আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোচিং নিয়ে কচকচানি!!

কথা কম বলতে ভালবাসি। দীর্ঘদিন হয়ে গেছে কোচিং এ পড়াই। যখন কোচিং বন্ধ করার বিষয়টা সামনে চলে আসে তখন কিছু প্রশ্ন আমার মাথায় কাজ করছিল। তাই কিছু আলোচনার প্রয়োজন মনে হল। আমাদের দেশে মোটামুটি তিন চার ধরণের কোচিং আছে।

১। একাডেমিক কোচিং(ই। হক, ম্যাবস) ২। এডমিশন কোচিং(ইউসিসিস, ওমেকা, উদ্ভাস) ৩। প্রাইভেট কোচিং(বিভিন্ন শিক্ষকদের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান) ৪।

প্রফেশনাল ট্রেনিং(ইংরেজি স্পোকেন, কম্পিউটার সম্পর্কিত) এই কটাই আমার চোখে পড়েছে সাধারনভাবে। এর প্রতিটাই কিন্তু গত দুই দশকে আমাদের দেশে ছত্রাকের মত বিস্তৃতি লাভ করেছে। একটা জিনিষ তখনই বিস্তার করতে পারে যখন তার বস্তুগত ভিত্তি পরিবেশে বিরাজ করে। বীজ শুধু মাটি পেলেই বিস্তার লাভ করে। দেশের পাবলিক বলি আর প্রাইভেট বলি উভয় প্রকার স্কুল কলেজের পড়াশোনা এমন যায়গায় চলে গিয়েছে যে দেশের সেরা স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরাও কোচিং এ যাচ্ছে।

কিন্তু কেন? গত দুই দশকে শিক্ষকতার পেশায় যে ধ্বস নেমেছে তার ফলাফল হচ্ছে এই কোচিং। শিক্ষকতার মত একটা পেশায় এখন যারা যাচ্ছেন তার বড় অংশটাই বাস্তবে পেটের দায়ে। আমি এমন অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে চিনি যারা শিক্ষকতায় আগ্রহী কিন্তু সামাজিক বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে এই দিকে ভুলেও আসবেন না। এর ফলাফল কি? শিক্ষকতা একটা চাকরি ছাড়া আর কিছু না। মাত্র কিছু দিন আগে সরকারি হরগঙ্গা কলেজের একজন শিক্ষকের সাথে বাকবিতন্ডার সময় তাকে বলতে শুনি, আগে আমি সরকারি ক্যাডার, তারপরে শিক্ষক! এটা হচ্ছে উচ্চশিক্ষিতদের অবস্থা।

জ্ঞান কবে ক্লাশের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে শ্রেণিকক্ষ থেকে... কিন্তু এই পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়ে যে ভাগাড়ে গিয়ে জুটেছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, সেটাই বিভিন্ন রকমের নাম নিয়ে শুরু করেছে কোচিং ব্যবসা। স্কুল কলেজের দৈন্য পূরণের বাণিজ্যিক সমাধান হয়েছে একাডেমিক কোচিং। এই দৈন্য শিক্ষার্থী-শিক্ষক-প্রতিষ্ঠানিক আয়োজন-সিলেবাস-কারিকুলাম ও সামাজিক চিন্তা চেতনার। শিক্ষার্থীর দৈন্য আসে সবার শেষে কারণ তারা বাস্তবে শিকার মাত্র। শিক্ষকতা পেশায় উপার্জন সম্ভবত ঢাকা শহরের রিকশাচালকের চেয়েও কম।

প্রাথমিক শিক্ষক(অনেক ক্যাটাগরি আছে) সরকারি স্কেলে ৫২০০ টাকা পান, আর রিকশাচালক দিনে গড়ে ৩০০টাকাx২৫দিন ৭৫০০ টাকা। সম্মানের তো একটা অর্থনৈতিক ভিত্তি চাই, নাকি? পত্রিকায় খবর এসেছে স্কুল শিক্ষক ধান কাটার মৌসুমে মাঠে নেমে যান। আমি ধান কাটতে নামাকে তুচ্ছ করছি না। কিন্তু এই বেচারা শিক্ষকদের সামনে কোচিং ব্যবসা ছাড়া আর কিছু কি আমরা খোলা রেখেছি? প্রাইভেট কোচিং এর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকটি হচ্ছে সাংস্কৃতিক। এটা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে একটা ব্যবসা আর মুনাফার সম্পর্কে পরিণত করেছে।

সরকারি যে রেগুলেশন আসলো ১০জনের বেশি পড়ানো যাবে না...... টাইপের তাতে দেখলাম শুধু ছোট ছোট এই প্রাইভেট শিক্ষকদের উপর দিয়ে হম্বি তম্বিটা চলে গেলো! সর্বশেষ শুনলাম ঢাকায় স্বনামধন্য শিক্ষকরা ১০ জনের ব্যাচ পড়াচ্ছেন ১০০০টাকার যায়গায় ৩০০০-৫০০০টাকা নিয়ে! লাভের গুড় কে খাইলো??? void(1); আডমিশন কোচিং হচ্ছে একটা লুটপাটের আসর ছাড়া আর কিছুই না। আমি নিজে এরকম একটা জায়গায় পড়াই। মাত্র তিন মাস পড়িয়ে ৮-১৫হাজার টাকা নেয়া হয় স্রেফ অসহায়ত্বকে পুঁজি করে। কি পড়ানো হয় আর কি কোচিং দেয়া হয় তা লিখতে গেলে রাত ফুরিয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা যারা এখানে পড়ান তারা একটা বড় অংশ এখানে এসে অতি সস্তায় শ্রম বিক্রি করেন আবার কেউ টাকার নেশায় নিজের পড়া শোনা ছেড়ে এই ব্যবসায় কাঁচা টাকার নেশায় ডুবে যান।

যেহেতু আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক আর বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যেখানে প্রায় ৮০% শিক্ষার্থী ঝরে যাবেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সিট সংকটের কারণে সুতরাং জমি বিক্রি করে মানুষ তার সন্তানের জন্য এই ইনভেস্টমেন্ট এ নামতে তো বাধ্য। যদি কোচিং সত্যি সত্যি বন্ধ করার ইচ্ছাই থাকতো তাহলে সবার আগে এইটা পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া উচিত। হাতে গোণা কিছু কোচিং ব্যবসায়ী যারা কোটি কোটি টাকা কামিয়েছে তারা ছাড়া আর কারো কোনো ক্ষতি এতে হবে না। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম, অ্যাডমিশন কোচিং দিনে দিনে ফুলেফেঁপে বাড়ছে। ফার্মগেট মোড়ে দাঁড়ালে চারিদিকে দেখি ইউসিসির পাঁচটা ছয়টা বিশাল দালান, সাইফুর'স এ ছেয়ে গেছে সারাদেশ! এই টাকা কোথা থেকে এলো? বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এসে বলতে পারবেন, 'এই কোচিংগুলো আসার পর থেকে আমরা আরো উন্নতমানের শিক্ষার্থী পাচ্ছি!' ক্লাশ ১ থেকে প্রায় ১২ বছর ইংরেজি পড়ে আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে দুইটা শুদ্ধ বাক্য বলতে পারেন না, এটা সত্য।

শিক্ষা বোর্ডের যারা গত ৪০ বছর এই সিলেবাস-কারিকুলাম বানিয়েছেন তাদের একটা ট্রাইব্যুনালে নিয়ে বিচার করা উচিত না দেশের কোটি কোটি টাকা নষ্ট করে 'কমিউনিকেটিভ' টাইপের ফালতু গারবেজ উৎপাদন করার জন্য? এর ফলাফল হচ্ছে সারা দেশ ছেয়ে গিয়েছে বিভিন্ন ধরণের ইংরেজি শিখুন- স্পোকেন- আর্ট কোচিং- দিয়ে অল্টারনেটিভ কোচিং এর একটা লাভজনক ধারা শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে গিয়েছে। অনেকে এই শিক্ষামন্ত্রীর প্রশংসা করেন । ভালো। কিন্তু মাদ্রাস-বাঙ্গলা বা জেনারেল লাইন- ইংলিশ মিডিয়াম এই ধারাগুলা সমাজে যে বিভক্তির সৃষ্টি করে সেই জিনিষে হাত দেয়ার ক্ষমতা বা মনোবাঞ্ছা কি তার আদৌ আছে? পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা যে ক্যারিয়ারিজমের অন্ধ গন্ডারের পিঠে সওয়ারি হয়ে ছুটছে সেই অন্ধ গন্ডারে দৃষ্টি দানের ক্ষমতা কি তার আছে? তাই আমি তার কাছে কিছু আশা করি না। আশা করাটা ভূল বলে মনে করি।

একটা সমাজ যে দিকে ছুটছে শিক্ষা ব্যবস্থাও তার পিছু পিছু ছুটবে সেটাই স্বাভাবিক। বিপ্লবের পরে দেশ গড়ার সময় মানুষ স্বপ্ন দেখে বিজ্ঞানী হবে- শ্রম দিয়ে মেধা দিয়ে দেশকে বদলে দিবে । সেটাই স্বাভাবিক। অর্থ যে সময়ে সব কিছুর অর্থ নির্ধারণ করে সেই সময়ে শিক্ষা বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে কোচিং-এ আশ্রয় নিবে, এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধাচারণ করার আগে একটু ভাবা দরকার, কি চাই, কেন চাই।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।