আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চিৎকার নির্ভর দেশ, আওয়াজ সর্বস্ব জাতি

বসে আছি পথ চেয়ে.... একটা সময় ছিল যখন মানুষ কথা দিয়ে আগুন জ্বালাতে পারত। রুশো-ভলটেয়ারের কলমের তেজে কথাগুলো ফসফরাসের মত ফরাসী বিপ্ল¬বের ক্ষেত্রে আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছিলো। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি ও বিপিন চন্দ্র পালের বক্তৃৃতায় আগুন জ্বলত। বিৃটিশ বিরোধী চেতনায় গোটা জাতিকে প্রজ্বলিত করেছিল তাদের বক্তৃতা। স্বদেশি আমলে মুকুন্দ দাসের গান।

মানুষের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালাত। স্বাধীনতার রক্তস্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে দীক্ষিত করতে সমগ্র বাঙালির মনে আগুন জ্বেলেছিলো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। সেই আগুনঝড়া দিনগুলো হারিয়ে গেছে। নেই আর তেমন কোনো অগ্নিপুরুষ। কালের বিবর্তনে এখন চারিদিকে শেয়াল-কুকুরের আর্তচিৎকার, কাক-শকুনের কর্কশ নিনাদ।

নেতা-নেত্রী-বুদ্ধিজীবীদের কথায় এখন আর তেমন কোন মাধুর্য নেই, নেই আগুন, তেজ। কিন্তু এখনও যা আছে তা হচ্ছে অজস্র কথা, অফুরন্ত ভাষণ আর চিৎকার। শুধু কথা দিয়ে, চিৎকার কিংবা বক্তৃতার মাধ্যমে যদি কোনো জাতি উন্নতি কিংবা শ্রেষ্ঠ হতে পারত তবে নিঃসন্দেহে আমাদের চেয়ে উন্নত, শ্রেষ্ঠ জাতি পৃথিবীতে আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। কিন্তু কথার ফুলঝুড়ি, বক্তৃতার বেসাতি, প্রতিশ্র“তির বন্যা, অনিঃশেষ মিথ্যে পঙ্তিমালার চিৎকার আমাদের সমস্ত গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়েছে। কর্মবিমুখ কথা এবং উৎকট চিৎকারে উচ্চারিত বক্তৃতা জীবনের সমস্ত এগিয়ে চলার পথ আঁধারে ঢেকে দিয়েছে।

মানবেতিহাসের বিভিন্ন পর্বকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। যেমন আদিম যুগ, প্রস্তর যুগ, লৌহ যুগ, তাম্র যুগ ইত্যাদি। অতীত ভারতবর্ষকে বিভিন্ন অধ্যায়ে বিভক্ত করে পৌরাণিক যুগ, আর্য যুগ, মৌর্য যুগ, মোগল যুগ, বিৃটিশ যুগ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। বর্তমান বাংলাদেশকে আমরা অভিহিত করতে পারি চিৎকারের যুগ হিসেবে। এখন দেশটা চলছে স্রেফ চিৎকার আর আওয়াজের ওপর।

আমাদের রাজনীতি স্থায়ী ভিত্তিতে সরকারি ও বিরোধী দল এই পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জ্ঞানী-গুণি-বুদ্ধিজীবীরাও এই দুই শিবিরে নাম লিখিয়েছেন। তৃতীয় পক্ষ বলে এখানে কেউ নেই। এক পক্ষ বলছে : আমরা সেরা আমরা এটা করেছি, ওটা করেছি, এটা করব, ওটা করব। আমরা বাংলার কুঁড়েঘর সোনার ঢেউটিন দিয়ে মুড়ে দিয়েছি; আগামীতে সবার জন্য বিনামূল্যে কাবাব-পরোটার ব্যবস্থা করব।

কিন্তু ওরা আমাদের কাবাব-পরোটা কর্মসূচিতে তেলাপোকার বিষ্ঠা ছড়িয়ে দিচ্ছে। ওরা ষড়যন্ত্রকারী, ওরা মিথ্যুক, হিংসুটে। ওদের শিক্ষা দিতে হবে। অন্য পক্ষ বলছে : ওরা চোর আমরা সাধু। আমরা কেজি দরে মাটি এনে দেশের আয়তন বাড়িয়েছি।

ওরা দেশ বিক্রি করছে। আমরা খাল কেটেছি ওরা কুমির এনেছে। আমরা ফেরেস্তা আর ওরা শয়তান। ওদের ঘাড় ধরে ক্ষমতা থেকে নামাতে হবে। এভাবে ‘আমরা ভালো আর ওরা খারাপ’, ‘ওরা নষ্ট আমরা সেরা’এ নিয়ে চলছে চিৎকার, কথা আর বক্তৃতা।

পথে-ঘাটে, রেডিও-টিভিতে, পেপার-পত্রিকায় সব জায়গায় কথা আর বক্তৃতা, অভিযোগ আর বিষোদগার, আত্মপ্রশংসা আর কৃতিত্ব প্রচার, গালাগালি আর ঝগড়া, নোংরামি আর মিথ্যাচার, আস্ফালন আর উস্কানি, প্রতিনিয়ত চলছে পরস্পরের মধ্যে ‘ব্যাক বাইটিং’। গ্রামাঞ্চলে সন্ধ্যে বেলায় ঝোপ-ঝাড় থেকে ঝিঁঝিঁ পোকা যেমন একটানা বিরক্তিকর মাতম তোলে, তেমনি সমস্ত দেশ জুড়ে চলছে অহর্নিশ গগণবিদারী আওয়াজ। আমাদের ইন্দ্রিয়, মস্তিষ্ক কোষ, আমাদের বোধ, অনুভূতি সব কিছু অসার, অকেজো হয়ে যাচ্ছে। এখন আর কেউ কারো কথা শুনি না, বুঝি না। কেউ কারুকে বুঝতে পারি না (বুঝতেও চাই না)।

সব যেন দম দেয়া পুতুল। চলছে ফিরছে দৌড়াচ্ছে আর গড় গড় গড়্-ড়-ড়-ড় করে আওয়াজ বেরুচ্ছে। দীপেন কুমার সান্ন্যাল আজ থেকে বহুবছর আগে বিখ্যাত অচলপত্র পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘রেল স্টেশনগুলোতে ফেরিওয়ালারা গরম চা, গরম চা বলে চেঁচায় কেন? চা তো গরমই হওয়ার নিয়ম’। দীপেন কুমার নিজেই জবাব দিয়েছেন, ‘হকারেরা ‘গরম চা গরম চা’ বলে চেঁচায় কারণ চাটা মোটেই গরম নয়, বেশ ঠাণ্ডা, তাই চেঁচাতে হয় গরম গরম বলে’। আমাদের দেশে এখন যারা ক্ষমতায় আছেন, অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা সবাই সব সময় নিজেদের ‘গণতান্ত্রিক’ বলে দাবি করছেন, নিজেদের ‘সেরা’ বলে নিজেরাই স্বীকৃতি দিচ্ছেন।

তারা গণতান্ত্রিক হবেন, সেরা হবেন এটাই প্রত্যাশিত, কিন্তু যখন তারা নিজেরাই ‘গরম চা’ বলে চেঁচায় তখন তাদের সততা ও চরিত্র নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে। আসলে বর্তমানে সবকিছুই পরিণত হয়েছে সাজানো, বানানো, লোক ঠকানো, লোক দেখানো আওয়াজ নির্ভর। অন্তরের প্রেম যখন দুর্বল হয়ে পড়ে, ভক্তির পরিমাণ যখন সন্দেহজনক স্তরে পৌঁছায়, তখন তা বাইরের পোশাকে আশ্রয় নেয়, ভেতরে সে আসলে আশ্রয়হীন, ঠুনকো। আত্মপ্রচারের বক্তৃতাও জরুরি নয়। মানুষের প্রকৃত সেবক হলে সেটা ঢাক-ডোল পিটিয়ে গেলানোর প্রয়োজন নেই।

যে কল্যাণ প্রচার সর্বস্ব, যে কেবলই কৃতিত্ব দাবি করে বুঝতে হবে সেটা আসলে ছল বা মতলব মাত্র। চারিদিকের শব্দ, আওয়াজ আর চিৎকারে গোটা জাতির মগজই ক্যামন যেন ঢিলে হয়ে গেছে। অনবরত ঘ্যাঁ ঘোঁ ক্যাঁ কোঁ টুং টাং ক্রিং হর্ণ বেল হুইসেল হাসি কথা ভাষণ সুর ক্রুড ক্রুয়েল। টকশো-এফএম রেডিও। টিভি, ডিভিডি, এমপি থ্রি, এমপি ফোর, মোবাইল, মাইক, রেকর্ডার।

স্ত্রীর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর। কলিগদের অট্টহাসি, বসের অকারণ গর্জন। ছেলেপিলের প্যানপ্যানানি, যুবকদের হুল্লে¬ার, ভাবী গায়ক-গায়িকাদের মেটালিক সুরের ভীভৎস কসরৎ। সবকিছু মিলিয়ে কেন্দ্রীয় নার্ভতন্ত্রে প্রতিটি স্নায়ু জর্জড়িত বিকল। আমরা এখন চিল্ল¬ানো ছাড়া কিছুই পারি না, অন্য কিছু শুনতেও পারি না।

চিৎকার নির্ভর এই দেশে আমরাও সহজেই আওয়াজ-সর্বস্ব জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের দেশের নেতানেত্রী, বুদ্ধিজীবী, জনতা সবাই যেন কেবল চেঁচাতেই শিখেছে, সকলে যেন শুধু চিৎকার করার বিদ্যাটাই আয়ত্ব করেছে। এদেশের প্রত্যেকেই যেন একেকটি হাইড্রোলিক হর্ণ। যার মধ্যে থেকে শুধু উৎকট-কর্কশ ক্ষতিকর আওয়াজ বের হয়। অথচ পরিবেশ অধিদফতর হাইড্রোলিক হর্ণ ব্যবহার সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ করেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বিজ্ঞাপনের ভাষায়‘হাইড্রোলিক হর্ণের বিকট শব্দ শরীরের রক্তচাপ বৃদ্ধি করে; হৃদকম্পন বাড়িয়ে দেয়। হজম শক্তি ব্যহত করে এবং মাংসপেশীর খিঁচুনি সৃষ্টি করে........’ আমাদের দেশের পরিবেশ অধিদপ্তর নিজেই শব্দ-দূষণের শিকার হয়ে অকর্মণ্য-বধিরে পরিণত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গলাবাজ, কথাবাজ, বক্তৃতাবাজ, অভিযোগবাজ, প্রতিশ্র“তিবাজ কেবল উৎকট আওয়াজ সৃষ্টিকারী চিৎকারবাজদের হাত থেকে আমাদের কে রক্ষা করবে? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.