আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্থাপত্যের আইনস্টাইন যার জন্ম বাংলাদেশে

এফ আর খান জন্ম বাংলাদেশের শিবচরে। কিন্তু পেশাজীবনে পাড়ি দেন আমেরিকায়। সে দেশের সর্বোচ্চ ভবন, এমনকি তার জীবদ্দশায় বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন, সিয়ারস টাওয়ারের নকশা এঁকেছিলেন এই বাঙালি স্থপতি। ১১০ তলা, ১ হাজার ৪৫৪ ফুট উঁচু ওই ভবনই তাকে এনে দেয় বিশ্বখ্যাতি। তাকে বলা হয় স্থাপত্যশিল্পের আইনস্টাইন।

গগনচুম্বী ইমারত রেনেসাঁর এই স্রষ্টাকে নিয়ে এই লেখা। এফ আর খান ১৪৯২ সালে ইতালির সমুদ্রনাবিক কলম্বাস পৃথিবীর মানচিত্র বদলে দিয়েছিলেন আমেরিকা মহাদেশ আবিষ্কার করে। আর আমেরিকায় ১৯৫২ সালে পাড়ি জমিয়েছিলেন ২৩ বছরর এক তরুণ, তার মাতৃভূমি ছেড়ে। যার ওই চলে যাওয়ায় স্থাপত্যশিল্পের মানচিত্রে এসেছিল সম্পূর্ণ নতুন এক অবয়ব। কালবৈশাখী ঝড় যেমন প্রকৃতির চেহারা পুরো বদলে দেয়, তেমনি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পুরনো কাঠামোই পুরো বদলে দিয়েছিলেন ওই তরুণ।

উন্মোচিত হয়েছিল ভবননকশার নয়া নয়া দিগন্ত। আমেরিকায় পাড়ি জমানো সেই তরুণের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই বাংলাদেশে। নাম ফজলুর রহমান খান (এফ আর খান)। ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের অধ্যাপক মির এম আলী তার আর্ট অব দ্য স্কাইস্ক্র্যাপার : দ্য জিনিয়াস অব ফজলুর খান বইতে উল্লেখ করেছেন, বাংলাদেশি এই বিদ্বানকে বলা হয় ‘আইনস্টাইন অব স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার’। আমেরিকার সর্বোচ্চ ভবন ১১০ তলাবিশিষ্ট সিয়ারস টাওয়ারের নকশা এঁকেছিলেন বাংলার এই আইনস্টাইন।

১১০ তলাবিশিষ্ট সিয়ারস টাওয়ার। আমেরিকার সর্বোচ্চ ভবন এটি। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন। এই ভবনের নকশা করেছিলেন আমাদের এফ আর খান। বাংলার মেধাবী মুখ আরমানিটোলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এফ আর খান।

এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে যান কলকাতার শিবপুরে। ভর্তি হন শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। কিন্তু সেখানে স্নাতক পর্যায়ের পুরো পাঠ সম্পন্ন করতে পারেননি খান। পঞ্চাশের দাঙ্গা দিনে দিনে দানা বাঁধলে ফিরে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট)।

এই কলেজ থেকেই প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে স্নাতক সম্পন্ন করেন খান। এমন মেধাবী মুখই তো শিক্ষক হিসেবে দরকার। কলেজ কর্তৃপক্ষ খানকে সাধুবাদ জানালেন শিক্ষক হওয়ার সুযোগ দিয়ে। কলেজে স্ট্রাকচার ও অ্যাপ্লাইড মেকানিক্স পড়াতেন তরুণ শিক্ষক এফ আর খান। স্থাপত্যশিল্পে তার স্বপ্নএফ আর খানের মেধার কিরণ কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

একই সঙ্গে দু-দুটো বৃত্তি পেয়েছিলেন খান। ফুলব্রাইট বৃত্তি ও পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি। স্থাপত্যশিল্পে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্নটা তখন হাতছানি দিয়ে খানকে ডাকছে। ১৯৫২ সালে তিনি পাড়ি জমালেন আমেরিকায়। ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ে।

এই ক্যাম্পাস থেকে তিন বছরে দুটো মাস্টার্স (একটা স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, আরেকটা থিওরিটিক্যাল অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড মেকানিক্সে) এবং স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একটা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এফ আর খান! তার মেধার তীক্ষতা অনুধাবন করে স্থাপত্য সংস্থা স্কিডমুর-ওয়িংস-মেরিল। তারা আমন্ত্রণ জানায় খানকে এবং খান তাদের সঙ্গে ১৯৫৫ সালে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে সুযোগ পেলে দেশে ফিরে আসেন তিনি। যোগ দেন করাচি ডেভেলপমেন্ট অথরিটিতে। কিন্তু হতাশা ছাড়া কিছু জোটেনি তার ভাগ্যে।

শৈশবে যেমনটি বাবা বুঝেছিলেন, চৌকস ও বিচক্ষণ খান আপনার চোখ দিয়ে দেখতে পান নিজ স্বপ্নের অদূর অপমৃত্যু। ফলে মাতৃভূমি ছেড়ে আবার আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চিন্তা করেন। ১৯৬০ সালে আমেরিকার সেই স্থাপত্য সংস্থা স্কিডমুর-ওয়িংস-মেরিলে পুনরায় যোগদান করেন। এরপর স্বপ্নটা তার ডানা মেলা শুরু করে। ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ডে ৫ বার (১৯৬৫, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭১ ও ১৯৭৯) মনোনীত হয়েছেন স্থাপত্যশিল্পে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখার জন্য।

আর ১৯৭২ সালে কনস্ট্রাকশন’স ম্যান অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন খান। তাকে বলা হয় গগনচুম্বী ইমারত রেনেসাঁর স্রষ্টা। গগনচুম্বী ইমারত রেনেসাঁর স্রষ্টাউনিশশ’ ষাটের দশকে এফ আর খান একের পর এক বড় বড় ভবনের নকশা আঁকতে থাকেন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি তখন সিয়ারস অ্যান্ড কোং। তাদের কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার।

সব কর্মীর একটি মাত্র কার্যালয় বানানোর স্বপ্ন সিয়ারস কোম্পানির। এ স্বপ্নটার বাস্তবায়ন করেন আমাদের এফ আর খান। ১১০ তলা উঁচু একটি ভবনের নকশা তৈরি করেন তিনি। ১০১ একর জমির ওপর ১৯৭৩ সালে সেই ভবনটি দাঁড়িয়ে যায় সম্পূর্ণ মাথা উঁচু করে। মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় এক বাঙালি ব্যক্তিত্বও।

সিয়ারস টাওয়ার (১৬ জুন, ২০০৯ থেকে পরিবর্তিত নাম উইলিস টাওয়ার) ছিল ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন এবং এখনও আমেরিকার সর্বোচ্চ ভবন সেটিই। কেউ যদি সিয়ারস টাওয়ারে গিয়ে থাকেন, দেখে থাকবেন করিডোরের মূল ফটকে বাংলায় লেখা ‘স্বাগত’ আর এফ আর খানের একটা ছবি। নতুন ছাঁচে জীবনের সব কুলকে ঢেলে সাজানোর আরেক নাম যদি হয় রেনেসাঁ, তবে স্থাপত্যশিল্পে এমনি এক রেনেসাঁ ঘটিয়েছিলেন এফ আর খান। ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ডে ৫ বার (১৯৬৫, ১৯৬৮, ১৯৭০, ১৯৭১ ও ১৯৭৯) মনোনীত হয়েছেন স্থাপত্যশিল্পে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখার জন্য। আর ১৯৭২ সালে কনস্ট্রাকশন’স ম্যান অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হন খান।

তাকে বলা হয় গগনচুম্বী ইমারত রেনেসাঁর স্রষ্টা। স্বদেশপ্রেমস্বদেশ, স্বদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি খানের ভীষণ ভালোবাসা ছিল, বোঝা যায়। ১৯৭১ সালে যখন দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত, প্রবাসের বাঙালিদের নিয়ে তিনি ‘বাংলাদেশ ইমারজেন্সি ওয়েলফেয়ার আপিল’ নামে একটা ফান্ড গঠন করেছিলেন। এফ আর খানই প্রথম বাঙালি, যিনি মার্কিন সিনেটে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমনে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য। বাংলাদেশ তার এই অবদানকে সম্মানিত করে।

১৯৯৯ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেয় বাংলাদেশ সরকার। অবশ্য ততদিনে তিনি গত হয়েছেন ১৭ বছর! ১৯৮২ সালের ২৭ মার্চ ৫৩তম জন্মদিনের এক সপ্তাহ আগে সৌদি আরবের জেদ্দায় হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় বাংলার আইনস্টাইনের। মানুষ বাঁচে তার স্বপ্নের জন্য জীবনকে কীভাবে দেখতেন এফ আর খান? তিনি বলতেন, ‘জীবন মানেই শিল্প। জীবন মানে একটা নাটক আর সুর-সংগীত। ’ তিনি নিজে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে ভালোবাসতেন।

জীবনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কতটা? বাংলার আইনস্টাইন বলতেন, ‘জীবন মানে মানুষ, মানুষই জীবন। ’ মানুষ কেন বেঁচে থাকে? এফ আর খান বলতেন, ‘মানুষ বাঁচে তার স্বপ্নের জন্য। মানুষ বাঁচে তার স্বপ্ন পূরণের জন্য। মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে কেউই চায় না। কিন্তু আমি মাতৃভূমি ছেড়েছি স্বপ্নকে বাঁচাতে।

’ এফ আর খান বেঁচে আছেন ইমারতশিল্পে, মানুষের হূদয়ে। এফ আর খানের কন্যা ইয়াসমিন সাবিনা খান বাইরন বাবা সম্পর্কে বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে বাবা ছিলেন ঈশ্বরপ্রদত্ত ব্যতিক্রম ধারার এক ইঞ্জিনিয়ার। ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন নম্র-ভদ্র, সরল এবং দূরদর্শী ও উদ্যমী। ’ এফ আর খানের খ্যাতি ও সম্মাননা * স্থাপত্যের আইনস্টাইন * গগনচুম্বী ইমারত রেনেসাঁর স্রষ্টা * ম্যান অব দ্য ইয়ার : ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ডে ১৯৭২ সালে নির্বাচিত হন কনস্ট্রাকশন ম্যান অব দ্য ইয়ার হিসেবে * এফ আর খান চেয়ার : তার সম্মানার্থে লিহাই ইউনিভার্সিটিতে এফ আর খান চেয়ার তৈরি করা হয়েছে * এফ আর খান সড়ক : সিয়ারস টাওয়ারের পাদদেশে জ্যাকসন সড়কের পশ্চিম ও ফ্রাঙ্কলিন সড়কের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ সংযোগস্থলকে ১৯৯৮ সালে এফ আর খান ওয়ে হিসেবে নামকরণ করা হয় * সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি : নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, লিহাই ইউনিভার্সিটি এবং সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। এফ আর খানের সেরা ১০ নকশা১।

ব্রানসউইক ভবন, শিকাগো ৩৭ তলা নকশা : ১৯৬২ সাল। সম্পন্ন : ১৯৬৪ সাল। ২। চেস্টনাট ডি-উইট প্লাজা, শিকাগো ৪৩ তলা নকশা : ১৯৬৩ সাল। সম্পন্ন : ১৯৬৬ সাল।

৩। জন হ্যানকক, শিকাগো ১০০ তলা নকশা : ১৯৬৫ সাল। সম্পন্ন : ১৯৬৯ সাল। ৪। ওয়ান সেল প্লাজা, হোস্টন ৫২ তলা সম্পন্ন : ১৯৭১ সাল।

৫। সিয়ারস টাওয়ার, শিকাগো ১১০ তলা নকশা : ১৯৬৯ সাল। সম্পন্ন : ১৯৭৩ সাল। ৬। ইউএস ব্যাংক সেন্টার, ৪২ তলা সম্পন্ন : ১৯৮০ সাল।

৭। হজ টার্মিনাল, জেদ্দা [কিং আবদুল আজিজ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট] নকশা : ১৯৭৪ সাল। সম্পন্ন : ১৯৮০ সাল। ৮। কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটি, জেদ্দা নকশা : ১৯৭৭ সাল।

সম্পন্ন : ১৯৭৮ সাল। ৯। ওয়ান ম্যাগনিফিশেন্ট মাইল, শিকাগো ৫৭ তলা সম্পন্ন : ১৯৭৮ সাল। ১০। অনটারি সেন্টার, শিকাগো ৬০ তলা সম্পন্ন : ১৯৮৬ সাল।

তথ্যসূত্র ও ছবি : ইন্টারনেট ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।