আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয় না



"একজন রাজাকার চিরকাল রাজাকার, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা চিরকালই মুক্তিযোদ্ধা থাকবেন তার কি গ্যারান্টি?" এই প্রশ্নটা বহুল উচ্চারিত এবং অনেকেই বহুবার ব্যাবহারও করেছেন। কিন্তু এই বস্নগে এসে নতুন ভাবে আবার প্রশ্নটি মনে আসছে। বিশেষ করে যখন এখানে নানাবিধ তর্ক-বিতর্কের আড়াল থেকে ব্যক্তি মানুষের চরিত্র ও অবস্থান সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মায় তখন প্রশ্নটি এতোটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে, এর উত্তর খুঁজে বের করাটাও জরম্নরী হয়ে দাঁড়ায়। এই বস্নগে কিংবা তার বাইরে পত্রপত্রিকাতেও অনেকেই আজকাল প্রশ্ন তুলছেন, মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজাকার _ এই ভাগাভাগির কি এখনও কোনও প্রয়োজন আছে কি না? স্বাধীন দেশের বয়স যতোই বাড়ছে ততোই এই বিভক্তির প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছে বলেও কেউ কেউ মতামত ব্যক্ত করছেন। কিন্তু অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার প্রসঙ্গটির প্রাসঙ্গিকতা বদলেছে কিংবা এর প্রয়োজন ফুরিয়েছে বলাটা হবে আত্মহত্যার মতো।

কারণ এই প্রশ্ন ছাড়া আমরা যে গনত্দব্যের দিকেই এগুবো না কেন সেদিকেই থাকবে বিশাল ও বিস্তৃত কোনও খাঁদ এবং নিশ্চিত ধ্বংস জেনেও সেদিকে এগিয়ে যাওয়াটা আত্মহত্যা নয়তো কি? পয়ত্রিশ বছর আগে যখন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তখন একে স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা নিছক যুদ্ধ না বলে মুক্তিযুদ্ধ বলার পেছনে বহুবিধ কারণ ছিল। তবে মোটাদাগে বলতে গেলে, মুক্তিযুদ্ধ বলতে বাঙালির শিৰা, সংস্কৃতি, অসত্দিত্ব ও ভৌগলিক সার্বভৌমত্বের ওপর পাকিসত্দানী শাসকগোষ্ঠীর ধর্মভিত্তিক দখলদারীত্ব থেকে মুক্তি অর্জনকেই বোঝানো হতো। এর বাইরে নিগূঢ় যে সত্যটি এই মুক্তিযুদ্ধ-এর মধ্যে সুপ্ত ছিল তাহলো বাঙালি-চৈতন্যের মুক্তি, সকল পশ্চাতপদতা, ধর্মান্ধতা, ভীরম্নতা, সামপ্রদায়িকতা ইত্যাদি সকল নিচয়ের অবরম্নদ্ধ অাঁধার থেকে বাঙালি জাতিকে আলোকিত পথে এনে দেওয়াই মুক্তিযুদ্ধ। তখন এসবের যারা বিরোধিতা করেছিল তারাই রাজাকার, তারাই স্বাধীনতাবিরোধী, তারাই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা-বিরোধী। বলাবাহুল্য স্বাধীনতা অর্জনের সশস্ত্র যুদ্ধে বাঙালি জাতি পাকিসত্দানী শাসকগোষ্ঠীর একটি সুগঠিত ও সুপ্রশিৰিত সেনা বাহিনীকে পরাজিত করেছিল এবং সেই সঙ্গে পরাজিত করতে সৰম হয়েছিল নিজেদের ভেতরকার এই পঞ্চম বাহিনীকেও।

তবে পরাজিত করা মানেই নিঃশ্চিহ্ন করা নয়, এবং সেটা সম্ভবও ছিল না। কারণ একটি নব্য স্বাধীনতালব্ধ ও জাতি হিসেবে প্রথমবারের মতো মুক্তির মুখ দেখা কোনও নৃতাতি্বক গোষ্ঠীর পৰে তার ভেতরকার ৰতিকারক ভাইরাসকে রাতারাতি দমন করার মতো শক্তিও তখন পর্যাপ্ত ছিল না। এ জন্য যতোই শেখ মুজিবের দোষ দেওয়া হোক না কেন, তাতে সত্য বদলাবে না। বিতর্ক সৃষ্টির জন্য কেউ প্রসঙ্গটি তোলেন তাহলে তার জন্য এটাই জবাব হবে যে, পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যনত্দ এমনতর কোনও নজির নেই। বাঙালির পৰেও তাই সেটা সম্ভব হয়নি।

কিন্তু এই সম্ভব না হওয়াই যে বাঙালির জন্য কাল হয়েছে তা নয়, কারণ স্বাধীনতা পরবতর্ী তিন-চার বছর বাঙালির ভেতরে যে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের প্রতি ঘৃণা কমে গিয়েছিল কিংবা রাজাকারদের সমাজের রন্ধ্রে মিশে যাওয়ার ব্যাপক সুযোগ জনগণ দিয়েছে তা কিন্তু নয়। জনগণ কিংবা বলা ভালো জনগণের একটি উলেস্নখযোগ্য অংশ সবসময়ই সজাগ ছিল বিষয়টি সম্পর্কে কিন্তু পরাজিত পৰ ও অৰশক্তির ক্থটচালে পাশার দান উল্টে যাওয়ায় যে শকুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দখল পেলো তাদের পৰে একা শাসনৰমতা ভোগ করা সম্ভবপর ছিল না। তাই তারা বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করে থাকা ধর্মবাদী গোলামদের দেশে তো ফিরিয়ে আনলোই সেই সঙ্গে দেশে আত্মগোপন করে থাকা (কেউ বা ধর্মের আলখালস্না পরে, কেউ বা একেবারে সাধারণ্যে মিশে গিয়ে নিজেকে ভীড়ে মিশিয়ে রেখেছিল) দেশজ রাজাকারগোষ্ঠীকেও ৰমতার অংশীদার করে নিলো। ফলে দেখা গেলো রাতারাতি দেশের পরিস্থিতি পঁচাত্তর পরবতর্ী কয়েক বছরের মধ্যেই আমূল বদলে গেলো, কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে রাজাকার সেই প্রশ্ন আবারও প্রকট হয়ে উঠলো। হাজারে হাজারে মুক্তিযোদ্ধা, কখনও সরকারী নির্দেশে, কখনও সামরিক অর্ডিন্যান্স জারী করে হত্যা করা হলো, এতে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীরাও আরও সাহসী হলো এবং তারা নিজেরাই সংঘঠিত হয়ে অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করতে শুরম্ন করলো।

এগুলো আমাদের জ্ঞাত ইতিহাস, চোখের সামনেই সংঘঠিত, তাই এগুলো নিয়ে যখন কেউ ক্থটতর্কে নামে তখন আমাদের প্রজন্মের অনেকেরই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে যাহোক, এই জানা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে লেখা দীর্ঘায়িত না করে মূল কথায় ফিরে আসি। কথা হচ্ছিলো মুক্তিযুদ্ধ ও রাজাকার প্রসঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ বলতে যে ব্যাপক ও বিশালায়তন নিচয়কে বোঝানো হয়েছিল তার প্রয়োজনীয়তা যে পয়ত্রিশ বছরেও ফুরায়নি কিংবা আগামি পঞ্চাশ বছরেও এর প্রয়োজন ফুরাবে না সেটা নিয়ে কেউ হয়তো দ্বিমত পোষণ করতে পারেন কিন্তু তা পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারেন কি? স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীনতা পরবতর্ীকালে রাজাকার কিংবা মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীরা যেভাবে রাষ্ট্র ৰমতার অংশীদারীত্ব লাভ করেছে তাতে তাদের শনৈ শনৈ বাড় বেড়েছে। সেই সঙ্গে যদি যোগ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের পদস্খলিত অংশটির তাহলে এই দু'য়ের যোগফল ভয়াবহ রকম সংখ্যার সামনে নিয়ে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেবে।

আর এর সঙ্গে যদি আমরা যোগ করি তাদের ছানা-পোনাদের, যারা ইতোমধ্যেই সাবালকত্ব অর্জন করেছে এবং এই বস্নগেও সদম্ভে তাদের অসত্দিত্ব ঘোষণা করছে তাহলে এমন একটি নিরেট সংখ্যা আমরা পাবো যা নিঃসন্দেহে একটি জাতির ভিতকে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে বাঙালি জাতির মতো একটি নব্য, নরোম ও কথিত আবেগ সর্বস্ব জাতির জন্যতো বটেই। শুরম্নতেই যে প্রশ্ন তুলেছি সেটি দিয়েই শেষ করছি। ধরম্নন, আজকে বাংলাদেশ একটি গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত (যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে এর সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা ছাত্রদের যেভাবে রাষ্ট্র-ৰমতার লোভ দেখিয়ে বাংলা শিৰায় শিৰিতদের বিরম্নদ্ধে উস্কে দেওয়া হচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বলতে যা বোঝায় তা যেভাবে একে একে সব নিমর্ূল করে দেওয়া হচ্ছে, সেই সঙ্গে দুনর্ীতি ও ৰমতার অপব্যবহার যেভাবে গোটা রাষ্ট্রকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় পেঁৗছে দিচ্ছে তা যে কোনও দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধার পূর্বলৰণকেই চিহ্নিত করে) এবং গৃহযুদ্ধের স্বাভাবিক নিয়মানুসারে নানা পৰ ও বিপৰ বিচ্ছিন্নভাবে একে অপরের বিরম্নদ্ধে অস্ত্রাঘাতে লিপ্ত, তখন আপনার পাশের ব্যক্তিটিকে আপনি কি করে চিনে নেবেন? কি করে আপনি ভাববেন যে, আপনি যে পস্ন্যাটফরমে দাঁড়িয়ে আছেন তিনিও সেখানেই দাঁড়িয়ে? আমার মনে হয়, এই চিনে নেওয়ার কাজটির জন্যই এখনও মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার প্রশ্নটিই মোৰম অস্ত্র।

মুক্তিযুদ্ধ শব্দের ব্যাপকতা থেকে যিনি একচুলও সরে গিয়েছেন তাকেই দেখবেন যুদ্ধৰেত্রে আপনার দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে আসতে, কারণ সে বিভ্রানত্দ, সে বিচলিত এবং তার অবস্থান শত্রম্নর শিবিরেই। আমি এই লেখাটির সঙ্গে একাত্তরের ঘাতক গোলাম আজম ও তার দোসর বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী মইত্যা রাজাকারের বক্তব্য সম্বলিত দু'টি লিফলেট ছবি হিসেবে উপস্থাপন করছি। আপনারা মিলিয়ে দেখবেন যে, এরা এখনও এই পয়ত্রিশ বছর পরেও তাদের অবস্থান বদলিয়েছে কিনা। যদি না বদলে থাকে তাহলে কেন আমরা এখনও মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারের প্রশ্নটি তুলবো না। কেন মুক্তিযোদ্ধারা এখনও তাদের ঘৃণা করবে না? এখনওতো গোলাম আজম কিংবা মইত্যা রাজাকার বেঁচে আছে, তাদের ছানাপোনারাও বেরিয়ে পড়েছে দাঁতে বিষ হাতে তলোয়ার নিয়ে, তাহলে? সবচেয়ে বড় কথা হলো, গোলাম আজমের এই বক্তব্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন একালের রাজাকারদের বক্তব্যও এর থেকে একচুল বদলায়নি।

তবে কি করে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার বিভক্তির প্রাসঙ্গিকতা বদলালো? আমি বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয় না, ব্যক্তি মানুষের জীবতকালের প্রতিটি ৰণই মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে হয়, বিশেষ করে ভাগ্যাহত বাঙালি জাতির প্রতিটি নাগরিককে তো বটেই। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় বড় বুলি ঝেড়ে শেষে নতুন প্রজন্মের রাজাকার-গোষ্ঠীর ধমর্ীয় উন্মাদনায় ঘি ঢালা প্রকৃতপৰে মুক্তিযুদ্ধকেই (ব্যাপক অর্থে) ব্যহত করা, মুক্তির পথে বাঁধার সৃষ্টি করাই। অবশ্য এই কাজটি এককালের বামপন্থী, প্রগতির ধারক (!) ফরহাদ মযহার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা যেভাবে করছেন তাতে তাকেই আমরা শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে টানতে পারি। এই বামক্থল শিরমণি এখন জিহাদকে বিপস্নবের নব্যরূপ হিসেবে দেখছেন - এককালের সুগন্ধি পুলাওয়ের এখন এই পাঁচনীয় অবস্থা! (বিষয়টি ব্যাপক ও বিসত্দারিত বলে এই ছোট্ট পরিসরে লেখাটি যথাসাধ্য সংৰিপ্ত রাখার চেষ্টায় অনেক কথাই লিখা হলো না, পরবতর্ীতে লেখার আশা রাখছি)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.