আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেভাবে আপাত নিরীহ ছেলেগুলোকে কারখানায় ঢুকিয়ে একেকটি উন্মাদ ধর্মান্ধ বানানো হয়---

মনে প্রাণে ঘৃণা করি রাজাকার। পাকিস্তানের দালালি করার শখ থাকলে এখানে ল্যাদাতে না আসার জন্য বলা হচ্ছে। আমি যখন ২০০৩ সালে একটা সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হই তখন আমাদেরকে ওখানে যেয়ে প্রথম দশ মাস থাকতে হয়েছিল কমন রুমে। গোয়াল ঘরের মতো বিশাল একটা রুমে প্রায় ২৫-৩০জন একসাথে মাটিতে বিছানা করে। কারন ছিল ছাত্রাবাসে পর্যাপ্ত সিটের অভাব।

আমার মেডিক্যাল কলেজটির নাম বলছিনা কিন্তু অনেকেই হয়তো বুঝবেন যে ৫-৬ ডিগ্রী তাপমাত্রা শীতকালে কোন অঞ্চলে থাকতে পারে। এবারে একবার ভাবুনতো ঐরকম শীতে আপনাকে (যে কিনা ঢাকা শহরের এই গরম আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা) যদি রাতের পর রাত ফ্লোরিং করে থাকতে হয় কেমন লাগবে? এর উপর সপ্তাহে অন্তত দু'তিন বার মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে সিনিয়রদের র‍্যাগিং তো আছেই! এতোসব কথা এজন্যে বললাম যে--- আমরা যারা সাধারণ ছাত্র ছিলাম তারা এই যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে যেতাম ঠিকই কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা কিছু ছেলেকে একটা উগ্র রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের সিনিয়ররা আগেই টার্গেট করতো, ভর্তির সময় কিংবা তারও আগে যখন ওদের পলিটিকাল কোচিং সেন্টার রেটিনায় কোচিং করতো তখন থেকেই। এই ছেলেগুলোকে তারা কমন রুমের এই দুর্বিষহ কষ্টগুলো থেকে পরিত্রান দিত। শিবিরের একটা মেসে এই সাদাসিধা ১৮-১৯ বছর বয়সের ছেলেগুলোকে ভাল থাকা আর খাবারের ব্যাবস্থা করে দিত। যেহেতু এরা বেশির ভাগই নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সেহেতু টাকা এদের জন্য একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল।

আমরা যেখানে বাপ মায়ের টাকার শ্রাদ্ধ করতাম মাসে মাসে এরা সেখানে রেটিনা কোচিং এ ক্লাস নেয়ার সুযোগ পেত মেডিক্যাল জীবনের শুরু থেকেই। হাতে আসতো কাঁচা টাকা আর সেই সাথে সদ্যই নতুন যৌবনে পৌঁছানো এই ছেলেগুলোর উপরি কামাই হতো কেবল HSC পাশ করা কচি কচি মেয়েগুলোর মুখে "ভাইয়া ভাইয়া" আহ্লাদী ডাক যা তাদের যৌবনের শুরুতে আক্ষরিক অর্থেই রক্তের বান এনে দিত। কারন শহর অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা অনেক আগেই একসাথে স্কুল-কলেজ কিংবা প্রাইভেট টিচারের ব্যাচে পড়ার কারনে বয়ঃসন্ধিকালের প্রাথমিক সুড়সুড়ির সাথে ইতোমধ্যে পরিচিতি লাভ করে ফেলে যেটা সাধারণত ঘটেনা আমাদের আলোচ্য এই ছেলেগুলোর ক্ষেত্রে। তাই রক্তে ভাললাগার এই বান তাদের বেলায় অনিবার্য। কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতে পারাটা তাদের জন্যে তখন হাতে চাঁদ নয় পুরো সৌরজগতটা পেয়ে যাওয়ার মতো হয়ে ওঠে।

কলেজে ক্লাস করতে করতে ধীরে ধীরে আমাদের একজনের সাথে আরেকজনের পরিচয় হতে থাকে, কথা বার্তা হতেথাকে। বাবা-মা,ভাই-বোন, বন্ধুদের ফেলে কয়েকশত মাইল দূরে আমরা একেকজন খুব অসহায় দিন কাটাতাম। হোস্টেলে বাস করা আমাদের কষ্টের কথা -- থাকার কষ্ট, নতুন নতুন হল ডাইনিঙের অখাদ্য খাবারের কষ্ট, যখন তখন সিনিয়রদের অত্যাচারের কষ্ট- এসব তারা আমাদের মুখ থেকে শুনত। আমরা যেখানে রিফিউজি ক্যাম্পের মতো একটা ঘরে বিছানার পাশে রাখা একটা ট্রাঙ্ক এ সংসার পাতার চেষ্টা করে যাচ্ছি অবিরাম, তারা সেখানে মেসের একটা আস্ত রুম নিয়ে বাস করছে বহাল তবিয়তে! আমদের ঐ ট্রাঙ্কে থাকতো একই সাথে আমাদের বই-খাতা, জামা-কাপড়, টাকা-পয়সা, টুথব্রাশ-পেস্ট..... আর বন্ধ অবস্থায় সেই ট্রাঙ্কই হতো আমাদের পড়ার টেবিল। মেডিক্যাল জীবনের শুরুর দিকের ভয়াবহ নতুন নতুন ইংরেজি শব্দ, দুর্বোধ্য সব পড়াগুলো আমরা দশটা মাস এই ট্রাঙ্কের উপরই পড়ে শেষ করেছি।

আর সেখানে ঐ ছেলেগুলো আমাদের তুলনায় রাজার জীবন যাপন করতে থাকল। এভাবেই বোধ করি তাদের মাঝে একটা ধারনা তৈরি হতে শুরু করল যে-- তার একই ব্যাচের অন্যান্য ছেলেদের তুলনায় তারা তো স্বর্গে বাস করছে!! আর যে সিনিয়র ভাইয়েরা তাদেরকে এই স্বর্গসুখের জীবন Provide করছে তারা তো দেব তুল্য! এক অর্থে পূজনীয়!! আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়--- যেসব ছেলেগুলোকে এইরকম মেসে থাকা-খাওয়ার, কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিয়ে টাকা রোজগারের ব্যাবস্থা করে দেয়া হতো এরা প্রায় ৯৯% ই এসেছে গরিব ঘর থেকে। আর এটা তো প্রতিষ্ঠিত সত্য যে -- পয়সাওয়ালাদের থেকে অপেক্ষাকৃত গরিব লোকজনের মাঝে ধর্ম ভীতি অনেক বেশি কাজ করে। তাই দেখা যায় এই ছেলেগুলোর অনেকেই পরিবার থেকেই ধর্মের প্রতি একটা আসক্তি এবং ভীতি নিয়ে বড় হয়। ইচ্ছে করেই জামায়াত, শিবির এই জাতীয় ছেলেগুলোকে টার্গেট করে থাকে।

এ পর্যায়ে বলে নিতে হচ্ছে দয়া করে আমার কথার ভুল অর্থ দাড় করাবেন না। আমি নিজেও একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, আমি এই শ্রেণীর মানুষদের ছোট বা তাচ্ছিল্য করছি না তাদের ধর্মানুরাগকেও কটাক্ষ করছিনা কোনভাবেই। আমি কেবল পরিস্থিতির আলোকে বিষয়টার সংশ্লিষ্টতা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। ফিরে আসা যাক মূল কথায়। সুতরাং এই নব্য তরুণদের মাঝে তৈরি হওয়া কৃতজ্ঞতাবোধ আর ধর্মভীরুতাকে পুঁজি করে শিবিরের কর্মীরা শুরু করে মগজ ধোলাই অভিযান।

দিনের পর দিন তাদেরকে একদিকে দেয়া হয় টাকা উপার্জনের সহজ রাস্তা, থাকা খাওয়ার আরাম আয়েশ আর তার বিনিময়ে তাদের কাছথেকে কেড়ে নেয়া হয় তাদের স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতাটুকু, তাদের মগজের আনাচে কানাচে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয় একটা উগ্র, স্বার্থাভিলাষি রাজনৈতিক দলের বেদ বাক্য। শ্রেষ্ঠ ও শান্তির ধর্ম "ইসলাম" কে Surf Excel হিসেবে ব্যবহার করে এরা এই ছাত্রদের মগজগুলোকে ঝকঝকে করে ধৌত করে ফেলে। এই মেধাবী তরুন গুলোর হৃদয়, মননকে চিরতরে মেরে ফেলে সেখানে তারা জন্ম দেয় একেকটি বায়োবট (জৈবিক রোবট)। যাদের মুক্ত চিন্তা করার ক্ষমতা বিলীন হয়ে যায় চিরতরে, এদের চিন্তাধারা এরপর থেকে কেবল শিখিয়ে দেয়া একটি বৃত্তেই আবধ্য হয়ে থাকে। ঘুরপাক খেতে খেতে তাদের সেই স্বত্বা সময়ের সাথে সাথে আরও অস্থির, আরও উগ্র হতে থাকে।

এটা অনেকটা One way traffic এর মতো। শুধু ভিতরে ঢোকার রাস্তা আছে কিন্তু বেরোবার নেই! দেশজুড়ে এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমনই হাজার হাজার কারখানায় উৎপাদিত এইসব "প্রোডাক্টগুলোকে" আজকাল সবখানে চোখে পড়ে। ফেসবুকে, ব্লগে, রাস্তা ঘাটে, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে- সবখানে। একটা সময় ছিল এদের সাথে কখনো কখনো আমি নানা বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছি (করাটাই স্বাভাবিক) এবং তাই নিয়ে তাদের সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছি, কিন্তু এখন বুঝতে পারি সেটা কত বড় ভুল বা সময়ের অপচয় ছিল। আপনি গাছের সাথে বাঁধা একটা বলদকে দিয়ে নিশ্চই হাল চাষ করতে পারবেন না? তার আগে আপনাকে বলদটাকে তার বাঁধন থেকে মুক্ত করতে হবে।

তেমনি এই প্রডাক্টগুলোর কাছ থেকেও আপনি কোন সুস্থ চিন্তা আশা করতে পারেন না। কারন তাদের চিন্তা করার ক্ষমতাটাই একটা অচিন বৃক্ষের শেকড়ে বাঁধা। এদের অবস্থা অনেকটা এরকম---- "ঠিক আছে, বিচার মানি, তয় মা'রে ভাত আমি দিমুনা। দিতে হইলে বড় ভাই দিব" !!! সত্যি বলছি! খুব মায়া হয় আমার এদের জন্যে ! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.