আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নকল পোষাক পড়িয়ে আমাকে...'

ওই যে নদী যায়রে বইয়া... শনিবার। হাটের দিন। স্থানীয় হাটে লোকজনের ভিড়। বিশেষ করে আম-কাঁঠালের বাজারের ভিড় চোখে পড়ার মত। মানুষের ভিড় কাটিয়ে একটু সামনে যেতেই খোলামত একটি যায়গায় দেখা গেল গোল হায়ে অনেক মানুষ দাঁড়ানো।

সেখান থেকে ড্রামসেট, ঢোল, হারমোনিয়ম, করতাল, ইত্যাদির উচ্চ বাদ্য শোনা যাচ্ছে। একটু কৌতুহল জাগলো। এগিয়ে গেলাম সামনে। মানুষের ভিড়ের মধ্যে যাঁরা বিভিন্ন ধরণের বাদ্য বাজাচ্ছিলেন, তাঁরা প্রায় সবাইই আমার চেনা। দেখলাম, দিলীপ কুমার, দিলীপ কুমার মালী একটি সাইড-ড্রাম বাজাচ্ছেন।

দিলীপরা ওইখানে শখের বসে গান-বাজনা করতে আনেনি। তাঁরা এসেছেন একজন ক্যানভাসারের (রাস্তার পাশের ওষুধ বিক্রেতা) সঙ্গে ভাড়ায় (চুক্তিতে)। তাঁদের কাজ গান-বাজনা করে জলসা জমিয়ে দেওয়া। গান শুনতে লোকজন জমে গেলে ক্যানভাসার সাহেব মাইক্রোফোন হাতে নিবেন। এবং ওষুধ বিক্রির কাজ শুরু করবেন।

আমার মন যেন কেমন করে উঠলো। কেননা, দিলীপতো ছিল এক সময়ের ডাকসাইটে নায়ক। একজন নায়ক এভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বা বসে ড্রাম বাজাবেন! তাও আবার জীবীকার তাগিদে? এ কী করে হয়। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। পাশের এক শহরে বেড়াতে গিয়েছিলাম।

ডবিকেল বেলা একটি টি-স্টলে বসে আড্ডা দিচ্ছি। এরই মধ্যে শুনলাম মাইকিং হচ্ছে-- হৈ-হৈ কাণ্ড, রৈ-রৈ ব্যাপার, যাত্রা, যাত্রা, যাত্রা.............. সুদূর ... থেকে আগত..... যাত্রা পালায় আজ মঞ্চস্থ হবে কমলার বনবাস। এতে কমলার ভুমিকায় থাকছেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী মঞ্জু রানী। আর নায়ক হিসেবে রয়েছেন, আপনাদের বহুল পরিচিত দিলীপ কুমার! যে লোকটি মাইকিং করছিলেন, উনি কাছাকাছি আসতে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম--- আচ্ছা, দিলীপ কুমারের বাড়ি কোথায়? উনি বললেন, তা তো জানি না। তবে চ্যাতা (খুবই ভালো) অভিনয় করেন।

ওনাকে অনেক টাকা দিতে হয়। জানতে চাইলাম আপনি কি প্যান্ডেলের দিকে যাবেন? উনি বললেন, হ্যাঁ। বললাম নায়ক দিলীপ কুমারকে বলবেন-- আপনার জন্য টি-স্টলে একজন লোক অপেক্ষা করছেন। অল্প সময়ের মধ্যেই দিলীপ বাবু আসলেন। দাদা কেমন আছেন বলে দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন দিলীপ।

অনেক কথা হলো। রাতে দিলীপ আমার সঙ্গে আমার আত্মীয়ের বাড়িতে খেলেন। এর পর অনেকটা জোর করেই আমাকে নিয়ে গেলেন যাত্রাপালা দেখতে। দেখলাম, দিলীপ সত্যিই খুব ভালো অভিনয় করেন। ওই রাতে তাঁর অভিনয় এবং গানে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই তাঁকে পুরস্কৃত করেছেন।

দিলীপ এক সময় নিয়মিত যাত্রার দলের শিল্পী হিসাবে কাজ করতেন। আমি যে সময়ের কথা বলছি, ওই সময় থেকেই দেশে নিয়মিত যাত্রার দলের সংখ্যা খুবই কমে গেছে। আর এ কারণে শৌখিন শিল্পীদের উদ্যোগে প্রতি মৌসুমে দুএকটি দল সংগঠিত হয়ে বিভিন্ন এলাকায় পালা করে বেড়াতে শুরু করে। দিলীপ ওই রকম একটি মৌসুমী দলের সঙ্গেই ছিলেন। শেষ রাতের দিকে প্রদর্শনী প্রায় শেষ হতে চলছে।

এ সময় দর্শক শ্রোতাদের মধ্য থেকে অনুরোধ এলো-- দিলীপ বাবুর একটি গান গাইতে হবে। দিলীপ তৈরি হচ্ছিলেন গান গাওয়ার জন্য। ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেন-- দাদা, মান্না দের গাওয়া একটি গান গাই? বললাম, হুম, ঠিক আছে। মঞ্চে ইঙ্গিত করতেই অর্কেস্ট্রা বেজে উঠলো।

নায়কোচিত মেজাজে মঞ্চে আসলেন দিলীপ কুমার। গান ধরলেন, 'দুঃখ আমাকে দুঃখী করেনি, করেছে রাজার রাজা------- ও রানী সাহেবা, বিদায় এবার, তোমার সাজঘরে রাজা সাজবো না আর তুমি নকল পোষাক পড়িয়ে আমাকে অনেক দিয়েছো সাজা-----' দারুণ গাইলেন, দিলীপ। তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হলাম। গানের শেষ দিকে দেখলাম দিলীপ কাঁদছেন। তাঁর গাল ভিজে গেছে চোখের পানিতে।

আমার মনে হলো, দিলীপের এ কান্না কোনো অভিনয় নয়। গানের এ কথাগুলো যেন দিলীপেরই জীবন-গাঁথা, অসংখ্য দিলীপদের জীবন-গাঁথা। যে সব দিলীপরা এক সময় অভিনয়কে, যাত্রার দলে কাজ করাকে পেশা হিসাবে নিয়েছিলেন, এখন তাঁদের অনেকেই কর্মহীন। জনপ্রিয় নায়ক দিলীপ কুমার মালী একজন ক্যানভাসারের সঙ্গে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ড্রাম বাজান বেঁচে থাকার প্রয়োজনে। অন্যরা হয়তো এরকম একটু কাজও পাচ্ছেন না।

যাত্রা শিল্পীদের মধ্যে অর্থ কষ্টে ঘর-সংসার ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন এমন ঘটনাও রয়েছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।