আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি ঢোলা হাফ প্যান্ট

বিদ্যা লাভের প্রতি আমার কতটুকু আগ্রহ আছে জানি না। তবে স্কুলের প্রতি আমার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল ছোটবেলা থেকেই। সেই সময় গ্রামের স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের টিফিনের সময় বিস্কিট ও গুড়া দুধ দেয়া হত। আর প্রতি তিন মাস পর পর একটা এক সেট গেঞ্জি ও ঢোলা হাফ প্যান্ট । গ্রামের সব ছেলে মেয়ে সেই গেঞ্জি ও ঢোলা হাফ প্যান্ট পরে স্কুলে আসত।

আর আমরা ছোটরা সেই গেঞ্জি ও ঢোলা হাফ পেন্টের আশায়ে প্রতিদিন স্কুলে যেতাম, কারন জানতাম না কোনদিন সেই কাংক্ষিত গেঞ্জি ও ঢোলা হাফ প্যান্ট পাওয়া যায়। বিকালে খেলার সময় সবাই এক ড্রেস পরে খেলতে আসে। আর আমরা ছোটরা হিংসা চোখে দূরে দাড়িয়ে থাকতাম। আর ভাবতাম ইস আমার যদি থাকত। সেই সময় আমার কিছু চাচাতো ভাই (আমাদের তিন বা চার ক্লাস বড়) সেই গেঞ্জি আর প্যান্ট পরে বেশ ভাব নিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে চলত।

একদিন বিকালে খেলার সময় কিভাবে যেন দেলু ভাইয়ের হাফ প্যান্ন্টের একটি বিশেষ স্থানে ছিঁড়ে গেল। দেলু ভাই টের পেল কিনা জানি না, তবে সেই মাঠের সবাই সেটা টের পেল। দেলু ভাই সেটা টের পেল সবার শেষে। দেলু ভাই লজ্জা পেয়ে দৌড়ে বাড়িতে চলে গেল। আর আমরা বেশ খুশি মনে বাড়ি ফিরলাম।

মনে মনে ভাবলাম যাক একটা চরম প্রতিশোধ নেয়া হল। দেলু ভাই কয়েকদিন বাড়ি থেকে বের হলেন না। আমরা ছোটরা বেশ খুশি মনে কয়েক দিন বাইরে খেলাধূলা করালাম। কারন দেলু ভাই ছিল আমাদের কাছে অনেকটা আতংকের মত। কোন কাজ করতে গেলেই আম্মার কাছে নালিশ করতেন।

আমরা প্রতিদিন স্কুলে যেতাম আর টিফিনের জন্য অপেক্ষা করতাম। যদিও আমাদের কোন টিফিন প্রিরিয়ড ছিল না। কারণ টিফিন প্রিরিয়ড ছিল শুধু ক্লাস থ্রী উপরের ক্লাস গুলোতে। তার পর ও আমরা টিফিন প্রিরিয়ডে অন্য ক্লাস এর সামনে দাড়িয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে সেই ক্লাস এর স্যাররা দয়া করে যা দিতেন।

এক ধরনের জিদ জাগত মনে মনে, গেঞ্জি হাফ পেন্ট পাই না সেটা ঠিক আছে কিন্তু বিস্কুট ও দুধ পাই না, সেটা কেমন? আমরা দুধের গুড়া হাতে নিয়ে চাটতে চাটতে বাড়ি ফিরতাম, আর মনে মনে সরকার নামের সেই ব্যক্তি কে গালি দিতাম। আর আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করতাম যেন আল্লাহ্‌ আমাদের দ্রুত ক্লাস থ্রীতে তুলে দেন। আল্লাহ্‌ মনে হয় আমাদের দোয়া কবুল করলেন। না ক্লাস থ্রীতে উঠতে হল না। কয়েক দিন পর আমাদের স্কুলের হেডস্যার, সালাম স্যার আমাদের ক্লাস বললেন, এখন থেকে ক্লাস ছুটির পর আমরাও বিস্কুট আর দুধ পাব।

কিন্তু আমরা সেই কারনে খুশি হলাম না, কারণ বিস্কুট আর দুধ আমরা প্রতিদিন এমনিতেই পাই। খুশি হলাম অন্য কারনে, তা হল এখন থেকে যে প্রতিদিন স্কুলে আসবে তিন মাস পরপর সে ও গেঞ্জি আর হাফ পেন্ট পাবে। আমরা খুশিতে সেইদিন স্যাররের জন্য অনেক দোয়া করলাম, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম পরের জুম্মা নামাজে স্যাররের জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করব। আমরা সব সময় এমনিতেই স্কুলে যাই। এই কথা শুনার পর আমাদের উৎসাহ দিগুন বেড়ে গেল।

কখনো ক্লাস এ দেরিতে যেতাম না, যদি নাম ডেকে ফেলে! ঝড় বৃষ্টি কোনটাই পারত না আমাদের স্কুল যাওয়া রোধ করতে। এখন আর অন্য ক্লাস এর সামনে দাড়িয়ে নয়, নিজেদের ক্লাস এ বিস্কুট আর গুড়া দুধ পেতে শুরু করলাম। এবার মনে মনে সরকার নামের লোকটাকে ধন্যবাদ দিতে শুরু করলাম। কিন্তু কিছু দিন পরেই সেই বিস্কুট আর দুধের গুড়া কোনটাই ভাল লাগলো না। কিন্তু স্কুলে যেতেই হবে............ একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে বন্ধুদের সাথে অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজলাম।

সেই দিন রাত থেকেই প্রচণ্ড জ্বর। পর দিন সকালেও একই অবস্থা। কিন্তু স্কুলেতো যেতেই হবে। কিন্তু মা বাবা কেও আমাকে স্কুলে যেতে দিলেন না। বিছানায়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদলাম।

সবাই ভাবলও আমার জ্বর মনে হয় অনেক বেশি। মা আমার মাথায় পানি ঢাললও অনেকক্ষণ। আমি শুধু কাঁদতেই থাকলাম। মনে মনে গেঞ্জি আর হাফ প্যান্টের দুঃখে আমার চোখ বার বার ভিজে যেতে লাগলো। সুস্থ হলে কয়েক দিন পরে আবার স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম।

অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষন, স্কুলের দপ্তরিকে দেখলাম এক বস্তা গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট নিয়ে আমাদের ক্লাস এর দিকে আসছে। আমরা সবাই খুব খুশি। স্যার একজন একজন করে নাম ডাকছে আর সে সামনে গিয়ে গেঞ্জি আর হাফ পেন্ট নিয়ে আসছে। একজন একজন করে স্যার প্রায় সবার নাম ডাকল, কিন্তু আমি আর আমাদের ক্লাস আর কয়েক জন শুধু বাদ গেলাম। স্যার বলল আমরা ক্লাস এ রেগুলার না, তাই আমরা পাব না, গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট নিয়ে দপ্তরি চলে গেল।

আমি আর কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। স্যারের সামনেই কাঁদতে শুরু করলাম। স্যার বলল কাঁদবি না, একদম চুপ, স্কুলে ঠিক ভাবে আসতে পারিস না? কাঁদলে একদম মেরে ফেলবো। আমার কান্না যেন আরও বেড়ে যায়। অবশেষে স্যার হেডস্যারের কাছ থেকে বলে আমাদের বাকিদের কে গেঞ্জি আর প্যান্ট দেয়।

কিন্তু ততক্ষনে ছোটদের গেঞ্জি আর প্যান্ট শেষ। বড় ক্লাসের ছাত্রদেরগুলু শুধু আছে। আমরা সেই গেঞ্জি আর প্যান্ট নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাসায় এসে পরে দেখি গেঞ্জি যেন পাঞ্জবি আর হাফ পেন্ট যেন ফুল প্যান্ট। আমি সেই ড্রেস পরে বিকালে খেলতে বেরুলাম।

কিন্তু বেশিক্ষন খেললাম না যদি নষ্ট হয়ে যায়। সন্ধ্যায়ে বাসায়ে ফিরে আয়নার সামনে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে দেখলাম, না অতটা খারাপ না। তারপর ড্রেস পালটে অন্য ড্রেস পরলাম। তারপর সুন্দর করে ভাঁজ করে আলনার উপর রেখে দিলাম। পরদিন সকালে উঠে দেখি আমার গেঞ্জি ঠিকই আছে কিন্তু আমার হাফ প্যান্ট কই? কাকে বলব? কাকে ধরব? সবারটাই তো একই রকম! চোখ ফেটে কান্না আসতে শুরু করল! সারাদিন বাসা থেকে বের হলাম না, স্কুলেও গেলাম না।

বিকালে মাঠে খেলতে গিয়ে দেখি দেলু ভাই একটা নতুন হাফ প্যান্ট পরে খেলছে, কিন্তু আজ তার প্যান্টের সেই বিশেষ স্থানে ছেঁড়া নেই........................ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.