আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অর্থমন্ত্রী, কতজনকে পেটাবেন?

আমিতো মরে যাব চলে যাব রেখে যাব স্মৃতি.................... অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বরাবর সোজাসাপ্টা কথা বলেন। তিনি নিজে যা ভালো বোঝেন, সরাসরি বলেন। একসময়ের নামকরা এই কূটনীতিক-আমলা কূটনীতির ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করেন না। যে কারণে তাঁকে অনেক সময় দলের ভেতরে ও বাইরে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু মুহিত সাহেব হয়তো ভাবছেন, বেলা শেষের বেলায় তাঁর কী আর হারানোর আছে? প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু নিয়ে এখন দেশব্যাপী তোলপাড়।

এই সেতু নিয়ে যাঁর কথা বলার কথা, সেই যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘তিনি কিছুই বলবেন না। ’ কিন্তু বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে প্রতিদিন কথার ঝড় বইছে। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীরা জোর গলায় বলছেন, বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করায় বাংলাদেশের মানুষের জন্য সুযোগ এসেছে একাত্তরের মতো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার। তাঁরা আরও বলছেন, যে জাতি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারে, সে জাতি পদ্মা সেতুও করতে পারবে। তবে পদ্মা সেতু করতে যুদ্ধ করার প্রয়োজন নেই।

প্রয়োজন টাকার। অন্যদিকে বিরোধী দলের বিজ্ঞ নেতারা বলছেন, দেশীয় অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার নামে সরকার চাঁদাবাজি করছে। আগামী নির্বাচনের অর্থ জোগাড় করছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দল খুব চিন্তিত হলেও গাজীপুর-৪ আসনের উপনির্বাচন নিয়ে মোটেই চিন্তিত নয়। তফসিল ঘোষণার আগেই তারা উপনির্বাচন বয়কটের ডাক দিয়েছে।

সোমবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আবদুল্লাহ আল হাসান নামে যে ছাত্রলীগের নেতা নিহত হলেন, তার পেছনেও ছিল পদ্মা সেতু নিয়ে কথিত চাঁদাবাজির ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দেওয়ার পরই ছাত্রলীগসহ সরকার-সমর্থক নানা সংগঠন মহাসমারোহে অর্থ উত্তোলনে নেমে পড়েছে। একটি মওকা পাওয়া গেল বটে। যাঁদের ব্যাংক, বিমা, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারি, ঠিকাদারি আছে, তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করে হাজার হাজার কোটি টাকা পদ্মা সেতু প্রকল্পে জমা দেওয়ার আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। কিছু দিনের মধ্যে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিন্দন জানানোর প্রতিযোগিতাও শুরু হয়ে যাবে।

কিন্তু যাঁদের সেই সামর্থ্য, যোগ্যতা ও দক্ষতা নেই, তাঁরা ঘরে বসে থাকবেন? নিশ্চয়ই না। নিজেদের বঙ্গবন্ধুর সাচ্চা সৈনিক হিসেবে প্রমাণ করতে দিকে দিকে তাঁরা চাঁদা তোলার মহড়া শুরু করেছেন। শোনা যাচ্ছে, দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও পদ্মা সেতুর নামে চাঁদাবাজি চলছে। বিদেশে চাঁদাবাজি মানে ডলার, পাউন্ড, দিনার, রিংগিত পাওয়া। অবমূল্যায়িত টাকা নয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা আবদুল্লাহ আল হাসান ওরফে সোহেল হত্যার নেপথ্যেও সেই চাঁদাবাজির ঘটনা। অন্য আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই গ্রুপে বিভক্ত। আমরা এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কথা স্মরণ করতে পারি, যেখানে ছাত্রলীগের এক গ্রুপের ক্যাডারেরা আরেক গ্রুপের এক নেতাকে হত্যা করেছিল তিনতলা থেকে ফেলে। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বড় বড় কলেজে যখন বিরোধীদলীয় ছাত্রসংগঠন সরকার-সমর্থকদের ভয়ে ক্যাম্পাসছাড়া, তখন ছাত্রলীগই তাদের শূন্যস্থান পূরণ করেছে আত্মঘাতী অস্ত্রের মহড়া দিয়ে। উচ্চতর শিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বাবা-মা যেদিন সোহেলকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছিলেন, সেদিন কি তাঁরা চিন্তা করেছিলেন, ক্যাম্পাস থেকে তাঁর লাশ ফিরে আসবে? কিংবা যেদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষা নিয়ে সোহেল ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছিলেন, সেদিন কি তিনি ভাবতে পেরেছিলেন এভাবেই তাঁকে জীবন দিতে হবে ছাত্রদল বা ইসলামী ছাত্রশিবিরের ক্যাডার নয়, নিজ ছাত্রসংগঠনের প্রতিপক্ষ নেতা-কর্মীদের হাতে? এ ঘটনায় অন্যান্য মন্ত্রী চুপ থাকলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মুখ খুলেছেন।

এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাই। মঙ্গলবার সচিবালয়ে ‘সামাজিক ব্যবসা ও সামাজিক বিনিয়োগ’সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর নামে যারা চাঁদা তুলছে, তারা সবাই চান্দাবাজ (অর্থমন্ত্রী এই আঞ্চলিক শব্দটিই ব্যবহার করেছেন), তাদের ধরে পেটানো উচিত। পদ্মা সেতুর জন্য কাউকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ’ তাহলে কারা চাঁদা তুলতে পারবে আর কারা পারবে না—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘কেউই চাঁদা তুলতে পারবে না। ’ তিনি চাঁদাবাজদের ধরে পেটানো উচিত বলে মন্তব্য করেছেন।

অর্থমন্ত্রীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি প্রশ্ন না উঠে পারে না। এক. কেউ চাঁদা তুলতে পারবে না সরকারের এই সিদ্ধান্ত থাকার পরও কীভাবে দলীয় ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা চাঁদাবাজি করছেন? দুই. অর্থমন্ত্রী চাঁদাবাজদের পেটানোর কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি কতজনকে পেটাবেন? সারা দেশেই তো অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ‘চান্দাবাজদের’ মহাদৌরাত্ম্য চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহাসড়ক, সচিবালয় থেকে ফুটপাত—কোথায় চান্দাবাজি নেই? সম্প্রতি প্রথম আলোতেই সচিত্র খবর বের হয়েছিল, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ঢাকা মহানগরের ফুটপাতগুলো আম ব্যবসায়ীদের ভাড়া দিয়েছেন। সেই খবরের পর ফুটপাতে আমের উৎপাত কমলেও সরকারদলীয় লোকদের দখলবাজি-চাঁদাবাজি কমেনি।

এই মহানগরে আওয়ামী লীগের হরেক কিসিমের সহযোগী সংগঠনের নামে কত বিচিত্র অফিস স্থাপন করা হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এবং সবটাই সরকারি জায়গায়। যখনই যে দল ক্ষমতায় আসে সেই দলের নামে ফুটপাত ও খাসজমিকে নিজেদের তালুক মনে করে। বিএনপির আমলে আমরা ফুটপাতগুলো বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের দখলে থাকতে দেখেছি। এখন আওয়ামী লীগ-সমর্থকদের দখলে।

আমরা এ কথা হলফ করে বলতে পারি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত (যদিও দলের নেতারা মনে করেন তাঁরা রোজহাশর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন) হলে এঁদের টিকিটি থাকবে না। এসব স্বঘোষিত জনদরদি নেতা-কর্মীর কাছে জিজ্ঞাসা, যদি আওয়ামী লীগের প্রতি এতই ভালোবাসা থাকে তাহলে বাপ-দাদার সম্পত্তিতে অফিস খুলে বসেন না কেন? কেন মাঠ, ফুটপাত, পার্ক দখল করে জনগণের দুর্ভোগ বাড়াচ্ছেন? মাননীয় অর্থমন্ত্রীর কাছে তৃতীয় প্রশ্ন, আপনি চাঁদাবাজদের আচ্ছা করে পিটিয়ে দিতে বলেছেন। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? বাংলাদেশের প্রশাসন, পুলিশ, উপাচার্য, আমলা, সচিব—সবাই ছাত্রলীগ-যুবলীগের ভয়ে তটস্থ। যারা পিস্তল উঁচিয়ে চাঁদাবাজি করে, যারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে সতীর্থকে হত্যা করতে দ্বিধা করে না তাদের কি পিটিয়ে (অর্থমন্ত্রী কথাটি প্রতীকী অর্থে বললেও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা মানবেন না। তাঁরা একে হয়তো আক্ষরিক অথেই বিষয়টি দেখবেন) শায়েস্তা করা যাবে কি? আর দুর্মুখেরা বলবেন, অর্থমন্ত্রীর কাজ অর্থনীতির বিষয়াদি দেখা, সংসদে বাজেট পাস করা।

চান্দাবাজ-ধান্দাবাজ খোঁজা নয়। আর এই চান্দাবাজদের পেটানোর দায়িত্ব যাঁর, সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী তো কিছু বলছেন না। কয়েক দিন আগে বঙ্গবন্ধুর এই সাচ্চা সৈনিকেরাই সিলেটের এমসি কলেজে শতবর্ষী ছাত্রাবাস পুড়িয়ে দিয়েছেন পেট্রল ঢেলে। সারা দেশের মানুষ যখন এমসি কলেজের ঘটনায় স্তম্ভিত, তখনই তাঁরা নিজ সংগঠনের এক নেতাকে হত্যা করে বাহাদুরি জারি করলেন। অর্থমন্ত্রী পদ্মা সেতু নিয়ে চাঁদাবাজি করা যাবে না বলে এলান জারি করেছেন।

কিন্তু চাঁদাবাজিটা শুরু হলো কীভাবে, কার নির্দেশে, কারা চাঁদাবাজিতে করছেন সে বিষয়টি কি খুঁজে বের করা সরকারের দায়িত্ব নয়? সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক। . প্রথম আলো থেকে.... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.