২ শতাংশ মানুষের মধ্যে ছিলেন বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলিম ও ভালো সংখ্যক সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ। বিটিসি তৈরির পর বোড়ো লিবারেশন টাইগার তাদের কার্যকলাপ গুটিয়ে নেয়। কিন্তু তাদের একদা প্রধান হাগ্রামা মাহিলারি একটি রাজনৈতিক সংগঠন তৈরি করেন এবং বোড়োকাউন্সিলের নির্বাচনে বিজয়ী হন। অ-বোড়োদের অভিযোগ কাউন্সিল তাদের প্রতি উদাসীন। অন্যদিকে বিটিসি তৈরির পরেও এই বিটিসি এলাকায় মুসলিম অনুপ্রবেশের সূত্রে বোড়োদের জমির অধিকার কমে যাওয়া এবং গোঁসাইগাঁও মহকুমার মতো অনেক জায়গায় তাদের তুলনায় বোড়োদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়া তাদের মধ্যে একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে।

দীর্ঘদিনের পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণই সাম্প্রতিক জুলাই দাঙ্গার মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য এর আগেও এই অঞ্চল মারাত্মক কিছু জাতি দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছিল। ১৯৮৩র ১৮ ফেব্রুয়ারী সংগঠিত নেল্লি গণহত্যায় ছয় ঘন্টার মধ্যেই দুহাজারের বেশি মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছিল। এছাড়াও মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা ও চাপা উত্তেজনা এখানকার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এরকম সংবেদনশীল অঞ্চলে দাঙ্গা শুরুর পরেও তা নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপের অভাব পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ এর নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করলেও তিনি কেন্দ্রের ওপর দায়ভার চাপিয়ে বলেছেন চারজনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরেই তিনি কেন্দ্রীয় বাহিনী চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু চারদিন পরে তা পাঠানো হয়, যা ইতোমধ্যেই পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে। দাঙ্গা পরিস্থিতি মাত্রা ছাড়ানোর পর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম, মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ অকুস্থল পরিদর্শন করেছেন, শরণার্থী শিবিরগুলিতে গেছেন। কিন্তু শরণার্থী শিবিরগুলো অব্যবস্থার তীব্রতম নিদর্শন হয়েই রয়েছে। এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ বজায় থাকায় ঘরছাড়া মানুষ ঘরেও ফেরার সাহস পাচ্ছেন না।

রাজ্য ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শরণার্থী শিবিরগুলিকে যথাসাধ্য বাসযোগ্য করে তুলতে হবে, এলাকায় শান্তি ফেরানোর জন্য কঠোর ব্যবস্থাপণা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু পাশাপাশি মনে রাখা দরকার জমি ও জীবিকার অপ্রতুলতার ক্রমবর্ধমান সমস্যাই এই জটিলতাকে প্রতিদিন বাড়িয়ে তুলছে, আর সেটাই আরো নানা বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পারস্পরিক জাতিবিদ্বেষের আকারে এখানে আছড়ে পড়ছে। শুধু বোড়োল্যাণ্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল গঠন করে যে সমস্যার মৌলিক কোন সমাধান করা যাবে না, সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করে এটা স্পষ্ট হচ্ছে। দাঙ্গা প্রতিরোধে আশু সমস্ত ব্যবস্থার পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার ভিত্তিতে সমস্ত পক্ষের জীবন জীবিকার মৌলিক সমাধান ও পারস্পরিক সৌহার্দের সংস্কৃতি নির্মাণ করাই অশান্ত এই এলাকায় শান্তি স্থাপনের প্রকৃত রাস্তা হতে পারে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.