আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চারুলতা বিদ্যাপীঠ

মধ্যরাতে জোছনা দেখি, উদভ্রান্ত হেঁটে বেড়াই শহরের রাজপথে । আমি বুকপকেটে স্বপ্ন জমা করি । পয়লা বৈশাখের রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে সবাই নতুন কাপড়-চোপড় পরে সেজেগুজে বাসা থেকে বের হচ্ছে। ছেলেমেয়েগুলো যেন এক একটা পাখি হয়ে গেছে। উড়ে উড়েই চলে যাবে বর্ষবরণের বিভিন্ন অনুষ্ঠানস্থলে।

আমি দাঁড়িয়ে আছি ষোলশহর রেলক্রসিংয়ের কাছে তুলাতলি বস্তিতে। রাফির ওপর মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। সকালটায় একটু আরাম করে ঘুমাব ভেবেছিলাম। এই ছোকরা কয়েক শ বার ফোন করে ঘুম থেকে তুলে একরকম জোর করেই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। ঘটনা কী বুঝতে পারছি না।

হঠাৎ কোত্থেকে জনি আর ফয়সাল এসে টপাটপ আমার পা ধরে সালাম করে বলল, ‘ভাই, টাকা দেন। ’ দুজনকে কষে দুইটা থাপড় দিতে পারলে মনে একটু শান্তি পেতাম। পয়লা বৈশাখের দিন এটা করা যাবে না। আমি দুজনকে দুইটা দুই টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘যাও, মিষ্টি কিনে খেয়ো। ’ ওদের চেহারা হলো দেখার মতো।

অনেকগুলো ছেলেমেয়ে রেললাইনের পাশে বস্তির একটা ঘরকে ঘিরে জটলা করছে। চেহারা দেখে মনে হলো সবগুলো ছেলেমেয়েই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। রাফি খুবই ব্যস্ততার ভাব নিয়ে অকারণেই দৌড়াদৌড়ি করছে। শেষমেশ তাকে পাকড়াও করলাম, ‘ঘটনা কী, আমাকে এখানে ডেকে আনার কারণ কী?’ রাফি বেশ লাজুক স্বরেই বলল, ‘ভাই, আগে থেকে কাউকে কিছু জানাই নাই। চুয়েট, চমেক আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ জন ছাত্র মিলে আমরা একটা অবৈতনিক স্কুল চালু করেছি এই বস্তিতে।

চারুলতা বিদ্যাপীঠ। আজকে তার উদ্বোধন হবে। ’ আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। এ রকম কিছু তো আশা করিনি। সামলে নিয়ে তাকে বললাম, ‘তোমরা টাকা-পয়সা কোত্থেকে জোগাড় করেছ?’ রাফি বলতে থাকে, ‘প্রাথমিকভাবে আমাদের কিছু টাকা দিয়েছে সিটি কলেজের নুরুন্নাহার ম্যাডাম এবং শ্রাবণী ম্যাডাম।

মূলত তাঁদের উৎসাহেই আমরা এই কাজটা শুরু করেছি। তবে স্কুলটা চলবে এই ২৪ জন সদস্যের মাসিক চাঁদার ভিত্তিতে। আমরা বুঝতে পারছি, আমাদের টাকায় স্কুলটা চালানো কঠিন হয়ে যাবে। তাই আমরা পরিকল্পনা করেছি, যখন এ রকম কঠিন সময় আসবে তখন আমরা সামর্থ্যবান লোকদের কাছে গিয়ে হাত পাতব। ’ আমার নিজের কাছে নিজেকে খুবই লজ্জিত মনে হতে থাকে।

এখন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেরা ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে নিজেরা নিজেদের খুন করে ফেলতেও বিন্দুমাত্র চিন্তা করছে না। অথচ সদ্যতরুণ এই ছেলেগুলো কী অসম্ভব সুন্দর একটি উদ্যোগ নিয়েছে। আমি মুগ্ধ হয়ে রাফির কথা শুনতে থাকি। সে বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘আমরা মাসিক ১৩০০ টাকায় একটা ঘর ভাড়া নিয়েছি। আপাতত একদম অক্ষরজ্ঞান নেই এ রকম ৫০টি বাচ্চাকে নিয়ে আমরা স্কুল চালু করেছি।

যদি আমরা এই বস্তিতে প্রাথমিক সমাপনী, জেএসসি কিংবা এসএসসি পরীক্ষার্থী পাই তাহলে তাদের জন্য বিশেষ কোচিংয়ের ব্যবস্থা করব। আমাদের মধ্যে বেশির ভাগই মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র। আশা করি আমাদের খুব একটা সমস্যা হবে না?’ রাফির চোখগুলো স্বপ্নালু হয়ে আসে। হঠাৎ করে একটা অপার্থিব আনন্দ আমাকে ছুঁয়ে যায়। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের পরিকল্পনা কী এই স্কুল নিয়ে?’ ও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আসলে আমাদের সাধ্য তো খুবই সীমিত।

আমরা এই বস্তির ছেলেমেয়েগুলোকে স্কুল-কলেজ পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চাই। তারপর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাটা ধরে ফেলতে পারলে ওরা নিজেরাই নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। আমরা শুধু ওদের পেছনে থাকব। ’ হঠাৎ চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে স্কুলঘরটার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে দেখি, বাচ্চাগুলোর মধ্যে লাল মলাটের শিশু শিক্ষার বই বিতরণ করা হচ্ছে। বাচ্চারা সবাই বইগুলো মাথার ওপর উঁড়িয়ে ধরে মহা আনন্দে ছবি তুলছে।

দেখে মনে হচ্ছে, ফুটে থাকা একগুচ্ছ রক্তগোলাপ। বাচ্চাদের সঙ্গে সঙ্গে তরুণ শিক্ষকদের কেউ কেউ পানির বোতল, হাজিরা খাতা মাথার ওপর উঁচিয়ে ধরে ছবি তুলছে। হঠাৎ ট্রেন আসার শব্দে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী সবাই চিৎকার করতে করতে হুড়মুড় করে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। যেন জীবনে কেউ ট্রেন দেখেনি। আমি এদের এমন নিষ্পাপ আনন্দে অভিভূত হয়ে থাকি।

হঠাৎ করে বুঝতে পারি, আমাদের জীবনে আনন্দের ঘটনা খুবই কম বলে আমাদের মস্তিষ্ক এমন কিছু সহজে গ্রহণ করতে পারে না। হয়তোবা এ কারণেই আমার চোখের কোনাগুলো চিকচিক করতে থাকে। আমি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের আলাদা করতে পারি না। (প্রথম আলো'র ছুটির দিনে'তে ৫/৫/২০১২ তারিখে প্রকাশিত। মূল লেখার লিংক এইখানে বিঃদ্রঃ এটা সাহিত্য বিষয়ক কোনো লেখা নয়।

একটি খবর মাত্র। এই লেখার উদ্দেশ্য, ছেলেগুলো যে লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে তারা যেন কোনোভাবেই মাঝপথে থেমে না যায়। আর কিছু না পারেন অন্তত এই ছেলেগুলোকে একটু উৎসাহ দিয়ে যান, তারা যেন এগিয়ে যেতে পারে। এবং চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের কাছে অনুরোধ, যদি পারেন তো একবার অন্তত গিয়ে দেখে আসবেন ছেলেগুলো ঠিকঠাক মত কাজ করছে কিনা। চাইলে দুচারটা ধমকও দিয়ে আসতে পারেন, ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর জন্য! ষোলশহর ২নং গেইট এর কর্ণফুলী মার্কেটের পাশের/পেছনের রেললাইন ধরে কিছুদূর হাঁটলেই বামদিকে আপনি "চারুলতা বিদ্যাপীঠ" এর সাইনবোর্ড দেখতে পাবেন।

আর্থিক সাহায্য করতে পারলে ওদের কষ্টটা একটু কমে যাবে। যেকোনো প্রয়োজনে এই নাম্বারগুলোতে যোগাযোগ করতে পারেনঃ রাফিঃ০১৭১৭১২০৮৪৬, ০১৮১৮৩৯৭৪৫১। উদ্বোধনের দিনই আমরা প্রায় সবকটি পত্রিকাতে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছিলাম। হয়তোবা পেছনে খুব বড় কেউ নেই বলে এটা নিয়ে কোনো পত্রিকাতে কোনো সংবাদ ছাপা হয়নি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।