আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নক্ষত্রের সন্তান

( এমনও হতে পারে অতীতে কোনো একসময় এমনটা লিখেছিলাম, মনে নেই, তাই পুনরাবৃত্তির সম্ভবনা মাথায় রেখেই পুন:লিখিত বলা যায়) Whatever else it may be, at the level of chemistry life is fantastically mundane: carbon, hydrogen, oxygen and nitrogen, a little calcium, a dash of sulphur, a light dusting of other very ordinary elements - nothing you wouldn't find in any ordinary pharmacy - and that's all you need. The only thing special about the atoms that make you is that they make you. That is, of course, the miracle of life. - Bill Bryson কোনো অলৌকিক ব্যাখ্যা নয় বরং বিজ্ঞান সবসময়ই প্রতিটি ঘটনার গ্রহনযোগ্য যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে চায়। যা কিছু বিদ্যমান এবং যা কিছু পর্যবেক্ষণলব্ধ সব বিষয়ের যৌক্তিক ব্যাখ্যা সম্ভব, আমাদের বিদ্যমান বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অনেক ধরণের অসামঞ্জস্যতা এখনও বিদ্যমান, তারপরও মহাবিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ের অলৌকিক ব্যাখ্যার চেয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা অনেক বেশী যৌক্তিক এবং আকর্ষণীয়। হিংটিংছট, এবরাকাড্যাবরা কিংবা ইনি মিনি মাইনি ডো কোনো রকম যাদুকরী শব্দের বাইরে বিজ্ঞান নিজেই অনেক বেশী আকর্ষণীয়। বিজ্ঞান যেসব সম্ভবনার কথা বিবেচনা করে সেখানে ধর্মপুস্তকের যবতীয় ছন্দবদ্ধ বাক্যগুলো নিতান্ত ছেলেমানুষী ছড়ায় রূপান্তরিত হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের ভেতরের কৌতুহলগুলোকে নিপূন অস্ত্রোপচারে একেবারে মস্তিস্ক থেকে ছেঁটে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, সুতরাং আমাদের ভেতরে তেমন কৌতুহল জন্ম নেয় না।

আমরা প্রশ্ন করতে দ্বিধাবোধ করি এমন কি প্রশ্ন করাটাকেও আপত্তিকর বিবেচনা করি। স্টিফেন ওয়াইনবার্গ "দি ফার্স্ট থ্রি মিনিটস" একটি বই লিখেছিলেন, বিজ্ঞানে আগ্রহী, বিজ্ঞানমনস্ক সাধারণ পাঠকদের জন্যে লেখা এই বইটিতে মহাবিশ্বের উদ্ভব এবং এর প্রথম তিন মিনিটে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর যৌক্তিক বর্ণনা আছে, সেখানে অবশ্য একটাই অনুমাণ, মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিলো "হট বিগব্যাং" এ। যদি মহাবিশ্ব হট বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে শুরু হয়ে থাকে তাহলে এর প্রথম তিন মিনিটে যা যা ঘটতে পারে, বর্তমানের মহাবিশ্বকে পর্যালোচনা করে সেটার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। সেখানে বিজ্ঞানের অন্য একটি ধারণার উপরে ভিত্তি করে ওয়াইনবার্গ একটি উপসংহারে এসেছেন- যদি আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বে বস্তু-শক্তি-ভরের ঘনত্ব সীমান্তবর্তী মাণের বেশী হয় তাহলে মহাবিশ্ব পুনরায় সংকুচিত হবে এবং মহাবিশ্বের প্রথম তিন মিনিটের ঘটনাগুলো বিপরীতক্রমে ঘটবে। যদি বস্তুকণা ও শক্তির গড় ঘনত্ব সীমান্তবর্তী মানের চেয়ে বেশী হয় তাহলে যে মহাবিশ্ব বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে শুরু হয়েছিলো তা বিগ ক্রাঞ্চের মাধ্যমে সমাপ্ত হবে।

আবার পুনরায় নতুন করে মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটবে কি না এমন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়, যদি পূর্বতম পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে পুনরায় বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের পুন:সূচনা হবে এবং সেই মহাবিশ্বে বর্তমান মহাবিশ্বের কোনো স্মৃতি থাকবে না। প্রথম তিন মিনিটে যা ঘটেছিলো কিংবা শেষ তিন মিনিটে যা ঘটবে সেসব নিয়ে অনুমাণ বাদ দিলেও অনেক আকর্ষণীয় ঘটনা ঘটছে মহাবিশ্বে। মহাবিশ্বের প্রথম তিন মিনিটের ইতিহাসে প্রোটোন, ইলেক্ট্রন, নিউট্রন, ফোটনের আবির্ভাব ঘটেছে, আরও অনেক ধরণের কণিকার অস্তিত্বও সম্ভবপর সেখানে কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে প্রোটন, ইলেক্ট্রন, নিউট্রন ফোটন আমাদের মহাবিশ্বের বর্তমান বর্নীল দৃশ্যপটের অন্যতম উপাদান। প্রোটন এবং নিউট্রন সংযুক্ত হয়ে হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস তৈরি করতে সক্ষম হলেও মহাবিশ্বের প্রাথমিক পর্যায়ে অন্যান্য ভারী নিউক্লিয়াসের জন্ম হয় নি তেমন ভাবে। কার্বন পরমাণু তৈরি হতে তিনটি হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে সংযুক্ত হতে হবে, অক্সিজেন পরমাণু তৈরি হতে হলে কার্বন পরমাণুর সাথে একটি হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে সংযুক্ত হতে হবে, পারমাণবিক ফিউশন প্রক্রিয়ায় এসব সম্ভব হলেও সাম্ভাব্যতা বিচার করলে এসব ভারি নিউক্লিয়াস তৈরি হওয়ার সম্ভবনা ক্ষীণ।

মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হয়েছে, সম্প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে এটা শীতল হয়েছে, তাপমাত্রা কমেছে, পরমাণু কিংবা নিউক্লিয়াসগুলোর গতিশক্তি হ্রাস পেয়েছে, এবং একটা পর্যায়ে যখম মহাবিশ্বের গড় তাপমাত্রা ৩০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন নিউক্লিয়াসগুলোর সাথে ইলেক্ট্রন সংযুক্ত হয়ে এখনকার পরমাণু গঠিত হয়েছে। পরমাণু গঠিত হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ইলেক্ট্রন, প্রোটন, এবং অন্যান্য কণিকা থেকে যেসব আলো প্রতিফলিত হয়েছিলো, সেসব আলো প্রায় বিনাবাধায় অদ্যাবধি ভ্রমণ করছে- সেইসব আলোক কণিকাগুলোকে আমরা এখন পর্যবেক্ষণ করছি। তিনটি স্যাটেলাইটভিত্তিক টেলিস্কোপ সেই আলোককণাগুলোর ঘনত্ব পরিমাপ করছে, মহাবিশ্বে যখন পরমাণু গঠিত হয়েছিলো তখন মহাবিশ্বের গড় ঘনত্বে কোনো ধরণের ব্যতিচার ছিলো কি না, কোনো ধরণের অসামঞ্জস্যতা কি কি পরিণতি বয়ে আনতে পারে এসব নিয়েও গবেষণা হচ্ছে। মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হওয়ার একটি পর্যায়ে এখানে গ্যালাক্সির ভ্রুণ তৈরি হয়, কোনো একটি নির্দিষ্ট বিন্দুর চারপাশে হিলিয়াম আর হাইড্রোজেন গ্যাস জমা হতে থাকে, এদের সম্মিলিত মহাকর্ষ বলের প্রভাবে এরা সংকুচিত হতে শুরু করে, স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসীয় গোলক তৈরি হয়। সকল গ্যাসীয় গোলকই যে পরবর্তী পর্যায়ে নক্ষত্রে পরিণত হবে এমনটা বলা যায় না, নির্দিষ্ট পরিমাণ ভর না থাকলে এইসব গ্যাসীয় গোলকের মহাকর্ষীয় সংকোচন এবং কেন্দ্রের দিকে পতিত হওয়া গ্যাসকণাগুলোর পারস্পরিক সংঘর্ষে উৎপন্ন তাপে তাপমাত্রা ১০ মিলিয়ন ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের উপরে পৌঁছাবে না, সাধারণভাবে বলা যায় যদি কোনো গ্যাসীয় গোলকের ভর বৃহ:স্পতি গ্রহের ভরের কয়েকশত থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশী হয় তাহলে তাদের কেন্দ্রে মহাকর্ষের প্রভাবে এমন তাপমাত্রা তৈরি হতে পারে, সে তাপমাত্রায় পারমাণবিক ফিউশন শুরু হবে, ফলে নক্ষত্রের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে চারটি হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস একিভূত হয়ে একটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি হবে এবং আরও কিছু শক্তি নির্গত হবে, সে তাপে অন্যান্য হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসও ফিউশন শুরু হবে, এই ধারাবাহিক বিক্রিয়ায় একটা পর্যায়ে দপ করে জ্বলে উঠবে নক্ষত্র।

কোন বলের প্রভাবে নক্ষত্র নক্ষত্র হয়ে উঠে তা আমাদের জানা, ন্যুনতম কতটুকু ভর হলে কোনো গ্যাসীয় গোলক নক্ষত্রে পরিণত হবে সেটাও আমাদের জানা, যদি কোনো গ্যাসীয় গোলক তার চেয়ে কম ভর বিশিষ্ট হয় তাহলে সে আজীবন সম্ভবনাময় নক্ষত্র হয়ে উঠতে পারতো জোতিস্ক হয়েই মহাবিশ্বে বিরাজ করবে। প্রকান্ড এমন গ্যাসীয় গোলকের পরিমাণ মহাবিশ্বে প্রচুর কিন্তু আমরা খুব বেশী ভাগ্যবান না হলে দুরবর্তী গ্যালাক্সীগুলোতে এসবের সন্ধান পাবো না। নক্ষত্র জ্বলতে শুরু করলে এর শক্তি উৎপাদনের পরিমাণ নির্ভর করে এর সূচনা ভরের উপরে, যদি সূর্যের মতো সাধারণ নক্ষত্র হয় তাহলে সেটা কয়েকশত মিলিয়ন বছর পর্যন্ত একই গতিতে জ্বলতে থাকবে কিন্তু সূর্যের চেয়ে ভারী নক্ষত্রগুলোর জীবনের ব্যাপ্তি কম, যে নক্ষত্র যত বেশী ভারী সেসব নক্ষত্রের জীবনীকাল তত সংক্ষিপ্ত। দ্যা বিগার দে আর দ্যা ফিউরিয়াস দে বার্ন। ভারী নক্ষত্রের ক্ষেত্রে যখন সকল হাইড্রোজেনই হিলিয়ামে পরিণত হয় তখনও তাদের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ তাদের সংকুচিত করতে থাকে, এমনিতে নক্ষত্রের ফিউশন প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তাপ এবং মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এক ধরণের সাম্যাবস্থা বজায় রাখে, একবার হাইড্রোজেনের ফিউশন সমাপ্ত হলে সে সাম্যাবস্থা বিনষ্ট হয় এবং নক্ষত্র পুনরায় সংকুচিত হতে থাকে।

এভাবে ধারাবাহিক ফিউশনে কার্বন, অক্সিজেন, সিলিকন তৈরি হতে থাকে নক্ষত্রের কেন্দ্রে। প্রতিবার জ্বালানী শেষ হলে নক্ষত্র আরও সংকুচিত হয়, আরও তীব্রতার সাথে সেটা জ্বলে উঠে, সেই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিই সমাপ্ত হয় যদি একবার ফিউশন প্রক্রিয়ায় নক্ষত্রের গাঠণিক পরমাণুগুলোর সবগুলোই লোহায় পরিণত হলে। যদি এরপরও নক্ষত্র নিজের মহাকর্ষে নিজে সংকুচিত হতে থাকে তাহলে একটা পর্যায়ে সুপার নোভা বিস্ফোরণ ঘটে। সেই সীমিত সময়েই তামা, দস্তা, সোনা রূপা, যাবতীয় ভারী মৌলিক পরমাণু গঠিত হয়। আমাদের শরীরে এবং পৃথিবীতে এইসব ভারী পরমাণুর উপস্থিতি দেখে একটা বিষয় অনুমাণ করা যায় পৃথিবী এবং আজকের সূর্য হয়তো কোনো সুপারনোভা বিস্ফোরণের স্মৃতি ধরে রেখেছে।

কিভাবে সৌরজগতের আবির্ভাব হলো সেসব নিয়েও গবেষণা চলছে। আমাদের শরীরের কার্বন-অক্সিজেন-তামা- দস্তা-লোহা- এবং অন্যান্য মৌলের কিঞ্চিৎ উপস্থিতি নিশ্চিত হয়ে একটি সিদ্ধান্তেই পৌঁছানো যায়, আমরা কোনো না কোনো দুর অতীতে নক্ষত্রের অংশ ছিলাম। আমাদের প্রত্যেকের শরীর সেই নক্ষত্রের স্মৃতি বহন করছে। মাতা-নক্ষত্র বিস্ফোরিত হওয়ার পর আমরা ভাসমান ছিলাম, হয়তো পৃথিবী আমাদের পরমস্নেহে গ্রহন করে আশ্রয় দিয়েছে কয়েক শত কোটি বছর আগে, কিংবা সেই মাতা-নক্ষত্রের অংশবিশেষ নিয়েই গঠিত হয়েছিলো আমাদের পৃথিবী। সেই বিস্ফোরিত নক্ষত্রের শেষ রক্তবিন্দুগুলো সঞ্চালিত হচ্ছে আমাদের ধমনীতে, আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।