আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার: হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ (পর্ব ৪)

সদ্য প্রয়াত কথাকার হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক এই সাক্ষাৎকার গুলো গ্রহন করেছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। সেই সাক্ষাৎকার গুলো নিয়ে এই পোস্ট। ধারাবাহিক ভাবে দেয়া হবে। প্রথম তিন পর্বের লিঙ্ক চতুর্থ পর্ব হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ ইমদাদুল হক মিলন হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্র হয়ে ওঠার গল্পটা বলি। গল্প না, ঘটনা।

গল্পে কল্পনা থাকে, ঘটনায় থাকে সত্যতা। ছেলেবেলায় পড়াশোনায় খুবই খারাপ ছিলেন তিনি। আসলে পড়াশোনায় তাঁর মন বসত না। একেবারেই মনোযোগী ছিলেন না লেখাপড়ায়। স্কুলের পরীক্ষাগুলোয় টেনেটুনে, কায়ক্লেশে পাসটা করতেন।

বাবার বদলির চাকরি। একেকবার একেক জেলায়। চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ছেন। সে বছর পাসই করতে পারলেন না। ডাহা ফেল।

ফেল করা মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরবেন কী করে! ক্লাস টিচার বড়ুয়া স্যার। তাঁর কাছে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলেন। ছাত্রের কান্না দেখে বড়ুয়া স্যারের হৃদয় দ্রবীভূত হলো। তিনি বিশেষ বিবেচনায় ক্লাস সেভেনে তুলে দিলেন। ওপরের ক্লাসে উঠে যেই কে সেই! অবস্থা আগের মতোই।

পড়ায় মন বসে না। মন বসল ক্লাস এইটে ওঠার পর। স্কুল থেকে তখন খুবই সুস্বাদু, ভালো টিফিন দেওয়া হতো। সেই টিফিনের জন্য ব্যাপক লোভ ছিল বালক হুমায়ূন আহমেদের। এখানে ব্র্যাকেটে আরেকটা কথা বলে রাখি।

হুমায়ূন আহমেদের ডাকনাম 'বাচ্চু'। কবি শামসুর রাহমানেরও ডাকনাম ছিল 'বাচ্চু'। পরে দুজনের কেউ এই নাম কখনো ব্যবহার করেননি। কাউকে বলতেনও না। যা হোক, ক্লাস এইটে বৃত্তি পরীক্ষা হবে।

ক্লাসের ভালো ছাত্রদের সিলেক্ট করা হয়েছে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য। যারা সিলেক্ট হয়েছে, স্কুলে তাদের মহাসমাদর। স্যাররা খাতির করছেন, ছাত্ররা খাতির করছে। তাদের যত্ন-আত্তির অভাব নেই। যেহেতু বৃত্তি পরীক্ষা দিতে হবে, সেহেতু ফাইনাল পরীক্ষাও তাদের দিতে হবে না।

আর যেটা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ঘটনা সেটা হলো, ভালো ছাত্রদের টিফিন দেওয়া হবে ডাবল। সাধারণ ছাত্ররা যে টিফিন পাবে, ওরা পাবে তার দ্বিগুণ। এই টিফিনের লোভটা ঢুকল হুমায়ূন আহমেদের মাথায়। যেমন করে হোক বৃত্তি পরীক্ষা তাঁকে দিতেই হবে। বৃত্তি পরীক্ষায় সিলেক্ট হলেই ডাবল টিফিন।

তিনি ক্লাস টিচারের কাছে গিয়ে, হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, 'ঘ্যানরঘ্যানর শুরু করলাম। রোজই স্যারকে ধরি আর করুণ মুখ করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলি, স্যার, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব। ' প্রথম দিন ক্লাসের খারাপ ছাত্রগুলোর একটি বৃত্তি পরীক্ষা দিতে চাইছে শুনে স্যার আকাশ থেকে পড়লেন। 'বলিস কী, তুই দিবি বৃত্তি পরীক্ষা!' _জি স্যার। _আরে তুই তো ক্লাস সিক্সে ফেল করেছিলি।

সেভেন থেকে এইটে উঠেছিস তাও দুটো না তিনটে সাবজেক্টে ফেল। _তাও আমি স্যার বৃত্তি পরীক্ষা দেব। _যা যা ভাগ। স্যার ধমক দিয়ে বিদায় করলেন। পরদিন আবার সেই ঘ্যানঘ্যানানি, 'স্যার, আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব।

' আজ স্যার বিরক্ত হলেন আরো বেশি। পারলে মেরে ক্লাস থেকে বের করে দেন। হুমায়ূন আহমেদের করুণ কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে মারলেন না। আগের দিনের মতোই ধমক দিয়ে থামালেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ থামার জিনিস না।

চান্স পেলেই স্যারকে ধরছেন, 'আমি বৃত্তি পরীক্ষা দেব, স্যার। আপনি ব্যবস্থা করে দিন। ' একই ঘ্যানঘ্যানানি রোজ শুনতে শুনতে স্যার একদিন মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, 'আয় আমার সঙ্গে। ' নিয়ে গেলেন হেডস্যারের রুমে, 'স্যার, এই ছেলেটা বৃত্তি পরীক্ষা দিতে চায়। ' হেডস্যার অবাক, 'বলেন কী!' _জি স্যার।

_আরে ও তো সব সাবজেক্টে পাসই করতে পারে না, ও কী বৃত্তি পরীক্ষা দেবে? স্কুলের মান-ইজ্জত থাকবে না। সারা জীবনই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে বিচিত্র সব মানুষের দেখা হয়েছে। ওই স্যারটিও কিঞ্চিৎ বিচিত্র চরিত্রেরই ছিলেন। হেডস্যারকে বললেন, 'তার পরও আপনি স্যার ওকে কনসিডার করেন। দেখা যাক কী হয়।

' সেই শিক্ষকের নাম আমার মনে পড়ছে না। হুমায়ূন ভাই বলেছিলেন, 'ভুলে গেছি। স্মৃতি আজকাল কিছুটা প্রতারণাও করছে। ' তো, ক্লাস টিচারের কথা শুনে হেডস্যার হতভম্ব, 'এসব আপনি কী বলছেন? এটা কী করে সম্ভব? স্কুলের মান-ইজ্জত সব যাবে। ' শেষ পর্যন্ত ওই স্যারের কারণেই হেডস্যার কনসিডার করলেন।

ক্লাস এইটের একটি খারাপ ছাত্রও বৃত্তি পরীক্ষা দেবে_এমন ঘটনা চিটাগাং কলেজিয়েট স্কুলে কখনো ঘটেনি। হুমায়ূন আহমেদ দারুণ খুশি। আরে, কিসের বৃত্তি পরীক্ষা, টিফিন ডাবল পাওয়া যাবে_এটাই হচ্ছে আসল ঘটনা। পরদিন থেকে ভালো ছাত্রদের মতো ডাবল টিফিন পেতে লাগলেন। কিন্তু কপাল খারাপ, চার-পাঁচ দিনের মাথায় জলবসন্ত হয়ে গেল।

জলবসন্ত নিয়ে স্কুলে যাওয়া যায় না, বাড়িতে শুয়ে থাকতে হয়। রাতের বেলা তো বটেই, দিনের বেলাও মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। মাথার কাছে নিমের একটা ডাল রাখা হয়েছে। ডাল ভর্তি পাতা। নিমপাতা জলবসন্তের মহৌষধ।

শরীর অবিরাম চুলকায়। তখন নিমপাতা শরীরে বুলিয়ে দিলে আরাম হয়। কিন্তু মশারির তলার জীবন লেখকের ভালো লাগে না। ভাইবোনরা কেউ তাঁর সামনে আসেই না। জলবসন্ত ছোঁয়াচে রোগ।

কাছে এলেই বা ছুঁলেই হবে। বাবা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, মা সংসার নিয়ে। বালক হুমায়ূন আহমেদ মশারির তলায় একা একা ছটফট করেন। সময় আর কাটে না। ওদিকে বৃত্তি পরীক্ষার মাস দেড়-দুয়েক বাকি।

একদিন মনে হলো, আচ্ছা, ক্লাসের বইগুলো একটু পড়ে দেখি তো! কিছু হোক আর না হোক, সময়টা তো কাটবে। জলবসন্ত ভরা শরীরে মশারির তলায় সময় কাটানোর জন্য ক্লাসের বইগুলো পড়তে শুরু করলেন, অঙ্কগুলো একা একাই করতে লাগলেন। লেখাপড়ার আশ্চর্য এক নেশা ধরে গেল। ধীরে ধীরে জলবসন্ত সারল। বৃত্তি পরীক্ষার দিন এসে গেল।

পরীক্ষা দিলেন। ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেলেন। স্কুলের ভালো ছাত্র যারা তাঁর সঙ্গে পরীক্ষা দিয়েছিল, তারা কেউ তাঁর ধারেকাছেও নেই। সবাইকে পেছনে ফেলে হুমায়ূন আহমেদ নাম্বার ওয়ান! শুরু হলো হুমায়ূন আহমেদের ভালো ছাত্রের জীবন। এসএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন, এইচএসসিতে স্ট্যান্ড করলেন।

ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলেন, তুখোড় রেজাল্ট। ডক্টরেট করতে গেলেন আমেরিকার নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটিতে। অলথ্রু এ ক্যাটাগরির স্টুডেন্ট। শিক্ষকতার জীবন শুরু করলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার।

অধ্যাপক হয়ে ডক্টর হুমায়ূন আহমেদ শিক্ষকতা ছেড়ে দিলেন। তত দিনে সাহিত্যজগতে তিনি কিংবদন্তি হয়ে গেছেন। কিন্তু ক্লাসের খারাপ ছাত্রটি বৃত্তি পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো করেছে, স্কুলে হৈচৈ পড়ে গেছে। সেই টিচার পারলে হুমায়ূন আহমেদকে কোলে নিয়ে হেডস্যারের রুমে চলে যান। ছাত্রের ভালো রেজাল্টের গৌরবে স্কুলে তাঁর পজিশনও হাই হয়ে গেছে।

ক্লাস নাইনে ঘটল আরেক ঘটনা। জেনারেল ম্যাথের টিচার হুমায়ূন আহমেদের খাতা দেখতে দেখতে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গেছেন, ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০ নম্বর দিয়ে দিয়েছেন। আজব ব্যাপার! হেডস্যার অঙ্কের টিচারকে ডেকে পাঠালেন। এটা আপনি কী করেছেন? ১০০ নম্বরের জায়গায় ১১০? অঙ্কের টিচার খেপে গেলেন। ছেলেটা অঙ্কে এত ভালো, আমার ইচ্ছা আমি তাকে ১০০-র মধ্যে ১১০ দিয়েছি।

আপনার কোনো অসুবিধা আছে? হেডস্যার হতভম্ব। এ দেখি অদ্ভুত চরিত্র! নিশ্চয় জীবনের এসব অভিজ্ঞতা থেকেই হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস-গল্প-নাটকে অদ্ভুত সব চরিত্রের সমাবেশ ঘটান। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং দেখার ভঙ্গি অন্য কারো সঙ্গে মেলে না। এসব ঘটনা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আড্ডায় হুমায়ূন ভাই মজা করে বলেছেন। আমি আমার স্মৃতি থেকে লিখছি।

হুমায়ূন ভাইয়ের ভয় পাওয়া নিয়ে এবার নিজের একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। ১৯৮৫-৮৬ সালের কথা। বিটিভিতে চলছে হুমায়ূন আহমেদের দেশ-কাঁপানো ধারাবাহিক 'এইসব দিনরাত্রি'। প্রযোজক মুস্তাফিজুর রহমান। সেই নাটক নিয়ে চারদিকে চলছে তুমুল আলোচনা।

নাটকের ছোট্ট মেয়ে টুনি, তার ব্লাড ক্যান্সার। দর্শক আতঙ্কে আছে টুনির মৃত্যু নিয়ে। ওই প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনের কোনো ধারাবাহিক নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় পোস্ট এডিটরিয়াল পর্যন্ত লেখা হলো। টুনিকে যেন মেরে ফেলা না হয়। কোনো কোনো সাপ্তাহিক পত্রিকা কাভার স্টোরি করেছে।

নাটক যখন তুঙ্গে, তখন এক সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই গেছেন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে। তিনি তখন নিউ মার্কেটের দক্ষিণ দিককার সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। প্রায়ই আমাকে নিয়ে হুমায়ূন ভাই তাঁর ফ্ল্যাটে যান। খাওয়াদাওয়া, গল্প-আড্ডা আর নাটক নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা। আড্ডা শেষ করে হুমায়ূন ভাই ফিরে যান তাঁর আজিমপুরের বাসায়, আমি চলে যাই গেণ্ডারিয়ায়।

ও রকম এক সন্ধ্যার ঘটনা। সিঁড়ি ভেঙে আমরা দুজন মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছি। সরকারি পুরনো আমলের ফ্ল্যাট। দরজাগুলো পুরনো। দরজার মাথার ওপর পুরনো আমলের কলিংবেলের সুইচ।

সিঁড়িতে টিমটিম করে জ্বলছে অল্প পাওয়ারের একটা বাল্ব। হুমায়ূন ভাই আনমনা ভঙ্গিতে কলিংবেলের সুইচে হাত দিতে গিয়েই 'উরে বাবা রে' বলে একলাফে সরে এলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। প্রথমে মনে হলো পুরনো কলিংবেল, তারফারে লিকটিক হয়ে আছে কি না! হুমায়ূন ভাই কি ইলেকট্রিক শক খেলেন! আমি খুবই নার্ভাস ভঙ্গিতে তাঁর হাত ধরলাম।

কী হলো, হুমায়ূন ভাই? তিনি কোনো রকমে বললেন, 'মাকড়সা। ' _মাকড়সা? _হ্যাঁ। তিনি রীতিমতো কাঁপছেন। তাকিয়ে দেখি, কলিংবেলের সুইচের ওখানে মাঝারি সাইজের একটা মাকড়সা। মাকড়সাকে এ রকম ভয়? সত্যি তা-ই।

হুমায়ূন ভাই সবচেয়ে ভয় পান মাকড়সা। তাঁর ভাইবোনরাও কেউ কেউ মাকড়সাকে খুবই ভয় পান। সেদিন মাকড়সার ভয়ে মুস্তাফিজ ভাইয়ের ফ্ল্যাটে তিনি আর স্বাভাবিকই হতে পারলেন না। দ্রুত আড্ডা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম। আমরা তখন প্রায়ই বাংলাবাজারে পাবলিশারদের ওখানে গিয়ে চা-বিস্কুট খাই আর আড্ডা দিই।

রয়ালটির টাকা-পয়সার জন্যও যাই কোনো কোনো দিন। আমার অবস্থা তখন খুবই খারাপ। হুমায়ূন ভাই ইউনিভার্সিটির টিচার। তাঁর একটা বাঁধা রোজগার আছে। আমার নেই কিছুই।

হুমায়ূন ভাইয়ের কাছ থেকে পঞ্চাশ-এক শ টাকা ধারও নিই। সেই ধার কোনোদিন শোধ করি না। একদিন দুপুরের দিকে বাংলাবাজার থেকে রিকশায় করে যাচ্ছি তাঁর শহীদুল্লাহ হলের কোয়ার্টারে। বাহাদুর শাহ্ পার্কের ওখানে দেখি এক পাখিওয়ালা খাঁচায় করে মুনিয়া পাখি বিক্রি করছে। আমরা রয়ালটির কিছু টাকা পেয়েছি।

খাঁচাসহ হুমায়ূন ভাই তিন জোড়া মুনিয়া পাখি কিনে ফেললেন। ঢাকায় তখন ট্রাফিক জ্যাম বলতে কিচ্ছু নেই। আমরা রিকশায় করে ইউনিভার্সিটি এলাকার দিকে যাচ্ছি। যেতে যেতে দুজনে মিলে একটা বিজনেসের প্ল্যান করে ফেললাম। আমাদের সেই ব্যবসার প্ল্যান ইত্যাদির কথা পরে বলব।

এবার আসুন আমাদের দুজনার কথোপকথন বা আমার নেওয়া হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকারের পরের অংশে নিয়ে যাই আপনাদের। হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার ইমদাদুল হক মিলন : মানে, আপনার হাতে লেখা কপিটাই পড়েছেন? হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ। ইমদাদুল হক মিলন : পড়ে কী বললেন? হুমায়ূন আহমেদ : আমাকে কিছু বললেন না। বাবার সঙ্গে আমাদের ভাইবোনদের দূরত্ব ছিল। বাবা সরাসরি আমাদের কিছু বলতেন না।

ভায়া মিডিয়া কথা বলতেন। তাঁর যা বলার তিনি মাকে বলতেন, মা আমাদের বলতেন। ইমদাদুল হক মিলন : তিনি আপনার মাকে কী বললেন? হুমায়ূন আহমেদ : পৃথিবীর সব বাবাই সন্তানদের সামান্য প্রতিভায়ই মুগ্ধ হন। তিনিও হয়েছিলেন। তাঁর মুগ্ধতা যে উঁচু পর্যায়ে ছিল, তার প্রমাণ পেলাম কিছুদিন পর।

তিনি তখন একটা রেডিও নাটক লিখে শেষ করেছেন। নাম 'কত তারা আকাশে'। হঠাৎ সেই নাটকের পাণ্ডুলিপি আমার হাতে দিয়ে বললেন, তুই তোর মতো করে ঠিকঠাক করে দে। আমি আমার একজীবনে অনেক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি_ওই দিনের সাহিত্য পুরস্কার সব পুরস্কারের ওপরে। মিলন, আজ আর না।

অনেক বকবক করেছি। ইমদাদুল হক মিলন : ঠিক আছে, আজ এ পর্যন্তই। সেদিনের মতো আমরা থেমে গেলাম। তারপর একে একে বন্ধুরা এলেন, আলমগির রহমান, আর্কিটেক্ট করিম, অন্যদিন গ্রুপের প্রধান মাজহারুল ইসলাম, মাসুম রহমান, কমল_শুরু হয়ে গেল আমাদের আড্ডা। প্রিয় পাঠক, ঘটনা ২০০৬ সালের, অন্যদিন পত্রিকার জন্য হুমায়ূন ভাইয়ের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম আমি।

এই সেই সাক্ষাৎকার, যা কয়েক পর্বে ছাপা হয়েছিল অন্যদিনে। এবার আমার নিজের স্মৃতিচারণাসহ সেই সাক্ষাৎকার নতুন আঙ্গিকে শিলালিপিতে ছাপা হচ্ছে। কয়েক দিন পর আরেক সন্ধ্যায় আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে বসলাম। ইমদাদুল হক মিলন : আমরা কথা বলছিলাম আপনার আমেরিকা যাওয়া প্রসঙ্গে। আপনার চারটি বই বের হলো, আপনি আমেরিকায় চলে গেলেন।

আমেরিকায় তো আপনি ছয় বছর ছিলেন একটানা। নোভা, শীলা_দুজনেরই কি জন্ম হয়েছে ওখানে? হুমায়ূন আহমেদ : নোভা দেশেই হয়েছে। শিলার জন্ম হয়েছে ওখানে। ইমদাদুল হক মিলন : ছয় বছর আপনি কিছু লেখেননি? হুমায়ূন আহমেদ : না। ওখানে পড়াশোনার চাপ এত বেশি ছিল, লেখালেখির বিষয়টা মাথায়ই ছিল না।

তা ছাড়া তখন বিদেশে আমাদের প্রথম সংসার, জানি না কিছু, নোভার মাও তো খুবই বাচ্চা মেয়ে, সেও তো কিছু জানে না। সংসার চালানো এবং পড়াশোনার বাইরে কিছু করার সুযোগ ছিল না। অবসর কাটত টিভি দেখে। ইমদাদুল হক মিলন : আর এমনিতে সাহিত্যের পড়াশোনা? হুমায়ূন আহমেদ : সাহিত্যের পড়াশোনা মানে কি গল্প-উপন্যাস? গল্প-উপন্যাস একটা বয়স পর্যন্ত পাগলের মতো পড়েছি। তারপর সেই পাঠকের মৃত্যু হয়েছে।

অন্য সব বিষয় পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিষয় কী তোমাকে বলব না। তুমি আমাকে বুদ্ধিজীবী ভেবে বসতে পারো। আমার পছন্দের বইপত্র পড়ার সুযোগ আমেরিকায় ছিল। ইউনিভার্সিটির বিশাল লাইব্রেরি।

লাইব্রেরি ভর্তি বই। তবে আমার সময় ছিল না। গাদা গাদা বই লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসতাম, এক সপ্তাহ পর না পড়েই ফেরত দিতাম। পড়াশোনাটা করতাম, মাঝেমধ্যে, যখন সামারে ছুটি হতো। এত পয়সা-কড়ি তো ছিল না যে পুরো সামার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ঘুরব।

পছন্দের পড়াশোনা বা গল্পের বই যা পড়ার ওই সময়ই পড়তাম। ওই সময় পাঠ্যবই খুলে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ইমদাদুল হক মিলন : আচ্ছা, আপনি যে আমেরিকায় পড়লেন 'পলিমার কেমিস্ট্রি', ওই বিষয়ে কি আপনি লেখালেখি করেননি? বা থিসিসটা কি বের হয়নি বই হয়ে? হুমায়ূন আহমেদ : বিজ্ঞানের ওপর বিদেশে যে কাজগুলো হয় ওগুলোর থিসিস পাবলিশড হয় না, থিসিস থেকে পেপার পাবলিশড হয় বিদেশি জার্নালগুলোতে। আমার ২৫টির মতো পেপার ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। থিসিসের কাজ এবং পরে পোস্ট ডক করার সময়ের কাজ নিয়ে।

ইমদাদুল হক মিলন : আমেরিকা থেকে আপনি ফিরে এলেন '৮৪-র দিকে বোধ হয়? তার আগে, মাত্র চারটি বই লিখে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন। এটা একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা আমার কাছে। আপনি ফিরে এসে আবার লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা ভাবলেন কী করে? তখন তো আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন, আপনার সংসারটা বড় হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ : হয়তো লেখালেখির বিষয়টা ভেতরে ছিল সব সময়। যদি ভেতরে থাকে তাহলে লেখালেখি বিষয়টা মাথার গভীরে এক ধরনের চাপ দিতেই থাকে।

এই চাপটা একটা কারণ হতে পারে। দেশে ফিরে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি। আবার আমি যে একজন লেখকও, ওটাও তো মাথায় ছিল। ইমদাদুল হক মিলন : লেখালেখির ক্ষেত্রে বড় গ্যাপ পড়লে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়। আপনার সে অস্বস্তিটা কি তৈরি হয়েছিল যে এত দিন পর আমি আবার শুরু করলাম! হুমায়ূন আহমেদ : এটা আসলে মনে করতে পারছি না।

মনে হয় না ছিল। কারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাঁরা লেখালেখি করেন, তাঁরা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামান না। অনেক দিন লিখিনি তাতে কী হয়েছে? আবার লিখব। ইচ্ছা না করলে আবার বন্ধ করে দেব। ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ততা কি আপনার প্রথম থেকে ছিল, নাকি আস্তে আস্তে...? হুমায়ূন আহমেদ : না।

আমার মনে হয় এটা শুরু থেকেই ছিল। মাঝেমধ্যে এটা একটু কেটে গেছে, এটা বলতে পারো। কিছু কিছু লেখার ক্ষেত্রে খুবই চিন্তাভাবনা করে লাইনগুলো লিখতে হয়েছে। একটা লাইন লিখে দ্বিতীয় লাইনটির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। দ্বিতীয় লাইন আসি আসি করছে, আসছে না_এই অবস্থা।

ইমদাদুল হক মিলন : নাটকের দিকটায় আপনি যে গেলেন, সেই প্রসঙ্গটায় আমি একটু পরে আসছি। এই যে দেশের বাইরে থেকে ফিরেই একটার পর একটা বই আপনি লিখতে থাকলেন, নাটক তো আরো পরে '৮৫-র দিকে। '৮৫-তে আপনি 'এইসব দিনরাত্রি' শুরু করেছিলেন। আমার মনে আছে। কিন্তু এই যে একটার পর একটা লেখা, পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করা, এই যে এই অবস্থাটা তৈরি হলো, আপনার কী মনে হয়, এর পেছনে রহস্যটা কী? হুমায়ূন আহমেদ : এই অবস্থা যে তৈরি হয়েছিল, এই বিষয়টার একটা নরমাল আর একটা আদিভৌতিক ব্যাখ্যা আছে।

ইমদাদুল হক মিলন : আপনি বলেন, আমরা দুটোই শুনি। হুমায়ূন আহমেদ : নরমাল ব্যাখ্যা হলো, আমি নাটক লেখা শুরু করলাম। আমাদের দেশে নাটকের দর্শক তো অনেক বেশি। 'এইসব দিনরাত্রি' বহু লোক দেখা শুরু করল এবং এরা মনে করল এই যে লোকটি নাটক লিখছে, তার একটা বই পড়ে দেখি না কেন! তারা বই কিনতে শুরু করল। পাঠকদের আমার বইয়ের প্রতি আগ্রহী হওয়ার পেছনে 'এইসব দিনরাত্রি' নাটকটা কাজ করেছে বলে আমার নিজের ধারণা।

একজন নতুন লেখক লিখবে আর সঙ্গে সঙ্গেই তার বই বিক্রি হবে_এটা তো হওয়ার কথা না। আমার ধারণা, আমার নাটক দেখে লোকজন আগ্রহী হয়েছে, একটা বই পড়ে হয়তো সেকেন্ড বই পড়তে চেয়েছে_এটা হতে পারে। আর আদিভৌতিক ব্যাখ্যা যেটা হলো_শহীদুল্লাহ হলে যখন থাকি, তখন একসঙ্গে প্রকাশকদের কাছ থেকে আমি হঠাৎ কিছু বড় অঙ্কের টাকা পেয়ে গেলাম। ২৫-৩০ হাজার টাকা। সেই সময় ২৫-৩০ হাজার টাকা অনেক টাকা।

বই বিক্রির টাকা। তখনো বই লেখা বাবদ অ্যাডভান্স দেওয়া শুরু হয়নি। যেহেতু টাকা পেয়েছি, আমার হাত খুব উশখুশ করছিল টাকাটা খরচ করার জন্য। কাজেই করলাম কি, স্ত্রী এবং বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম ইন্ডিয়ায়। এই টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দেশভ্রমণ হবে_এই হলো পরিকল্পনা।

প্রথমে গেলাম নেপালে, নেপাল থেকে দিলি্ল। ভাবলাম, এত কাছে যখন এলাম, মরুভূমি দেখে যাই। জয়সলমীরের উদ্দেশে রওনা দিলাম। জয়সলমীরের পথে পড়ল আজমীর শরিফ। এত নাম শুনেছি_পথে যখন পড়লই, তখন ভাবলাম যে আজমীর শরিফ দেখে যাই।

আজমীর শরিফ গেলাম। আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েটি, বিপাশা, সে খুবই বিরক্ত হয়ে গেল; বলল_কোথায় নিয়ে এলে? চারদিকে ফকির। ফকিরে ভর্তি জায়গাটি। বিপাশার বয়স তখন তিন-সাড়ে তিন; আমি তাকে বোঝালাম যে এখানে একজন অতি বড় সাধু মানুষের কবর আছে। এখানে এলে আল্লাহর কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায়।

দেখা গেল যে এই কথা শুনে মানসিকভাবে সে স্বস্তি বোধ করল। তখন তাকে নিয়ে গেলাম কবর জিয়ারত করতে, জিয়ারত শেষ করে চলে আসব, দেখি বিপাশা দাঁড়িয়ে। ব্যাপার কী? বিপাশা বলল, 'আমি যেটা চেয়েছি, সেটা তো পাইনি। না পেলে যাব না। ' আমি বললাম, মা, তুমি কী চেয়েছ? বিপাশা বলল, 'আল্লাহর কাছে আমি এক হাজার বস্তা টাকা চেয়েছি।

এই টাকা না পাওয়া পর্যন্ত এখান থেকে আমি যাব না। ' কবরস্থানের পাশে রেলিংটা ধরে সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আমি ও তার মা তাকে নিয়ে টানাটানি করতে লাগলাম। না, সে এ জায়গা ছেড়ে নড়বে না। এদিকে বাংলাভাষী কিছু লোক ছিল, তারা খুবই মজা পেয়ে গেল।

একটি মেয়ে এক হাজার বস্তা টাকা আল্লাহর কাছে চাইছে, না পাওয়া পর্যন্ত সে যাবে না_এটা তো মজার বিষয়ই। তখন বিপাশাকে বোঝালাম যে এখন টাকাটা পেলে বরং সমস্যা হবে। এত টাকা দেশে নিয়ে যেতে হবে। কান্নাকাটি না করে চলো দেশে যাই। দেশে গেলে টাকাটা পেয়ে যাবে।

অবশ্যই পাবে। আমরা দেশে ফিরে এলাম। আসার পরপরই জলের মতো হু হু করে টাকা আসতে লাগল। কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে, লেখালেখি করে বিপুল অর্থ উপার্জন আপনি কিভাবে করলেন? আমি বলি, আমার ছোট মেয়ে বিপাশার কারণে করেছি_এখানে আমার কোনো হাত নেই। ইমদাদুল হক মিলন : আপনি যে ঘটনা বললেন, এটি সত্যি মনে রাখার মতোই ঘটনা।

আপনি কি অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসী? হুমায়ূন আহমেদ : না। পৃথিবী লজিকে চলে। মিরাকল পৃথিবীর চালিকাশক্তি নয়। ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু আপনি তো প্রায়ই মাজারে যান। সিলেটে গেলেই শাহজালাল সাহেবের মাজার জিয়ারত করেন।

হুমায়ূন আহমেদ : মহাপুরুষদের মাজার জিয়ারত করা মানেই কিন্তু অলৌকিকে বিশ্বাস স্থাপন না। শাহজালাল, শাহ মখদুম, শাহ পরান_এঁরা সবাই উঁচু শ্রেণীর সুফি মানুষ। সব কিছু ছেড়েছুড়ে মানুষের কল্যাণের জন্য এ দেশে এসেছেন। ধর্মীয় কাজকর্মের পরও তাঁরা পুরো জীবন ব্যয় করেছেন সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য। তাঁরা তো মহাপুরুষ পর্যায়ের মানুষ।

আমরা যদি অন্য কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির কবরস্থানে যাই তাঁকে সম্মান দেখানোর জন্য_আমরা এঁদের কাছে যাব না কেন? একটু চিন্তা করে দেখো, কোথায় কোন দেশ থেকে কত জায়গা ঘুরে তাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন। তাঁদের ত্যাগটা দেখো না! তাঁদের কষ্টটা দেখো না। তা ছাড়া মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, ইসলামী ভাবধারায় বড় হয়েছি, ছোটবেলা থেকে মা-বাবাকে দেখেছি_তাঁরা নামাজ পড়ছেন, সকালবেলা ঘুম ভেঙেছে আমার মায়ের কোরআন তিলাওয়াত শুনে। এটা তো ব্রেনের মধ্যে ঢুকে যায়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.