আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার হৃদয়ে যার মরন নেই

ভাতের মজা কিছুতেই পাই না। জনাব মাহবুবুর রহমান চৌধুরী। আমার হৃদয়ের গভীরে খোদিত এক নাম। সততার এক বিমূর্ত প্রতীক। আজ থেকে ষোল বছর আগে যাকে এই পৃথিবী বিদায় জানিয়েছিল এক অসময়ে।

মনে হলে এখন আমার বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। তখন কিন্তু একটুও কাঁদিনি। কারন মৃত্যু কি জিনিস তখন তা জানতাম না। শুধু জানতাম কেউ মারা গেলে বলতে হয় ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজিয়ূন। আমি ঠিক ঠিক সেদিন বলেছিলাম।

বুকটা কেপেছিল হয়ত একটু। চোখ ভিজেনি। এখন ভিজে কান্না গাল বেয়ে নেমে পড়ছে! আমার মনটা যখন নিতান্তই এক কাঁদামাটি ছিল তখন সেই কাঁদামাটিকে গড়ে তোলার এক অনন্য কারিগরের দায়িত্বে ছিলেন জনাব মাহবুব স্যার। আমাদের এলাকার সরকারি প্রাইমারী বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন উনি। সবাই খুব ভয় পেত উনাকে।

কিন্তু কি কারনে জানি(পরে আমি কারনটা আমি জানতে পেরেছি) আমাকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। প্রত্যেকদিন একবার উনার অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে গিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন ই করতেন। ক্লাসে গিয়ে অন্যান্য শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন। বলতেন ও হল আমার স্যারের ছেলে। আমার আব্বা নাকি উনার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন তাই তিনি আমার এত খোঁজ খবর নিতেন।

আর আমি আব্বার চেহারা পেয়েছি তাই স্যার আমাকে সব সময় দেখতে চাইতেন। আমাকে দেখলে উনার প্রিয় স্যার কে দেখা হয়ে যায়। তাই বুঝি এত সমাদর! মাহবুব স্যারের ছেলে আমাদের সাথে একই ক্লাসে পড়ত। দেখতে ঠিক স্যারের কার্বন কপি ছিল। আমি দুই চউক্ষে ওকে দেখতে পারতাম না।

ওটা একটা বদের হাড্ডি ছিল। গালি গালাজ ছিল ওর কাছে একদম ডাল ভাত ব্যাপার। নাম না বিগড়িয়ে কাউকে ডেকেছে বলে মনে পড়ে না। স্যার এত ভাল মানুষ, আর উনার ছেলেটা হইসে একটা আস্ত বেত্তমিজ- এটা ছিল আমার আক্ষেপ। আর মাহবুব স্যার আক্ষেপ করে বলতেন- তোমার আব্বা এত বড় একজন জ্ঞানী গুণী মানুষ আর তুমি হইস তার উল্টাটা।

না আছে কোন জ্ঞান আর না আছে কোন গুন!! স্যারের বড়ই আক্ষেপ ছিল। স্যার আপনি জানেন না, এই আক্ষেপটা শুধু আপনার একার ছিল না, এখন আমারও আছে!!! হাদারাম ডিএনএ শুধু চেহারাটাই পাচার করেছে। অন্য কোন ভাল জিনিস ই পাচার করতে পারেনি আমার মধ্যে স্যার শুধু আমার নয় অন্যান্য ছাত্রদেরও সমভাবে নিতেন। ছাত্র ছাত্রিদের পড়ালেখার খবর তিনি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতেন। দুই ক্লাসের মাঝখানে যে বিরতি থাকত তাতে তিনি অনায়াসেই ক্লাসে ঢুকে যেতেন।

হাতে একটা লম্বা বেত থাকত ঠিক ই কিন্তু কাউকে কখনো মারতে দেখিনি। শুধু ভয় দেখাতেন। আর এতেই কাজ হত ষোল আনা। ভাল ছাত্র দেখে তাদের মেধা যাচাই করতেন। যারা ভাল করত তাদের চার আনা দামের চকলেট উপহার দিতেন।

হাকিম নামের এক ধরনের কনিষ্ঠা আঙ্গুলের সমান চকলেট পাওয়া যেত তখন। এক টাকায় চারটা। কমলালেবুর স্বাদ। চমৎকার। আমি একদিন একটা চকলেট পেয়েছিলাম।

পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের একটা কবিতা ছিল আসমানী। স্যার সেটাকে মুখস্ত আবৃত্তি করতে বললেন। আমি গরগর করে আবৃত্তি করে গেলাম। স্যার কবিতাটি থেকে শেষের লাইনটি আবৃত্তি করতে বললেন। আমি করলাম- বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।

বৈদ্য শব্দটির অর্থ কি বল। স্যার জিজ্ঞেস করলেন। আমি উত্তর দিলাম চিকিৎসক। স্যার খুশি হয়ে বললেন শাবাশ! শার্টের পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে দিলেন আমাকে। আমি ত মহা খুশি।

এটা মনে হয় ক্লাস থ্রি নয়ত ফোরের ঘটনা হবে। ক্লাস ফাইভে যখন উঠি তখন উনার উৎসাহে প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় নাম লেখালাম। আলাদা করে বৃত্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং ক্লাস করানো হত। স্যার উনার পকেট থেকে কোচিং এ ভর্তির টাকাটা দিয়ে দেন। তিন মাস কোচিং হয়েছিল।

সকাল বেলা ইংরেজী আর অঙ্ক প্রাইভেট পড়তাম এক স্যারের কাছে গিয়ে। দশটা থেকে শুরু হত স্কুলের ক্লাস তাই সকাল বেলা ঠিক মত নাস্তা করতে পারতাম না। দুপুরে টিফিনের সময় এটা সেটা খেয়ে নিতাম। আমিও দেখতে ঠিক আসমানীর মতই রোগা আর হ্যাংলা পাতলা ছিলাম। হেহেহহেহে... তো স্যার আমাকে টিফিনের সময় উনার অফিসে ডেকে নিতেন।

স্কুলের দপ্তরী উনার জন্য হোটেল থেকে পরোটা আর ডালভাজি এনে দিত। স্যার আর উনার ছেলের জন্য। সেখান থেকে স্যার আমাকে প্রত্যেকদিন খেতে দিতেন। আমি লজ্জায় খেতে চাইতাম না। কিন্তু স্যার জোর করে খাইয়ে দিতেন।

বলতেন না খেলে বেয়াদবি হবে। আর বলতেন বাসায় যেন না বলি। কিছুদিন পরে দুপুরের পরোটা ভাজি আনার দায়িত্বটা পরে আমার উপর। আমিও আনন্দের সাথে কিনে আনতাম। পরোটা ভাজি খাচ্ছি তাতে আনন্দ ছিল না।

আনন্দটা ছিল স্যারের সাথে খাচ্ছি। কি আনন্দ! তিন মাস পরে বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং শেষ হয়। ডিসেম্বর মাসে বৃত্তি পরীক্ষা দেই। ১৭ই ডিসেম্বর আমার বৃত্তি পরীক্ষা ছিল। সে বছর আমার বিজয় দিবস ১৬ তারিখে ছিল না হেহেহেহে... বিজয় দিবস আসে ২০ তারিখের পর।

যাই হোক, ভাল মতন পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা হলে স্যার দেখতেও গিয়েছিলেন। মনে সাহস দিয়ে আসলেন। উনার ছেলেটা পরীক্ষা দিতে পারেনি। তাই স্যারের মনটা খারাপ ছিল অনেক।

আমাকে বলেছিলেন- তুমি আমার আরেকটা ছেলে। তুমি পরীক্ষা দিচ্ছ আমি এতেই অনেক খুশি। ঠিকটাক মত পরীক্ষা দিলাম। তিন মাস পরে রেজাল্ট বের হল। তখন আমি ক্লাস সিক্সে উঠে গেছি।

ভর্তি হয়েছি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। রেজাল্ট আনতে গেলেন আমার মাহবুব স্যার। সন্ধ্যা বেলা কে যেন বাসার কলিং বেল টিপল। আমি খুলে দিলাম। মাত্র বিকেলের ঘুম সেরে উঠলাম।

চোখ ঢলতে ঢলতে চেয়ে দেখি মাহবুব স্যার দরজায় দাঁড়িয়ে! প্রথমেই এক ঝটকায় স্যার আমাকে কোলে তুলে নিলেন! আর আমাকে অনেক আদর করতে লাগলেন। বললেন- তুমি ত টেলেন্টফুলে বৃত্তি পেয়েছ। তুমি পুরো থানার মধ্যে ফার্স্ট হয়েছ!! আমার যে কি ফুর্তি লাগছে!!! দোয়া করি যেন জীবনে অনেক বড় হও!!!! [স্যারের দোয়াটা ফলেনি আজ অবধি ছয় ফুট লম্বাও হতে পারলাম না] তার এক বছর পর। আমি তখন সবে মাত্র ক্লাস সেভেনে উঠেছি। একদিন খবর পেলাম।

কি এক সাংস্কৃতিক সংঘটন নাকি আমাদের কে সম্বর্ধনা দিবে। উপহার হিসেবে থাকবে একটা সার্টিফিকেট আর একটা এটি দেবের(A.T DEB) ইংলিশ টু বাংলা ডিকশনারী। অনুষ্ঠানটা হবে আমাদের স্কুলে। পুরস্কার দিবেন মাহবুব স্যার। যথারীতি সেই দিনটি এল কিন্তু আমি যেতে পারিনি।

মারাত্নক অসুস্থ ছিলাম। চিকেন পক্স হয়েছিল তাই যেতে পারি নি। স্যার আমার বন্ধুদের মাধ্যমে সার্টিফিকেট আর ডিকশনারীটি পাঠিয়ে দেন। ডিকশনারিটির পেছনে স্যারের হাতে নীল কালি দিয়ে লিখা ছিল- জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শিক্ষার কোন শেষ নেই!!! তাই যত পার জ্ঞান আহরন কর। এর কিছুদিন পর একদিন সকাল বেলা শুনি এলাকায় মাইকে করে খবর দিয়ে যাচ্ছে অমুক জায়গা নিবাসী জনাব মাহবুবুর রহমান চৌধুরী সাহেব উনার নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেছেন।

ইন্না লিল্লাহি ওয়া... ভাবলাম মৃত্যু দিয়ে বুঝি স্যারের জ্ঞান আহরনের ইতি ঘটেছে!!! স্যার মারা গেছেন এটা এখনো ভাবতে পারি না। স্যারের মত মানুষরা মরতে পারেন না। এরা অবিনশ্বর, অমর। মৃত্যুঞ্জয়ী!!! আর হৃদয়জয়ী ত বটেই!!! স্যারের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। ************************************************* অনেকদিন পর আসমানি কবিতাটা মনে পড়ল তাই সবার সাথে শেয়ার করলাম।

আসমানী পল্লীকবি জসীমউদ্দিন। আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি, একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি। একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে, তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে। পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক-খান হাড়, সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার।

মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি থাপড়েতে নিবিয়ে দেছে দারুণ অভাব আসি। পরনে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস, সোনালি তার গা বরণের করছে উপহাস। ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি, সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি। বাঁশির মতো সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে, হয় নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে। আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল্-বিল্-বিল করে।

ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে, সেই জলেতে রান্না-খাওয়া আসমানীদের চলে। পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার, বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর। ************************************** ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।