আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সবচে’ বড় পাখীরা ( The Largest Birds )

প্রবাসী জার্মান শব্দ “ফান্ডেরলুস্ট” (Wanderlust ) এর মানে হল ভ্রমনের নেশা। কথাটা নাকি ইংরেজীতেও ব্যবহার হয় আর তখন উচ্চারন হয় ওয়ান্ডার লাস্ট (Wander = ঘোরাফেরা , Lust= ইচ্ছা বা কামনা) এ সব কিছুই শিখেছি সত্যজিত রায়ের সিনেমা “আগন্তুক”দেখে। সে সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র “মামা’ মনমোহন মিত্রের মত মেধা বা টাকা আমার নেই কিন্তু দেশ ভ্রমনের বাতিক আছে ষোল আনা। গত সপ্তাহে একটা দিন বেশী ছুটি পেয়েই বেরিয়ে পড়েছিলাম । মন্ট্রিল শহরের একটা দর্শনীয় স্থান হল বায়োডোম , যা ছিল ১৯৭৬ সালের অলিম্পিক গেমসের স্টেডিয়াম।

বায়োডোমের অনেক জিনিসের মধ্যে “এলিফ্যান্ট বার্ড” বা হস্তী পাখির ডিম দেখে তো চোখ আমার ছানা বড়া। এত বড় ডিম হয় পাখির? কত বড় ছিল সে হস্তি পাখি? বাসায় ফিরে সে “বিষম চিন্তা” র উত্তর খুজতে যথারীতি শরনাপন্ন হলাম ইন্টারনেটের। ফলে যা হবার তাই হল, অর্থাৎ এলিফ্যান্ট বার্ড খুজতে গিয়ে অন্য কি কি বড় পাখি ছিল বা আছে সে ব্যাপারেও কৌতুহলী হলাম। ছোটবেলায় সিন্দাবাদের ভ্রমন কাহিনীতে পড়েছিলাম রক পাখির গল্প। রক পাখির পায়ে নিজেকে বেধে পাখির সাথে উড়ে গিয়ে কিভাবে সিন্দাবাদ পাহাড়ী দ্বীপ থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন সে গল্প ছিল রীতিমত বিস্ময়কর।

কিন্তু রক পাখি তো রুপকথার গল্প। বিখ্যাত পরিব্রাজক মার্কো পোলো তার ভ্রমন কাহীনিতেও রুখ পাখির বর্ননা দিয়েছেন। ধারনা করা হয় যে মার্কো পোলো যে পাখীর বর্ননা দিয়েছেন তা ছিল হস্তি পাখি বা এলিফ্যান্ট বার্ড। পাখির আকৃতি মাপা যায় তিনভাবে ১) ওজন দিয়ে, ২) উচ্চতা দিয়ে ৩) পাখার দৈর্ঘ্য দিয়ে । মজার ব্যাপার হল যে অধিকাংশ বড় পাখিরা উড়তে পারে না।

যে সমস্ত পাখি উড়তে পারে না তাদের বুকের হাড় সমতল, মুরগী বা অন্য পাখির মত উচু নয়। সমতল বুকের হাড়ওয়ালা উড়তে না পারা পাখিদের বলা হয় র্যা টাইট ( Ratite)। পাখীদের এভলুশানের গোড়ার দিককার এই র্যা টাইট পাখিদের বেশ কিছু আল বিলুপ্ত। আবার বেশ কিছু পাখি আজ ও টিকে আছে। বিলুপ্ত ৫ বড় পাখি- (Five Biggest Extinct Birds) ১) হস্তী পাখী- মাত্র অল্প কিছুদিন আগে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায় চিরকালের বৃহত্তম এই পাখি।

এর উচ্চতা ছিল প্রায় ১০ ফুট এবং ওজন ৪০০ কিলোগ্রামেরও বেশী। আফ্রিকার মাদাগাস্কার দ্বীপে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত দেখা মিলত এই পাখীদের। অন্য সব বড় পাখিদের মত এরাও উড়তে পারত না। পাখীর ডিমের মধ্যে সবচে বড় ছিল এই পাখিদের ডিম, যার সর্বোচ্চ পরিধি ১মিটার পর্যন্ত , দৈর্ঘ ছিল ৩৬ সেঃমিঃ এবং আয়তন ১৬০টা মুরগীর ডিমের সমান। এদের বৈজ্ঞানিক নাম হল আইপিয়োরনিস আর সবচে বড় প্রজাতির নাম ছিল আইপিয়োরনিস ম্যাক্সিমাস।

(Aepyornis maximus )। ফলমূল, গাছের পাতা খেয়ে বাচত এরা অর্থাৎ তারা ছিল তৃনভোজী। ২) মোয়া- মোয়া পাখিদের বাড়ী ছিল নিউজিল্যান্ডে। আজ থেকে ৭ কোটি বছর আগে আন্টার্কটিকা মহাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দ্বীপরাস্ট্র নিউজিল্যান্ড, এই দ্বীপে ছিল না কোন শিকারী প্রানী। ফলে ভাল ভাবেই ৮ লক্ষ বছরের ও বেশী সময় ধরে রাজত্ব করে চলেছিল মোয়া পাখি।

১০ম শতাব্দীতে প্রশান্ত মহাসাগরের অনান্য দ্বীপ থেকে মাওড়িরা বসতি স্থাপন শুরু করে। সুশ্বাদু মাংশের সহজলভ্য উৎস হিসেবে পেয়ে যায় মোয়া পাখিদের। নির্বিচারে চলল পাখি নিধন। ফলে ১৪০০ সালের দিকে অর্থাৎ এই দ্বীপে ইউরোপীয়দের পা পড়ার আগেই মোয়া পাখি শুন্য হয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। ধারনা করা হয় যে নির্বিচার শিকার এবং বনজঙ্গল উজাড় হওয়ার কারনে বিলুপ্ত হয়ে যায় মোয়া পাখি।

এরা উড়তে পারত না । অন্য র্যা টাইট পাখিদের ছোট হলেও ডানা থাকত, এদের তা ও ছিল না। পা থেকে মাথা পর্যন্ত উচ্চতা হত ১২ ফুট পর্যন্ত এবং ওজন থাকত ২৫০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত। এরা ছিল তৃনভোজী। প্রায় ১১ প্রজাতির মোয়া পাখি পাওয়া যেত ।

এদের মধ্যে সবচে’ বড় প্রজাতি ছিল ডাইনরনিস ম্যাক্সিমাস (Dinornis maximus ) ৩) থান্ডার বার্ড- আজ থেকে দেড় কোটী থেকে ৩০ লক্ষ বছর আগ পর্যন্ত প্লিওস্টিসিন এবং অলিগোস্টিসিন যুগে অস্ট্রেলিয়াতে বাস করত এই প্রাগ ঐতিহাসিক পাখি। কেউ কেউ দাবী করে থাকেন এদেরকে সর্বকালের সর্ববৃহৎ পাখী হিসেবে। এদের বৈজ্ঞানিক নাম ড্রোমোরনিস এবং সবচে বড় প্রজাতি হল ড্রোমোরনিস স্টার্টোনি (Dromornis stirtoni)। উচ্চতায় এরা হত ১০ ফুট এবং ওজন ২৫০ থেকে ২৬০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত। এরা ছিল সম্ভবতঃ তৃনভোজী।

অস্ট্রেলেশিয়া অঞ্চলের ইমু বা কেশোয়ারীদের সাথে চেহারার মিল ছিল এদের। শিল্পির তুলিতে ৪) টেরর বার্ড- এদেরকে ফোরুসরাইকোস নামেও ডাকা হত। আজ থেকে ১ কোটী ২০ লক্ষ বছর আগে মধ্য মায়োসিন যুগে দক্ষিন আমেরিকার সমতল ভুমিতে বাস করত এই পাখি। এরা ছিল মাংশাসী। শিল্পীর আঁকা ৫) জায়ান্ট টেরাটর্ন- আজ থেকে ৬০ লক্ষ বছর আগে মায়োসিন যুগে বাস করত উড়তে পারা এই পাখি।

এদের আবসভূমি ছিল আর্জেন্টিনা , সেখান থেকেই এদের বৈজ্ঞানিক নাম আর্জেন্টাভিস ম্যাগনিফিসিয়েন্স (Argentavis magnificens ) । উড়তে পারা পাখিদের মধ্যে সবচে বড় হল এই পাখি। সর্বোচ্চ দুই মিটার পর্যন্ত উচু, ৭০ থেকে ৮০ কিলোগ্রাম ওজনের এই পাখির ডানার দৈর্ঘ্য ছিল ২৩ ফুট পর্যন্ত। শিল্পির আঁকা টিকে থাকা ৫ বড় পাখি- ( Five Biggest Extant Birds) ১) উট পাখি ( The Ostrich -Struthio camelus ),পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা সবচে’ বড় হল উঠপাখি। আফ্রিকা মহাদেশের সমতল তৃনভূমিতে এবং মরু অঞ্চলেএদের বাস।

এরাও উড়তে পারে না কিন্তু খুব দ্রুত দৌড়াতে পারে, ঘন্টায় ৭০ কিলোমিটার বেগ পর্যন্ত। এরা সর্বভুক অর্থাৎ ঘাস ফলমূলের পাশাপাশি এরা পোকা মাকড়, ছোটখাট প্রানীর মাংশও খেয়ে থাকে। এদের পা আত্মরক্ষার কবচ। দু আঙ্গুল ওয়ালা ধারালো নখের পা দিয়ে জোরসে লাথি দিয়ে সিংহ এবং হায়েনাকেও কুপোকাত করে ফেলে। প্রচলিত ভ্রান্ত ধারনা হল যে এরা উটের মত বালিতে মুখ লুকায়।

বাস্তবতা হল বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে এরা মাটিতে শুয়ে পড়ে মাথা নীচু করে রাখে । এদের উচ্চতা হয় ৭ থেকে ৯ ফুট পর্যন্ত এবং ওজন হয় ১০০ থেকে ১৬০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত। উটপাখি ৩০ থেকে ৪০ বছর বাচে। উট পাখির চোখ ডাঙ্গায় বসবাসকারী প্রানীদের মধ্যে সবচে বড় (ব্যাস পাঁচ ইঞ্চি মত)। ১০ -১২ টা উটপাখি দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করে।

এদের ডিমের আকারও বড় –প্রায়২৪ টা মুরগীর ডিমের সমান। দৌড়ানোর সময় এরা লম্বা লম্বা পা ফেলে। এক পা থেকে আরেক পা ফেলার দৈর্ঘ্য ২৩ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। ২) এমু পাখি- ( The Emu Dromaius novaehollandiae ) দ্বিতীয় বৃহত্তম পাখি এমু ,অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পাখি । বন্য পরিবেশে অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে এদের সবচে বেশী দেখা যায়।

এরা পৃথিবীতে বেচে আছে ডাইনোসরদের যুগ থেকে। সমতল তৃনভূমি বা খোলামেলা বন জঙ্গলে বাস করে। এরা যাযাবর অর্থাৎ ঘুরে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে । এমু র্যা টাইট গোত্রের অর্থাৎ এরাও উড়তে পারে না এবং বেশ দ্রুত দৌড়াতে পারে(ঘন্টায় সর্বোচ্চ ৪০ মাইল পর্যন্ত) এবং দক্ষ সাতারু। এমু খুব শান্তশিস্ট এবং উৎসুক পাখি।

উট পাখির মত পা দিয়ে এরা আত্মরক্ষা করে থেকে কিন্তু এদের পায়ে থাকে ধারালো নখওয়ালা তিনটে আঙ্গুল । এদের শরীর বাদামী রঙের পালকে ঢাকা, ২ মিটার পর্যন্ত উচু হয়ে থাকে, এবং সর্বোচ্চ ওজন হয় ৬০ কিলোগ্রাম। বাচ্চা দেওয়ার সময় এরা বাসা বাধে। মা এমু ডিম দেওয়ার পর পুরুষ এমু ডিমে তা’ দেয়। এই সময় তারা ডিম ছেড়ে নড়ে না এমন কি খাওদাওয়াও করে না, পায়খানা প্রস্রাব করে ডিমের উপর বসেই।

এরা গাছপালা ফলমুল,পোকা মাকড় সবকিছুই খেয়ে জীবন ধারন করে অর্থাৎ এরা সর্বভুক। এক সময় সারা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে পাওয়া গেলেও কোন কোন এলাকার এমু পাখি আজ বিলুপ্ত, যেমন তাসমানিয়ান এমু এবং ক্যাঙ্গারু দ্বীপের এমু পাখি। প্রায় ৫ লক্ষ এমু পাখি বসবাস করে অস্ট্রেলিয়াতে, আর সারা পৃথিবীর চিড়িয়াখানাতে বসবাস আরো বেশ কিছু এমু পাখির। ৪) রিয়া পাখি-( The rheas -Rhea americana, Rhea pennata ) দক্ষিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু,চিলি উরগুয়ে প্রভৃতি দেশে দেখা মেলে রিয়া পাখিদের। এরাও র্যাpটাইট গোত্রের এবং উড়তে পারে না।

সমতল তৃনভুমির খোলামেলা যায়গায় বাস করতে পছন্দ করে। দুই ধরনের রিয়া পাখির দেখা মেলে গ্রেটার এবং লেসার রিয়া। রিয়ারা সর্বভুক, গাছের পাতা, পোকা মাকড়, ছোট ছোট প্রানী ব্যাং সাপ ইত্যাদি খেয়ে থাকে। এরা ১.৭ মিটার পর্যন্ত উচু এবং ৪০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের হয়ে থাকে। স্ত্রী পাখি ডিম পেড়ে চলে যায় আর বাসায় বসে ডিমে তা দেয় পুরুষ পাখি।

ক্রমশঃ কমে আসছে রিয়া পাখির সংখ্যা। International union for conservation of nature (IUCN) এর তালিকায় রিয়া পাখি ঝুকিপুর্ন প্রজাতি। ৫) কোরি বাস্টার্ড (The Kori Bustard (Ardeotis kori) ). আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিনাঞ্চলের দেশ বোতসোয়ানা, জাম্বিয়া নামিবিয়া, জিম্বাবুয়ে, প্রভৃতি দেশে দেখা মেলে এই পাখিদের। এরা ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চতার, ২০ কিলোগ্রাম পর্যন্ত ওজনের হয়ে থাকে এবং ডানার দৈর্ঘ হয় ৮-১০ফুট পর্যন্ত। ডানার দৈর্ঘে জায়ান্ট এলবাট্রস পাখি সবচে’ বড় হলেও ওজনের দিক দিয়ে কোরি বাস্টার্ড (কারো কারো মতে দক্ষিন আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালার শকুন বা আন্দিজ কনডর) বৃহত্তম উড়তে পারা পাখি।

সূত্র- ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এনিম্যাল প্লানেট ডিস্কভারী চ্যানেল উইকিপেডিয়া। বিবিসি ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।