আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওহাবী বা সালাফী মাজহাবের গোপন কথা ( 2 )

আসুন আমরা ২টি ভারী বস্তু আল্লাহর কুরান ও রাসুলের(সাঃ) পরিবারকে(আঃ) অনুসরন করি। ওহাবী বা সালাফী মাজহাবের গোপন কথা ( 2 ) ইবনে তাইমিয়ার চিন্তাধারার অন্যতম প্রচারক মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব বলেছিলেন ' যারা ফেরেশতা, পয়গাম্বর এবং আল্লাহর অলিদের প্রতি তাওয়াসসুল করে এবং তাদেঁরকে নিজেদের শাফায়াতকারী হিসেবে চিন্তা করে কিংবা তাদেঁর ওসিলায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশা করে, তাদেরকে হত্যা করা বৈধ এবং তাদের মালামাল মোবাহ। " মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাব তার এই মনগড়া চিন্তাধারার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন এবং কোনোরকম প্রমাণপঞ্জী ছাড়াই নিজের বিচ্যুত চিন্তাধারাকে ইসলামের ধর্মীয় চিন্তা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ ' ইসলাম সকল মাজহাব এ ব্যাপারে একমত যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তার মাঝে তৃতীয় কাউকে মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করাবে এবং ঐ মাধ্যমের কথা উল্লেখ করবে, সে কাফের এবং মুরতাদ,তার রক্ত হালাল এবং তার ধন-সম্পদ মোবাহ। " নবীজীর প্রতি তাওয়াসসুল সম্পর্কে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি শেইখ আব্দুল আযিয বিন আব্দুল্লা..আশ শেইখ মনে করেন, মৃত্যুর পর যেহেতু এই পৃথিবীর সাথে নবীজীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং কোনো কাজ করার শক্তি থাকে না, এমনকি কারো জন্যে দোয়া পর্যন্ত করতে পারে না, এককথায় সর্বপ্রকার কর্মশক্তি হারিয়ে ফেলেন, তাই অক্ষমের প্রতি তাওয়াসসুল করা বিবেক-বুদ্ধি অনুসারে বাতিল এবং শের্‌ক হবে।

" ওহাবি আলেমরা চেষ্টা করছেন কেবল শিয়াদেরকেই নবীজী এবং তাঁর আহলে বাইতের সাথে তাওয়াসসুলকারী হিসেবে দেখাতে এবং তাদেরকে নিকৃষ্টতম কাফের হিসেবে সাব্যস্ত করতে। ওহাবিদের ফতোয়া জারির প্রধান কেন্দ্র সৌদি ইফতা পরিষদ শিয়াদের সাথে বিয়ের ব্যাপারে দেওয়া এক প্রশ্নের জবাবে ফতোয়া দিয়ে লিখেছেঃ শিয়া এবং কমিউনিস্টদের সাথে আহলে সুন্নাতের বিয়ে বৈধ নয় আর যদি বিয়ে হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে,কেননা শিয়ারা আহলে বাইতের প্রতি তাওয়াসসুলকারী, আর এটা মস্ত বড়ো শেরেকি। অথচ ইহুদি খ্রিষ্টানদের সাথে বিয়ের ব্যাপারে তাদের দেওয়া ফতোয়া হলোঃ 'ইহুদি কিংবা খ্রিষ্টান যদি ব্যভিচারী না হয়ে থাকে তাহলে আহলে কিতাব হবার কারণে তাদের সাথে মুসলমানদের বিয়ে জায়েয। ' এখানে আশ্চর্যজনক এবং দুঃখজনক বিষয়টি হলো এই যে ইসলামী পরিভাষায় আলেম নামধারীগণ ইহুদি নাসারার সাথে বিয়েকে বৈধ বলে মনে করে অথচ কোরআন এই দুই দলকে কাফেরদের সারিতে স্থান দিয়ে বলেছেঃ ইহুদীরা বলে ওযাইর আল্লাহ্ পুত্র এবং নাসারারা বলে 'মসীহ আল্লাহ্ পুত্র'। এ হচেছ তাদের মুখের কথা।

এরা পূর্ববর্তী কাফেরদের মত কথা বলে। আল্লাহ্ এদের ধ্বংস করুন, এরা কীভাবে সত্য পথ থেকে বিচ্যুতির পথে চলে যাচেছ? শিয়াদের ব্যাপারে ওহাবিরা কুফুরির অভিযোগ এনে তাদের রক্তকে হালাল বলে ঘোষণা করলেও বাস্তবতা হলো এই যে,আল্লাহর একত্ব, নবী কারিম (সা) এর রেসালাত, কোরআনের প্রতি ঈমান, পরকালের প্রতি ঈমান ইত্যাদির মতো বিষয়গুলোর ব্যাপারে আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাসের সাথে শিয়াদের দৃষ্টিভঙ্গি এক ও অভিন্ন। তাওয়াসসুল নিয়ে ওহাবিদের এ ধরনের চিন্তা আসলে একান্তই ভ্রান্ত। কেননা কোরআন এবং কোরআনের বর্ণনার সাথে পরিচিত সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন যে, তাওয়াসসুল তৌহিদের সাথে তো বৈপরীত্যময় কিংবা অসংলগ্ন নয় ই, বরং আল্লাহর দরবারে দোয়া করা এবং তাঁর নৈকট্য লাভের অন্যতম একটি উপায়ও বটে। প্রত্যেক মুসলমানই জানেন আল্লাহ তায়ালা একক এবং স্বাধীন সত্ত্বা।

বিশ্বের সকল কিছুর মূলে রয়েছেন তিনি। বিশ্বের সকল আবিষ্কার-উদ্ভাবনী তাঁরই ইচ্ছায় কার্যকরী হয়। কোরআনে কারিমে রাসূলে খোদা (সা) কে সম্বোধন করে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছেঃ 'আর যুদ্ধে যখন তুমি তীর নিক্ষেপ করেছিলে, আসলে তা তো তুমি নিক্ষেপ করো নি, বরং তা নিক্ষেপ করেছিলেন আল্লাহ স্বয়ং। ' (সূরা আনফালঃআয়াত-১৭) এ আয়াতে নবীজীর তীর নিক্ষেপের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আল্লাহর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তার মানে ঐ তীর আল্লাহ এবং তাঁর পয়গাম্বর উভয়েই নিক্ষেপ করেছেন।

এ আয়াতের মাধ্যমে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে সকল কাজেরই মূল কর্তা হলেন আল্লাহ,তাঁর ইচ্ছাতেই সকল কাজ সংঘটিত হয়, এদিক থেকে নবীজী হলেন কাজের একটি মাধ্যম,বলা যায় কাজ সমাধা করার গৌণ মাধ্যম,মূখ্য নন,মূখ্য হলেন আল্লাহ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেউ কলম দিয়ে কিছু একটা লিখলো। এখানে কলম হচ্ছে লেখার একটা মাধ্যম যা দিয়ে মানুষ লেখার কাজ করে থাকে। এখন কলম আর লেখক ব্যক্তিটিকে কি একই কাতারে দাঁড় করানো যায়? কিংবা এ দুয়ের মর্যাদা বা অবস্থান কি এক? দুঃখজনকভাবে ওহাবিরা তাওয়াসসুলকে শাফায়াতের মতোই ভুল বুঝেছেন। তারা মাধ্যমকে অদ্বিতীয় স্রষ্টার সাথে একই কাতারে শামিল করে ফেলেছেন।

এ কারণেই তারা মুসলমানদেরকে মুশরিক বলে সাব্যস্ত করেছেন। অথচ তাওয়াসসুল মানে রাসূলে খোদা (সা) কে একক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহর দরবারে পবিত্র একটি মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা বোঝায়, কোনোভাবেই আল্লাহর সাথে নবীজীকে শরিক করা বেোঝায় না। আল্লাহর নৈকট্য লাভ ইবাদাত বন্দেগির পথে মানুষের সবোর্চ্চ সাফল্য। সূরা মায়েদার পঁয়ত্রিশ নম্বর স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কোনো মাধ্যম ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যাবে না। বলা হয়েছেঃ"হে মুমিনগণ! আল্লাহ্কে ভয় কর,আল্লাহর আদেশের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকো! তাঁর নৈকট্য লাভের জন্যে ওসিলা অন্বেষণ কর এবং তাঁর পথে জেহাদ কর যাতে তোমরা সফলকাম হও।

" এই আয়াতে ঈমানদারদের সাফল্যের লক্ষ্যে তিনটি বিশেষ আদেশ দেওয়া হয়েছে। আদেশ তিনটি হলোঃ তাকওয়া এবং পরহেজগারী, আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার উদ্দেশ্য একজন ওসিলা অন্বেষণ করা এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করা। কিন্তু এ আয়াতে ওসিলা বলতে কী বোঝানো হয়েছে? এখানে আসলে ওসিলার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। তবে সর্বাবস্থাতেই এমন কোনো বস্তু কিংবা ব্যক্তিকে বোঝায় যা বা যিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভের কারণ হবেন। এখানে বস্তু বলতে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান, জিহাদ, নামায, রোযা, আল্লাহর ঘরের যিয়ারত, দান, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ইত্যাদিকেও বোঝায়, এগুলোর সবই আল্লাহর নৈকট্য লাভের ওসিলা হতে পারে।

রাসূলে খোদা (সা), ইমামগণ, আল্লাহর নেক বান্দাগণের প্রতি তাওয়াসসুলও সে ধরনেরই ইবাদাতের শামিল, কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী যা আল্লাহর নৈকট্য লাভের কারণ হতে পারে। শ্রোতাবন্ধুরা! এ নিয়ে আরো কথা বলার ইচ্ছে রইলো পরবর্তী আসরে। আজ আর সময় নেই। যারা সঙ্গ দিলেন সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। # পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে এসেছে নবী করিম (সা) নিজেও বান্দাদের প্রতি দয়া ও মহানুভবতা প্রকাশ করেন।

সূরা তাওবার ৫৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ"আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন তার প্রতি যদি তারা সন্তুষ্ট থাকতো,এবং যদি বলতো আল্লাহ আমাদের জন্যে যথেষ্ট,শীঘ্রই আল্লাহ এবং তার পয়গাম্বর তাদেঁর অনুগ্রহ আমাদের প্রতি আরো দান করবেন এবং আমরা আল্লাহর প্রতি আগ্রহী হয়ে রইলাম, তবে তাদের জন্যে তা অবশ্যই উত্তম হতো। "এখানে স্বয়ং কোরআনই রাসূলে খোদা (সা)কে দয়ালু এবং দাতা হিসেবে পরিচয় করেছেন। তাহলে আমরা কেন তাঁর কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করবো না কিংবা তাঁর মহান অবস্থান ও মর্যাদার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করবো না? আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা নিসা'র ৬৪ নম্বর আয়াতে নবীজীর শাফায়াত লাভ করা এবং তার প্রতি তাওয়াসসুল করার জন্যে অনুপ্রাণিত করেছেন এবং নবীজীকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ "যদি তারা স্বীয় জীবনের ওপর অত্যাচার করার পর তোমার নিকট আগমন করতো, তারপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতো, আর রাসূলও তাদের জন্যে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতেন, তবে নিশ্চয়ই তারা আল্লাহকে তওবা কবুলকারী এবং করুণাময় হিসেবেই পেতো। " ওহাবিরা তাওয়াসসুলকে রদ বা প্রত্যাখ্যান করার দলিল হিসেবে কোরআনের বহু আয়াত উদ্ধৃত করেছেন। যেমন সূরা ফাতিরের চৌদ্দ নম্বর আয়াত,যেখানে বলা হয়েছেঃ "তোমরা তাদেরকে আহ্বান করলে তারা তোমাদের আহ্বান শুনবে না এবং শুনলেও তোমাদের আহ্বানে সাড়া দেবে না,তোমরা তাদেরকে যে শরিক করেছো তা তারা কিয়ামতের দিন অস্বীকার করবে।

সর্বজ্ঞানী,সর্ববিষয়ে সচেতন আল্লাহ ছাড়া আর কেউই তোমাকে সত্যাসত্যের ব্যাপারে অবহিত করতে পারে না। " এই সূরাতে মূর্তি পূজকদের উদ্দেশ্যে বেশ কয়েকটি আয়াত এসেছে, এসব আয়াতেও মূর্তি পূজা করতে নিষেধ করা হয়েছে। কেননা মূর্তিগুলো না তাদের পূজাকারীদের চাহিদা বা প্রার্থনাগুলো শুনতে পায়, কিংবা শুনতে পেলেও না তারা তাদের পূজকদের কোনো সমস্যা নিরসণ করার শক্তি রাখে, না এই সৃষ্টি জগতের ওপর তাদের বিন্দুমাত্র ক্ষমতা আছে। কিন্তু ওহাবিদের একদল নবীজী এবং আল্লাহর আরো অনেক মহান বান্দার সাথে মানুষের তাওয়াসসুল করাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্যে এই আয়াতসহ এরকম আরো কিছু কিছু আয়াত উদ্ধৃত করে বলেনঃ কোরআন বলছে, আল্লাহ ছাড়া আর যাকেই ডাকো না কেন-এমনকি পয়গাম্বরকেও-তারা তোমাদের কথা শোনে না, কিংবা শুনলেও তা মঞ্জুর করতে পারে না। ওহাবিরা সূরা আরাফের ১৯৭ নম্বর আয়াতেরও উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে।

যেখানে বলা হয়েছেঃ "আল্লাহ ছাড়া তোমরা যাদেরকে ডাকো, তারা তোমাদের সাহায্য করার কোনো ক্ষমতা রাখে না, এমনকি তারা নিজেদেরকেও সাহায্য করতে পারে না। " এ ধরনের আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে সালাফিরা নবীজী কিংবা ইমামদের রুহের ওপর তাওয়াসসুল করাকে তৌহিদের বিরোধিতা বলে মনে করে। অথচ এসব আয়াতের প্রতি একটু মনোযোগ দিলেই দেখা যাবে আয়াতগুলোতে মূর্তির কথা বলা হয়েছে, যেসব মূর্তি কাঠ পাথরের তৈরি এবং সেগুলোকে তাদের পূজকরা আল্লাহর সাথে শরিক করেছিল,যাদের প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর বরাবরে বিন্দুমাত্র শক্তিও নেই। এ কথা কে না জানে যে, নবী-রাসূল, অলি-আওলিয়া, আল্লাহর পথে শহীদগণকে পবিত্র কোরআন সুস্পষ্টভাবে জীবিত বলে উল্লেখ করেছে! তাঁরা বারযাখি জীবনের অধিকারী। আর বারজাখি জীবনে রুহ বা আত্মার তৎপরতা অনেক বেশি বিস্তৃত কেননা পার্থিব জগতের বস্তুতান্ত্রিক সম্পর্ক থেকে আত্মাগুলো পুরোপুরি মুক্তি লাভ করেছে।

অপরদিকে নিঃসন্দেহে পবিত্র আত্মার প্রতি তাওয়াসসুল করার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর সামনে তাদের স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে প্রতিস্থাপন করা, বরং আল্লাহর কাছে তাদেঁর যে সম্মান ও মর্যাদা রয়েছে বা আল্লাহর কাছে তাদের যে ঘনিষ্ট অবস্থান রয়েছে তাকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করা। তবে হ্যাঁ! কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউই শাফায়াতের আবেদন করবেন না। ঠিক সেভাবেই বিশ্ব প্রতিপালকের অনুমতি ছাড়া কারো প্রতি তাওয়াসসুল করার বিষয়টিও সংঘটিত হবে না। এ কারণেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজীর মাধ্যমে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছেনঃ "মনে রেখো! যাদের চাহিদা বা অভাব অভিযোগ আছে, কিংবা কোনোরকম দুরবস্থায় পড়ে এখন তা থেকে মুক্তি আশা করছে, তাদের উচিত মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পবিত্র আহলের মাধ্যমে আমাকে ডাকা,যাতে সবোর্ত্তম উপায়ে তাদের চাহিদাগুলো মেটানো যায়। " এ কারণেই নবীজীর সাহাবায়ে কেরাম এবং অন্যান্য বুযুর্গানে দ্বীনের জীবনীতে লক্ষ্য করা যাবে, যে কোনো সমস্যায় পড়লে তাঁরা রাসূলে খোদার কবরের পাশে গিয়ে তাওয়াসসুল করতেন এবং রাসূলের পবিত্র আত্মার মাধ্যমে পরোয়ারদেগার আল্লাহর দরবারে সাহায্য প্রার্থনা করতেন।

এ সম্পর্কে শিয়া এবং সুন্নিদের নির্ভরযোগ্য বহু গ্রন্থে অনেক বর্ণনা রয়েছে। রাসূলে খোদা (সা) এর স্ত্রী হযরত আয়েশার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি বর্ণনা রয়েছে। দারমি'র লেখা 'সহিহ' গ্রন্থে আবুল জাওযা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, এক বছর মদিনায় প্রচণ্ড খরা দেখা দিয়েছিল। আয়েশা তখন জনগণকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা যেন এই খরা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে পয়গাম্বরের প্রতি মুতাওয়াসসিল হয়। জনগণ তা-ই করে এবং সেই বছর ব্যাপক বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল।

সহিহ বোখারিতে এসেছে,দ্বিতীয় খলিফা খরা এবং দুর্ভিক্ষের সময় নবীজীর চাচা আব্বাসের প্রতি তাওয়াসসুল করে বলেছিলেনঃ"হে আল্লাহ! রাসূলে খোদার জীবিতাবস্থায় আমরা খরার কবলে পড়লে তাঁর প্রতি তাওয়াসসুল করতাম আর রহমতের বৃষ্টি নাযিল হতো। এখন তাঁর চাচাকে আমরা বৃষ্টির জন্যে আবেদনের ওসিলা করেছি। হে আল্লাহ আমাদেরকে তুমি পানিতে পরিপূর্ণ করে দাও!" বোখারি লিখেছেন, এই তাওয়াসসুলের পর বৃষ্টি নাযিল হয়েছিল। বিশিষ্ট মুফাসসির আলূসিও তাঁর বইয়ের বহু অংশে তাওয়াসসুল সংক্রান্ত অনেক বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁর সেইসব বর্ণনার সারসংক্ষেপ হলো রাসূলে খোদার প্রতি তাওয়াসসুল করার মাঝে কোনো বাধা নেই-না তাঁর জীবিতাবস্থায় কিংবা রেহলাতের পর।

নবীজী ছাড়া অন্যদের প্রতিও তাওয়াসসুল করার মধ্যে কোনো সমস্যা নেই, তবে শর্ত হলো আল্লাহর দরবারে সত্যিকার অর্থেই তাঁর মর্যাদা থাকতে হবে। # ইসলামে যিয়ারতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যিয়ারত মুসলমানদের ইবাদাতের কর্মসূচিগুলোর একটি। তাঁরা শাফায়াতের প্রতি বিশ্বাস অনুযায়ী তাওয়াসসুল এবং পূত-পবিত্র ব্যক্তিত্ববর্গের কবরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে তর্কাতীত বিষয় বলে মনে করে। যদিও ইবনে তাইমিয়ারা নবীজীর কবর যিয়ারত করাকে হারাম বলে মনে করে।

যাই হোক,বিষয়টি নিয়ে আমরা আজকের আসরে কথা বলার চেষ্টা করবো। আগেকার দিনে হাজিগণ রাসূলে খোদার চাচা এবং ওহুদ যুদ্ধের শ্রেষ্ঠ শহীদ হামযা'র কবরের মাটি দিয়ে তাসবিহ তৈরি করতেন। হিজরি ষষ্ঠ শতাব্দির একজন বিখ্যাত কবি খাকানি শেরবানি রাসূলের নামকরা সাহাবি সালমানের মাযার যিয়ারতকারীদের উদ্দেশ্যে তাঁর লেখা একটি কবিতায় উপদেশ দিয়েছেন, সালমানের কবরের মাটি দিয়ে তাসবিহ তৈরি করতে, কেননা এই মহান সাহাবির কবরের পবিত্র মাটির একটা আধ্যাত্মিক মূল্য রয়েছে। তিনি লিখেছেনঃ মক্কা থেকে সবাই নেয় হামযার কবরের মাটির তাসবিহ তুমিও নাও মাদায়েন থেকে সালমানের কবরের তাসবিহ এই ধরনের বক্তব্যের কারণে কোনো মুসলমান তো গোলোযোগ করতোই না বরং মক্কার অগ্রজেরা খাকানির কসিদাকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখতেন। কিন্তু সালাফিয়া মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তাইমিয়া নবীজী (সা) এর কবর যিয়ারত করাকে এমনকি যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করাকেও হারাম বলে ঘোষণা করেছে।

ইবনে তাইমিয়া তার মিনহাজুস সুন্নাহ নামক গ্রন্থে কোনো দলিল প্রমাণ ছাড়াই লিখেছেনঃ "যিয়ারত সম্পর্কে নবীজীর যেসব হাদিসের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেগুলোর সবই মিথ্যা এবং বানোয়াট, ঐ হাদিসগুলোর সনদ সবই দুর্বল বা জায়িফ। " ইবনে তাইমিয়া আরো বলেছেনঃ "নবীজী কিংবা অন্য কারো কবর যিয়ারত করার অর্থ হলো আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ডাকা এবং আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করা,তাই এ ধরনের কাজ পুরোপুরি হারাম এবং শির্ক। " যদিও নবীজী কিংবা বুযুর্গানে দ্বীনের কবর যিয়ারত করা হয় আল্লাহর কাছে তাদেঁর উচ্চ মর্যাদার কারণে,আল্লাহর সাথে তাদেঁরকে তুলনা করে নয়। ইবনে তাইমিয়া এবং ওহাবি ফের্কার প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহহাব শিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরোপ করেছে যে, শিয়ারা তাদের ইমামদের মাযার যিয়ারত করাকে আল্লাহর ঘর কাবার হজ্ব করা থেকেও বড়ো বলে মনে করে। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহহাব "কাশফুশ শাবহাত" নামক বইতে নবী, আউলিয়া এবং আহলে বাইতের ইমামদের কবরের প্রতি শিয়াদের সম্মান প্রদর্শন করাকে অজুহাত বানিয়ে তাদেরকে শির্ক এবং বহু খোদায় বিশ্বাসী বলে অভিযুক্ত করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে ইবনে তাইমিয়া, মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহহাব এবং তাদের অনুসারীদের সবচে বড়ো একটি দুর্বলতা হলো নিজেদের জ্ঞানগত বিভ্রান্তি। তারা দ্বীন সম্পর্কে তাদের অপরিপক্ক জ্ঞান এবং বিচ্যুত মানদণ্ড দিয়েই অন্যদের শেরেকি বা একত্ববাদ বিচার করে থাকে। তারা দ্বীন সম্পর্কে তাদের ভুল উপলব্ধি, ভ্রান্ত জ্ঞান বা ধারণাকে অন্যদের আকিদা-বিশ্বাসের ওপর চাপিয়ে দেয়। অথচ কোরআনে কারিম, বিভিন্ন বর্ণনা এবং ইসলামী জ্ঞান সম্পন্ন নির্ভরযোগ্য আলেমদের ফতোয়া বা রায় ওহাবিদের চেয়ে ভিন্ন। যিয়ারত সম্পর্কে স্বয়ং নবী করিম (সা) এর একটি হাদিস হলোঃ "বেশি বেশি কবর যিয়ারত করবে যাতে পরকালীন পৃথিবীর কথা মনে জাগে।

" আরেকটি হাদিস এরকমঃ "কবর যিয়ারতে যাবে কেননা তার মাঝে তোমাদের জন্যে রয়েছে দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা। " মানুষ কবর যিয়ারত করতে গেলে নিজেদের স্বাভাবিক দুর্বলতার বিষয়টি উপলব্ধি করে। বস্তুগত শক্তি সামর্থের নশ্বরতা খুব কাছে থেকে টের পায়। বিচক্ষণ মুসলমান যাঁরা তাঁরা কবর দেখে বুঝতে পারেন দ্রুত ক্ষীয়মান এই পার্থিব জীবনকে অবহেলায় কাটিয়ে দেওয়া ঠিক নয় বরং অনন্ত জীবনের পাথেয় সঞ্চয়ে সচেষ্ট হওয়া উচিত। রাসূলে খোদা (সা) কিংবা তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের ইমামদের কবর যিয়ারতকালে যিয়ারতকারীগণ প্রকৃতপক্ষে তাদেঁর সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন যে, জীবনে তাদেঁর প্রদর্শিত পথ ছাড়া আর কোনো পথে পা বাড়াবেন না।

নিঃসন্দেহে কবর যিয়ারত হচ্ছে রাসূলের সুন্নাত। অনেক হাদিস গ্রন্থে এসেছে রাসূলে খোদা (সা) মা আমেনার কবর যিয়ারত করতে গিয়ে কান্নাকাটি করতেন। আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলে খোদা (সা) তাঁর মায়ের কবর যিয়ারত করে নিজেও কেঁদেছেন এবং অন্যদেরকেও কাদিয়েঁছেন, তারপর বলেছেন... "কবরগুলোকে যিয়ারত করবে,কেননা কবর যিয়ারত করলে মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। " সূরা তাকাসুরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন একদল মুশরিকের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যারা কবর যিয়ারত করতে গেছে কিন্তু শিক্ষা নেওয়ার জন্যে নয়। এই সূরার ১ এবং ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "আত্মগৌরব এবং প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে আল্লাহ থেকে দূরে রেখেছে।

তোমরা কবর যিয়ারত করতে গেছো এবং তোমাদের মৃত ব্যক্তিদের কবরগুলো গুনেছো। " আল্লাহ মৃতদের সংখ্যা বা কবর গণনার মাধ্যমে গর্ব করাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তবে তাদের যিয়ারত করাকে কোনোভাবেই নিষেধ করেন নি। হিজরি সপ্তম শতাব্দির বিখ্যাত মুফাসসির মুহাম্মাদ কুরতাবি এই আয়াত দুটির ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ "কঠিন হৃদয়গুলোর জন্যে কবর যিয়ারত হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম ঔষধ। কারণ যিয়ারত তাদেরকে আখেরাত এবং মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেবে আর মৃত্যু ও আখেরাতের কথা স্মরণ হলে দুনিয়াবি চাওয়া পাওয়া হ্রাস পাবে এবং দুনিয়ায় থাকার আগ্রহ দূর হবে। " নবীজীর কবর যিয়ারত সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়ার সামগ্রিক বক্তব্য থেকে কয়েকটি পয়েন্ট বেরিয়ে আসে।

যেমন নবীজীর কবর যিয়ারত করা বেদআত এবং হারাম। যারা নবীজী কিংবা অপর কোনো নেককার বান্দার কবর যিয়ারত করার লক্ষ্যে সফরে বের হয়, তারা হারাম কাজের উদ্দেশ্যে সফরে বেরিয়েছে, তাদের উচিত তাদের নামায (কসর না করে) পূর্ণ করা। এ ধরনের সফরকে তিনি গুনাহের কাজ বলেও মনে করেন। ইবনে তাইমিয়ার এ ধরনের কথাবার্তা কেবল যে ভিত্তিহীন এবং বাতিল তাই নয় বরং বেয়াদবিপূর্ণও বটে। ইবনে হাজার আসকালানিসহ বহু ফকিহ ইবনে তাইমিয়ার এসব বক্তব্য খণ্ডন করে রাসূলের বহু হাদিসের উদ্ধৃতিত দিয়ে গ্রন্থ লিখেছেন।

এসব হাদিস ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লা ইবনে ওমর, আনাস ইবনে মালিক, ইবনে আসাকিরের মতো নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের থেকে বর্ণিত হয়েছে। আনাস ইবনে মালিক থেকে বর্ণিত একটি হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করবো আজকের আলোচনা। নবী করিম (সা) বলেছেনঃ "যে-কেউ যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মদিনায় আসবে এবং আমাকে যিয়ারত করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার জন্যে শাফায়াত করবো এবং তার পক্ষ্যে সাক্ষ্য দেবো। বলাবাহুল্য, নবীজীর অনেক সাহাবি এবং তাবেয়িন যুগ যুগ ধরে নবীজীর কবর যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সফর করেছেন। তাই রাসূলে খোদার কবর যিয়ারত করা হারাম-ইবনে তাইমিয়া কিংবা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহহাবের এরকম বক্তব্য মেনে নেওয়ার মানে হলো হালালকে হারাম বলে সাব্যস্ত করা,যা অনেক বড়ো গুনাহের কাজ।

আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের সঠিক উপলব্ধি দান করুন। মুসলমানরা সবসময়ই দ্বীনের মহান মনীষীদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাদেঁরকে স্মরণ করে এসেছে। তাঁরা নবী করিম (সা) এবং আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক সৃষ্টিকারীদেরকে নিজেদের শাফি অর্থাৎ শাফায়াতকারী বলে মনে করেন। সেজন্যেই তাদেঁর কবর যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন। যিয়ারত হলো মূলত সেইসব নেককার মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা আল্লাহর কাছে যাঁরা সম্মানিত এবং মর্যাদাবান।

এ ধরনের ব্যক্তিত্বদের প্রতি সম্মান দেখানো, তাদেঁর মাযারের যারিহ বা লোহার বেষ্টনীতে চুম্বন করা, তাদেঁর হারামে দোয়া করা, নামায পড়া ইত্যাদি সবই আল্লাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করা বা তাঁর নৈকট্য অর্জন করার লক্ষ্যেই করা হয়ে থাকে, আল্লাহর সাথে শরিক করার জন্যে নয়। যেহেতু রাসূলে খোদা (সা), তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের অবস্থান আল্লাহর দরবারে খুবই ঘনিষ্ট সেজন্যে মুসলমানরা তাদেঁর কবর যিয়ারত করার জন্যে বেশি আগ্রহী। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা আমিনী তাঁর "সিরাতানা ওয়া সুন্নাতান" নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ "মদিনা মুনাওয়ারা যে আল্লাহর কাছে সম্মানিত হারাম হিসেবে পরিগণিত এবং সুন্নাতে নববীতেও মদিনা শরিফ, সেখানকার মাটি এবং বাসিন্দারা এমনকি সেখানে যাদেঁরকে দাফন করা হয়েছে তাঁদেরকে অনেক উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন বলে মূল্যায়ন করা হয়, সেটা নবীজী এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্কের কারণে। একইভাবে নবীজী, আল্লাহর আউলিয়া এবং অসিদের সাথে কিংবা সিদ্দিকিন, শুহাদাসহ খাটিঁ মুমিনদের সাথে সম্পর্কের কারণেও সম্মান ও মর্যাদা বাড়ে। " আসলে যিয়ারত মানে কেবল মাযারের ইট পাথর যারিহ গম্বুজ তথা বাহ্যিক দিকটাই নয়-যেমনটি ওহাবিরা মনে করে-বরং যিয়ারতের মধ্যে রয়েছে গোপন শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আধ্যাত্মিকতা তথা আল্লাহর প্রতি ইমানের গভীরতা ইত্যাদি।

যে তার প্রিয়জনকে হারায় বিভিন্ন কারণে তাকে ভুলতে পারে না,তাই বিচিত্র অনুষ্ঠানে তাকে স্মরণ করে এবং তার মাযারে হাজির হয়। প্রিয়জনকে হারানোর ব্যথায় কান্নাকাটি করা মানুষের মধ্যকার সাধারণ একটি রীতি যেই প্রবণতাটি মানুষের প্রকৃতিগত বা স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। সহিহ বোখারি শরিফের সংকলক বোখারি (রহ) লিখেছেনঃ "নবী (সা) এক মহিলাকে একটি কবরের পাশে দেখলেন কান্নাকাটি করছে। তিনি মহিলাকে বললেনঃ "বিরত থাকো এবং প্রিয়জনের দূরত্বে ধৈর্যধারণ করো। " নবীজী বলেন নি তুমি যা করছো তা হারাম, বরং তিনি ঐ মহিলাকে সুস্পষ্টভাবে ধৈর্য ধরার আদেশ দিয়েছেন, যিয়ারত করা থেকে দূরে থাকতে বলেন নি, অথচ সালাফিয়ারা মহিলাদের যিয়ারত করাকে হারাম ঘোষণা করেছে।

হযরত আলি (আ) থেকে বর্ণিত আছেঃ নবী করিম (সা) কে যখন দাফন করা হলো, ফাতেমা (সা) তখন তাঁর কবরের পাশে দাঁড়ালেন এবং কবরের সামান্য একটু মাটি নিয়ে চেহারায় মাখলেন আর কান্নাকাটি করতে করতে দুটি পংক্তি আবৃত্তি করলেন। পংক্তি দুটির বঙ্গানুবাদ এরকমঃ আহমাদের কবরের মাটি শুঁকবে যে একবার প্রয়োজন নেই জীবনে তার দামি সুগন্ধি নেয়ার মস্ত বিপদ এসে ভর করেছে আমার পর উজ্জ্বল দিনও যেন হয়ে যায় রাতের আঁধার॥ আল্লাহ তায়ালা যাকে সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছেন তাঁর প্রতি সম্মান দেখানোটা বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকেও যুক্তিযুক্ত এবং পূণ্যময়, আর যিয়ারত করা এক ধরনের সম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর মাত্র। আল্লামা মাহদি নারকি তাঁর "জামেউস সাআদাত" নামক গ্রন্থে যিয়ারত সম্পর্কে লিখেছেনঃ"জেনে রাখো,পয়গাম্বরগণ কিংবা ইমামদের রুহ মোবারক মৃত্যুর পরও...পার্থিব জগতের ওপর সক্রিয় থাকে। পার্থিব এই জগতের বিষয় আশয় এই পবিত্র আত্মাগুলোর কাছে সুস্পষ্টভাবেই প্রকাশ্য...তাঁরা আল্লাহর দেওয়া অনুগ্রহে খুশি,যাঁরা তাদেঁর কবর যিয়ারত করতে আসেন বা তাদেঁর কবরে উপস্থিত হন সবার ব্যাপারেই অবহিত। যিয়ারতকারীগণের প্রশ্ন, তাদেঁর তাওয়াসসুল, অনুনয়-বিনয়,তাদের শাফায়াতের আবেদন ইত্যাদি শুনতে পান।

পবিত্র এইসব রূহের সহৃদয় দয়ার মৃদুমন্দ যিয়ারতকারীদের ওপর প্রবাহিত হয় এবং তাদেঁর নূর যিয়ারতকারীদের ওপর বিকীর্ণ হয়। পবিত্র এই আত্মাগুলো যিয়ারতকারীদের চাওয়া পাওয়া, তাদের পাপ ক্ষমা করা, বিপদ-মুসিবত দূর করার ব্যাপারে আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। নবী আকরাম (সা) কিংবা পবিত্র ইমামগণের মাযার যিয়ারতকে মুস্তাহাব বলে অনুমোদন করার এটাই হলো মূল রহস্য। " কোরআনও কবর যিয়ারতকারীদেরকে তো কাফের বলেই নি বরং পরোক্ষভাবে যিয়ারত করাকে অনুমোদন করেছে। সূরা তাওবার ৮৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীজীকে সম্বোধন করে বলেছেনঃ "কক্ষণো কোনো মুনাফিকের নামাযে জানাযা পড়বেন না কিংবা কক্ষণো তাদের কবরের পাশে দাড়িয়েঁ ক্ষমার আবেদন জানিয়ে দোয়া করবেন না! কেননা তারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে এবং ফাসেক অবস্থায় মারা গেছে।

" এ আয়াত থেকে বোঝা যায় নবীজী মুমিনদের মাযারের পাশে দাড়িয়েঁ তাদের ক্ষমার জন্যে দোয়া করতেন। অবশ্য মুনাফিকরা এই অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, কেবলমাত্র মুমিনরাই নবীজীর এই দোয়ার বরকত লাভে ধন্য হয়েছে। এইসব বক্তব্য থেকে স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় কবর যিয়ারত করাটা কেবল বৈধই নয় বরং নবীজীর একটি সুন্নাতও বটে। সালাফিয়া মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তাইমিয়া বুযুর্গানে দ্বীনের কবর যিয়ারত করাকে "কবর পূজা" বলে অভিহিত করে এটাকে জাহেলিয়াতের যুগের মূর্তি পূজার সাথে তুলনা করেছেন। দ্বাদশ শতাব্দিতে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহহাব -আলে সৌদের সহযোগিতায় ইবনে তাইমিয়ার আকিদা বিস্তার ঘটিয়েছেন-যিয়ারতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং হারাম শরিফ, কবর ও অন্যান্য পবিত্র স্থাপনা ধ্বংস করে ফেলেন।

তার আকিদার বিরোধীদের তিনি কাফের ঘোষণা করেন এবং তাদেরকে হত্যা করা ওয়াজিব বলে রায় দেন। মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহহাবের ভাই সোলাইমান সমকালীন বিখ্যাত একজন আলেম ছিলেন। তিনি তাঁর ভাইয়ের আকিদাকে প্রত্যাখ্যান করে বহু চিঠি এবং বই লেখেন। সাওয়ায়েকুল ইলাহিয়া" নামক বইতে তিনি মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহহাবকে লিখেছেনঃ "প্রত্যেক মাযহাবের আলেমগণই একজন মুসলমানের মুরতাদ হবার কারণগুলো উল্লেখ করেছেন। তাদেঁর কেউই বলেন নি যে-কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্যে মানত করবে কিংবা অন্য কারো কাছে প্রয়োজনীয়তার কথা বলবে সে মুরতাদ হয়ে যাবে।

কারো কবর স্পর্শ করা, কিংবা কবরের মাটি নেওয়া ইত্যাদিদ কাজ করলে মুরতাদ হয়ে যাবে কিংবা তাকে হত্যা করা ওয়াজিব হয়ে যাবে-এরকম কোনো হুকুম কেউই দেন নি। তুমি তোমার নিজস্ব চিন্তাধারা অনুযায়ী কাজ করে মুসলমানদের এজমা থেকে পৃথক হয়ে গেছো বিশেষ করে কবর স্পর্শ করা, কিংবা কবরের মাটি নেওয়ার কাজ করলে তাকে কাফের ফতোয়া দিয়ে এমনকি যে তাকে কাফের বলবে না তাকেও কাফের বলে প্রকারান্তরে সমস্ত উম্মাতে মুহাম্মাদ (সা) কেই কাফের বলে সাব্যস্ত করেছো। অথচ সাত শ' বছরেরও বেশি সময় ধরে সমগ্র মুসলিম ভূখণ্ডেই এইসব আমল হয়ে আসছে, কিন্তু কোনো আলেম কাউকে এজন্যে কাফের বা মুরতাদ বলে ফতোয়া দেয় নি। .." যিয়ারতের উদ্দেশ্য বস্তুজাগতিক গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আধ্যাত্মিকতার জগতে প্রবেশ করা এবং এক আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ সালাফিরা মরহুম শহিদান, নেককার ও সালেহ বান্দাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকারীকে মুশরিক বলে অভিহিত করে তাদের হত্যা করাকে ওয়াজিব বলে ঘোষণা করেছে।

যদিও বুযুর্গানে দ্বীনের কবর যিয়ারত করাটা মুসলমানদের জন্যে গর্ব এবং আন্তরিক প্রশান্তির কারণ। আল্লাহর সবাইকে শুভবুদ্ধি দিন। # মুসলমানরা সবসময়ই দ্বীনের মহান মনীষীদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাঁদেরকে স্মরণ করে এসেছে। এমনকি তাঁদের সমাধিসৌধ নির্মাণ করে মাযারের পাশে মসজিদ তৈরি করে ইবাদাত বন্দেগির মধ্য দিয়ে মনীষীদের স্মৃতিকে মনের ভেতরে জাগ্রত রেখে এসেছে। কিন্তু ওহাবিরা আল্লাহর অলি, সালেহিন এমনকি নবীদের কবরের ওপরেও মসজিদ কিংবা সমাধিসৌধ নির্মাণ করাকে বেদআত বলে অভিহিত করেছে।

এভাবে বেদআতের প্রসঙ্গটি সর্বপ্রথম উত্থাপন করেছিলেন সালাফিয়া মতবাদের তাত্ত্বিক ইবনে তাইমিয়া এবং তারপরে তাঁরই সুযোগ্য ছাত্র ইবনে কায়্যেম জোওযি। তারা কবরের ওপর কোনো স্থাপনা নির্মাণ করাকে হারাম ঘোষণা করেছেন এবং ঐ ধরনের স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার জন্যে ফতোয়া জারি করেছেন। ইবনে কায়্যেম তার বইতে লিখেছেন এ ধরনের স্থাপনা ধ্বংস করার কাজে এমনকি একটি দিনও বিলম্ব করা জায়েয নয়। এইসব নীতিমালার ভিত্তিতে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওহাবের মাধ্যমে ওহাবি মতবাদ সংগঠিত হবার পর এবং আলে সৌদের পৃষ্ঠপোষকতার পর পবিত্র স্থাপনাগুলোতে ব্যাপক সেনা সমাবেশ করা হয় এবং সেগুলোকে ধ্বংস করে, সেখানকার সম্পদ লুট করা হয়। ১৯২৬ সালে মদিনায় বাকি কবরস্থানে নবী করিম (সা) এর সাহাবিবৃন্দ এবং খান্দানের মাযারগুলোকে ধ্বংস করার ঘটনা ওহাবিদের সবচেয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও ধৃষ্টতামূলক আচরণ হিসেবে পরিগণিত।

অথচ আজ পর্যন্তও সালাফি বা ওহাবি আলেমরা তাদের এই অমানবিক, নোংরা ও ধৃষ্টতাপূর্ণ কাজের পক্ষে দ্বীনী প্রমাণ তো দূরের কথা, বুদ্ধিবৃত্তিক কোনো যুক্তিও দেখাতে পারে নি। ইসলামের দ্বীনী নিদর্শনগুলোর প্রতি সম্মান দেখানো বা সেগুলোকে সংরক্ষণ করা মহান আল্লাহরই নির্দেশ বা পরামর্শ। সূরায়ে হাজ্জের বত্রিশ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেনঃ "কেউ যদি ঐশী নিদর্শনগুলোকে সম্মান করে তাহলে সে যেন তার আন্তরিক তাকওয়ারই বহিপ্রকাশ ঘটালো। " সাফা, মারওয়া, মাশআর, মিনা এবং হজ্জের সামগ্রিক আনুষ্ঠানিকতা সবই ঐশী নিদর্শন হিসেবে পরিগণিত। একইভাবে নবী-রাসূলসহ সালেহিনদের কবরের প্রতি সম্মান দেখানোটাও ইসলামের একটি দ্বীনী দায়িত্ব এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায়।

কেননা ইসলামের মহান নবী এবং আল্লাহর অন্যান্য অলি-আওলিয়ারা হলেন আল্লাহর যমিনে তাঁরি সর্বোত্তম নিদর্শন,তাঁদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি উপায় হলো তাঁদের কবর এবং কীর্তিগুলোকে সংরক্ষণ করা। নবী, রাসূল আর সালেহিনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা বা তাঁদের কবরগুলোকে সংরক্ষণ করার মধ্য দিয়ে দ্বীনে ইসলামের প্রতি মুসলমানদের ভালোবাসাই প্রকাশ পায়। কোরআনে কারিমও এই কাজকে পছন্দনীয় বলে উল্লেখ করে আদেশ দিয়েছে, কেবল নবীজী (সা) কেই নয় বরং তাঁর আত্মীয় স্বজনদের ব্যাপারেও সবাই যেন সহানুভূতিশীল হয়। সূরা শূরা'র তেইশ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছেঃ "..বলো, আমি এর (অর্থাৎ আমার রেসালাতের) বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে-আমার-আত্মীয়দের (অর্থাৎ আহলে বাইতের) সৌহার্দ ছাড়া আর কোনো প্রতিদান চাই না...। " এই আয়াত অনুযায়ী প্রশ্ন দাঁড়ায়, রেসালাতের খান্দানের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করার একটা উপায় কি আল্লাহর অলিদের স্মৃতিগুলো, তাঁদের পবিত্র মাযারগুলো কিংবা তাঁদের বাসস্থানগুলো সংরক্ষণ করা নয়? মজার ব্যা।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.