আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জার্মানির জার্নাল ৫

আল্পসের চুড়ায় ইউরোপের দিনগুলি দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। জার্মানিতে এসেছি SCHENGENERS STAATEN ভিসা নিয়ে। কাজেই দেশ ভ্রমণের অবারিত সুযোগ। ভাড়াও তেমন কিছু নয়। ইউরো ট্রেনে ফ্রান্স, ইটালি, বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া ঘুরে আসা যায়।

কিন্তু যাই যাই করে কোথাও যাওয়া হয়নি। অভিজ্ঞতা বলতে মিউনিখের গোটা দশেক জাদুঘর, ইংলিশ পার্ক, বিপণী কেন্দ্র, Olympia Zentrum আর U Bahn (পাতাল রেল)। সময়টা এমন যে রাস্তায় বেরুনো কঠিন। দিনের পর দিন ডিমের খোসার মত আকাশ, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি আর তীব্র শীতের হাওয়া অনভ্যস্ত বাঙালি শরীরে আদৌ সুখপ্রদ নয়। জার্মানিতে আসার পর থেকেই শুনে আসছি “ খুবই খারাপ সময় এসেছ।

শীতের সময় কেঊ ইউরোপে আসে? এলেই যদি তো মাস খানেক আগে এলে না কেন? আন্তত Oktoberfest টা ধরতে পারতে । “ খোঁজ নিয়ে জানা গেল Oktoberfest হচ্ছে ফোক লোর উতসব। ফোকলোর চর্চার সাথে সাথে বয়ে যায় বিয়ারের বন্যা। মিউনিখ শহরে কয়েক হাজার বিয়ার গার্ডেন আছে। অক্টোবর মাসের ২৩ তারিখে সেখানে মদের মচ্ছব লাগে।

সুরায় আসক্তি নেই। কাজেই বিষয়টি খুব বেশি আলোড়িত করল না। মাঝখানে বলে রাখি জার্মানির ব্যভারিয়া প্রদেশের রাজধানি মিউনিখ। যে তিনটি জিনিষের জন্যে এ শহরের বিশ্ব জোড়া খ্যাতি তার একটি বিয়ার অন্য দুটি হচ্ছে ইলেক্ট্রনিক্স আর মোটরগাড়ি। তবে আমি এ শহরের খ্যাতির আরও তিনটি কারন খুঁজে পেয়েছি।

এক – বরিষ বেকার, দুই – বেকেন বাওয়ার, তিন স্টেট বিবিওলিথিক (বিশ্বের দশম বৃহত্তম লাইব্রেরী)। একদিন ক্লাশের ফাঁকে আমার শিক্ষক Dr Reinherd Ernst ব্ললেন, “জার্মানীর শীতটাও খারাপ না। আল্পসে তুষার জমতে শুরু করেছে। এক উইক এন্ডে ঘুরে আসতে পারো। ” জীবনে তুষার পাত দেখিনি।

Reinherd এর কথাটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকলো গোটা সপ্তাহ। আল্পসের নাম প্রথমে শুনি ছোটবেলার ইতিহাসের ক্লাশে। প্রায় দুই হাজার বছর আগে কার্থেজের সেনাপতি হ্যানিবল আল্পস অতিক্রম করেছিলেন গোটা বাহিনী নিয়ে। ১১১৬ কিঃ মিঃ দীর্ঘ এই পর্বতমালা ফ্রান্স থেকে ইটালি পর্যন্ত বিস্তৃত। আল্পসের কথা মনে হলে Helvetia’র ডাকটিকেটে আঁকা বরফে ছাওয়া পাহাড়ের ছবি চোখে ভাসে।

ঠিক করলাম, আল্পস দেখতে যাব ডিসেম্বরের ৩ তারিখ। Reinherd বললেন, Byerisehes Fernshen চ্যানেলে আল্পসের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানায়। বের হবার আগে টিভিতে আবহাওয়ার খবরটা দেখে নিও। মেঘলা আবহাওয়ায় না যাওয়াই ভাল, রোদ ঝলমলে দিনে বরফের গায়ে আলোর ঝিলিকই আল্পসের আসল সৌন্দর্য। ” যাত্রা শুরু।

মিউনিখ থেকে আল্পসের পাদদেশে পৌছানোর সহজতম উপায় হচ্ছে ট্রেন। মিউনিখ শহরে মোট চার ধরনের ট্রেন চলে। ICE বা ইন্টার সিটি এক্সপ্রেস সবচেয়ে দ্রুতগামী। আন্তঃ দেশীয় যোগাযোগের জন্যে এ ট্রেনের খ্যাতি ইউরোপ জুড়ে। আন্তঃ মহানগর ভ্রমণের জন্যে রয়েছে ইউরো ট্রেন।

U bahn দ্রুতগামী হলেও মিউনিখ শহরের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। আর S bahn ততটা দ্রুত না হলেও পুরো জার্মানিতে সস্তায় ভ্রমণের সবচেয়ে উপযোগী বাহন। সপ্তাহান্তে বিশেষ ছাড়ে টিকেট পাওয়া যায়। মাত্র ৪০ ইঊরোর একটি উইক এন্ড টিকিটে পাঁচ জন যাত্রী শুক্রবার বিকেল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত জার্মানির ভেতরে যে কোন গন্তব্যে যাওয়া আসা করতে পারে। আমাদের যেতে হবে S bahnএ গারমিস- পার্টেন কিচেন রুটে।

ডিসেম্বরের ৩ তারিখে ঘুম থেকে উঠতেই মনটা আনন্দে ভরে গেল। জানালার ভারি পর্দার ফাঁক দিয়ে মিহি আলো ছুয়েছে দরজার চৌকাঠ। আবহাওয়া বার্তা না দেখেই বলে দেওয়া যায়, আজ রৌদ্রজ্জ্বল দিন। আজ আমাদের দিন। দ্রুত তৈরি হয়ে সকাল ন’টায় পাতাল রেলে Hauptbahnhof পৌছলাম আমরা দশজন।

মিউনিখ শহরের প্রধান স্টেশন Hauptbahnhof, এখান থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে প্রতি তিন মিনিটে একটি করে ট্রেন ছাড়ে। ICE, EURO, U bahn এবং S bahn সব ট্রেনেরই কেন্দ্রীয় স্টেশন Hauptbahnhof এখানে নয়টায় পৌছেও সাড়ে নয়টার ট্রেন ধরতে পারলাম না। তার প্রধান কারণ স্টেশনের বিশালত্ব এবং ডয়েচেবানের (জার্মান রেলয়ে) সময়ানুবর্তিতা। জার্মানিতে সাড়ে ন’টার ট্রেন সাড়ে ন’টায়ই ছাড়ে। গারমিস পার্টেন কিচেনের ট্রেন ছাড়ে ২৭ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে।

সেখনে পৌছাতে পৌছাতে নয়টা একত্রিশ বেজে গেল। কাজেই পরবর্তী ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা। এটা ছাড়বে সাড়ে দশটায়। ট্রেনের অভিজ্ঞতা। ট্রেনে উঠতে গিয়ে এক মজার কান্ড।

উইকএন্ড টিকিট শুধুমাত্র ২য় শ্রেণীতে ভ্রমনের জন্যে। দরজায় ২য় শ্রেণীর চিহ্ন আছে ঠিকই, ভিতরের আবস্থা আমাদের দেশের প্রথম শ্রেণীকে হার মানায়। এত পরিপাটি যে মনে হয় ভুল কামরায় উঠে পড়েছি। এদেশে বিনা টিকেটে কিম্বা ভুল টিকেটে রেল ভ্রমণ বড় মাওএর অপরাধ। ধরা পড়লে ৬০ মার্ক জরিমানা।

এদের কাছে ৬০ মার্ক খুব বড় অংক না হলেও, পুলিশের খাতায় নাম উঠে যাওয়া চরম দুর্ভাগ্যজনক। কামরায় আগে থেকেই এক মহিলা যাত্রী বসে ছিলেন চোখের সামনে গল্পের বই মেলে। জার্মানিতে এটি অতি স্বাভাবিক দৃশ্য। ট্রেন, বাস, ট্রাম সব জায়গাতেই এদের সঙ্গী বই। বাসের দরজায় বই, ট্রামের ভেতরে বই, ট্রেনের জন্যে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কেউ তারও সঙ্গী বই।

কত টুকু পড়া হয় জানি না। তবে নিজেকে গুটিয়ে রাখা যায়। সহযাত্রী মহিলাকে টিকেট টা দেখালাম ঠিক আছে কিনা জানার জন্যে। উনি যা বললেন, তার সরল অর্থ হচ্ছে “আমি ইংরেজি জানিনা”। সুতরাং টিকেট টেকারের অপেক্ষায় বসে রইলাম পকেটে ৬০ মার্ক আলাদা করে।

বেশিক্ষণ উৎকণ্ঠায় কাটাতে হল না। দু–একটা স্টেশন পরে টিটিসি এসে টিকিট দেখে গেল। আমরা নিশ্চিত হলাম। জার্মানির এই ধীর গতির S bahn আমাদের আন্তঃনগর ট্রেনের চেয়ে দ্রুত ছোটে। Passing স্টেশন ছাড়াতেই হঠাত করে প্রকৃতি যেন আমাদের কাছাকাছি চলে এল।

বুঝলাম শহর ছাড়িয়েছি। এদিকে জনবসতি বেশ হালকা। ইংরেজি সিনেমায় দেখা গ্রামের মত। ছড়ানো ছিটানো দু- একটা ঘর। মাঝে মাঝে ফা্রের কিম্বা ঝাউ বনের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে ট্রেন।

সূর্য তখনও মাথার উপর ওঠেনি। ট্রেনের ডান পাশে লম্বা ছায়াটি দ্রুত এগিয়ে চলেছে আমাদের সাথে। অনেক দিন পর একটা ঝক ঝকে নীল আকাশ দেখছি। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে অবশ্য মেঘলা দিনের কথা বলা হয়েছিল। এদের আবহাওয়া বার্তা আমদের বিটিভির মত।

পূর্বাভাসের সাথে আবহাওয়া মেলে না। গাইয়েরবাওয়েন নামের এক স্টেশনে যেয়ে ট্রেন বদলে আর এক ট্রেনে যেতে হবে গারমিস। বার বার বাইরে তাকিয়ে স্টেশনের নাম পড়তে গিয়ে অনেক কিছুই দেখা হচ্ছে না। এরই মধ্যে পেরিয়ে এসেছি Tutzing. মিউনিখের বিখ্যাত স্ট্র্যানবারগ হ্রদের তীর ঘেঁষা পরিচ্ছন্ন কাউন্টি শহর। প্রকৃতি জার্মানিকে সমুদ্র দেয়নি।

তার বদলে যে অপার সৌন্দর্য দিয়েছে, তা তুলনাহীন। এই হ্রদের গাঢ় নীল পানি, হ্রদের বুকে ঝুঁকে পড়া মেঘ আর বিশাল উপত্যাকা একে করে তুলেছে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। শোনা যায় জার্মানির স্বপ্নবিলাসী রাজা দ্বিতীয় লুডউইগ এই হ্রদে আত্ম বিসর্জন দিয়ে ছিলেন। সুন্দরের খোঁজে না সৌন্দর্য পান করতে তা অবশ্য জানা যায়নি। Tutzing থেকেই আল্পস পর্বতের চূড়ায় জমে থাকা বরফ দেখা যাচ্ছিল।

জমাট বরফে সূর্যের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে রুপের ছটা। পাহাড়ের নিচ দিকে রোদ যেখনে তেমন প্রখর নয়, বরফ যেন সেখানে বিছিয়ে আছে রূপালী চাদীররের মত, বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। রাস্তার ঘোরপ্যাঁচের জন্যে পাহাড়কে মনে হচ্ছে কখনো কাছে, কখনো বা দূরে। গাইয়েরবাওয়েন থেকে সাধারণ ট্রেনে যাওয়া যায় না। এখান থেকে উঠতে হল কগ হুইল ট্রেনে।

অদ্ভুত এই ট্রেনে দু’পাশের চাকার বদলে একটি মাত্র চাকা থাকে ট্রেনের মাঝ বরাবর। দু’টি সমান্তরাল লাইনের একটি লাইনের উপর চলে এই ট্রেন। ঠিক ১ ঘণ্টা ২১ মিনিট পর ট্রেন পৌছালো গারমিসে। (অসমাপ্ত)  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।