আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেভাবে যেভাবে ৫/৬ জনকে জামা দেয়ার প্ল্যান করে আমরা একেবারে ৪৪৩ জন শিশুকে ঈদের জামা দিয়ে ফেল্লাম!

একটি ভীষণ না থাকাকে সঙ্গে নিয়ে প্রতি রাতে ঘুমাতে যাই এই রমজানে ফেসবুকে দেখি শত শত গ্রুপ উঠে পড়ে লাগছে রাস্তার টোকাইদের ঈদ উপলক্ষে জামা দিতে। এগুলা আগেও দেখছি। ২০জন পাংকু পোলাপাইন মিলে ৫টা রাস্তার ছেলেকে নতুন জামা দিয়ে নিজেদের সাথে গ্রুপ ফটু তুলে ফেসবুকে দিবে আর ভাব নিবে! এর মাঝে হয়তো আবার টাকা মারিং-কাটিং এর ব্যাপারও আছে! show off! এসব ভাব-নেয়া-সমাজসেবকদের থেকে দূরে দূরে ছিলাম সবসময়। কিন্তু ঐদিন ভার্সিটি যাওয়ার পথে এক ছেলে ফোন দিছে। বলে, কোথায় টাকা দিতে আসবো।

প্রথমে ভ্যাবাচেকা খেয়ে সামলে নিয়ে বুঝলাম ক্লাসমেটরা এই টাইপ একটা ইভেন্ট করছে আর সেখানে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে রাখছে আমার এলাকার একমাত্র টাকা কালেক্টর হিসাবে। যাই হোক, কেউ টাকা দিতে চাইলে মানা করতে পারি না। জায়গার নাম বলে বল্লাম ইফতারীর পর আসতে টাকা নিয়ে। ছেলে বলে, "ইফতারীর পর তো আমি তারাবীহ পড়ি, এর আগে সম্ভব না?"। চরম বিরক্তি নিয়ে বলে দিলাম, নাহ! বাসায় এসে ১৫ মিনিটে ইফতার করে টিভির সামনে বসলাম এমন সময় ছেলের ফোন।

বাসার সামনে দাড়ায় আছে টাকা হাতে। গিয়ে তো অবাক হয়ে গেলাম। পিচ্চি একটা ছেলে। আমি যে স্কুল থেকে পাশ করছিলাম সেটারই ক্লাস টেন-এ পড়ে। চেহারায় বাচ্চা বাচ্চা ভাব।

বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মুখ গোমড়া করে ২০০ টাকা দিলো। বাসা কই জিজ্ঞাসা করতে বুঝলাম অনেক দূর থেকে আসছে টাকা দিতে। অবাক হয়ে গেলাম। হয়তো ঠিকমত ইফতারটুকুও করতে পারে নাই। পানি খেয়েই দৌড় দিছে।

এখন আরেক দৌড়ে মসজিদে ঢুকবে। নিজের কাছেই খারাপ লাগা শুরু হলো। এতটুকু ছেলের কত দায়িত্ববোধ! দেশের জন্য কিছু করার প্রতি কতটা টান!! আমি ইভেন্টের পেইজটা খুল্লাম। পড়ে দেখলাম। আমারই কিছু ক্লাসমেট নিজেরা নিজেরা টাকা তুলে ১০/১২ জনকে ঈদের জামা দেয়ার প্ল্যান করতেছে।

আমি পার্টিসিপেট না করেও চুপচাপ ওদের সাথে যোগ দিয়ে ফেল্লাম! এরপর আরেকটা ফোন আসলো, সে থাকে আরো দূরে কিন্তু কোচিং করতে এখানে আসে। তখনই আমাকে টাকাটা দিয়ে দিবে। নিজের ফোন নাই, বাবার ফোন থেকে ফোন দিছে। পরদিন সকাল ১১টায় বাসার সামনে দোকান থেকে ফোন দিয়ে বলে আমি আসছি, টাকাটা নিয়ে যান। গেলাম।

৫০০ টাকা দিয়ে বলে এরচেয়ে বেশি পারলাম না। বল্লাম, "ঠিক আছে, এটাই অনেক। আপনার নাম ইভেন্টে লিখে দিবো। " বলে, "না না! নাম লেখা লাগবে না। সমস্যা আছে।

"। আলাপ করে জানলাম এই ছেলেও স্কুলে পড়ে। এভাবে আমার এলাকা থেকে ১২০০ টাকা উঠে গেলো। ঐদিনই ছিলো টাকা জমা দেয়ার শেষ দিন। আমি ১২০০টাকা ক্লাসমেটদের কাছে জমা দিতে গিয়ে দেখি ২২,০০০টাকা উঠে গেছে! ইভেন্টে তখন ৫০০ মানুষের এটেংডিং! এরপরের দিন ওরা গেলো সদরঘাট/বংগবাজার থেকে জামা কিনতে।

আমি এসব ভেজালে আর গরমে না গিয়ে বাসায় বসে ছিনেমা দেখতে লাগলাম। রাতে শুনি আরো টাকা আসতেছে। সবশেষ ২৬ অগাস্ট শুনলাম ৯ দিনের মাথায় ৭৪০০০ টাকা উঠে গেছে!! ২৭ তারিখ ওরা আবার গেলো পাইকারী শপিং করতে। সারাদিন রোদে ঘুরে ঘুরে শপিং করলো আর আমি বাসায় ফ্যানের বাতাস খেলাম!! ২৮ তারিখ এদের একজনের বাসায় যেতে বল্লো। ভলেন্টিয়ার লাগবে।

জামা কাপড় সব বস্তায় প্যাকেট করা। এগুলা খুলে আলাদা আলাদা প্যাকেট করা লাগবে। ৪০০ জনের জামা। ছেলেদের ২টা করে(শার্ট-প্যান্ট) আর মেয়েদের ১টা(কামিজ বা ফ্রক) করে দেয়া হবে। বয়স/সাইজ অনুযায়ী জামা সাজিয়ে প্যাকেট করলাম।

সারাদিন লেগে গেলো! ইফতার করে বাসায় ফিরলাম। পরদিন ২৯ তারিখ, গিফট দেয়ার দিন!! টাকা-পয়সা খরচের ব্যাপারে আমরা সতর্ক ছিলাম। একটাকাও যেনো এদিক-ওদিক না হয় এবং পুরো টাকা যেনো শিশুরা পায় সেজন্য সবকিছুর হিসাব রাখা হচ্ছিলো। একজন আমাকে বল্লো, "মানুষের বিশ্বাসটাই আসল। আমরা জাগো বা ইউনিসেফ না।

মানুষ যে আমাদের মত একটা ছোট অনলাইন কমিউনিটিকে বিশ্বাস করে হাজার হাজার টাকা দিতেছে - সেই বিশ্বাসটা রাখতে হবে। " ২৯ তারিখ সকাল সকাল আগারগাও থেকে শুরু করলাম। এরপর বিজয়স্মরনী, ধানমন্ডি, মহাখালী, আবদুল্লাহপুর, মিরপুর, মোহাম্মদপুর। আমাদের টার্গেট ছিলো ঢাকা শহরের অনুর্ধ ১২ বছরের শিশুরা - যারা ট্রাফিক সিগনালে ভিক্ষা করে, ফুল-পেপার বিক্রি করে। মানুষ নাকি বলে সাত আসমানের উপর স্বর্গ।

আপনি যদি একবার দেখতেন রোদে পোড়া খালি গায়ের বাচ্চাগুলা হাতে নতুন জামা নিয়ে হাসি দিতেছে - সেই হাসিতে কৃতজ্ঞতা আর চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক...খোদার কসম, সাত আসমানের স্বর্গকে আপনার সদরঘাট লাগতো! স্বর্গ তো এখানে, বাংলাদেশের এই না পাওয়া শিশুদের চোখে! এই স্বর্গীয় সুখের ছোয়া পাবার পর আমার নেশায় ধরে গেলো। খুজে খুজে একজন একজন করে জামা দিচ্ছি আর তাদের হাসিমাখা মুখ ক্যামেরাবন্দী করতেছি। কত হবে? এক একটা জামা ১০০/১৫০ টাকা? আমার আপনার একবেলা খাওয়ার টাকা। অথচ এই সামান্য "কমদামী" জামা পেয়ে ওদের যেই আনন্দ - নতুন কেনা স্যামসাং গ্যালাক্সী ট্যাব-ও আমাকে এত আনন্দ দিতে পারে নাই। এতগুলা শিশুকে জামা দিয়ে, ঈদের খুশি ভাগ করে, একটা শান্তির পরশ নিয়ে আমার বাসায় ফেরার কথা ছিলো।

কিন্তু বাসায় ফিরলাম মন খারাপ করে। কেননা শুধু জামা দিয়ে এদের একদিনের আনন্দ দিলেই হবে না। এদের নিয়ে স্থায়ী একটা সমাধান বের করতে হবে। এরা যেনো শিশুশ্রমে লিপ্ত না হয়, পড়াশোনা করে, ঠিকমত খাবার পায় এবং ভালো যায়গায় থাকতে পারে - সেই ব্যাবস্থা করতে হবে। যদি আমরা সবাই মিলে এদের পুনর্বাসনের ও পড়াশোনার একটা ব্যাবস্থা করতে পারতাম - তাহলে হয়তো আমাদের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে জামা দেয়া লাগতো না।

এরা নিজেরাই কামাই করে নিজেদের জামা কিনে ফেলতে পারতো! ফেসবুকে একজন এইসব দেখে কমেন্ট করছিলো, "That's amazing man. hopefully next year it will be 800+ and so on, but hopefully by ten years we can say - আজকে জামা কাপড় কম দেয়া লাগলো। poverty আসলেই কমতেছে" এরকমই একটা বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে যাচ্ছি আমরা কয়েকজন। আপনিও চাইলে যোগ দিতে পারেন আমাদের সাথে। আপনার "সাথে থাকা" আমাদের সবচেয়ে বড় ডোনেশন। সমাজের জন্য কিছু করতে গেলে নির্বাচনে জয়ী হয়ে মন্ত্রী হওয়া লাগে না।

আপনি আপনার জায়গা থেকেই সেটা করতে পারবেন। আপনি নিজেই পারেন আপনার এলাকার কয়েকটা পথশিশুদের জন্য কিছু করতে, সেজন্য আমাদের সাথে হাত মেলাতেও হবে না! আপনার ইচ্ছাটাই আসল। একবার করেই দেখেন না... স্বর্গের স্বাদ কিন্তু অদ্ভূত সুন্দর! ৫/৬ জনকে জামা দেয়ার প্ল্যান করে আমরা একেবারে ৪৪৩ জন কে জামা দিয়ে ফেল্লাম! ব্যাপারটা মোটেও ছোটোখাটো না। বিশাল এই ব্যাপারটা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র আপনাদের সাপোর্টের জন্য। অনেক অনেক মানুষ যে টাকা দিয়ে সাহায্য করছে তা কিন্তু নয়।

৬৭ জনের কাছ থেকে আমরা ডোনেশন পেয়েছি। ২ জন রেডিমেড নতুন জামা কার্টনে ভরে দিয়ে গেছে। আর সাপোর্ট পেয়েছি হাজারেরও বেশি মানুষের! তাই বলে আমরা কিন্তু থেমে যাইনি। ২৯ তারিখ জামা গিফ্ট দিয়ে বাড়ি ফিরার পথে আমরা সবাই ভাবছিলাম সামনের কোরবানী ঈদে কি করা যায়। সামনের ঈদে শীত পড়বে, তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শীতবস্ত্র সংগ্রহ করে এবং ক্রয় করে উত্তরবঙ্গের মানুষদের কষ্ট সামান্য হলেও দূর করার চেষ্টা করবো।

এজন্য আবারো আমরা আপনাদের কাছে সাহায্যপ্রার্থী। গত শীতের কাপড় যা আপনি ফেলে দিবেন, পুরাতন সোয়েটার-কাথা-কম্বল-লেপ-শাল-হাত মৌজা-টুপি অথবা নগদ টাকা। যে যতটুকু পারবেন, সাহায্য করবেন। আপনি না পারলে অন্তত আপনার বিল্ডিং-এর মানুষ, আত্মীয়স্বজন, অফিসের কলিগ - সবাইকে জানিয়ে দিন। হয়তো আপনার সামান্য হাত বাড়িয়ে দেয়া বাচিয়ে দিতে পারে ৭০ বছরের কোনো শীতার্ত বৃদ্ধকে।

আশা করছি এবারো আপনাকে আমাদের সাথে পাবো। আপনার মতামত, সাহায্য ও আপডেটের জন্য চোখ রাখুন আমাদের ফ্যান পেজে: ইভেন্ট পেইজ | আমাদের ফেসবুক পেইজ ডিসক্লেইমার: ১। এটা সম্পূর্ন একটা ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার ব্লগ। আমি যেভাবে টাকা নিয়েছি (আমার বাসার সামনে এসে টাকা দিয়ে যান), বাকি সবাই এভাবে টাকা নেয় নাই। ডোনাররা ফোন দিয়েছে, ভলেন্টিয়াররা বাড়ি/অফিস গিয়ে টাকা নিয়ে আসছে।

টাকা নেয়ার ব্যাপারে আমি ছাড়া সবাই আন্তরিক ছিলো। ২। আমি সবসময় দূরে দূরে ছিলাম, সবচেয়ে কম পরিশ্রম করেছি। ছবি তোলা আর আইডিয়া দেয়ার প্রতি আমার আগ্রহ ছিলো বেশি। পুরো ব্যাপারটা ঠিকঠাক সম্পন্ন করা যে কত কষ্ট - সেটা আমার লেখা হতে বুঝা যাবে না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.