আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাছের রৌদ্রস্নান

ইদানিং যদিও নারীরা অনেকেই নিত্যদিন কাঁচাবাজারে যান, কিন্তু সেইকালে বিষয়টা এমন ছিল না। আমি এক কি দুইজনকে স্মরণ করিতে পারি যাহাদের আমি মাঝে মধ্যে কাঁচবাজারে আমার পাশাপাশি তরিতরকারী মূলামূলি করিতে দেখিতাম। তৎকালীন সময়ে উহারা শুধুমাত্র নিউমার্কেট অথবা গাউছিয়াতেই গমনাগমন সীমিত রাখিতেন (কারণ অন্য কোন মার্কেট তেমন ছিল না)। নিত্যদিনের কাঁচাবাজারের ভারটি আমার ঘাড়ে আসিয়া পড়ে আমি যখন অষ্টম ক্লাসে উপনীত হই! মূলত আমার আমার পূর্বে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এই গুরু দায়িত্বটি পালন করিতেন। ঠিক কি পরিস্থিতিতে এবং কিরূপে এই গুরু দায়িত্বটি আমার ঘাড়ে সওয়ার হইল তাহা মনে করিতে পারিতেছি না।

তবে আমার উপরে আরও এক ভ্রাতা থাকিবার পরেও এই দায়িত্বটি আমার ঘাড়ে আসিয়া পরার অন্তঃত কোন ঐতিহাসিক কারণ নাই। যতদূর স্মরণ করিতে পারি বাজার সংক্রান্ত প্রথম পরীক্ষায় আমরা ভ্রাতৃদ্বয় যুগপৎ অংশগ্রহণ করিয়াছিলাম এবং উভয়েরই প্রাপ্ত ফলাফল ছিল ‘অনুত্তীর্ণ’। তবে বোধকরি আমার পিতার এই প্রাত্যহিক কাঁচা বাজারের দায়িত্বটি আমার ঘাড়ে চাপাইবার একটি সুদীর্ঘ পরিকল্পণা ছিল। কারণ তিনি আমাকে হটাৎ হটাৎ তাহার সহিত বাজারে লইয়া যাইতেন এবং আনাজপাতি ক্রয়ের এক ফাকে দোকানীকে জানাইয়া দিতেন যে আমি তাহার সেজ ছেলে এবং যদি কোন সময় আমাকে কিছু খরিদ করিতে পাঠানো হয়, তখন দোকানী যেন ভালো জিনিসটিই আমাকে দেন। আমি মোটামুটি নিশ্চিত তাহার অনুরোধে তেমন কোন কাজ হয় নাই।

পিতার সহিত যখন বাজারে যাইতাম তখন সব্জীর বাজারের হালকা হলুদ হালকা সবুজ সব্জীটি আমার ব্যপক দৃষ্টি আকর্ষণ করিত। দোকানীরা সব্জীটি ৫-৬টি একত্রে আঁটি বাধিয়া দোকানের শোভা বর্ধনের জন্য ঝুলাইয়া রাখিত বলিয়া প্রতীয়মান হয়। কারণ আমি কখনও কাহাকেও তাহা সওদা করিতে দেখি নাই। আমার মনে মাঝে মাঝে উহা খরিদ করিবার তীব্র বাসনা হইত, তবে কখনও পিতাকে বলিবার সাহস সঞ্চয় করিয়া উঠিতে পারি নাই। পাঠিকবৃন্দ যাহারা এক্ষণে চিন্তার নদী বহাইয়া দিতেছেন তাহাদের জ্ঞাতার্থে জানাইতেছি উহা ছিল কাঁকরোল।

সেই সময় কাঁকরোল তেমন জনপ্রিয় ছিল না। তবে আমি বাজারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হইবার পর শিশুকালের স্বপ্ন নিয়মিতই পূরণ করিয়াছি। যে বাজারের কথা হইতেছে, উহা খুব একটা বড় ছিল না; তবে ২০-২৫ বছর পূর্বের জনসংখ্যার অনুপাতে তাহা যথেষ্ঠ ছিল বলিয়াই মনে হয়। উহা আমাদিগের পাঠশালায় যাইবার পথে পড়িত। কখনও কখনও সেই বাজারের ভিতর দিয়া পাঠশালায় যাইতাম।

বর্তমানে সেই স্থলে ওয়াসার পানির পাম্প বসিয়াছে; কাজেই বাজার বড় পরিসরে অন্যত্র স্থানান্তরিত হইয়াছে। পাঠকবৃন্দ বুঝিতেই পারিতেছেন যেইকালের কথা হইতেছে, সেই কালে এই ঢাকা শহরে চাপকলই ছিল ভরসা। যাই হোক বলিতেছিলাম বাজারের গুরুদায়িত্বের কথা। দুঃখের কথা হইতেছে জীবনের প্রথম বাজার করিবার অভিজ্ঞতাটি মোটেই সুখকর ছিল না এবং এ কথা বলা বাহুল্য হইবে না যে বয়সটিও কাঁচা বাজারে যাইবার জন্য যথেষ্ট কাঁচা ছিল। অথাপি, কোন অজানা কারণে জননী আমাকে সেই কঠিন দায়িত্ব দিয়া বাজারে পাঠাইয়াছিলেন; সঙ্গে দিলেন আমার মেজ ভ্রাতাকে।

দায়িত্বটি ছিল বড়ই সুকঠিন, কারণ ইহা কোন সব্জীর অ্যাসাইনমেণ্ট ছিল না; ভ্রাতাযুগলকে মৎস্য খরিদ করিবার জন্য পাঠানো হইয়াছিল। দুই ভাই কোনরূপ ঝামেলা ছাড়াই বাজারে পৌঁছিয়াছিলাম এবং এখনও চক্ষু মুদিলে নিজেকে মাছের ডালার সম্মুক্ষে দেখিতে পাই। পরবর্তী ঘটনাবলী তেমন স্মরণ নাই। তবে বাড়ি ফিরিবার পরের অভিজ্ঞতায় হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়। মৎস্য দেখিয়া জননী যারপরনাই ক্রোধান্বিত হইলেন এবং আমদিগের ছোট্ট দুই ভাইয়ের বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে নিদারুণ সন্দেহ পোষণ করিলেন।

তিনি বলিয়াছিলেন মৎসগুলি একটু উল্টাইয়া পাল্টাইয়া না দেখিয়া কিরূপে নগদে উহাদিগকে খরিদ করিয়া লইয়া আসিলাম! ইহারা নাকি পঁচা ছিল! ইয়া মাবুদ! সেই ছোট্ট শিশুদ্বয় তাহা কিরূপে জানিবে? তাহা ছাড়া পিতাও তো আমাকে বিভিন্ন দোকানীর সহিত পরিচয় করাইয়া দিয়া ভালো জিনিসটিই দিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন! সেখানে আমাদিগের ন্যায় দুই ক্ষুদ্র বালকের কি করিবার থাকে, যেখানে পিতার অনুরোধ রক্ষা হয় নাই? শেষ কথা: দুপুরে খাইতে বসিলে দেখিলাম কোন মাছের তরকারী নাই। খাইতেছি তথাপি কোন মাছ সম্মুখে আসিতেছে না। মনে মনে ভাবিলাম না হয় পচা মাছ কিনিয়া আনিয়াছি, তাই বলিয়া খাইতেও পাইব না! মিন মিন করিয়া জননীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, মাছ কোথায়? জননী বাহিরে ইঙ্গিত করিলেন। একটু অবাক হইয়া বাহিরে তাকাইলাম। ততোধিক বিস্ময় বালকদ্বয়ের জন্য অপেক্ষমান ছিল।

দেখিলাম মৎস্যগুলি কাপড় শুকানোর তারের সহিত লটকাইয়া রৌদ্রস্নান করিতেছে। সিঙ্গাপুর ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।