আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাখিদের আরও গল্প

গত পর্বে পাখিদের গল্প শুরু করেছিলাম মুরগি দিয়ে। শুরুতেই অন্তু প্রতিবাদ করে বলেছিল মুরগি কি পাখি? আমি বলি, তেলাপোকা যদি পাখি হতে পারে, তো মুরগি কী দোষ করল? তারপর উপরের ছবিটা খুঁজে বের করে দিল সে আমার জন্য। ছবিটা দেখে মনে পড়ল, মুরগি কাহিনী আরও ছিল যেগুলো বলা হয়নি। যা হোক, গল্পের শুরুটা যখন মুরগি দিয়ে করেছি, শেষটাও তাই করব। এখন কবুতরের গল্পে আসি।

তখন মনে হয় ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ি। আম্মার শখ হল বাড়িতে কবুতর পালার। নানার শখগুলো আম্মার মধ্যেও অনেকখানিই এসেছে। তো শখ পূরণ করতে আম্মা নিয়ে এলেন কয়েক জোড়া কবুতর। ইটের দালান কোঠায় কবুতরের বাড়ি বানানো একটা ঝক্কিই।

তারপরও পুরনো কার্ডবোর্ডের বাক্স দিয়ে আম্মা ঠিকই বানিয়ে দিলেন তাদের জন্য বাড়ি। তাদের জন্য বিশেষ করে আলাদা ধান আর চাল নিয়ে আসতেন আব্বা। আর খাওয়ানোর দায়িত্ব নিজে থেকেই নিয়ে নিয়েছিলাম আমরা। আর সুযোগ পেলেই কবুতরগুলোকে কোলে নিয়ে আদর করতাম। আমার ফ্রকে প্রায় সবসময়ই কবুতরের ইয়ে লেগে থাকত।

প্রথম প্রথম জামা পাল্টে নিতাম। পরে শুধু ঐটুকু অংশ ধুয়ে নিতাম কোনমতে। পায়রাগুলোর বাকবাকুম শুনে ঘুম ভাঙত আমাদের। সারাদিন পায়রার বাকবাকুম শোনাটাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটা সময় কবুতরের নোংরা পরিষ্কার করাটা একটা বড় ঝামেলা হয়ে দাঁড়ায়।

সংসারের সব কাজ করে আবার এই কাজ করা আম্মার উপর একটা বড় চাপ হয়ে যায়। অবশেষে একদিন কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন আম্মা। কবুতরগুলোকে রান্না করা হল। সবাই মজা করে খেলেও আমি খেতে পারিনি। এখনও পারি না কবুতরের মাংস খেতে।

অবশ্য মুরগির বেলায় এরকম কিছু হয়নি। বরং চিকেনের যে কোন রান্না আমার পছন্দের তালিকায় থাকে সব সময়। যা হোক মুরগির কথায় আবার আসি। আম্মার নানান শখের মধ্যে একবার একটা শখ জাগে পোল্ট্রি ফার্ম করার। শখটা জেগেছিল আম্মার এক বান্ধবীর বাসায় সবাই মিলে বেড়াতে যাওয়ার পর।

সেই আন্টি তার বাড়ির আঙিনায় মিনি পোল্ট্রি ফার্ম করতেন। তাই দেখে আব্বা আম্মা দুজনেরই শখ হল বাড়িতে এমন কিছু করার। আব্বা কিনে আনলেন ছোট একটা দোতলা খাঁচা, সেই সাথে এক ডজন লাল মুরগি। লেয়ার মুরগি ছিল এগুলো, তবে ডিম দেয়া শুরু করেনি তখনও। খাঁচাগুলো বিশেষভাবে তৈরি, সামনে খাবার আর পানির ট্রে দেয়া আলাদা করে।

আর মেঝেটা একটু ঢালু করে রাখা যাতে ডিম পাড়লে ডিমগুলো গড়িয়ে একেবারে সামনের ট্রে তে চলে আসে। বস্তা বস্তা পোল্ট্রি খাবারও নিয়ে এলেন আব্বা। শিখে এলেন লেয়ার মুরগির খাবার কিভাবে তৈরি করতে হয়। সপ্তাহে একবার খাবারের মিশ্রণ তৈরি করে রাখতেন। দিনে দুই-তিনবার সেখান থেকে নিয়ে মুরগিদের খাবারের ট্রেতে ছড়িয়ে দেয়া হত।

আর পানির ট্রেতে দিনে একবার পানি দিলেই হত। খাঁচাটা রাখা হয়েছিল নিচতলার একটা খালি রুমে। রুমটা সব সময় তালা দেয়া থাকত। এমনিতে মুরগিগুলো চুপচাপই থাকত। কিন্তু যখনই খাবার দেয়ার জন্য রুম খোলা হত, ঐ তালা খোলার শব্দেই মুরগিগুলোর মাথা খারাপ হয়ে যেত।

লাফ-ঝাঁপ করতে করতে মনে হত একেবারে খাঁচাটাই ভেঙে ফেলবে। খাবার দেয়ার সময় পারলে হাত থেকে ঠোকর মেরে খেয়ে ফেলবে এমন একটা অবস্থা। আর পানির ট্রেতে বদনা দিয়ে পানি ঢালার সময় তো সরাসরি বদনা থেকে পানি খেয়ে নিত। এমন না যে ট্রে একেবারে শুকনো থাকত। সব সময়ই কিছু পানি থাকতই ট্রেতে কিন্তু ফ্রেশ পানিটা খাওয়ার সুযোগ ছাড়ত না তারা।

যেদিন প্রথম একটা মুরগি ডিম পাড়ল, আমাদের খুশি আর দেখে কে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সবগুলো মুরগি ডিম পাড়া শুরু করল। আমাদের আর বাজার থেকে ডিম কেনা দরকার হত না। প্রতিদিনই দশ-বারোটা করে ডিম পাওয়া যেত। একবার আম্মার শখ হল ডিমে বাচ্চা ফুটানোর।

একটা সুন্দর দেখে মোরগ কিনে আনলেন। মোরগটা সত্যি খুব সুন্দর ছিল। বেশ লম্বা, চকচকে সাদা-কালো পালক, উঁচু লেজ, আর মাথার লাল টকটকে ঝুঁটিটা এতই বড় যে একপাশে ঝুলে এক চোখ ঢেকে রাখত। একেবারেই সিনেমার হিরো লাগত মোরগটাকে। মোরগটার সাথে একই খাঁচায় জায়গা হল সবচেয়ে তাগড়া দুই মুরগির।

এরপর আম্মা এই মুরগি দুটোর ডিম আলাদা করে রাখতেন। কিন্তু ডিম ফোটানো কম ঝক্কির কাজ নয়। পরে মেজ মামাকে আম্মা এই দায়িত্ব দিলেন। কিন্তু কপাল খারাপ, ডিমগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। একটাও ফোটানো যায়নি।

যা হোক, ডিম ফুটুক আর নাই ফুটুক, আমাদের মোরগটা ছিল পাড়ার সবচেয়ে মাস্তান মোরগ। যদিও সে চব্বিশ ঘন্টাই খাঁচায় বন্দি থাকত, তার গলার আওয়াজ পাড়ার প্রতিটা কোণায় পৌঁছে যেত। তার সেই বিকট কুক্কুরুঊঊঊঊকুঊঊঊঊঊঊউ শুনে পাড়ার অন্য সব মোরগ ভয়ে কাঁপত। সকালবেলা আমাদের ঘুম ভাঙানোর কাজটা তো করতই, সারাদিনেও যখন মন চায় তখনই কুক্কুরু কু করতে থাকত মোরগটা। একবার আমি বারান্দায় কাপড় নাড়তে গিয়েছি।

হঠাৎ চোখে পড়ল রাস্তায় একটা মোরগ পা টিপে টিপে আমাদের বাসার দিকে এগিয়ে আসছে। এইভাবে কোন মোরগকে কখনও হাঁটতে দেখিনি, ঘটনা কি বোঝার জন্য আমি তাকিয়ে আছি, তক্ষুণি আমাদের মোরগটা ডাক দিল, কুক্কুরুঊঊঊঊঊঊঊঊঊ কুঊঊঊঊঊঊঊঊউ। সেই ডাক শুনে রাস্তার সেই মোরগটা প্রথমে পাখা দুটো ছড়িয়ে একটা লাফ দিল, তারপর উল্টো দিকে পড়ি মরি করে দৌড়। কার্টুনের মত এই দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে আমার পেটে খিল ধরে গেল। মুরগিগুলো সারাদিন খাঁচায় বন্দী থাকত, এই ব্যাপারটা একটু কষ্টই লাগত।

তবে আম্মা ওদের যত্নে কোন কমতি রাখেন নি। নিয়মিত টিকা দিতেন আম্মা নিজে। একবার ওদের কি একটা সমস্যা হল, ওদের ডিমগুলোর খোসা পাতলা হতে থাকল। এমনকি মাঝে মাঝে খোসা ছাড়া ডিমও পাড়তে থাকল। তখন পোল্ট্রি ফার্মারদের পরামর্শ নিয়ে আম্মা ওদের ডিমের খোসা খাওয়ানো শুরু করলেন।

আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে এল এই সমস্যা। মাঝে মাঝে ডিমগুলো পাড়ার পর ঠিকমত গড়িয়ে আসত না, এটা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। এমন হলে মুরগিগুলো নিজেরাই ডিম খুঁচিয়ে খেয়ে ফেলত বা নষ্ট করে ফেলত। মুরগির নোংরাগুলো যে ট্রেতে জমা হত সেটা প্রতিদিন পরিষ্কার করার দায়িত্ব ছিল এক বুড়ি মহিলার। এই বুড়ি আসলে ভিক্ষা করে কাটাত।

আম্মা বুড়িকে অফার দেন যে সে যদি কিছু কাজ করে দেয় তাহলে আম্মা তাকে এককালীন কিছু টাকা দিবেন। বুড়ি খুশিমনেই তাতে সম্মত হয়। বুড়ি হলেও খুব ভালো কাজ করত সে। মুরগির ট্রে পরিষ্কার করে সে আমাদেরকে এসে বলত, ডিম তো খাইয়া ফেলে। আমরা বলি, কে খায়? সে কি যেন একটা শব্দ বলত।

আমরা বুঝতাম না। পরে সে বলত, ঐ তো যার ডিম হেই খায়। বুড়ির বাড়ি কোথায় জানি না, কিন্তু সে মুরগিকে কিছু একটা বলত যেটা আমরা কখনই উদ্ধার করতে পারিনি। মাঝে মাঝে স্বাভাবিকের চেয়ে বড় ডিম পাড়ত কিছু মুরগি। এগুলোর ভিতর দুইটা কুসুম থাকত।

আর আমার মত বিশিষ্ট রাঁধুনীদের জন্য ডিম দিয়ে রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করাও তখন ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। সিদ্দিকা কবীরের 'রান্না খাদ্য পুষ্টি' বই থেকে ডিমের আইটেমগুলো একটা একটা করে ট্রাই করে যেতাম। এর মধ্যে নরম সিদ্ধ ডিম আর স্ক্র্যাম্বলড এগ - এই দুই আইটেমে সফল হয়েছিলাম। বাকীগুলোর কথা ঠিক মনে নেই। এই ফার্মের সব ডিম আমরাই খেতাম।

বাড়তি যত ডিম রয়ে যেত আম্মা প্রতিবেশিদের বাসায় বিলিয়ে দিতেন। তবে একবার, সেবার আব্বা-আম্মা দুজনে হজ্জ্বে গিয়েছিলেন, বেশ কিছু ডিম জমে গেল বাসায়। যেহেতু দুইজন মানুষ বাসায় নেই, ডিম খাওয়া এমনিতেই কমে গিয়েছিল। বাসার সামনের মুদির দোকানীর সাথে কথা বলে দুই ডজন ডিম বিক্রি করা হল। ঐ একবারই বিক্রি করা হয়েছিল আমাদের মিনি পোল্ট্রি ফার্মের ডিম।

মুরগির এই গল্প শেষ করতে হবে সেই করুণ পরিণতি দিয়েই। একটা সময় মুরগিগুলোর বয়স হয়ে গেল, ডিম দেয়া একেবারে বন্ধ না করলেও কমিয়ে দিল। বেশি বুড়ি হয়ে যাওয়ার আগেই আম্মা তাদেরকে ডাইনিং টেবিলে আনার ব্যবস্থা করলেন। দুই দফা এমন করে মুরগি পালনের পর আম্মা সবকিছু ছেড়ে দিলেন। খাঁচাটা খালি পড়ে রইল গ্যারেজের এক কোণায়।

তারপর এক সময় বিক্রিই করে দিলেন। সবকিছুই এক সময় শেষ হয়ে যায়। আমার পাখির গল্পও শেষ হল। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।