আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তি (সায়েন্স ফিকশান)

বড় ধরনের স্বপ্নবাজ এক নিঃসঙ্গ পথচারী! মুক্তি --তৌফির হাসান উর রাকিব দরজা খুলেই দেখতে পেলাম একটা রোবট আমার অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে। আজ সারাদিনই ও আমার সাথে সাথে থাকবে। অবশ্য একে রোবট বলাটা পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছি না! কারন একজন মানুষের সাথে এর আসলে খুব একটা পার্থক্য নেই! শুধুমাত্র মানুষের জৈবিক ক্রিয়াগুলো বাদ দিলে একে পুরোপুরি মানুষ বলা যেতে পারে। শরীরটাও যেমন একজন সুদর্শন যুবকের, তেমনি যে কোন আবেগ অনুভুতিতেও এটি অবিকল মানুষের মতই সংবেদনশীল। পি-ওয়ান মডেলের রোবট এটি।

হাতে গোনা যে কয়টি পি-ওয়ান মডেলের রোবট আছে গোটা পৃথিবী জুড়ে, তার একটি আজ আমার সেবায় নিয়োজিত, ভাবতে অবাকই লাগছে! একটু হলেও বুঝতে পারছি, অন্তত আজকের দিনের জন্য সারা পৃথিবীর কাছেই আমি একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। হব নাই বা কেন? আমি যা করতে যাচ্ছি, গত তিন শতাব্দীতে তা কেউ করেনি! রোবটটি একটি চাকাবিহীন গাড়ির দরজা খুলে দিল আমার জন্য। আমি ভিতরে বসতেই, সেও সামনের সিটে উঠে বসল। ড্রাইভারের সিট নেই গাড়িতে, কারন এইধরনের স্বয়ংক্রিয় গাড়িতে ড্রাইভারের কোন প্রয়োজন নেই। আস্তে আস্তে গাড়িটা চলতে শুরু করল।

ভিতরের পরিবেশ আরামদায়ক হবে, এটা আমার কল্পনায় ছিল, কিন্তু এতটা আরামদায়ক হবে এটা আমি সপ্নেও ভাবিনি। কমিউন প্রধানরা কতটা বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন, তার কিছুটা অন্তত আঁচ করতে পারলাম। গাড়িটা রাস্তার উপর দিয়ে পিছলে সরে যাচ্ছে, কোথাও সারফেস স্পর্শ করছে না, তাই কোন ঘর্ষণও হচ্ছে না। সম্ভবত কোনভাবে বিকর্ষণের পঞ্চম সুত্র ব্যাবহার করা হচ্ছে গাড়িটিতে। দ্রুত পিছনে চলে যাওয়া আশেপাশের দৃশ্যগুলোর দিকে তাকালেই শুধু বোঝা যায় যে, গাড়িটা চলছে।

ইঞ্জিনের একটুখানি গুঞ্জন অথবা একবিন্দু কম্পনও অনুভব করছি না আমি! বাইরে না তাকালে বুঝতামই না যে এত দ্রুত সামনে ছুটে চলেছি! : স্যার, আপনি কি কিছু খেতে চান? কোন বিশেষ কিছু? সামনে থেকে জিজ্ঞেস করল সুদর্শন যুবক। আমি চিন্তায় পরে গেলাম। আসলে আজকের দিনটির জন্য আমি বিশেষ কিছু পরিকল্পনা করিনি! সিদ্ধান্ত নেবার পর এত দ্রুত দিনটি এসে গেল, ভাববার সময়টুকুও পাই নি। সারা পৃথিবীতে ঘুরে সবার সাথে দেখা করতে হয়েছে। প্রত্যেকের অজস্র প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে।

ছুটতে ছুটতে পথেই কেটে গেছে বেশিরভাগ সময়। একান্তে নিজের ভাবনা ভাবার ফুরসত মেলেনি। একটু ভেবে নিয়ে বললাম, : কফি খেতে চাই। তাজা বিশুদ্ধ গরম ধোঁয়াওঠা এক কাপ কফি। আসল কফি।

সেটা কি সম্ভব? : আপনার জন্য অবশ্যই সম্ভব। আমরা তাহলে এখন রাষ্ট্রীয় প্রধান রেস্তোরায় যাব। ওখানে ছাড়া অন্য কোথাও এ ব্যাবস্থা করা সম্ভব নয়। আমি খানিকটা অবাক হলাম। কোথায় পাওয়া যাবে আসল কফি? এও কি সম্ভব! রেস্তোরাগুলোতে এখন ফুড পিল আর ড্রিংক পিল ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না।

আসল খাবার দেহের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ নয় বিধায়, বহু আগেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। এই সময় এক কাপ ধূমায়িত কফি এরা কোত্থেকে জোগাড় করবে? যতটা না আসল কফি পানের তৃষ্ণা ছিল, কফি সত্যিই পাওয়া যায় কিনা তা দেখার কৌতূহল তার চেয়েও বেশি বেড়ে গেল আমার। চরম উৎসাহ নিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রধান রেস্তোরায় পৌঁছলাম। সেখানে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো দুজন রাষ্ট্রীয় কাউন্সিলর! এরা কি আগেই জানতো যে আমি এখানে আসব? নাকি এদের সাথে দেখা হওয়াটা কাকতালীয় ব্যাপার? এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তো কাজ ফেলে আমার জন্য অপেক্ষা করার কথা নয়! আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বারবার আমার সাথে হাত মেলালেন ওনারা। মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে আমাকে দেখতে লাগলেন! সেই মুগ্ধতা এতটাই অকৃত্রিম ছিল যে, সত্যিই কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।

একসময় এক কাপ কফি নিয়ে এল সে যুবক, আর আমি অস্বস্তিকর পরিবেশটি থেকে মুক্তি পেলাম। প্রথম চুমুক দিয়েই অনুভব করলাম, এটা সত্যি সত্যিই আসল কফি! সারা শরীরে একটা অন্যরকম ভাললাগা ছড়িয়ে পড়ল। শেষবার আসল কফি খেয়েছিলাম, অন্তত তিনশ বছর তো হবেই! কফি শেষে যুবকের সাথে বেরিয়ে এলাম রাষ্ট্রীয় রেস্তোরা থেকে। সবার অদ্ভুত দৃষ্টির সামনে সেখানে কেমন যেন দম আটকে আসছিল। বাইরে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম! উপরে তাকাতেই ওজোন ওয়ালটা চোখে পড়ল।

তার বাইরের লালচে আকাশকে কেমন যেন হিংস্র মনে হয়, আগের মত মায়াবী মনে হয় না! নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। প্রাকৃতিক ওজোন স্তর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবার পর বিজ্ঞানীরা সারা পৃথিবী জুড়ে এই কৃত্রিম লাল কাঁচের দেয়ালটা লাগিয়েছিল। এর কারনেই বাইরের বিষাক্ত গ্যাসগুলো আর সূর্যের ক্ষতিকারক আলট্রা ভায়োলেট এবং আলট্রা পিঙ্ক রে গুলো পৃথিবীতে পৌঁছুতে পারে না। মাঝে মাঝে ওজোন ওয়ালের বিভিন্ন জায়গার ফিল্টার উইন্ডোগুলো খুলে, পৃথিবীতে সৃষ্ট দুষিত গ্যাসগুলো বের করে দেয়া হয়। বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে অতি জটিল এসব প্রক্রিয়াগুলো এখন কোন ঝামেলা ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যায়।

পি ওয়ান মডেলের রোবট যুবকের সাথে আবারো গাড়িতে চড়লাম। এবার যেতে চাইলাম আমাদের রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা কেন্দ্রে। বিশাল বিশাল অত্যাধুনিক যন্ত্র সম্বলিত ভবনগুলোকে এখন জাদুঘর বললেও ভুল হবে না! বহু বহু বছর ধরে একই রকমভাবে অলস পড়ে আছে কিনা! ওদের এখন কোন কাজ নেই, কারন মানুষের এখন কোন রোগই নেই! অমরত্ব পাবার পর থেকেই মানুষ সব ধরনের রোগমুক্ত। তারপরও কোন জরুরী অবস্থার কথা চিন্তা করে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো চালু রাখা হয়েছে। একে একে ঘুরে দেখতে লাগলাম ভবনগুলো।

সঙ্গী যুবক জানিয়ে দিতে লাগল, বিশাল যন্ত্রগুলোর কোনটার কি কাজ। একসময় কত ব্যস্তই না ছিল যন্ত্রগুলো, প্রতিনিয়ত শত শত মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য চেষ্টা করতে হত। আর এখন দিনের পর দিন নিঃশব্দে অলসভাবে পড়ে থেকে হয়তো পুরনো দিনের স্মৃতিচারণ করে চলেছে ওরা! ঘুরতে ঘুরতে এলাম ভ্যাক্সিনেশন সেন্টারে। চিকিৎসা কেন্দ্রের সবগুলো ডিপার্টমেন্টের মধ্যে সবচেয়ে শেষে বন্ধ হয়েছে এই সেন্টারের কাজ! পৃথিবীতে জন্ম নেয়া সর্বশেষ শিশুটিকে সব রোগের প্রতিষেধক দিয়েছিল ওরা তিনশত বছর আগে। ভাবতে ভাল লাগছে, শিশুটির পিতা আমিই ছিলাম! তারপর থেকে এই পৃথিবীতে আর কোন নতুন মানুষ জন্ম নেয় নি! আসলে জন্ম দিতে দেয়া হয়নি! কারন বুড়ো পৃথিবী আর একটি মানুষেরও ভার নিতে অক্ষম ছিল! অদ্ভুত সুশৃঙ্খলভাবে চলছে এখন এ পৃথিবী।

ঠিক যতজন মানুষকে সে গ্রহন করতে সক্ষম, ঠিক ততজন মানুষই টিকে আছে। একজন অতিরিক্ত মানুষ এলেও ভেঙ্গে যেতে পারে কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা এ ভারসাম্য। ভেঙ্গে যেতে পারে সুশৃঙ্খল এ জীবন-প্রণালী, ভেঙ্গে যেতে পারে অমরত্বের গোপন তরিকা! তাই সচেতন পৃথিবীবাসী সে ঝুঁকি নেয়নি, আর কোন নতুন শিশু আনেনি পৃথিবীতে। মধ্যবয়সে এসে থমকে গেছে সবার বৃদ্ধি! কেউ বৃদ্ধও হয়না, কেউ ছোটও থাকে না! সবারই আবয়ব দেখে মধ্যবয়স্ক মনে হয়। আমার ছেলেমেয়েরাও দেখতে আমারই বয়সী, আমার বাবা-মাও! বেরিয়ে এলাম চিকিৎসা কেন্দ্র থেকে।

: স্যার, আপনি কি আমাদের গ্যাস এক্সচেঞ্জ পয়েন্টগুলোর কোনটি দেখতে চান? : চাই। অক্সিজেন পয়েন্টে চল। যার উপর নির্ভর করে বেঁচে আছি, তাকে অন্তত দেখা উচিত! যুবকের বিনীত প্রশ্নের জবাবে বললাম। গাড়ি ঝড়ের বেগে ছুটে চলল। রাষ্ট্রীয় প্রথম শ্রেণীর গাড়ি বিধায় কোথাও থামতে হল না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মূল অক্সিজেন পয়েন্টটিতে। এত বড় কোন ভবন পৃথিবীতে আছে, না দেখলে কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না! কঠোর গোপনীয়তা বজায় রাখার ফলে গ্যালাক্সি মিডিয়াতেও কখনও এটার কোন ছবি আসেনি। রীতিমত ওজোন ওয়াল ছুঁইছুঁই করছে ভবনটার মাথা। আশেপাশের বহুতল ভবনগুলোকে নিতান্ত ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে এর বিশালতার কাছে। যুবকটি আমাকে পথ দেখিয়ে ভিতরে নিয়ে গেল।

বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকলাম অক্সিজেন উৎপাদনের আধুনিক প্রক্রিয়াগুলো। প্রতিটি পাইপ এত এত বিশাল যে, মনে হচ্ছে যেন এর ভিতর দিয়ে সমুদ্রের সব পানিও প্রবাহিত করা সম্ভব! এই পয়েন্ট থেকেই গোটা পৃথিবীর ছোট ছোট সাব-পয়েন্টগুলোতে অক্সিজেন সাপ্লাই করা হয়। আর সেসব পয়েন্ট থেকে হাজারো মাইক্রো পয়েন্টের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন বাতাসে উন্মুক্ত করা হয়। যে অঞ্চলে যত মানুষের বাস, ঠিক সেই অনুপাতে সেখানে মাইক্রো পয়েন্টগুলো সবার অলক্ষে ছড়িয়ে থাকে। চাহিদার প্রেক্ষিতে বাড়ে-কমে অক্সিজেনের প্রবাহ।

অক্সিজেন পয়েন্টের এক কোণে কিছু গাছ লাগিয়ে রাখা হয়েছে। ওদের কাছ থেকে অক্সিজেন পাবার জন্য নয়, শুধুমাত্র স্মৃতি রক্ষার জন্য। এগুলো দেখে যাতে মনে হয়, একসময় উদ্ভিদের প্রস্তুত করা অক্সিজেনের উপরই নির্ভর করতে হত গোটা মানব সম্প্রদায়কে! অনেকক্ষণ পর বের হলাম অক্সিজেন পয়েন্ট থেকে। পরিবেশটা এতটা নির্মল, কিছুতেই বের হতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু হাতে সময়ও বেশি নেই, শেষ হয়ে আসছে দিনটা! তাই নিজের উপর জোর খাটিয়েই বের হতে হল।

যুবককে জিজ্ঞেস করলাম, “প্রতিরক্ষা কেন্দ্রে কি যাওয়া যাবে? আজকের এই বিশেষ দিনেও কি ওখানে প্রবেশের অনুমতি মিলবে?” মিষ্টি করে হাসল যুবক। তারপর বলল, “আজকের দিনে আপনার জন্য কোথাও কোন বাঁধা নেই। আপনি যেখানে যেতে চান, নিয়ে যাবার অগ্রিম অনুমতি দেয়া আছে। তবে আমি প্রতিরক্ষা কেন্দ্রে ঢুকতে পারব কিনা বলতে পারছি না। হয়তো আমাকে প্রধান ফটকের বাইরেই থাকতে হবে।

সেজন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ” আমি মুখে কিছু না বলে মাথাটা শুধু একটু কাত করলাম। আবার চলতে শুরু করল গাড়ি। এবার অনেকটা দুরের পথ পাড়ি দিতে হবে। কারন প্রতিরক্ষা কেন্দ্র আবাসিক অঞ্চল থেকে যতটা সম্ভব দূরে বানানো হয়েছে বলেই জানি।

আরামদায়ক সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম, গত কয়েকদিনের ছুটাছুটিতে ঠিকমত বিশ্রামও নিতে পারিনি। ঘুম ভাঙল যুবকের ডাকে, গন্তব্যে চলে এসেছি। যুবকের আশংকাই সত্যি হল, তাকে ঢুকতে দেয়া হলনা। আমার জন্য গাড়িতেই অপেক্ষা করতে হবে তাকে। প্রতিরক্ষা কেন্দ্রের মত একটি সর্বোচ্চ গোপন জায়গায় পি ওয়ান মডেলের আধুনিক রোবটদের কিছুতেই প্রবেশ করতে দেয়া যায়না।

কারন তারা একজন সাধারন মানুষের মতই ভয়ংকর, যার কাছ থেকে সহজেই তথ্য পাচার হয়ে যেতে পারে এলিয়েনদের কাছে। এমনিতেই কয়েকটি গ্রহের সাথে পৃথিবীর সম্পর্ক আজকাল ভাল যাচ্ছে না। এই সময় কিছুতেই এত বড় ঝুঁকি নিতে পারেন না প্রতিরক্ষা কেন্দ্রের মহারথীরা! আমি একাই ভিতরে ঢুকলাম। আমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দুজন বিজ্ঞানী দাড়িয়ে আছেন দেখে খুব একটা অবাক হলাম না। আজ আমি তাদের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কিনা! তাই আমার জন্য অমন বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের দুএকজন দাড়িয়ে থাকতেই পারে, এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে! বিজ্ঞানীরা সংক্ষেপে আমাকে তাদের বর্তমান প্রজেক্টগুলো সম্পর্কে বললেন।

তারপর আমাকে পুরো প্রতিরক্ষা কেন্দ্র ঘুরে দেখার আমন্ত্রন জানিয়ে নিজেদের কাজে চলে গেলেন। আমাকে গাইড করার জন্য পি টেন মডেলের একটা সাধারন রোবট দেয়া হল। যার ব্রেইনের সার্কিটগুলোতে এই প্রতিরক্ষাকেন্দ্রের সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেয়া থাকলেও, এর বাইরের জগত সম্পর্কে কোন তথ্য দেয়া নেই! এই কেন্দ্রের বাইরে গেলেই তার মেমোরি অটোমেটিক ফরমেট হয়ে যাবে। তাই তথ্য পাচারের ভয়ও নেই। আমাকে জানানো হল, প্রতি একমাস পরপর নাকি এদের ব্রেইনের প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা হয়।

রোবটটিই আমাকে নিজের সম্পর্কে এ তথ্য দিল! আমি অবাক হয়ে একটার পর একটা জিনিস দেখতে লাগলাম। সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম “বিদাম” নামক গ্রহের কক্ষপথে স্থাপিত একটি স্যাটেলাইট দেখে। ঐ গ্রহের প্রতিটি প্রাণীর কাজকর্ম এখান থেকেই স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারছেন বিজ্ঞানীরা! অথচ বিদামের প্রাণীরা তা জানতেও পারছেনা। অবশ্য বিদামের প্রাণীরাই এই বিশ্বজগতের সবচেয়ে বোকা প্রাণী বলে বিবেচিত। তাদের শরীরও সিলিকন নির্ভর, আমাদের মত কার্বন নির্ভর নয়।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শত্রু গ্রহগুলোর দিকে তাক করা এম.এম বোমাগুলো দেখে রীতিমত আঁতকে উঠলাম। সত্যিই যদি কোনদিন অন্তঃগ্রহ যুদ্ধ বাধে, একে একে সবগুলো গ্রহই কি ধ্বংস হয়ে যাবে না? সৃষ্টির অদ্ভুত চক্র কি তখন আবার নতুন করে শুরু হবে? নাকি চিরতরে থেমে যাবে? আমাকে একটি নিম্নশ্রেণীর মহাকাশযানে চড়ার সুযোগ দেয়া হল। অল্প কিছুক্ষন পৃথিবীর সীমার মধ্যে ঘুরাঘুরি করেই ফিরে আসলাম। মহাকাশযানের ভিতরের ওজনহীনতা মানিয়ে নেয়া সত্যিই কষ্টকর। বেরিয়ে এলাম প্রতিরক্ষা কেন্দ্র থেকে।

সুদর্শন যুবক ঠায় দাড়িয়ে আছে গাড়ির কাছে আমার অপেক্ষায়। : আমার আর কিছু দেখার ইচ্ছে নেই। দিনও শেষ হয়ে এলো বলে। এখন কি তবে ফিরে যাব? যুবক হেসে বলল, “মহাপতি আপনার সাথে দেখা করতে চান। উনি বলেছেন, আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে যেন আপনাকে তার কাছে নিয়ে যাই।

” আমি কিছুক্ষনের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলাম। গোটা পৃথিবী এখন যার নিয়ন্ত্রনে সেই মানুষ আমার সাথে দেখা করতে চান! আজকের দিনে আমি যতই গুরুত্বপূর্ণ হই না কেন, তাই বলে এ ও কি সম্ভব? গলা দিয়ে ঠিকমত আওয়াজ বের হলনা, অস্ফুটে বললাম, “চল...” মহাপতির বাসভবন শহরের একদম মাঝখানে। আমাদের গাড়ির উপর নীল আলো জ্বলছে এখন, তাই নিরাপত্তারক্ষী রোবটেরা কেউ আমাদের আটকাল না। শুধুমাত্র মহাপতির বিশেষ অনুমতিপ্রাপ্ত কেউ দেখা করতে এলেই তার গাড়ির উপর নীল আলো জ্বলে। মহাপতির ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশের আগমুহূর্তে যুবক আমাকে বিদায় জানালো।

আজকের মত তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। সে এখন ফিরে যাবে তার নিজস্ব ল্যাবরেটরীতে। আর কোনদিনও তার সাথে আমার দেখা হবে না। কেন যেন বুকের ভিতরটা একটু মুচরে উঠল। এই অল্প সময়েই যুবককে ভাল লেগে গিয়েছিল।

যুবকের চোখও কি ছলছল করে উঠল না একটুখানি? নাকি ভুল দেখলাম! মানব সভ্যতা যতই এগিয়ে যাক না ক্যান, ভালোবাসার মত মৌলিক আবেগগুলো এখনও মাঝে মাঝে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে ভুল করেনা! একটা বিশাল টেবিলের ওপাশে বসেছিলেন মহাপতি। আমাকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাড়ালেন। উষ্ণ করমর্দনের পর বসতে বললেন। নিজেও ফিরে গেলেন তার আসনে। বসার পর চারপাশে তাকিয়ে রীতিমত ভিরমি খেলাম।

আশেপাশের দেয়ালের এক ইঞ্চি জায়গাও খালি নেই। শত শত ছোট-বড় মনিটরে দেয়ালগুলো ঢাকা। আর তাতে এ পৃথিবীর প্রতিটি কোনের তাৎক্ষণিক ছবিগুলো দেখা যাচ্ছে। কিছুকিছু মনিটরের ছবিগুলো এ পৃথিবীর নয়। বুঝতে পারলাম এগুলো অন্য কোন গ্রহের উপর নজর রাখা স্যাটেলাইট থেকে সরাসরি পাঠানো হচ্ছে।

মহাপতি নিরবতা ভাঙলেন, “আমি পরম সৌভাগ্যবান যে আপনি আমার সাথে দেখা করতে রাজী হয়েছেন। ” : কি বলছেন মহাপতি! আমি আমার নিজের ভাগ্যকে রীতিমত ঈর্ষা করছি! এখনও বিশ্বাসই হচ্ছেনা, আপনার সামনে বসে কথা বলছি। : না না স্যার। পুরো মানব জাতি আপনাকে নিয়ে গর্বিত। যতটা সাহসিকতার পরিচয় আপনি দিয়েছেন, তার সিকিভাগও আমার নিজের থাকলে সত্যিই গর্ববোধ করতাম।

আমি কিছু বললাম না, চুপ করে বসে রইলাম। কি ভাবছি নিজেও জানিনা। মহাপতি আবারো বললেন, “আমি কি জানতে চাইতে পারি, কেন আপনি এমন সিদ্ধান্ত গ্রহন করলেন? আপনার যদি আপত্তি না থাকে, তাহলে আমি ব্যাপারটা আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। অবশ্য আগেই বলে দিচ্ছি, আপনার বলতে আপত্তি থাকলে, আমি কিন্তু কিছুই মনে করবো না। ” আমি চমকে উঠলাম।

কি জবাব দেব এ প্রশ্নের? আমার মনের গভীরে আমি যে অনুভূতি সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে অনুভব করি, তা প্রকাশের ভাষা কি আমার জানা আছে? নাকি অন্য কেউ আমার অনুভূতি সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারবে? তবে আমিও হয়তো ব্যাপারটা কাউকে বলে যেতে চাইছিলাম মনে মনে। নাহয় মানব সভ্যতার ইতিহাস আমাকে সবচেয়ে বড় পাগল হিসেবে মনে রাখবেনা, তার কি নিশ্চয়তা আছে? : মহাপতি। আমি আসলে জানিনা যে, কতটুকু বোঝাতে পারব আপনাকে। তবে অতি সংক্ষেপে আমি ব্যাপারটা বলার চেষ্টা করছি... : কোন সমস্যা নেই স্যার। আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে আপনার কথায় পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করবো।

না বুঝতে পারলেও, এর ভুল কোন ব্যাখ্যা নিজে নিজে দাড় করাবো না। : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মহাপতি। আপনি সত্যিই অনেক মার্জিত একজন মানুষ। : ধন্যবাদ স্যার। আপনি নিঃসঙ্কোচে আমাকে বলতে পারেন।

: মানব সমাজে গত তিনশ বছরে কোন নতুন শিশু জন্মায়নি। যারা এর আগে জন্মেছিল তাদের সবার বয়সও একই অবস্থানে এসে থমকে গেছে। আস্তে আস্তে মানুষ একটা একঘেয়ে জীবনের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে গেছে। শত শত বিনোদনের উপাদান থাকা সত্ত্বেও মানুষের মধ্যে আগের সেই প্রাণচাঞ্চল্য নেই। নতুনত্ব বলতে কোন কিছুই আর নেই তেমন মানুষের জীবনে।

মাঝে মাঝে নতুন বলতে যা আসে, তা হল বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার। যার বেশিরভাগই ধ্বংস করার অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন মারণাস্ত্র। তাই এসব “নতুন” মানুষকে প্রাণচঞ্চল করার পরিবর্তে দিনদিন আরও বিমর্ষ করে তুলছে। মানুষ ভুলতে বসেছে তাদের পিতা-মাতা তাদেরকে কতটা আদর ভালবাসা দিয়ে বড় করেছিল। মানুষ এটাও ভুলতে বসেছে, এসব আদর ভালবাসার পরিবর্তে কতটা শ্রদ্ধা-ভালবাসা প্রাপ্য তাদের পিতামাতার! : আপনি যথার্থ বলেছেন।

সত্যি বলছি এভাবে কখনও ভেবে দেখিনি। : মহাপতি দেখুন, একটা শিশু না থাকার কারনে শুধুমাত্র মানুষের মনেরই পরিবর্তন ঘটছে তা কিন্তু নয়! পরিবর্তন হচ্ছে আমাদের নগর জীবনেও! দিনে দিনে তা হয়ে ওঠছে আরও বেশি স্থবির। সার্জারি সেন্টার, ভ্যাক্সিনেশন সেন্টার, ওয়াকিং সেন্টার, ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার, এডুকেশন সেন্টার... সবগুলো সেন্টারের এখন কোন কাজ নেই! কারন শেখানোর মত তাদের কাছে নতুন কেউ নেই। আমার বিশ্বাস, শুধুমাত্র একটা নতুন শিশুর জন্মই গোটা পৃথিবীকে নতুন করে সচল করার একমাত্র উপায়। : আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার।

আমি আপনার সাথে একমত না হয়ে পারলাম না কিছুতেই। কিন্তু... কিন্তু..... আপনি জানেন আমাদের সীমাবদ্ধতাটা কোথায়... : হ্যা মহাপতি, আমি জানি। আমি জানি এ পৃথিবীতে নতুন শিশু আনার কোন উপায় নেই। কারন পৃথিবীর পক্ষে তার ভরণপোষণ করা সম্ভব নয়। একটা বাড়তি মানুষ পৃথিবীকে হয়তো নিশ্চিত ধংসের দিকেই ঠেলে দেবে।

তাই, কেউ একজন মারা গেলেই কেবলমাত্র তার জায়গায় নতুন কেউ জন্ম নিতে পারে! তাই না? কিন্তু অমরত্ব পাওয়া মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর কোন সম্ভাবনা নেই। আর কোন মানুষ কখনও স্বেচ্ছায় নিজের জায়গা ছেড়ে দেবেনা নতুন কোন মানুষের জন্য! যত নিরানন্দই হোক না কেন, এই জীবনই অতিবাহিত করে যাবে শত শত বছর! তবু রহস্যময় মৃত্যুর জন্য কেউই। তাই আপাতদৃষ্টিতে এই পৃথিবীতে নতুন কোন শিশুর জন্ম সম্ভব নয়। তাই নয় কি মহাপতি? : ঠিক তাই স্যার। আমি মনে হয় ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছি।

: ধন্যবাদ মহাপতি। ঠিক এ কারনেই আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মানব সভ্যতার গতি ফিরিয়ে আনতে আমি আমার জায়গাটুকু ছেড়ে দেব! সেই জায়গায় জন্ম নেবে নতুন এক শিশু। আমি নিশ্চিত যে, গোটা পৃথিবী তার পুরনো গতি ফিরে পাবে। লক্ষ কোটি মানুষের জন্য এই সামান্য আত্মত্যাগ খুব বেশি কিছু তো নয় মহাপতি! দূর অতীতেও কিন্তু আত্মত্যাগের অমন ভুরিভুরি নিদর্শন রয়েছে।

: আপনি সত্যিই মহান স্যার... সত্যিই মহান। আজকের দিনের যে সম্মানটুকু আমরা আপনাকে দিয়েছিলাম, তা নিতান্তই ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে আমার কাছে। আপনাকে এত ক্ষুদ্র সম্মান দেবার দুঃসাহস যে কিভাবে করলাম আমার, ভেবে অবাক হচ্ছি! আপনি চাইলে আগামী একমাস কিংবা এক বছর কিংবা তারও বেশি সময় এ সম্মানটুকু উপভোগ করতে পারেন। তারপর যখন আপনার ইচ্ছে হয়, তখন নাহয় আমরা প্রক্রিয়াটার মধ্য দিয়ে যাব? : না মহাপতি। তার আর দরকার নেই।

আজই বিষয়টা চুকিয়ে ফেলতে চাই। কখন আবার পৃথিবীর প্রতি মায়া বেড়ে যায়, কে জানে! তখন হয়তো কাজটা করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া জীর্ণ পৃথিবীটা এমনিতেই তিন শতাব্দী ধরে অপেক্ষায় রয়েছে, একে আর অপেক্ষায় রাখা কি ঠিক হবে? মহাপতি আমার কথা শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালেন। : নতুন শিশুটি জন্ম দিতে আমরা কোন দম্পত্তিকে সুযোগ দেব, সে ব্যাপারে একটা বিরাট ঝামেলা হতে পারে।

নিঃসন্দেহে প্রচুর আবেদন আসবে। বাছাই করাটা অবশ্যই একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হবে। : আমি কি এ ব্যাপারে কোন মতামত দিতে পারি মহাপতি? : অবশ্যই পারেন স্যার, অবশ্যই পারেন। সত্যি বলতে সিদ্ধান্তটা আপনার কাছ থেকে আসাটাই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত। : তাহলে আমি এক্ষেত্রে কিছুটা স্বজনপ্রীতি দেখাতে চাই।

আমি চাই আমার ছেলে আর তার বউকে নতুন শিশুটির পিতামাতা হবার সুযোগ দেয়া হোক। : অবশ্যই এটা করা হবে স্যার। অনেক বড় ঝামেলা থেকে আমরা তাহলে বেঁচে যাব। সিদ্ধান্তটা আপনার, এটা জানার পর কারোর আর কিছু বলার থাকবে না। : আমার এ সিদ্ধান্ত নেবার পিছনে বিশেষ একটা কারন আছে মহাপতি।

: মনে হচ্ছে আপনি আমাকে কারণটা বলতে চাচ্ছেন। দয়া করে বলুন স্যার। : আমি আমার ছেলেকে বোঝাতে চাই, নিজের সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালবাসাটা কেমন থাকে। আমি তাকে বোঝাতে চাই, একজন বাবা তার ছেলের কাছে কি প্রত্যাশা করে। বিগত দুইশ বছর আমার ছেলে আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখেনি মহাপতি...... আমি আশা করি, এক মুহূর্তের জন্য হলেও সে বুঝবে, আমি আর তার মা তাকে কতটা অনুভব করতাম... আর কিছু বলতে পারলাম না, আবেগে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল।

মহাপতি চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। অনেক বছর পর, পৃথিবী গভীর আবেগে দুজন মানুষকে কাঁদতে দেখল! -----------------------------০------------------------------ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.