আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা কোচিংবাজ শিক্ষকদের সাদা মনে কাদা দেব দুলাল মিত্র ও এম মামুন হোসেন কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা ব্যর্থ প্রমাণে শিক্ষকদের একটি গ্রুপ তৎপর হয়ে উঠেছে। এই ইস্যুতে নানা অপকৌশলে তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলার নীলনকশা তৈরি করছে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সরকারকে সতর্ক করে দিয়েছে। এ সংক্রান্ত গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এ চক্রের বেশ কয়েকজন নেতাকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং কোচিং-বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা প্রণয়নের পর এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারী শিক্ষকরা তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান। গত ১৮ জুন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বাশার-সালাম) সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা না বাড়ানো পর্যন্ত কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর সুযোগ দেয়ার দাবি জানান।

তবে ভেতরে ভেতরে কয়েকজন শিক্ষক নেতা, বিএনপিসহ বর্তমান ১৮ দলীয় দল সমর্থক শিক্ষক নেতারা, তাদের সমর্থক শিক্ষক ও কোচিংবাজরা সম্মিলিতভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার পরিকল্পনা করছেন। এসব পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে, বিভিন্ন স্কুলের আসন্ন দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা ও সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ইচ্ছাকৃত বিলম্ব, পাঠদানে পাঠ্যসূচি সমাপ্তিতে ঘাটতি রেখে পরীক্ষায় অপ্রয়োজনীয় কঠিন প্রশ্ন করা, পরীক্ষাপত্র মূল্যায়নে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কম নাম্বার প্রদান এবং ইচ্ছাকৃতভাবে ফলাফল বিপর্যয় ঘটিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা। এভাবে কোচিংয়ের পক্ষে সাধারণ শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সুশীল সমাজের জনমত সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে ওই গ্রুপটি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, চলতি বছরে অনুষ্ঠিতব্য প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে উদ্দেশ্যমূলক কঠিন প্রশ্ন দেয়া হবে। কঠোরভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্যতার চাইতে কম নাম্বার দিয়ে দেশব্যাপী ফলাফল বিপর্যয় ঘটানো হবে।

এসবই করা হবে গৃহীত নীতিমালাকে ব্যর্থ হিসেবে প্রমাণ করে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার জন্য। ষড়যন্ত্রকারী গ্রুপের পরিকল্পনার মধ্যে আরো আছে, তাদের নিজেদের আত্মীয়স্বজন, মনোনীত ব্যক্তি বা পছন্দের ব্যক্তিদের দিয়ে কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা। ওইসব কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের পড়তে উৎসাহিত করা হবে। যেসব শিক্ষার্থী ওইসব কোচিং সেন্টারে কোচিং করেছে তাদের পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হবে এবং পরীক্ষাপত্রে অতিরিক্ত নাম্বার দিয়ে অনৈতিক সুবিধা দেয়া হবে। ষড়যন্ত্রকারীরা শিক্ষক সমাজের বিভিন্ন যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবি ঐক্যবদ্ধভাবে ঘন ঘন বিভিন্ন ফোরামে তুলে ধরে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেরতে এবং সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার প্রয়াস চালানো হবে।

এছাড়া তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গৃহীত নীতিমালার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সাংবাদিক, সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকদের কাছে প্রচারণা চালাবে। ষড়যন্ত্রের বিভিন্ন দিক তুলে ধরার পাশাপাশি ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কোচিং-বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে গতানুগতিক পাঠদানের পাশাপাশি ডিজিটালাইজড পদ্ধতিতে পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করে শিক্ষার্থীদের সরবরাহ করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকা প্রবাসী সালমান খান প্রতিষ্ঠিত খান একাডেমির ডিজিটাল পাঠদান পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে বিবৃত পাঠকে অ্যানিমেশন করে ধারাভাষ্যসহ উপস্থাপন করলে শিক্ষার্থীরা সহজে বুঝতে পারবে।

উন্নত বিশ্বে কম্পিউটারে অ্যানিমেশন পদ্ধতিতে সচল চিত্র, ভিডিও ধারণ চিত্র, ক্যামেরায় তোলা স্থিরচিত্রের মাধ্যমে পাঠদান করা হয়। এতে সাহায্যকারী শিক্ষকের বা কোচিং সেন্টারের প্রয়োজন হয় না। তৃতীয় বিশ্বের দেশ উগান্ডার শিক্ষা পদ্ধতিতে প্রি-স্কুল থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব বিষয়ের সিলেবাস ডিজিটাল পদ্ধতিতে উপস্থাপনা করা হয়। বাংলাদেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রি-স্কুল থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সব বিষয়ের সিলেবাস-ভিত্তিক ডিজিটাল সংস্করণ প্রস্তুত করে এফএলভি, জিফ, পিএনজি ফরমেটে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অথবা সিডি ডিস্কে বিশেষভাবে শিক্ষার্থীদের পাঠদানে সহায়তা করতে পারে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে বেশকিছু সুপারিশ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকদের বাইরে ব্যক্তি পর্যায়ে পরিচালিত সাধারণ বা একাডেমিক কোচিং বন্ধ করা যেতে পারে। কোচিং প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি প্রচলন করে উচ্চ কর আরোপ কিংবা আইন করে কোচিং সেন্টার পদ্ধতিতে পাঠদান দেশ থেকে তুলে দেয়া যেতে পারে। প্রতিবেদনে বলা হয় প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসকরা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীকে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হন। শিক্ষকরাও একইভাবে নির্দিষ্ট কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীদের পাঠিয়ে পরোক্ষভাবে আর্থিক লাভবান হতে পারেন। এক্ষেত্রে স্কুলে প্রথম শ্রেণী থেকে কলেজের দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদানের একাডেমিক কোচিং পরিচালনা সরকারিভাবে আইন করে বন্ধ করে দেয়া যেতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষকরা বছরের পর বছর একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ফলে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাইরের বিভিন্ন শক্তির সহযোগিতায় একটি সিন্ডিকেট গড়ে বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে লিপ্ত হন। সরকারি চাকরিজীবীদের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের একই প্রতিষ্ঠানে তিন বছরের বেশি সময় না রেখে দেশের যে কোনো স্থানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বদলির নীতিমালা করা যেতে পারে। যদি ক্যাডেট ভর্তি কোচিং, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং, কলেজ ভর্তি কোচিং, শিক্ষক ছাড়া অন্য ব্যক্তিদের পরিচালিত একাডেমিক কোচিং, বিসিএস কোচিং প্রভৃতি চলতে থাকে তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা কোচিং বন্ধ করতে আগ্রহী হবে না। তাই এ ধরনের ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা প্রাতিষ্ঠানিক কোচিং বন্ধের জন্যও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে।

বিপরীতমুখী অসামাঞ্জস্য নীতিমালায় বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষক সমাজকে ক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে বলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে। কোচিং সেন্টার বা বাসায় ব্যাচ পদ্ধতিতে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষাদানকে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অন্যতম অন্ধকার দিক হিসেবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত সব স্তরের অভিভাবকরা টিউশন ফি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। দেখা যায় বাংলা ও ধর্ম শিক্ষার মতো সহজ বিষয়ের জন্যও অভিভাবকরা সন্তানদের কোচিংয়ে পাঠাচ্ছেন। কোচিং দৌরাত্ম্যে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা কোচিংবাজ শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন।

গত বছর সেভ দ্য চিলড্রেন অস্ট্রেলিয়ার সহায়তায় পরিচালিত শিশু সংগঠন চাইল্ড পার্লামেন্টের জরিপে দেখা যায়, ৮২ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে বা কোচিংয়ে অংশ নেয়। জরিপে মন্তব্য করা হয়, বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় গুণগত শিক্ষা দিতে পারছে না। ফলে শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফলের জন্য গৃহশিক্ষক বা কোচিংয়ের শরণাপন্ন হচ্ছে। কোচিং পরিবারের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং এ ব্যয় নির্বাহে অভিভাবকরা হিমশিম খাচ্ছেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কোচিংবাজ শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে অনুপস্থিত থাকেন, ভালোভাবে পাঠদান করেন না, নিজের কাছে কোচিং করতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা, কোচিং না করা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় ইচ্ছাকৃতভাবে খারাপ রেজাল্ট করানো, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষার খাতায় অধিক নাম্বার প্রদান করা অনৈতিক কর্মে শিক্ষকরা জড়িয়ে পড়েন।

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোচিংয়ে পড়াতে পারবেন না। কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ করে শিক্ষকদের বিকল্প আয়ের ও একসাথে দুর্বল শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত পাঠ সহযোগিতার ব্যবস্থা রেখে কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে নীতিমালা-২০১২ প্রণয়ন করা হয়। এ ব্যাপারে রাজধানীর শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জু আরা বেগম যায়যায়দিনকে বলেন, কোচিং বন্ধের বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। অভিভাবকরা কোচিংয়ের পেছনে না ছুটলে কোচিং এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন কোচিং সেন্টার বন্ধের বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে তিনি মনে করেন।

কোচিং বন্ধে ইতোমধ্যে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষককে বলে দেয়া হয়েছে। সূত্র:দৈনিক যায়যায়দিন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.