আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার্মানির জার্নাল

অলম্পিক ভিলেজ মিউনিখ হাউজি খেলার একটা ভালো দিক আছে। এক জোড়া ছন্দ-বদ্ধ শব্দের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের দুই একটা দিন তারিখ মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আমার কৈশোরে এক হাউজি আসরে এভাবেই আমার মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো মিউনিখ অলিম্পিক...... সেভেন এন্ড টু ৭২। পরে মিউনিখ অলিম্পিকের খোঁজ খবর নিয়েছিলাম। দু’টি কারণে মিউনিখ অলিম্পিকের কথা মানুষ ভুলবেনা।

এক। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামে প্যালেস্টাইনি এক সন্ত্রাসী সংঠনের হাতে ১১ জন ইসরাইলি ক্রীড়াবিদ আর এক জন জার্মান নিরাপত্তা কর্মীর মৃত্যু হয়েছিলো এই অলিম্পিকের সময়। দুই মার্ক স্পিটয নামের একজন সাতাঁরু এই আসরে ৭টি স্বর্ণ জিতেছিলো নতুন রেকর্ড গড়ে। মাত্র ক’দিন আগে মাইকেল ফেল্পস ৮টি স্বর্ণ জিতে সে রেকর্ড ম্লান করে দিয়েছেন। ইসরাইলি ক্রীড়াবিদদের জন্যে এখনও চোখের জল ফেলছে তাদের পরিবার।

২০০০ সালে প্রথমবার মিউনিখে আসার পর, যে সব জায়গা দেখতে যাবো বলে ভেবেছিলাম, অলিম্পিক ভিলেজ ছিলো তার এক নম্বরে। বুন্দেস লিগার একটা খেলা দেখার সুবাদে অলিম্পিক ভিলেজ দেখার সুযোগ হয়ে গেল। অলিম্পিক ভিলেজে যাবার সহজতম উপায় হচ্ছে হফব্যানহফ (কেন্দ্রীয় পরিবহন টারমিনাল)অথবা ম্যারিয়ান প্লাটয থেকে পাতাল রেলে চাপা। হফব্যানহফ থেকে যায় U-8 আর ম্যারিয়ান প্লাটয থেকে যায় U-3। দু’টিরই উত্তর মুখী শেষ ষ্টেশন অলিম্পিয়াযেন্ট্রাম।

অলিম্পিক ভিলেজের শুরু এখান থেকেই। শনিবার বেলা ২টায় ম্যরিয়ানপ্লাটয ছাড়লাম U-3তে। এর আগেও এই ট্রেনে উঠেছি কয়েকবার। ইউনিভারসিটেইটে পৌছানোর পর প্রতিবারই মনে হয়েছে ট্রেন খালি হয়ে গেল এখানেই। পরের ষ্টেশনে যায় কিছু ট্যুরিষ্ট আর শহরের উত্তর প্রান্তের অল্প কিছু বাসিন্দা।

কিন্ত এবার দেখলাম উলটো। খালি তো হলোই না। ভিড় বাড়তে থাকলো ক্রমশঃ। প্রতিটি ষ্টেশন থেকে উঠতে থাকলো বায়ার্ন মিঊনিখের জার্সি লাল মাফলার জড়ানো বিভিন্ন বয়সের যাত্রী। ব্যাভারিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল দল তখন পর্যন্ত লিগ তালিকার দুই নম্বরে।

প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্র্যাঙ্কফূরট এফসি পড়ে আছে তলানীতে। শিরোপা লড়াইয়ে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ খেলা নয়। তবে বায়ার্ন ভক্তদের তাতে কিছু যায় আসে না। অন্যান্য দিন পাতাল রেলের যাত্রীদের খুব একতা কথা বারতা বলতে দেখিনি। বেশির ভাগ সময়ই তারা কোলের উপর বই অথবা পত্রিকা মেলে ধরে মনোযোগী ছাত্রের মত ঘাড় গুঁজে বসে থাকে।

সহযাত্রীর সাথে আলাপ চারিতা খুব একটা নজরে পড়েনা। আজ দেখলাম তাদের অন্যরুপ। বায়ার্ন মিউনিখ তাদের মনের অর্গল খুলে দিয়েছে। বাইশ মিনিটের পথ অলিম্পিয়াযেন্ট্রাম। যখন ট্রেন থেকে নামলাম খেলা শুরু হবার তখনও দেড় ঘন্টা বাকি।

এই সুযোগে অলিম্পিক ভিলেজ ঘুরে দেখবো ভাবলাম। অলিম্পিয়াযেন্ট্রাম থেকে মূল অলিম্পিয়া পার্কে হেটে যেতে লাগে ৭ মিনিট। ৭২ এর সামার অলিম্পিক উপলক্ষে নগরীর উত্তর প্রান্তে গড়ে তোলা হয়েছিলো এই পার্ক। আরও আগে ১৯২৫এ এখানেই গড়ে উঠেছিল মিউনিখের প্রথম যাত্রীবাহী বিমান বন্দর। আজ সে সব ইতিহাস, অলিম্পিয়া পার্কের সবচে’ আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য অলিম্পিক টাওয়ার, আকাশ ছোঁয়া এই টাওয়ারে ২৯০ মিটার উচ্চতায় রয়েছে রেশটুরেন্ত, অবজারভেশন টাওয়ার আর স্যুভেনির সপ।

এখান থেকে মিউনিখের এরিয়েল ভিঊ চমৎকার। অলিম্পিয়া পার্কে আরও রয়েছে কৃত্রিম পাহাড়, কৃত্রিম লেক, সুইমিং পুল আর তিনটি স্টেডিয়াম। ৫ মার্কের এখন লাগে সাড়ে ৫ ইউরো) টিকেট কেটে অলিম্পিয়া টাওয়ারে উঠে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সেদিন সূর্যের তেমন তেজ ছিলো না। কুয়াশা আর মেঘের ফাঁকে মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছিলো রোদ।

এই অদ্ভুত আলো ছায়ায় অপরুপ দেখাচ্ছিলো নিচের অলিম্পিক পল্লী, আর অনতি দূরের শহর। অসংখ্য ফ্লাইওভার, আকাশ ছোঁয়া বাড়ি ঘর আর মাঝে মাঝে ঘন সবুজের ছোপে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা যায় সারাদিন। অলিম্পিক ভিলেজের সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়টি নির্মাণ করা হয়েছে মহাযুদ্ধে চূর্ণ স্থাপনা, ইমারত আর রাস্তা ঘাট থেকে পাওয়া ইট,পাথরের টুকরা দিয়ে। এযেন মহাযুদ্ধের ধংশস্তুপ থেকে উঠে দাঁড়াবার অদম্য আকাংখারই বহিঃপ্রকাশ। পাহড়ের কোল ঘেসে যাওয়া কৃত্রিম লেক, অলিম্পিয়া প্ললীর শোভা বাড়িয়েছে বহু গুন।

অলিম্পিয়া টাওয়ার থেকে নেমে ঢুঁ মারলাম আইস হকি স্টেডিয়াম আর সুইমিং পুলে। ছুটিরদিনে সাঁতারুদের ভিড়ে মুখরিত সুইমিং পুল। যে কেউ টিকেট কেটে সাঁতার কাটতে পারে এখানে। সুইমিং পুল দেখে, খেলা শুরু হবার আগ পর্যন্ত লেকের পাড়ে পাখিদের উরোউড়ি দেখে সময় কাটালাম। অলিম্পিক স্টেডিয়াম এক অবাক করা স্থাপনা।

স্টেডিয়ামের তিন দিক জুড়ে ফাইবার গ্লাসের ছাদ। ১৩ টি ৪০ থেকে ৮০ মিটারের পাইলনের উপর তাবু আকৃতির ছাউনি। মিউনিখে এধরণের তাবু আকারের স্থাপত্যের সুচনা মিউনিখ অলিম্পিকের সময় থেকে। স্টেডিয়ামের অদূরেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে টিকেট বিক্রি করছে দু’এক জন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এরা টিকেটের কালো বাজারি।

৩০ মার্কের টিকেট এখানে বিকোচ্ছে ৪০ এ। আমি যখন স্টেদিয়ামে ঢুকছি, অলিভার কানের নেতৃত্বে তখন মাঠে নামছে বায়ার্ন মিউনিখ। কানের তখন দোদন্ড প্রতাপ। একই সাথে জার্মানি আর বায়ার্ন মিউনিখের গোল আগলাচ্ছেন। হাতে উঠেছে অধিনায়কের আরম ব্যান্ড।

কান চাড়া জাতীয় দলের আরও তিন জন খেলোয়াড় রয়েছে বায়ার্নে। স্টেডিয়ামের চারিদিকে বিশাল টিভী পর্দায় ভেসে উঠছে তাদের ছবি পচাত্তর হাজার দর্শক একসাথে খেলা দেখতে পারে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। তাদের মুহুরমুহ করতালি আর হর্ষ ধ্বনিতে মুখরিত স্টেডিয়াম। ফ্রাঙ্কফুর্ট এফ দি তে এমন কোন খেলোয়াড় নেই যাদের আমি চিনি। তাদের সমর্থকরা সংখ্যায় বেশি নয়, তবে দলকে তাঁতিয়ে দেবার জন্যে তাদের কার্যকলাপ দেখার মত।

হাজার পাঁচেক দর্শকের প্রায় সবাই এসেছে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে উইকএন্ড টিকেটে। ( ২৫ মার্ককেরেকটা টিকেটে পাঁচ জনের একটি দল জার্মানির যে কোন জায়গায় রেলে ঘুরতে পারে আড়াই দিন। এখন অবশ্য দাম ৩৫ ইউরো)। তাদের গায়ে ফ্রাঙ্কফুরটে নীল জারসি, মাফলার আর হাতে নীল পতাকা। স্টেডিয়ামে দর্শকদের জন্যে সিট নম্বর থাকে।

গুণীজনকে সম্মান জানাতে জানে মিউনিখ। অলিম্পিয়া স্টেডিয়ামের ১০টি আসন উৎসর্গ করা হয়েছে বেকেন বাওয়ার, বরিস বেকারদের মত ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের নামে। এই দু’জনই অত্যন্ত জনপ্রিয় মিউনিখে। তাদের অনুপস্থিতে আসন গুলি খালিই থাকে। বায়ারন মিউনিখকে সেদিন খুব বেশি সাবলীল মনে হচ্ছিলো না।

হাফ টাইমের আগেই সত্তর হাজার দর্শকের মুখ চুন করে গোল খেয়ে বসলো বায়ারন মিউনিখ। এ গোলের রিপ্লে দেখলাম প্রায় সাথে সাথেই। বড় পর্দার টিভি ছাড়াও স্টেডিয়ামে রয়েছে বিশাল স্কোর বোর্ড। কিছুক্ষণ পর পরই সেখানে ভেসে উঠছে অন্যান্য ভ্যেনুতে অনুষ্ঠান রত বুন্দেস্লিগার অন্যান্য খেলার ফলা ফল। নভেম্বরে পাঁচটার আগে সূর্য ডোবে মিউনিখে।

হাফটাইমের আগেই সন্ধ্যা নেমে এলো। সত্তর মিনিটে আরেকটা গোল হজম করলো মিউনিখ। তাদের তখন পঁচা শামুকে পা কাটার অবস্থা। গ্যালারি খালি হতে শুরু করলো ধীরে ধীরে। আমারও আর খেলা দেখতে ভাল্লাগছিলো না।

মন খারাপ কপ্রা দর্শকদের সাথে বেরিয়ে এলাম। তখন পর্যন্ত স্যুভেনিরের দোকানে বেচাকেনা চলছে। আমি বায়ার্ন মিউনিখের তকমা আঁকা একটি লাল মাফলার কিনলাম। বাইরের ঠান্দা বাতাস থেকে বাঁচার জন্যে ভালো ভাবে মাফলারটা গলায় জড়াচ্ছি, এমন সময় উল্লাসে ফেটে পড়লো অলিম্পিক স্টেডিয়াম। স্কোর বোর্ডে জ্বলে উঠলো বায়ারন-১ ফ্রাঙ্কফূরট- ২।

যাক একটা গোল শোধ করেছে বায়ার্ন|শেষ পর্যন্ত ফলাফল তাইই থাকলো। অলিম্পিয়াযেন্ট্রাম থেকে ফিরতি ট্রেন ধরলাম একটু পরে। আমার সামনের সিটে বসেছিলেন এক জার্মান ভদ্রলোক। গলায় মাফলার দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন খেলা দেখতে গিয়েছেল? রেজাল্ট কী? বায়ারনের হারের কথা শুনে মন খারাপ করে বসে রইলেন তিনি। পাতাল ফুঁড়ে ছুটতে থাকলো U-8 ।

এবারের গন্তব্য হফব্যানহফ।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।