আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ায় আমাদের ক্ষতি হয়েছে: সাক্ষাৎকারে পিয়াস করিম

সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে ওঠা দুটি সামাজিক সংগঠন— গণজাগরণ মঞ্চ ও হেফাজতে ইসলাম সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? কোনো সমাজেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সব ক্ষেত্র রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে থাকে না। যে কারণে সিভিল সোসাইটি তৈরি হয়। রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতার অনেক ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ের দায়িত্ব নেয়। এ বিষয়েই তাদের মূল উদ্যোগ থাকে। কিন্তু অনেক সময় সমাজের একটি বড় অংশের দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলো নিতে পারে না।

জীবনের সব অভিজ্ঞতাকে রাজনৈতিক দলগুলো স্পর্শ করতে পারে না। সেসব মুহূর্তে সামাজিক আন্দোলন দানা বাঁধে। বিরোধী দলের আন্দোলন বাদ দিলে আজ বাংলাদেশে গণজাগরণ মঞ্চ ও হেফাজত ইসলাম আন্দোলন করছে। এরা কিন্তু সামাজিক শক্তি। বিষয়টিকে আমি এভাবে দেখতে চাই— সামাজিক আন্দোলনের দুটি মেরুর প্রতিনিধিত্বকারী দুটি সংগঠন বিকাশ লাভ করেছে।

বর্তমান বলে কথা নয়, দুটি শক্তিকেই গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে আমাদের ও রাজনৈতিক দলগুলোকে। গণজাগরণ মঞ্চকে তার মতো করে এবং হেফাজতে ইসলামকে তার মতো করে বিবেচনায় নিতে হবে। আমি যদি বাংলাদেশের রাজনীতি বুঝতে চাই এবং এর কতগুলো রূপান্তর আনতে চাই, তাহলে এসব সামাজিক আন্দোলনকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। নইলে আমাদের পক্ষে এগোনো বা রাষ্ট্র পরিচালনা করা সম্ভব হবে না সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে এদের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপটটা কেমন? একটা ক্ষোভের জায়গা থেকেই মূলত গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি। আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটা অংশের মধ্যে একাত্তরে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের বিষয়ে চেতনা সুপ্ত অবস্থায় ছিল।

তবে যেভাবে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, তার সঙ্গে আমি এক মত কিনা, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। আমি সে আলোচনা বা সমালোচনায় যাচ্ছি না। সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করছি। শাহবাগে একটি চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। একটি পর্যায় পর্যন্ত নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে এ আন্দোলন বড় আকারের আবেদন তৈরি করতে পেরেছে।

এ আন্দোলনে আওয়ামী লীগের কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকবে, অন্যান্য রাজনৈতিক দল কীভাবে এ থেকে সুবিধা নেবে, স্বতন্ত্র সামাজিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ কতটা থাকবে প্রভৃতি মিলে কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চ তার গতিবেগ (মোমেনটাম) অনেকটা হারিয়ে ফেলেছে। যে চেতনা নিয়ে এ আন্দোলন প্রথম কয়েক সপ্তাহ চলেছিল, তা এখন আর বিদ্যমান নেই বলে মনে হচ্ছে। নাগরিকরা এ আন্দোলনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। প্রলম্বিত একটা আন্দোলনের প্রতি মানুষ খুব বেশি দিন আগ্রহ ধরে রাখতে পারে না।

সেখানে যদি ভুলের পরিমাণ বাড়তে থাকে, সেটি আরো আগেই গতি হারিয়ে ফেলে। দুই বা তিন সপ্তাহ এ আন্দোলন চললে যে আগ্রহ থাকত, দুই মাস ধরে চলায় এর ছন্দপতন ঘটেছে অনেকটা। এরই মধ্যে নানা বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছেন গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক-উদ্যোক্তারা। সামাজিক আন্দোলনগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সম্পর্কটা খুবই কৌতুহলোদ্দীপক। বিশেষত সজ্ঞা অনুযায়ী বড় রাজনৈতিক দলগুলো ভবিষ্যতের এক ধরনের নিশ্চয়তা (প্রেডিক্টটেবিলিটি) চায়।

তারা চায় এক ধরনের কাঠামোবদ্ধ ভবিষ্যত্ পরিকল্পনার পরিবেশ। সামাজিক আন্দোলন এক ধরনের আনপ্রেডিক্টটেবিলিটি তৈরি করে। এখানে এক ধরনের আবেগ উদ্দীপনা কাজ করে। রাজনৈতিক দলগুলো সামাজিক আন্দোলনগুলোকে যত দূর পারে ধারণের চেষ্টা করে। আবার সবটা করতেও পারে না।

শাহবাগের ক্ষেত্রে এটি আমরা লক্ষ করেছি। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ প্রধান ভূমিকা নিলেও গণজাগরণ নিজস্ব একটা ভরবেগ (মোমেনটাম) তৈরি করেছে। যেটিকে আওয়ামী লীগ আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এটা হচ্ছে একটা দিক। হেফাজতে ইসলাম আরেকটি কৌতুহলোদ্দীপক বিষয়।

নানা বাধা উপেক্ষা করে অল্প সময়ের মধ্যে রাজধানীতে এত লোকের সমাগম কম বড় বিষয় নয়। তবে তাদের লংমার্চ ও সমাবেশ নিয়ে অনেক দায়িত্বহীন কথা বলা হয়েছে। অনেকে বলছেন, সন্ত্রাসীগুলোকে শহরে আসতে দেয়া হলো কেন? বলেছেন অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মোল্লা। বলা হচ্ছে তারা মার্সিনারি। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, হেফাজতে ইসলামের উত্থানটি আরো বেশি বহুমাত্রিক জটিল একটা বিষয়।

এটাকে এত সরলভাবে দেখা বা ব্যাখ্যা করা যাবে না। কথা নেই, বার্তা নেই রাতারাতি একটি সংগঠন গঠন হয়ে গেল। এত বাধা, হরতাল, অবরোধ, বাস-ট্রাক-রেল বন্ধ করার পরও কয়েক লাখ মানুষ রাজধানীতে চলে এল। একে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এটা আমাদের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা তৈরি করেছে বটে।

আমাদের বিষয়টি বুঝতে হবে। এর তাত্পর্যটা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। হেফাজতে ইসলাম প্রমাণ করেছে, আমাদের সামাজিক মনস্তত্ত্বে, ঐতিহ্য ও চেতনায় ধর্মের একটি ভূমিকা রয়েছে। যেটা আমাদের তথাকথিত সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরা বহু দিন ধরে বুঝতে পারছিলেন না। ধর্মের বোধটা একটা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে ফুঁসে উঠতে পারে, সেটি আমরা চোখের সামনে দেখলাম।

এ প্রসঙ্গে আমি কিছু কথা বলে আসছি বহু দিন থেকে। এজন্য আমাকে প্রচুর ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়েছে; অবাঞ্ছিতও হতে হয়েছে। আমি যে কথাটা বলার চেষ্টা করছিলাম— আমাদের মতো দেশে সামাজিক মনস্তত্ত্বে ধর্মের একটা ভূমিকা আছে এবং এটা সবসময় বড় আকারেই ছিল। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে এ উপাদানটা আরো শক্তিশালী হয়েছে। কারণ মুসলিম বিশ্বে একটি ইসলামিক আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে।

এটাকে ইচ্ছা করলে সরকার বা আমরা বাংলাদেশে ঠেকিয়ে রাখতে পারব না। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের সরকার, সেক্যুলার সিভিল সোসাইটি এবং তথাকথিত প্রগতিশীল বামপন্থীরা পুরো বিষয়টি সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করেছেন। তাদের ক্যালকুলেশন ছিল ত্রুটিপূর্ণ। তারা ধরে নিয়েছিলেন, তাদের বাইরে মানুষ নেই। এটি যে মিথ্যা তা প্রমাণ হয়েছে রাজধানীতে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে বিপুল মানুষের উপস্থিতিতে।

গ্রামের মানুষ এখনো ধর্মভীরু। সেখানে সেক্যুলারের ধারণা পৌঁছেনি। হেফাজতে ইসলামীর আন্দোলনে আপনি কি শুধু ধর্মকে দেখছেন নাকি এর মধ্যে শোষণ-বঞ্চনার উপাদানও রয়েছে? হেফাজতে ইসলাম বা এমন একটি শক্তি যে রয়েছে, সেটি বুঝতে পারেনি ‘ভদ্রলোক মধ্যবিত্ত’ সংস্কৃতি। শাহবাগে সবাই মধ্যবিত্ত কিনা, সেটি আমরা জানি না। সেখানে অংশ নেয়া তরুণদের অনেকে গ্রাম থেকে এসেছে।

অনেকের বাবা কৃষক, অনেকে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। এর ডেমোগ্রাফিক অ্যানালাইসিস হয়নি বলে এটি কাদের আন্দোলন বা এর পেছনে কোন ইস্যু কাজ করেছে, সেটি এ মুহূর্তে বলা যাবে না। তবে ভবিষ্যতে এটি নিয়ে বিশ্লেষণ হবে বলে ধারণা। এরা গ্রাম থেকে আসুক বা না-আসুক, কৃষকের সন্তান হোক বা না-হোক, নাগরিক মধ্যবিত্তের সন্তান হোক বা না-হোক, তাদের জীবনটা মূলত শহুরে নাগরিক জীবনের মধ্যে প্রথিত। ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলে যারা পড়ালেখা বা চাকরি করে, তারা নাগরিক বুর্জোয়া জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

হেফাজতে ইসলামীর অধিকাংশ সদস্য কিন্তু তরুণ, তাদেরও বয়স ১৮-৩০ বছরের মধ্যে। এরা এসেছে একেবারে গ্রাম থেকে, যাদের সঙ্গে শহুরে নাগরিক মধ্যবিত্তের সম্পর্ক নেই। তারা কৃষকের সন্তান, এদের মেয়েরা গার্মেন্টে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। এ আন্দোলনে শ্রেণী সংগ্রামেরও উপাদান রয়েছে। তারা হয়তো শ্রেণী সংগ্রাম বা আন্দোলন হিসেবে এটিকে তৈরি করেনি।

কিন্তু এদের চেতনায় এটি বিদ্যমান। হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে যারা রাজধানীতে এসেছে, আন্দোলন করছে তাদের জীবনে আর কোথায় কী আছে? তারা পাস করে বের হয়ে চাকরি পাবে কিনা, তাতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই। নাগরিক মধ্যবিত্ত তাদের বিষয়ে নাক সিঁটকায়— কারো কারো বক্তব্যে এটি স্পষ্ট। হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে যেসব তরুণ এখানে এসেছে, তাদের একমাত্র পুঁজি ধর্মবিশ্বাস। তাতে আঘাত লাগলে তারা অস্তিত্বের মূল কেন্দ্রবিন্দু হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় ভোগে।

তাদের শেষ সম্পদটার ওপরে আঘাত এলে তারা ফুঁসে ওঠে। এ রাজনৈতিক মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টি আমরা যদি না বুঝতে পারি, তাহলে বড় আকারে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এটিই হয়েছে এবার। সামাজিক আন্দোলনগুলো দানা বাঁধার পেছনে রাজনৈতিক ব্যর্থতা রয়েছে কি? আমরা যুদ্ধাপরাধী ও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চাই, তবে সেটি হতে হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। বিচারটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হতে হবে।

বিচার আমরা চাই, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এখন যদি কেউ মনে করে, কাদের মোল্লার বিচার হয়নি, সেটি আদালতে সমাধান করা সম্ভব। আইন পরিবর্তন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে যদি প্রশ্ন করেন, গণজাগরণ মঞ্চ কেন তৈরি হলো? এটি ঠিক প্রচলিত ডিসকোর্স দিয়ে বোঝা যাবে না। এখানে মনস্তাত্ত্বিক একটা ব্যাখ্যা রয়েছে।

শাহবাগের তরুণদের মধ্যেও এক ধরনের না পাওয়ার বেদনা রয়েছে। তাদের জীবনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। করপোরেট পুঁজির সঙ্গে তারা লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। তারা হয়তো মনে করে, আগের প্রজন্ম তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যে প্রতিশ্রুতিগুলো ছিল, সেটি পূরণ করতে পারেনি আগের প্রজন্ম।

রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি তাদের আস্থা নেই। সর্বশেষ তারা মনে করেছে, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের নিয়ে বোধহয় এক ধরনের খেলা হয়ে গেল তাদের অজান্তেই। বিষয়টির পরিপ্রেক্ষিতে তারা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। আমি একেবারেই শাহবাগের গণজাগরণকে অশ্রদ্ধা করতে চাইছি না। আমি একে বোঝার চেষ্টা করছি।

এ আন্দোলন সম্পর্কে আমার সমালোচনা আছে। এর অর্থ এই নয় যে, আমি শাহবাগ বা তার সব চেতনার বিরোধিতা করছি। একইভাবে হেফাজতে ইসলামেরও সমালোচনা রয়েছে। তাদের ১৩ দফা দাবির সব মেনে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু এটাকে বোঝার চেষ্টা করছি।

আমরা যদি বাংলাদেশের সঠিক ও সুন্দর ভবিষ্যত্ কল্পনা করতে চাই, তাহলে ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে নিয়ে তা ভাবা যাবে না। ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে এক ধরনের মেলবন্ধন দরকার। ধর্ম ও সেক্যুলারিজম নিয়ে যে বিরোধ আমাদের এখানে তৈরি হয়েছে, সেটিকে কীভাবে দেখছেন আপনি? ধর্ম ও সেক্যুলারিজম পরস্পরবিরোধী প্রত্যয় নয়। আমাদের আধুনিক ডিসকোর্সে এক ধরনের বাইনারি অপজিশন তৈরি হয়েছে। একদিকে ধর্ম, অন্যদিকে সেকুল্যারিজম।

আজকে তালেবান বা আল কায়েদা কী বলছে, সেটি বড় কথা নয়। আমরা যদি ইসলামের ইতিহাস দেখি, সেখানে পরমত সহিষ্ণুতার কথা বারবার এসেছে। যখন ইহুদিরা সমস্ত ইউরোপে শোষিত হচ্ছে তখন তুরস্কে-মিসরে তাদের অধিকার দেয়া হয়েছে। ইসলামী শাসকরা সবসময় কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে দেশ শাসন করেছেন তা তো নয়। ইসলামী শাসকদের আমলে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন, প্রয়োগ ও ব্যাখ্যা ধর্মীয় শাস্ত্রের সঙ্গে মিলিয়ে সবসময় করা হয়েছে, তাও নয়।

সেক্যুলার ও বাস্তবিক সময়ের তাগিদে সেগুলো হয়েছে। ফলে ধর্ম ও সেক্যুলারিজমকে পরস্পরবিরোধী প্রত্যয় ভাবার কারণ নেই। এটা শুধু আমার কথা নয়, সমাজতাত্ত্বিক আলোচনায় তালাল আসাদ এ কথা বলেছেন। আশিষ নন্দী এ কথা বলছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে দুটি রুলিং দিয়েছেন।

যেখানে বলা হয়েছে, সেক্যুলারিজমও এক প্রকারের ধর্ম। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় কংগ্রেস আইন পাস করল— যদি তোমার ধর্মীয় বিশ্বাস যুদ্ধে যাওয়ার বিপক্ষে থাকে বা ধর্ম তোমাকে যুদ্ধে যেতে অনুমতি না দেয়, তাহলে যুদ্ধে যেতে হবে না। সে সময়ে বাধ্যতামূলকভাবে যুদ্ধ যাওয়ার আইন করা হয়েছিল। এটাকে বলে ‘কনসিয়াস অবজেকটর’। বিবেকের কারণে একজন যুদ্ধে নাও যেতে পারে।

কোর্ট রুল করল, এটি শুধু ধর্মালম্বীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, মরাল কনভিকশনের কারণেও যে কেউ যুদ্ধে নাও যেতে পারে। তার মানে সেক্যুলার কনভিকশনকে ধর্মের মর্যাদা দেয়া হলো। কোর্ট আরেকটি রুলিংয়ে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের উদ্ভব হয়েছে ইনক্লুডিং সেক্যুলারিজম। এখানে আমি একটি ভিন্ন দেশের উদাহরণ দিচ্ছি একটা প্যারালাল তৈরির জন্য। ঐতিহাসিক ও তাত্ত্বিক দিক দিয়ে সেক্যুলারিজম ও ধর্মকে আলাদা করে দেখা যাবে না।

মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সেক্যুলার চেতনা বিকাশ লাভ করেছে। এ কারণে দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে আসতে আমরা লড়াই করেছিলাম। যেখানে সেক্যুলারিজম একটি আদর্শগত অস্ত্র হয়েছে। কিন্তু আজকের পরিপ্রেক্ষিতটা আলাদা। আজকে সে অবকাশ নেই।

গান্ধীর একটি কথা আমার বারবার মনে হয়। তিনি বলেছিলেন— যিনি বলেন ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, তিনি ধর্মও বোঝেন না রাজনীতিও না। এটাকে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে হয়। কোথাও যদি শাহবাগের চেতনা এবং হেফাজতের চেতনা (এটা বলতে আমি ১৩ দফা কর্মসূচিকে বোঝাচ্ছি না) সাংর্ঘষিক হয়ে যায়, সেটি দূর করার চেষ্টা করতে হবে। আমরা নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি চাই না।

চাই না কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করা হোক। অবশ্যই আমরা প্রগতিশীল নারী নীতি চাই। ভাস্কর্যকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ শিল্প মনে করি। নারী-পুরুষের মেলামেশাকে আমরা গণতান্ত্রিকভাবে শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। তাদের ১৩ দফা কর্মসূচি নিয়ে কথা বলছি না।

আমি বলছি, হেফাজতে ইসলাম প্রমাণ করল— আমাদের সামাজিক ও মনস্তত্ত্বের গভীরে যে চেতনা রয়েছে, যেটি আধুনিকায়নের ফলে অবদমিত হয়ে গিয়েছিল, সেটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। আমাদের এখানে আধুনিকায়ন এসেছে ঔপনিবেশিকতার হাত ধরে। আমাদের এখানে যে চেতনা চাপা পড়ে গিয়েছিল ফ্রয়েডের ভাষায়, রির্টান অব দ্য রিপ্রেসড (repressed) হয়েছে। এটাকে আমার লিবারেটিং দিক মনে হয়। এ ধরনের আকাঙ্ক্ষার অবদমনকে ইতিবাচক মনে হয় না।

যে কণ্ঠ বা গোষ্ঠীগুলোকে আমাদের বুর্জোয়া রাজনীতি দূরে ঠেলে দিয়েছে অর্থাত্ মার্জিনালাইজ করেছে, তাদের ঠাঁই দেয়নি। বলা হয়েছে এরা অশিক্ষিত, দরিদ্র প্রভৃতি। তারা এখন বলছে, আমাদের অবহেলা করা যাবে না। গণতান্ত্রিক সমাজের কথা বললে আমাদেরও সেখানে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। এটাকেই আমাদের কাছে খুব তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা মনে হয়, যেমনটি মনে হয় শাহবাগের আন্দোলনকেও।

কান পেতে শুনতে হবে, তারা কী বলতে চাইছে। তাদের নাড়ীর স্পন্দনটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। বিশ্বের কোনো দেশে এ ধরনের ধর্মীয় উত্থানকে জোর করে দমানো যায়নি। যারা এটা বলছেন, তারা ইতিহাসটা জানেন না।

ইতিহাস জানলে তারা অন্য রকম আচরণ করতেন। এগুতে চাইলে কোন দিকে জোর দিতে হবে? মুক্তিযুদ্ধ ও ইসলামকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ায় আমাদের ক্ষতি হয়েছে। জাতি হিসেবে দাঁড়াতে চাইলে ঐক্যের কতগুলো জায়গা লাগবে। সেখানে আস্তিক-নাস্তিক, মুক্তিযুদ্ধ-ইসলাম এ বিভাজন রেখা তৈরি করে আমরা এগোতে পারব না। আমাদের কোথাও না কোথাও ঐক্যের সম্ভাবনার কথা ভাবতে হবে।

জাতি মানেই সাধারণ সর্বজনীন ভাষা নয়। জাতি মানে কিন্তু একটি ভৌগোলিক সীমারেখা নয়। জাতি মানে হচ্ছে, কতগুলো অভিন্ন, নৈতিক ও ঐতিহাসিক বিষয়ের ওপর একটি জনগোষ্ঠীর সংগঠিত হওয়া। জাতির মধ্যে বিভক্তির রেখা টেনে আমরা দাঁড়াতে পারব না। এ বিভক্তিগুলো যুক্তরাষ্ট্র হ্যান্ডেল করতে পারে।

কারণ তারা অনেক বেশি গণতান্ত্রিক আধুনিক সমাজ। এটা করতে পারে পশ্চিম ইউরোপ। কিন্তু আমরা একটি পোস্ট কলোনিয়াল সোসাইটি, সবে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি; আমরা মাথা উঁচু করে রাজনীতি ও অর্থনীতি সংহত করার চেষ্টা করছি। আমাদের জন্য এ বিভাজন আত্মঘাতী। যে বিভাজন তৈরি হলো, সেটি জাতির অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর।

এখান থেকে মুক্তির পথ কী? মজার একটি কথা প্রচলিত রয়েছে, তোমার শত্রু হচ্ছে সে, যার গল্পটা তুমি শোননি। পরস্পরের বিশ্লেষণগুলোকে শোনা, সমাজের মধ্যে এক ধরনের গণতান্ত্রিক অভ্যাস গড়ে তোলা, সংসদ থেকে নাগরিক সমাজ সবক্ষেত্রে সংলাপের অভ্যাস তৈরি করতে হবে। ক্লাস বাউন্ডারি বা জেন্ডার বাউন্ডারি অথবা কালচারাল বাউন্ডারি বলি— এ সংকট কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। আজ হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় এসেছে। এ ক্ষোভ কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তৈরি হয়েছে।

ফলে এ সমস্যা একদিনে সমাধানও করা যাবে না। দীর্ঘস্থায়ী একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সমাধানের ও ঐক্যের জায়গায় যেতে হবে আমাদের। এখানে বড় ভূমিকা রাখতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। যদি তারা দেশের ভালো চায়, তবে আলোচনা করতে হবে। রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হেফাজতে ইসলামের আবির্ভাবের সম্ভাবনা কতটা? হেফাজতে ইসলামের রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভাবের সম্ভাবনা রয়েছেই।

১৯৫৩ সালে মিসরে নতুন রেজিম তৈরি হলে সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তারা বলেছে— এটি রাজনৈতিক দল নয়, তারা সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন। পরের বছর অবশ্য মুসলিম ব্রাদার হুডকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। দেখা গেল, মুসলিম ব্রাদারহুড পরবর্তী সময়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ফলে যেকোনো সামাজিক আন্দোলন রাজনৈতিক দলে রূপ নিতে পারে। রাজনৈতিক দল ও সামাজিক আন্দোলন বা সংগঠনের মধ্যে এক ধরনের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান। যেকোনো সামাজিক সংগঠনের রাজনৈতিক দলে রূপান্তরের সম্ভাবনা থেকে যায়। যেভাবে যেকোনো রাজনৈতিক দলের সামাজিক সংগঠন হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা থাকে। এটা কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোয়।

ফলে হেফাজতে ইসলাম কাল একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হলে আমি অবাক হব না। হেফাজতে ইসলামের দাবিগুলো সম্পর্কে আপনার বিশ্লেষণ কী? নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির দাবিটি অযৌক্তিক, তবে শাস্তির বিধান থাকতে পারে। কেন বলছি। কোনো সমাজেই বাক স্বাধীনতার ধারণাটি অ্যাবসুলুট না। কমিউনিস্ট বা কর্তৃত্ববাদী অথরেটারিয়ান সমাজের কথা বাদ দিলাম, এমনকি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক সমাজেও অ্যাবসুলুট বাকস্বাধীনতা নেই।

ইউরোপের অনেক দেশে হলোকাস্ট ডিনাইল একটি বড় অপরাধ। কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে বলা যাবে না, সব নারী ধর্ষিত হোক। কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে বলা যায় না, সব শিশু নিপীড়িত হোক। একইভাবে কারো অধিকার নেই মানুষের গভীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার। এটা বাক স্বাধীনতার আওতায় পড়ে না।

এর জন্য এক ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা থাকতে হবে। এখানে আলোচনা করতে হবে, সংশ্লিষ্ট আইনটি আমরা কীভাবে করতে পারি, যাতে বিপরীত মতামত প্রকাশ বাধাগ্রস্ত না হয়। ধর্ম কিন্তু আর যেকোনো তত্ত্ব ও দর্শনের মতোই অভ্যন্তরীণ বিতর্কের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোয়। ইসলাম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের ইতিহাস তাই বলে। আমি কিন্তু এখানে ব্লাসফেমি আইনের কথা বলছি না।

নতুন আইনের মাধ্যমে তর্কগুলো যেন বন্ধ হয়ে না যায়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। ইসলামের সঙ্গে অন্যান্য তাত্ত্বিক বিতর্ক যেন বন্ধ করে দেয়া না হয়। এটি হলে বিপজ্জনক বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তবে এক ধরনের আইনি রক্ষাকবজ লাগবে যাতে ইচ্ছা করলেই মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে অসংবেদনশীলভাবে আঘাত করা না যায়। এর ফলাফল কী? কোনো উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দল হেফাজতে ইসলামীর সব দাবি মানতে পারবে না।

এর কোনো তাত্ক্ষণিক উত্তর আমার কাছে নেই। কারো কাছেই নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা এগুলো বিবেচনা করবেন। কিন্তু তারা ভালো করে জানেন, তারা তা পারবেন না। যেটা করতে হবে তা হলো, হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে এক ধরনের আলোচনার প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে।

এতে তারা সাড়া দেবে, তা নয়। কিন্তু প্রক্রিয়াটা চালু রাখতে হবে। একই সঙ্গে নিজেদের সংহত হতে হবে। সেটি হেফাজতে ইসলামকে দূরে ঠেলে দিয়ে নয়, একে বোঝার চেষ্টা করে নিজের শক্তিটা বাড়াতে হবে। এটা একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া।

এটি একদিনে তৈরি হয়নি এবং একদিনে সমাধানও করা যাবে না। এক্ষেত্রে সুশীল সমাজের ভূমিকাকে কীভাবে দেখছেন? বর্তমানে সুশীল সমাজের নামে কিছু ব্যক্তি খুবই বাজে ভূমিকা রাখছেন। এটি বিপজ্জনকও বটে। এরা হেফাজতে ইসলামকে শত্রুপক্ষে দাঁড় করিয়েছেন এবং অপমানজনক শব্দ ব্যবহার করে এ বিভক্তিকে বেহুদা তীব্র করে তুলছেন। বিরোধিতাকে এভাবে তীব্র করার দরকার নেই।

আমি বলছি না, সেকুল্যাররা নিজেদের অবস্থানে শক্তভাবে দাঁড়াবেন না। সবারই অধিকার আছে তার পয়েন্টকে রক্ষার। কিন্তু শত্রু শত্রু খেলা তৈরি করা বিপজ্জনক। এতে সমাজে আরো শত্রুতার জায়গা তৈরি হবে। বৈরিতা তৈরি হবে, যার মাশুলটা আমাদের সবাইকে গুনতে হবে।

সাংস্কৃতিক জোট বা বামপন্থীদের নীতিটা আত্মঘাতীই বলব। বর্তমান পরিস্থিতি সৃষ্টিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার পাশাপাশি আর কার দায় রয়েছে? সরকার তার দায় এড়াতে পারে না। আন্তনিও গ্রামসির একটা কথা আছে, যেকোনো রাষ্ট্র দুটি ভিত্তির ওপর দাঁড়ায়। একটা হচ্ছে বলপ্রয়োগ, আরেকটি মতাদর্শগত আধিপত্য। সরকার যদি ইসলামী শক্তিগুলোর বিকাশের বিষয়টি কান পেতে না শোনে, তাহলে ক্রমে তার মতাদর্শগত আধিপত্য হারিয়ে ফেলবে।

যদি সেটি হারিয়ে ফেলে তাহলে শুধু বলপ্রয়োগ, শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে তার কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারবে না। দুঃখের বিষয় হলো, সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এ বুদ্ধির উদয়টা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। তারা বিরোধী মত দমনে খড়গ হস্ত। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ৩১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.