আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তালেবানের কাব্যপ্রেম

অজানাকে জানতে ছুটছি অবিরাম...! অল্পদর্শী এক কাঁধে রাইফেল এবং আর অন্য কাঁধের ঝোলায় পাবলো নেরুদার কবিতা নিয়েই সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন মহান বিপ্লবী আর্নেস্টো চে গুয়েভারা। প্রগতিপন্থী চে-এর উন্নত রুচি প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের কাছে আশা করাটা নিরর্থক। তবে সম্প্রতি পাওয়া কিছু তথ্য থেকে জানা গেছে, দেরিতে হলেও কিঞ্চিৎ সুমতি হয়েছে তাদের। রাইফেল, বোমা আর ধারাবাহিক আত্মঘাতী হামলার পাশাপাশি ইদানীং কাব্য ও সঙ্গীত চর্চার দিকেও ঝুঁকছে তালেবান। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার সময় তালেবানের নৈতিকতাবিষয়ক মন্ত্রণালয় সঙ্গীতচর্চা এবং এর বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও এখন নিজেদের আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার কাজে সঙ্গীত ও কবিতার গুরুত্ব উপলব্ধি করছে মোল্লা ওমরের বাহিনী।

কাব্য ও সঙ্গীতচর্চাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে দিন দিন। দলের অনেক যোদ্ধাও যুদ্ধের পাশাপাশি আজকাল কবিতা ও গান লিখে যাচ্ছেন। দেশটির নানা গোষ্ঠীর জনগণের মাঝে ভাষাগত ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য থাকলেও বাহিনীতে এক আদর্শের নিচে জড়ো করার জন্য সঙ্গীত ও কবিতার সর্বজনীন আবেদনের উপযোগিতা হবে অসামান্য। ঊষর আফগানিস্তান দেখতে যতই নিষ্করুণ ও রূঢ় হোক না কেন, এর হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একেবারে কম নয়। বলা হয়ে থাকে, প্রতিটি আফগানের মাঝেই একজন কবি বাস করে, তা সে তালেবানই হোক, আর অন্য কেউ হোক।

আফগানদের আছে নিজস্ব অনেক পৌরাণিক চরিত্রও। এদের মধ্যে যুদ্ধগাথা আর পৌরাণিক কাহিনীর বীর চরিত্ররা যুগ যুগ ধরে দেশটির বিভিন্ন গোষ্ঠীর যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস হিসেবে কাজ করেছে। আফগানিস্তানের এসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে এবার নিজেদের কাজে লাগাতে চাচ্ছে তালেবান। আরো সরাসরি বলা যায়, এসব ঐতিহ্যের মালিকানায় ও নিয়ন্ত্রণকারীর পর্যায়ে নিজেদের নিয়ে যেতে চায় তারা। তালেবানের বিশ্বাস, এসব স্তব, শ্লোক ও যুদ্ধগাথা আফগানদের তাদের বাহিনীতে যোগ দিতে উৎসাহিত করবে।

এছাড়াও আত্মশক্তি বাড়াবে যোদ্ধাদের। এছাড়া এসব গান নিরীহ জনগণ, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্যও উদ্বুদ্ধ করে। ৮০’র দশকে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময়ও এসব গাথা যোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। চলতি বছরের প্রথম দিকে তালেবান ‘তারানি’ নামে একটি ওয়েবসাইট খুলেছে, যেখানে বিভিন্নজনের গাওয়া প্রায় ১০০-র মতো স্তব, শ্লোক আর যুদ্ধগাথার লিঙ্ক দেয়া হয়েছে। তালেবানি কবিতার একটি বইয়ের ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে এ বছর।

পশতু ও দারি ভাষার তালেবান-অনুমোদিত ছন্দবদ্ধ অনবদ্য ও সম্মোহনী এ গানগুলোর চর্চা বাড়ছে আগের তুলনায়। তবে এসব চর্চার সবটুকুই চলছে কোনো বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই। ধর্মীয় কারণে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব শিল্প ছড়িয়ে দেয়ার জন্য কাজ করছে তালেবান বাহিনীর একটি বিভাগ। আর অধিকাংশ ক্যাসেট-সিডি তৈরি হয় পাকিস্তানে।

আফগানিস্তানে এরই মধ্যেই এটি একটি উদীয়মান ব্যবসায় রূপ নিচ্ছে। এদের বিক্রিও একবারে খারাপ নয়। মোবাইল ফোন প্রযুক্তি ও ব্লু-টুথের সাহায্যেও ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে এসব গানের রিংটোন। তালেবান-রচিত গানগুলো কোথাও কোথাও জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের সুর দিয়েও গাওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানের পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কিবলা আয়াজের মতে, ‘তালেবানি শ্লোকগুলো যথার্থই অনুপ্রেরণাদায়ক।

এগুলো অনেক সরল, তবে শক্তিশালী। ’ তালেবান-অনুমোদিত আফগান পৌরাণিক চরিত্রগুলোর মধ্যে ‘নিঃসঙ্গ যোদ্ধা’ চরিত্রটিই সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয়। এটি হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত ডেভিড চরিত্রটির মতো একটি সঙ্গীহীন সাহসী যোদ্ধা আফগান, যে কি-না বহুগুণ শক্তিশালী একটি শত্রুপক্ষের সঙ্গে একা একা প্রাণান্ত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। দেশটির বিভিন্ন সঙ্কটের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এ ‘নিঃসঙ্গ যোদ্ধা’কে নিয়ে বিভিন্ন শ্লোক রচিত হয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে চরিত্রটির উৎপত্তি ১৭০০’ শতাব্দীর পশতুন কবি কুশান খান খাত্তাবের হাতে।

খাত্তাব একাধারে ছিলেন একজন কবি, যোদ্ধা এবং গোত্রপ্রধান। অত্যাচারী মুঘল শাসকদের প্রতিহত করতে পশতুনদের মধ্যে জাগরণের সৃষ্টি করাই ছিল খাত্তাবের কাব্য রচনার মূল উদ্দেশ্য। খাত্তাবের বেশিরভাগ কবিতাই যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট হলেও তাকে একজন যুদ্ধ-বিরোধী কবিও বলা যায়। বাংলা অনুবাদে তার একটি কবিতা দাঁড়ায় এমন, ‘কেন তবে যুদ্ধ, শান্তি যখন তোমার হাতের কাছেই/জীবন শান্তিতে কাটলে, কী দরকার এসব তীর-তলোয়ারের?’ মূলত এ কারণেই যুদ্ধক্লান্ত আফগানদের মাঝে খাত্তাব এতটা জনপ্রিয়। তবে আফগান সরকার এরই মধ্যে এসব তালেবানি সঙ্গীতের বিক্রি ও সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ করেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মানান ফারাহি বলেন, ‘এগুলো তালেবানকে আরো অধিক মাত্রায় সহিংস করে তুলবে। ’ তবে আফগানদের বড় অংশই এখনো তালেবানি সাহিত্য ও সঙ্গীত মন থেকে গ্রহণ করেনি বলেই জানা গেছে। যতখানি গ্রহণ করেছে, তাও তালেবানের জবরদস্তিতে। কারণ পথচারীদের মোবাইল ফোন ও অন্যান্য সরঞ্জাম প্রায়ই তল্লাশি করা হয় এবং নিষিদ্ধ গান পাওয়া গেলে কখনো কখনো হেনস্তাও হতে হয়। তালেবান সদস্যরা আফগানিদের তাদের অনুমোদিত জিহাদি সঙ্গীতগুলো শোনার পরামর্শ দিয়ে থাকে।

তাই তালেবানের প্রতি সহানুভূতিশীল আফগান হিসেবে ভান করার জন্য হলেও তাদের সঙ্গে এ গানগুলো রাখতে হয়। তথ্যসূত্র : বিবিসি অনলাইন  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.