আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি তোমাদের সুখে দেখতে চেয়েছি, তা আমি পেয়েছি

আমি নাই। এত কিছুর পরও যখন পারিবারিক সংসারে শান্তি আসছে না, তখন আর বেঁচে থেকে লাভ কি? মরেই যাব। আর পারছি না, সংসার জীবনের সাথে যুদ্ধ করে। কিভাবে মরব, গাছে ঝুলে গলায় ফাঁস দিয়ে? নাকি গলায় কলসি বেঁধে পানিতে পড়ে? না, এ পদ্ধতি সঠিক নয়, আত্মহনন ইসলাম সর্মথন করে না। তবে কিভাবে বুঝে পাচ্ছি না।

হ্যা! পেয়েছি, নিজেকে অনেক টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেব। আর এ টাকা আমার পরিবারকে দিয়ে সুখী করে যাব। কেউ বুঝবে না। টাকাগুলো দিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেব। এর বিনিময়ে আমিও পূণ্য পাব।

কে কিনবে আমায়? আমি কিভাবে বলি, আমি বিক্রি হব। পাচারকারীদের সাথে দেখা করব, তাদেরে বলব আমাকে কিনবে? এর বিনিময়ে আমায় ১০ লাখ টাকা দিলেই চলবে। ঘটনাক্রমে এক পাচারকারীর সাথে দেখা হয়, আমি তার কাছে আমার বিনিময়ে ১০ লাখ টাকা চাই। সে আমার কথাতে রাজি হয়। আগামীকাল টাকা নিয়ে কাকপুর কবরস্থানের পাশে একটি পাট খেতে আসবে সে।

সেখানে আমাকে টাকাগুলো দেবে। কিন্তু পরক্ষণেই মাথায় চিন্তা আসল, আরে! আমি যে পদ্ধতি গ্রহণ করছি, তাও তো অনেক কষ্টের ব্যাপার। পাচারকারীরা আমায় নিকট প্রতিবেশী ভারতের কাছে বিক্রি করবে ঠিকই, তারা তো আমায় মারবে না। সময়ে সময়ে আমার শরীর থেকে মূল্যবান জিনিসগুলো খুলে নেবে, আর আমি তা সহ্য করতে পারব না। না, এটাও করব না।

এটাও এক ধরণের আত্মহনন। মহাপাপ। এর অনুমোদন ইসলাম দেয় না। তাহলে কি করব? কোন টার্গেটই তো সফল হচ্ছে না। ব্যর্থ টার্গেট নিয়ে তো এগুনো যাবে না।

এমন একটা টার্গেট বুকে স্থির করব, আর যাতে নড়ছড় না হয়। কি করব? কি করব? ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে একটা রাস্তা আমায় খোঁজে বের করতেই হবে। একটা আইডিয়া আমার মাথায় এসেছে। ব্যাংক থেকে লোন তুলব।

বিরাট অংকের না হয়, মাঝারি সাইজের হতেই হবে। বেলা ২টা। ব্যাংক খোলা। যাওয়া যাক এবং এব্যাপারে ম্যানেজারের সাথে সবকিছু আলাপ সেরে আসব। এ মনোভাব নিয়ে ব্যাংকে ঢুকে দেখি।

ম্যানেজার সাহেব এককোণে বসে পা ঝুলাচ্ছে আর মরণব্যধি সিগারেট টানছে মনের আনন্দে। আমি গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলি এবং পরেরদিন ১০টায় আসার আশ্বাস দেন। আমি ম্যানেজারের দেয়া আশ্বাসমতে ব্যাংকের বেশ কয়েকটি শর্ত অনুযায়ী বাড়ি-খেতের কাগজপত্র নিয়ে ম্যানেজার বরাবর হাজির হলাম। আলাপ আলোচনার পর ১০ লাখ টাকা দিতে ব্যাংকের ম্যানেজার সাহেব রাজি হলেন। একটি কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে আমায় ১০ লাখ টাকা দিয়ে দেন ম্যানেজার সাহেব।

আমি সোজা বাড়ী চলে আসি। এসে বললাম মা, আমি আজ অনেক বড় ধনী। আর আমাদের দুঃখে মানবেতর জীবন যাপন করতে হবে না। এই দেখো ১০ লাখ টাকা! মা-বাবা, ভাইবোন সবাই হাজির। এত টাকা! এসব দেকে আনন্দে আত্বহারা।

সবাই বলে উঠল, আর আমাদের দুঃখের দিন নেই। সুখের পাখি আপনাআপনি ধরা দিয়েছে। এখন বোনা করে মজা করে জীবন কাটাব। কিন্তু কেউ জানতে চাইল না, এত টাকা কোথায় থেকে এল। সবাই লোভের মোহে পড়ে অন্ধ হয়ে গেছে।

এ টাকা হালাল না হারাম, তারা কিছুই জানতে চাইল না আমার কাছে। আর আমিও এ সম্পর্কে তাদের কিছুই বলিনি। আমার পরিবারের জীবনের মুখে হাসি দেখতে তাদের রুচিমত একটা অভূতপূর্ব অট্্রালিকা তৈরী করে দেই। গ্রামের অন্যদের অট্রালিকার চেয়ে অন্যরকম। যাতে তাদের দৃষ্টি অন্যদিকে না যায়।

এতেই সন্তুষ্ট থাকে তারা। পরে অন্যের কাছে বন্ধক রাখা তাদের জমিজমাগুলো এনে দেই। বাজারে একটি কম্পিউটার দোকান উদ্ধোধন করে দেই। সেরা দোকান। কাস্টমার যদি কম্পিউটারের কিছু কিনতে আসে, তাহলে এটাতেই আসতে হবে।

কারণ, অন্য দোকানের চাইতে তার দোকানে সব জিনিস পাওয়া যায়। পরিবারের সবাই পেটপুড়ে তিনবেলা খেয়ে-দেয়ে নাদুশনুদুশ হয়ে যাচ্ছে। সবার মুখে হাসির বন্যা বইছে। আর এ মনোরম কল্পনাতীত চিত্র দেখে আমি আনন্দের সাগরে ভাসছি। কিন্তু এদিকে, সময় এল ব্যাংকের লোন শোধ করার।

টাকা শোধ করার মতা যে আমার কাছে নেই, এখন আমি কি করব? এভাবে দিন কাটতে লাগল পলাশের। টেনশনে তার মুখটা ছোট হয়ে গেছে। মনমরা নয়, তবে মুখে তেমন হাসি দেখা যায় না। পরিবার বা মানুষের সামনে ঠিকই মুখটাকে সজীব করে তুলার চেষ্টা চালিয়ে একটু হাসি দেয় কোনমতে। তবে কিছু মানুষ রয়েছে, যারা পলাশের অবস্থা ঠিকই টের পেয়ে যায়।

সময় পার হয়ে গেলে ব্যাংক থেকে পলাশের বাড়ীতে নোটিশ আসে। নোটিশ পড়ে শুধু অশ্র“সিক্ত হয়ে ফ্যালফ্যালিয়ে নোটিশের উপর তাকিয়ে থাকে, আর চোখের নোনা জলে ভিজে যাচ্ছে নোটিশটি। কয়েক মাস পর রাষ্ট্র নিজে বাদী হয়ে পলাশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে । কয়দিন পালাবে, একদিন তো তাকে ধরা দিতেই হবে। আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু, পরশু নয় তরশু করতে করতে একদিন পলাশ ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।

যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দেয় আদালত পলাশকে। পলাশ স্বর্গীয় অনুভূতির সুভাস পেয়ে বরণ করে নেয় কারাদন্ড। কে দেখে তার এ করুণ অবস্থা, এ মহৎ মানুষটির ব্যাকুলতা। এদিকে তার পরিবার শান্তির সুখে হাবুডুবু খাচ্ছে জীবন সাগরে মাতাল হয়ে। যখন জানতে পারল পলাশ জেলে, তখন তাদের টনক নড়ে।

সব ঘটনা জানতে পেরে পরিবারের সবাই হতবাক! কেউ বুঝতে পারেনি তখন। এখন কান্নার রুল পড়ল ঘরজুড়ে। এর সাথে কাঁদে আকাশ-বাতাস নিরবে। হায় মাতম করা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিল না। এক নজর বড় ছেলেটিকে দেখার জন্য মা বাবা ছুটে হবিগঞ্জ জেলে।

তাদের সাথে তাদের ছেলে সন্তানেরাও। নিয়ম অনুসারে টিকিট কেটে অপেক্ষা করতে থাকে ছেলের জন্য। পলাশ এসে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে চোখের পানি ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে দেয়। কোন কথা না বলে তারাও কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এক পর্যায়ে কাঁন্না থামিয়ে এমন কাজ করতে গেলে কেন বাবা- বলছিলেন পলাশের মা।

বারবার একই কথা। মা আমি তোমাদের শান্তি-সুখ দিতে পারিনি। আমায় ক্ষমা কর। তোমাদের চাহিদা পূরণ করতে পারিনি আমি। তোমাদের সুখ এবং শান্তিতে দেখার জন্যই আমি একাজ করেছি।

আমার জীবনের মায়ার প্রতি তাকাইনি। আমি একজন রাখাল হিসেবে আমার দায়িত্বটা পালন করেছি মাত্র । মা আমি তো সব সময় তোমাকে ইসলামি কথাবার্তা শুনাতাম। এখনো শুনাচ্ছি, জান না মা, রাসুল সা. বলেছেন, প্রত্যেকই প্রত্যেকের পরিবারে একজন রাখাল মানে অভিভাবক? কাল কিয়ামত দিবসে আমায় কি জবাব দিতে হবে-সেই চিন্তায় আমি এমন কাজ করেছি। আমি কষ্টভোগ করলেও যাতে তোমাদের দুনিয়া এবং আখেরাতে কোন কষ্ট না হয়, সেজন্য একাজ করেছি।

দেখার সময় শেষ হয়ে গেলে সেলের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। আড়াল হয়ে যায় তাদের থেকে পলাশ। এই আড়াল তাদের মাঝে জীবনের জন্য আড়াল হয়ে যাওয়া। তাদের মাঝে আর পলাশ ফিরে আসবে না। যদি বেঁচে থাকে জেলজীবনে, তাহলে ফিরে আসার সম্ভবনা রয়েছে।

নইলে সেখানেই তার মরণ, কাপণ-দাপণ হবে। পাঠক মহল, নিশ্চই চিন্তায় পড়েছেন, কোন কারণে পলাশ এত বড় জীবনের ঝুকি নিয়েছে? কি তার এত কষ্ট? তাকে পাহাড়সমতুল্য কষ্ট বহন করতে হয়েছে কেন? জানি না, পাঠক বন্ধুদের মনে রেখাপাত করবে কি না? তবে যা সত্যি তাই বলছি, পড়ালেখার পর পলাশ কর্মজীবনে পা দেয়। তার বাবার কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারেনি পলাশ। পলাশের বাবা শিক্ষিত হলেও কিন্তু ধন পুঞ্জিভূত করার অভিনব কায়দা তার জানা ছিল না। তাকলেও হয়তো কাজে লাগাতে পারিনি।

এর পেছনে একটা মেনে নেয়ার মত কারণ খোঁজে পেয়েছি, আর তা হয় উনার আয়ের পরিবর্তে ব্যায়ের খাতটা বেশামাল অতিরিক্ত। এক ধরণের দিনমুজুরের মত আয়। দৈনিক আয় যদি ৩ শ’ টাকা হয়, তাহলে ব্যয় হচ্ছে নূন্যতম ৫০ শ’ টাকা। এত খরচ করার কারণ, তার মাঝে বাস করে এক বিলাসী রাক্ষস। ফলে ঐ রাক্ষসকে তার ইচ্ছেমত পানাহার করাতে হয়।

শুধু তিনি একা নন, পরিবারের সবাই একই টাইপের। বংশের আভিজাত্যের অহংকার না থাকলেও চলাফেরায় এবং খাওয়া-দাওয়া যেন এক রাজবাড়ীর লোকসকল। কিন্তু পরিবেশগত দিকটা তাদের নিম্নমানের। বাড়ীÑঘর ভাঙ্গাচুড়া এবং অনুপযোগী। এনিয়ে পলাশের বাবার তেমন টেনশন নেই।

শুনতাম, খাও দাও ফুর্তি কর, টাকা না থাকলে কর্জ কর। এ মনোভাবের লোক ছিল পলাশের বাবা। যার কারণে সংসার জীবনে তেমন উন্নতির শিকড়ে পৌছতে পারিনি। এ উন্নতির শিকড়ে না পৌছতে পারলেও ছোয়া লাগাতে পারবে ভেবে পলাশ বাবার নিস্ক্রিয় সংসারের মহান দায়িত্বটা নিজের কাধে তুলে নেয়। এমনকি দোকান-বাড়ীর সব দায়িত্ব পলাশই দেখাশুনা করে।

কর্মজীবনের রণক্ষেত্রে মরণপণ যুদ্ধ করেও পলাশ জিতে উঠতে পারিনি। উন্নতির ছোয়া লাগাতে পারিনি পলাশ। কিন্তু একটা হয়েছে, যুদ্ধের ময়দানে তার বাবার মত হারেনি। ঠিকে রয়েছে। ৫ বছর লাগাতার সংসার কাজে ব্যস্ত সময় কাটায়।

এ জীবনযুদ্ধে ঋণ নামক তলোয়ারের আঘাত পলাশের উপর পড়েনি। কিন্তু এর মাঝে থামিয়ে দিল ফের তার মা-বাবা। এগিয়ে যেতে দিল না। মা বাবা পেছন থেকে ডাক দেয়ায় পলাশের মাথায় ভেঙ্গে পড়ে পুরো আসমানটা। মা বাবা এবং ভাইবোনদের লাগামহীন চাহিদা মেটাতে নদীর তীর ভাঙ্গার মত যুদ্ধে পলাশ হারিয়ে যেতে বসেছে।

এক সময় পলাশের নিজস্ব তহবিল শূন্য হয়ে যায়। পরে পলাশ বাধ্য হয়ে সেই পথ বেছে নেয়, যা তার জীবনকে থামিয়ে দিয়েছে জেলখানার জীবন পর্যন্ত। পাঠক বন্ধুরা বলেন তো, দেখি পলাশের এছাড়া কি কোন উপায় ছিল? দুনিয়ার জীবনে তাদের সুখে দেখতে চাইছিল বলেই পলাশের এ করুণ পরিণতি। জেলে থেকেও পলাশ আত্মিকভাবে প্রশান্তি পাচ্ছে। কারণ, আজ তো তার পরিবারের কেউ অসুখী নয়।

কয়েক বছর পরে একখান চিঠি আসে- প্রেরক পলাশ, হবিগঞ্জ জেল হতে। চিঠি খুলে দেখে একটা লাইন লেখা ছাড়া আর কিছুই লেখা ছিল না, চিঠিতে লেখা রয়েছে “ আমি তোমাদের সুখে দেখতে চেয়েছি, তা আমি পেয়েছি”। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.