আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাদকের বিষে নীল সমৃদ্ধ নগরী

অজানাকে জানতে ছুটছি অবিরাম...! অল্পদর্শী দুই বছর আগেও সব ঠিকঠাক ছিল সেখানে। কলকারখানায় উৎপাদন, ব্যবসা-বাণিজ্য আর নগরবাসীর ব্যস্ততা সবই চলছিল সমান তালে। শহরের রাস্তা-ঘাট, আর্ট গ্যালারি আর নাইটক্লাবগুলো মুখর ছিল উচ্ছল পর্যটকদের পদচারণায়। কিন্তু হঠাৎ করে কী এমন হয়ে গেল যে, শহরের বড় বড় রেস্তোরাঁ, নাইটক্লাবের মালিকরা ঝোলাতে লাগলেন ‘ফর সেল’ আর ‘ফর রেন্ট’ নোটিশ। ব্যবসা গুটিয়ে নিতে থাকল বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি।

আর বন্ধ হতে লাগল বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানির কারখানাগুলো। কোন্ যাদুমন্ত্রে ফাঁকা হয়ে যেতে থাকল শহরটির রাস্তাঘাট? তবে কি কোনো ভয়ঙ্কর অভিশাপ গ্রাস করল মায়া সভ্যতার উত্তরাধীকারীদের? হ্যাঁ, অভিশাপই বটে! তবে তা কোনো পৌরাণিক অভিশাপ নয়, বর্তমান সভ্যতার এ অভিশাপের নাম ‘মাদক’। বিষাক্ত মাদকের ছোবল আর মাদকব্যবসার অভিশাপেই ভুতুড়ে হতে চলেছে মেক্সিকোর লিওন স্টেটের মন্টেরি জেলার সমৃদ্ধ নগরী ‘ব্যারিও অ্যান্টিগু’। মেক্সিকোর সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয়ের শীর্ষে থাকা অন্যতম এই ব্যারিও নগরী এবং মন্টেরি মোট জিডিপির সাড়ে সাত শতাংশ যোগান দিয়ে থাকে। চার মিলিয়ন অধিবাসীর এই শহরের রয়েছে জাতিসংঘ ও আঞ্চলিক বিভিন্ন সম্মেলন অনুষ্ঠানের গৌরব।

এখানেই রয়েছে মেক্সিকোর বিখ্যাত উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র ‘মন্টেরি ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি’। এছাড়াও শহরটির পরিচিতি রয়েছে মেক্সিকোর ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল পাওয়ার হাউস’ হিসেবে। মেক্সিকোর বেশিরভাগ বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কারখানা ছাড়াও বিশ্বখ্যাত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান জনসন অ্যান্ড জনসন, ওয়ার্লপুল, ক্যাটারপিলার, জেনারেল ইলেক্ট্রিকের কারখানা রয়েছে ব্যারিও এবং এর আশপাশে। ফলে সেখানকার অধিবাসীরা এই শিল্পায়নের ফল ভোগ করছিলেন এবং এক পর্যায়ে শহরটি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। শহরটির সমৃদ্ধ আর্ট গ্যালারি আর রঙিন নৈশজীবন দারুণভাবে আকৃষ্ট করে পর্যটকদের।

দুই বছর আগেও সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০ হাজার পর্যটকের আগমন ঘটত ব্যারিওতে। কিন্তু চিত্রটা দ্রুতই পাল্টে যেতে থাকে ২০১০ সালের পর। মেক্সিকো উপসাগরের ড্রাগ কার্টেল নির্মূলে নিযুক্ত লস জেটাস নামে সাবেক মাদকবিরোধী কমান্ডোদের একটি গ্রুপ ২০১০ সালে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেরাই মাদক-চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে মন্টেরি এলাকায়। তারা অন্যান্য ড্রাগ কার্টেলের মতো শুধু আমেরিকায় মাদক চোরাচালান করেই সন্তুষ্ট থাকেনি। চাঁদাবাজি, কিডন্যাপিং এবং স্থানীয় পর্যায়ে মাদক বিক্রি করে তারা ব্যারিওর পরিবেশকে খুব দ্রুতই ভয়ানক করে তোলে।

অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে ওঠে, যখন তারা বিভিন্ন সংঘবদ্ধ অপরাধ করতে থাকে এবং ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করে। মার্কেটের মতো জনবহুল জায়গায় অপরাধ সংঘটনের ফলে ক্রেতারাও ভয় পেয়ে সরে পড়তে থাকে। আর ব্যবসায় মন্দা দেখে একে একে ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হন ব্যবসায়ীরা। যারা এখনো টিকে আছেন তারাও ব্যবসা বড় করছেন না ভয়ে। মাদকব্যবসায়ীরা নাইটক্লাবের মালিকদের বাধ্য করছে মাদকদ্রব্য বেচাকেনায়।

আবার নিজেরাও লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসায় নেমে স্থানীয় অর্থনীতিতে তাদের ভিত পাকা করে বসছে। বিখ্যাত লা কাসা আমারিল্লা নাইটক্লাবের মালিক, একজন আমেরিকান মহিলাকে দেখা গেল ব্যবসা গোটাচ্ছেন। কারণ তাকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে হুমকি দিয়েছে ড্রাগ লর্ডরা। তার মতো আরো অনেকেই চলে যাওয়ায় ৪০টি নাইটক্লাবের মাত্র ৮টি এখন টিকে আছে ব্যারিওতে। মন্টেরিও এখন পুরোপুরি মাদকব্যবসায়ীদের কব্জায়।

ভয়ে সেখানকার অনেক অধিবাসীই টেক্সাস সিটিতে গিয়ে বাস করছেন। মাদকব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেদের মধ্যেই এখন যুদ্ধ বেধে যায় মাদকব্যবসায়ীদের। ফলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে হামেশাই। ২০১১ সালের আগস্টে এক জুয়ার আড্ডায় টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে নিহত হয় ৫২ জন। চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি মন্টেরির বাইরে পাওয়া যায় ৪৯টি মস্তকবিহীন মৃতদেহ।

এ রকম আরো বহু সংঘর্ষ ও হত্যার ঘটনায় ২০১১ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৬০০ লোক মারা গেছে মন্টেরিও এবং ব্যারিওতে। ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের দিন কাটছে আতঙ্কে। বড় কোম্পানিগুলো ও শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অর্থনীতির চাকাও থমকে গেছে। পুরো শহর যেন ঝিমিয়ে পড়েছে মাদকের নেশায়। তবে আশার বাণী শোনাচ্ছেন লিওনের গভর্নর, ব্যারিওর সাবেক মেয়র ও কিছু জনপ্রতিনিধি।

তারা সবাই মিলে আবার ব্যারিওর হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করতে চান। তবে তাদের প্রচেষ্টা যতদিন সফল না হচ্ছে, ততদিন ব্যারিওর রাস্তাঘাট হয়তো ক্রমেই আরো ফাঁকা হতে থাকবে। আতঙ্ক ঘিরে রাখবে শহরের বাড়িগুলোকে, আর নাইটক্লাবগুলোতে রাতের বেলা ঝলমলে আলোর বদলে জ্বলবে ‘ফর সেল’ লেখা সাদা কালো সাইন। তথ্যসূত্র : এএফপি  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।