আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাখে আল্লাহ মারে কে? (ফাঁসির মঞ্চ থেকে জীবন রক্ষা পেল প্রবাসী কফিল)

জানার আগ্রহ মানুষের চিরন্তন, বই হলো তার বাহন, আইনের মৃত্যু আছে কিন্তু বইয়ের মৃত্যু নেই। রাতে চমকে উঠি অনেক সময়। এ বুঝি আমার কফিল এল। এ বুঝি মা বলে ডাক দিল। দরজা খুলে দেখি কেউ নাই।

’ এভাবে দীর্ঘ ৭ বছর পার হয়েছে। অনেক বিনিদ্র রজনী কেটেছে কফিলের মা ফাতেমা বেগমের। ভোরে প্রতিদিন ফাতেমা বেগমই ঘরের দরজা খোলেন। তার ধারণা দরজা খোলেই বুঝি তার কফিলকে দেখতে পাবেন। কিন্তু একি! গত বুধবার সকাল ৬ টায় দরজা খুলতেই ফাতেমা বেগম অবাক।

তার ছেলে কফিল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। বিশ্বাস হয়না। ছুঁয়ে দেখেই বুকেই জড়িয়ে কান্নার রোল। পাড়া প্রতিবেশীরাও ছুটে আসে। দেখে শারজাহ থেকে তাদের কফিল ফিরে এসেছে।

যাকে নিয়ে সারা চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশেই তোলপাড় হয়। শারজায় এক ভারতীয়কে হত্যার ঘটনায় কারাগারে মৃত্যুদণ্ডের প্রহরগোনা সেই কফিল উদ্দিন। নগরীর খাজা রোডস্থ মাইজপাড়া এলাকায় কফিলদের বাড়ি। ওই বাড়িতেই তার সাথে গতকাল এ প্রতিবেদকদের কথা হয়। কফিল বর্ণনা দিলেন মৃত্যু পরোয়ানা পাবার পর কারাগারে প্রতিমুহূর্তে তার মৃত্যু চিন্তার শ্বাসরুদ্ধকর ক্ষণগুলো।

ঘটনা ২০০৫ সালের ১১ আগস্ট। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায় একটি হোটেলে হাতাহাতি হয় কফিল উদ্দিনের সাথে তারই সহকর্মী ভারতীয় নাগরিক রাজস্থানের পোরকারাম কুমারের। মদ্যপ পোরকারাম ছোরা নিয়ে তেড়ে আসছিল কফিলের দিকে। কফিলও আত্মরক্ষার জন্য পোরকারামের হাতের ছোরা কেড়ে নিয়ে তার পেটে বসিয়ে দেয়। মারা যান পোরকারাম।

দুবাই পুলিশ সাথে সাথেই ঘিরে ফেলে ওই হোটেল। গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় তাকে। বিচার শুরুর মাত্র ১ বছর পর সেদেশের আদালত তাকে মৃত্যুর পরোয়ানা শুনায়। সেই থেকে অর্থাৎ গত ৬ বছরে প্রতিটি মুহূর্ত কফিলের কেটেছে মৃত্যুর ভয়ংকর যন্ত্রণায়। কফিল জানান, কারাগার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয়েছে এখনই যেন আমাকে শিরচ্ছেদ এর জন্য নিয়ে যাওয়া হবে।

মা-বাবার মুখ দেখার সুযোগ বুঝি এ জনমে আর হবেনা। জানা গেছে, কফিল উদ্দিন (৩০) ২০০০ সালে ১৮ বছর বয়সে পেইন্টারের ভিসায় দুবাইয়ে যান। সেখানে তিনি ইসিসি ফার্নিচার ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি কারখানায় চাকরি নেন। পোরকারাম কুমার হত্যাকাণ্ডের দায়ে গত ২০০৬ সালের ১০ মে আমিরাতের আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আগামি ৬ ফেব্রুয়ারি দুবাইয়ের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে কফিলের মৃত্যুদণ্ড সংক্রান্ত আপিলের রায় ঘোষণা করা হয়।

বহাল থাকে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ। একই সঙ্গে ওই ঘটনায় কফিল উদ্দিনে বড় ভাই জসিম উদ্দিন, অপর বাঙালি যুবক মুজিব ও মফিজকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেয়া হয় এবং জানে আলমকে এক হাজার দেরহাম জরিমানা করা হয়। কফিলের ভাই জসিম উদ্দিন বলেন, আমার ভাই আরব আমিরাতের আদালতে স্বাক্ষী দিয়েছে, সে নিজেই খুন করেছে। সে আদালতেই তার খুনের বর্ণনা দেন। তার স্বীকারোক্তিতেই আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন।

আমি নিজেও ওই ঘটনায় সাজা প্রাপ্ত হই। এ নিয়ে বাংলাদেশী দূতাবাসের কর্তা ব্যক্তিরা সক্রিয় হওয়ার পর আদালত থেকে কফিলের ব্যাপারটি বাংলাদেশ ও ভারতের দূতাবাসের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় গড়ায়। আশার আলো ছড়ায় কফিল ও তার পরিবারের সদস্যসহ সকলের মাঝে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার পদধ্বনি পান কফিল শারজার কেন্দ্রীয় কারাগারে বসেই। রক্তঋণের ব্যাপারে আলোচনা চলছে উভয়পক্ষে।

আর মুক্ত পৃথিবীতে ফেরার প্রত্যাশার আলোও ছড়াতে থাকে কফিলের। কফিল জানান, প্রথম রায়ের ১৫ দিন পর আমি আপিল করি। কারাগারে থাকা অবস্থায় আমি পোরকারামের পরিবারের সাথে (শারজায় অবস্থানরত) টেলিফোনে কথা বলতে থাকি রক্তঋণের ব্যাপার নিয়ে। পোরকারামের পরিবার প্রথমে ৫০ হাজার দিরহামের বিনিময়ে আমাকে রেহাই দিবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। কিন্তু বাদ সাধেন তাদের আইনজীবী।

আইনজীবীর ভাষ্য অনুযায়ী ২ লাখ দিরহাম হচ্ছে সেখানকার আইনি বাধ্যবাধকতা। সুতরাং ২ লাখ দিরহাম বা ৪৪ লাখ টাকার কম হলে সমঝোতা করা হবেনা বলে ওই আইনজীবী কফিলকে জানিয়ে দেন। কিভাবে তিনি এসব বিষয় জানলেন এ ধরনের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাকে প্রতিমাসে আদালতে হাজির করা হতো। সেখানে তাদের সাথে আলোচনা হতো। তাছাড়া কারাগার থেকে টাকা দিয়ে টেলিফোন করার ব্যবস্থা আছে সেদেশে।

কোন মানবাধিকার সংস্থা সেখানে এনিয়ে কাজ করেছে কিনা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, মানবাধিকার সংস্থার অস্তিত্ব সেখানে দেখিনি। রক্তঋণের কথাবার্তার এক পর্যায়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা এসে কারাগারে আমাকে বলে যান চিন্তার কোন কারণ নেই। এদিকে কফিলকে বাঁচাতে গত জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে উদ্যোগ নেয়া হয়। জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে সাড়া দিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগ্রুপ পিএইচপি, এস আলম, টিকে গ্রুপ, এমইবি গ্রুপ, বিএমএস গ্রুপ, বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা এগিয়ে এসেছেন। একই সঙ্গে এ উদ্যোগে আছে চেম্বার অব কমার্স ও মেট্রোপলিটন চেম্বার।

বৈঠকে উপস্থিত ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেয়া শিল্পগ্রুপ হলো- পিএইচপি, টিকে ও এস আলম গ্রুপ পাঁচ লাখ টাকা করে, বিএমএস ও এমইবি গ্রুপ দুই লাখ টাকা করে, আ জ ম নাছির উদ্দিন এক লাখ টাকা, দোকান মালিক সমিতি ২০ হাজার টাকা এবং রেস্তোরা মালিক ৫০ হাজার টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। সবার প্রতিশ্রুতিতে মোট তাৎক্ষণিকভাবে ২৯ লাখ ২০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। বৈঠকের পর পরই সোনালি ব্যাংক আদালত শাখায় রক্তের ঋণ সংক্রান্ত একটি একাউন্ট খোলা হয়। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসককে প্রধান করে এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এহসানে এলাহী, রাজনীতিক আ জ ম নাছির উদ্দিন এবং চট্টগ্রাম চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বার, দোকান মালিক সমিতি, রেস্তোরা মালিক সমিতির একজন প্রতিনিধিকে সদস্য করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে বাকী টাকাও জোগাড় হলে কফিলের মুক্তিতে আর বাধা থাকেনা।

বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে কফিল উদ্দিন জানান, গত ৭দিন আগে রক্তঋণের ৪৪ লাখ টাকার একটি চেক আদালতে জমা দেয় বাংলাদেশ দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। ওই সময় ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা ও পোরকারাম কুমারের পরিবারের লোকজন আদালতে উপস্থিত ছিলেন। বিচারক ওই সময় ভিকটিমের পরিবারের হাতে চেকটি হস্তান্তর করে জিজ্ঞাসা করেন আপনারা আসামীকে ক্ষমা করে দিয়েছেন কিনা। এ সময় তারা ক্ষমা করে দেয়ার কথা বলেন। সেখান থেকে আমিরাতের কর্তৃপক্ষ নিজেদের তৎপরতায় সবকিছু করে আমাকে বিমান বন্দর পর্যন্ত এনে দেয়।

গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭ টায় বিমানে চড়ে চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে নামি রাত ২ টায়। আমার বাংলাদেশে আসার খবর পরিবারের কেউ জানতেননা। তাছাড়া ১২ বছর আগে বিদেশে যাওয়ার কারণে নিজের বাড়ির রাস্তা ভালভাবে চিনতে পারিনি। মাইজপাড়া এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নের কারণে রাস্তাঘাট অপরিচিত লাগছিল। এ কারণে অনেক ঘুরতে ঘুরতে বুধবার সকাল ৬ টায় বাড়িতে ঢুকেন কফিল।

শারজার কারাগার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এদেশের কারাগারেতো কখনো ঢুকিনি তাই অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু শারজায় আমি যে কারাগারে ছিলাম সেটা কারাগার নয় পুরোদস্তুর একটি আলিশান হোটেলের মতো। সেখানে এক রুমে আমরা ৪ জন ছিলাম। সবাই ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী। ৪ জনের আবার আলাদা আলাদা খাট আছে।

রুমে রঙ্গীন টেলিভিশন, এসি, খবরের কাগজ, গোসল করার জন্য ঝর্ণা, খোলামেলা জয়গা রয়েছে। কারাগারে কাজ করার জন্য কেউ জোর করেনা। ইচ্ছে হলে করতে পারে। কাজ করলে আবার তার মাইনেও রয়েছে। প্রতিমাসে ১৩০ দিরহাম করে।

কফিল জানান, ৪ বছর ৬ মাস কাজ করে তিনি প্রায় দেড় লাখ টাকার মতো পেয়েছিলেন। সেই টাকা দিয়ে জেলের ভেতরে টেলিফোন বিল এবং দেশে আসার বিমান ভাড়ার ব্যাপারটা সেরেছেন। কারাগারে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, মুরগীর মাংস, ছাগলের মাংস ও বিরিয়ানী দেয়া হতো। সর্বশেষ বক্তব্য হিসেবে কফিল উদ্দিন বলেন, আল্লাহ বাঁচাতে চাইলে মারার ক্ষমতা কার আছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে কফিল জানান, সংযুক্ত আরব আমীরাতের জন্য আমি এখন কালো তালিকাভুক্ত।

সুতরাং আমি আর ওই দেশে যেতে পারবোনা। তবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য যেকোন দেশে আবার যাওয়ার ইচ্ছার কথা জনালেন তিনি। কফিলের মা ফাতেমা বেগম বলেন, যারা আমার ছেলেকে এনে দিতে অবদান রেখেছেন তাদের জন্য আজীবন দোয়া করবো। বৃদ্ধ পিতা মোহাম্মদ হোসেন আহমদ জানান, আল্লাহর কাছে শোকরিয়ার শেষ নেই। তিনি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

আর এখানে যারা সাহায্য করেছেন তাদের সবার জন্য অশেষ দোয়া। জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক জহিরুল আলম মজুমদার বলেন, সরকার যে প্রবাসীদের জন্য কাজ করছে এটা তারই প্রমাণ। সবুর শুভ ও রেজা মুজাম্মেল ॥ দৈনিক আজাদী ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।