আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনাহুত কবি

ছোটবেলায় কাক নিয়ে একটি রচনা পড়েছিলাম। কাকের গুণগানে পরিপূর্ণ সেই রচনা। পড়তে পড়তে আমি যেন কাকের প্রেমে পড়ে গেলাম। আহা, কি সুন্দর ! কি কুচকুচে কালো। আর কত উপকারী ! সব ময়লা খেয়ে ওরাই তো শহরটা পরিষ্কার রাখছে।

সবচেয়ে ভাল লাগত কাকদের মধুর ডাক, কি মাধুর্য ওদের কণ্ঠে! লোকে শুধু শুধু কোকিলের ডাকের কথা বলে। এখানে আমি পুরো নিশ্চিত, পক্ষীডাক নিয়েও দলীয়করন হয়, পক্ষপাতিত্ব থাকে। ওদের সামাজিকতা দেখছেন ? একটি কাক আহত বা নিহত হলে, কাকের মেলা বসে যায়। এই কাক নিয়ে গবেষণা করতে করতে আমি হঠাৎ একদিন কবি হয়ে গেলাম। কবিত্বের কারণে এই কবি হওয়া নয়, কবি হতে ইচ্ছা করল তাই কবি হয়ে গেলাম।

ভাবলাম, যার কারণে কবি হওয়া তাকে নিয়েই একটা কবিতা লিখি এবং উৎসর্গ করি । লিখলাম অতি সুন্দর কবিতা আহা কাক, আহা কাক কি মধুর তোমার ডাক। লোকে কি কয় ? সেই কথা না হয় থাক। কি সুন্দর গাত্রবর্ণ কি তোমার লাক; ভালবাসা কত মনে লোকে শিক্ষা পাক। ……………….।

এইরকম থাক, পাক, যাক, খাক, শাক, ঢাক, যতরকম ভাবে মিলান যায়, মিলিয়ে সাড়ে সাত পাতা কবিতা দিয়ে ভরিয়ে ফেললাম অঙ্কের খাতা। আরো লিখতাম। তখন যেন আমার কবিত্ব কিলবিল করা শুরু করল। তাহারা বাঁধভাঙ্গা পানির মতো আসিতে শুরু করিল। কিন্তু অংক খাতা শেষ করার কারণে পিতৃপ্রদত্ত ঠ্যাঙ্গানীর কথা ভাবিয়া নিরস্ত হইলাম।

পিতৃদেব অঙ্কখাতার হিসাব নিয়ে যে অঙ্ক কষেন! তাতে ফলাফল পিঠের উপর পড়ার সমূহ আশংকা রহিয়াছে। খাতার উপর নিরস্ত হলাম বটে, কিন্তু প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিতে লাগিল স্কুলের দেয়ালে, বেঞ্চে, বন্ধুদের খাতায়, নানা জায়গায়, নানা ভাবে। ঘটনা ঘটিল উল্টা। পিতৃদেব যখন ঠাংগানোর প্রয়োজন বোধ করিতেন, আমাকে অঙ্ক করাতে বসতেন। ঐদিনও বসেছেন।

আমার কবিতা দেখে বললেন, একি ! এটা এখানে কে লিখছে ? আমার আত্মা আর বোধ করি ধরাধামে ছিল না ; কারণ কি উত্তর দিয়েছিলাম ইয়াদ করতে পারছি না। জবাব দিয়েছিলাম বটে, কারণ আমার পিতা কোন কাজে বিলম্ব পছন্দ করতেন না। জবাব দিতে কিছুমাত্র বিলম্ব করিলে উনি জবাব দিতে বিলম্ব করতেন না। তা যে মুখে নয়, বলাই বাহুল্য। পিতা আমার প্রতিভায় যাকে বলে ‘ ব্যাপক মুগ্ধ’ ।

দারুণ হিসাব কষা পিতা খুশী হয়ে আমাকে ৫ টাকা দিলেন । উহাই আমার প্রথম এবং শেষ আয় কবিতা বেচে। যাই হোক, পিতা আমাকে ধরে মায়ের কাছে নিয়ে গেলেন। মাকে বলেন, ” দেখো তোমার ছেলে তো কবি হয়ে গেছে ! আমাদের বংশে কোন কবি ছিল না । ” আমি খুব ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থা্কলাম।

মার উত্তর ” এই ছাগল আর কি কবিতা লিখবে ! প্রতি বছর অঙ্কে ফেল করে । মাথায় যদি এক ছটাক বুদ্ধি থাকত। যা এখান থেকে, তোর কবিতা চিবিয়ে খেয়ে দেখ কেমন লাগে ? ভাল লাগলে তোর বাবাকে একটু দিস ” আমি মুখ কালো করে ঐখান থেকে চলে আসলাম। আমার প্রতাপশালী বাবাও দেখলাম বোকা বোকা মুখে নিজের রুমে চলে গেলেন। বসে বসে ভাবতে পৃথিবীর সব কবিই কি অঙ্কে ভাল ছিল ? মার যত অবাস্তব চিন্তা।

কবিতা আবার খাওয়া যায় নাকি ! আমার বোন এসে বলল, ” দাদা, দেশে নাকি কাকের সংখ্যা বেড়ে গেছে ?” । আমি ভাবলাম, যাক ঘরের মধ্যে কবিতা না হোক কাক-গবেষক তো পাওয়া গেল। ” কই পাইলি এই খবর ?” ” মায়ের কাছে। তুমি নাকি কবিতা লিখা শুরু করছ !” এই কথা বলে চলে গেল আমার বোন। ওকি আমাকে ঘুরিয়ে কাক বলে গেল নাকি ! ধুত্তরি, আর কবিতাই লিখব না ।

কবিতা লিখা ছেড়ে দিলাম বটে। কিন্তু ডায়রী লিখা বজায় রাখলাম। কি এক কুক্ষণে, ডায়রী গিয়ে পড়লো আমার হবু প্রেমিকার হাতে। ওর এক বান্ধবীকে সহজ সরল আখ্যা দেয়ায় পরিস্থিতি যথেষ্ট ঘোলাটে হয়ে গেল। আমার এই ‘সরল’ উক্তির জন্য ‘জটিল’ যুক্তির অবতারনা করতে হল।

বুঝাতে হল, এ নিছক লিখার উদ্দেশ্যে লিখা, প্রেমবশত নয়। এ যাত্রা রক্ষা পেলাম বটে, তবে রক্ষা-ব্যয় যথেষ্টই ব্যয়বহুল ছিল ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে। নতুন প্রেমে পড়ে আমার ভেতর কবিতা আবার কিলবিল করতে লাগল। আমি নতুন একখানি বেশ বড় (আমি আবার ছোট কবিতা লিখতে পারি না) রোমান্টিক কবিতা হবু প্রেমিকাকে উপহার দিলাম। ভাবলাম, বেশ চমকে দেয়া গেল।

এবার আর আমাদের প্রেম ঠেকায় কে ? চমকে দেব ভেবেছিলাম কিন্তু নিজেই চমকে যাব ভেবেছিল কে ? তার বিস্মিত কণ্ঠ ” ও, তুমিও কবিতা লিখ !!” মানে কি এই কথার ? একি প্রশংসা না অন্য কিছু ? দুইদিন পর সব পরিস্কার হল একটি চিঠির মাধ্যমে । তাতে লেখা ছিল যে প্রেম হতে পারে এক শর্তেই , তুমি আর কবিতা লিখবা না। মানুষ প্রেমের জন্য কত কি করে, আমি না হয় কবিতাই ছাড়লাম। দ্বিতীয় দফা কবিতা ছাড়লাম। বিয়ের পরে সংসারের অস্থিরতায় আবার লিখতে শুরু করলাম।

আমার বউকে পড়তে দিলাম। ভাবলাম, এতদিনে নিশ্চয় কবি আর কবিতার প্রতি মায়া জন্ম নিয়েছে। সে এমন ভাবলেশহীন চোখে আমার কবিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমাকে বলল , তুমি কিন্তু শর্ত ভংগ করছ। আমি বললাম, সে তো বিয়ের আগে ছিল।

বউ বলে ” এটা সারা জীবনের শর্ত “। ” কিন্তু আমি তো কিছু না লিখে থাকতে পারি না। ” আমার বউ উপদেশ দিল” ঠিক আছে, তুমি লিখ। লিখতে না করছে কে ? তুমি বাজারের ফর্দ লিখ, সংসারে কি কি দরকার এটার তালিকা কর, আমার অ্যাসাইনমেন্ট টা করে দাও, ইত্যাদি ইত্যাদি ” বুঝলাম এই জনমে আর কবিতা লিখা হবে না। অশ্রুসজল চোখে কবিতাকে শেষ বারের মত কবিতাকে বিদায় জানালাম।

আজও কোথাও কোন কাক দেখলেই আমার মনে পড়ে যায় – আহা ! আমিও একদিন কবি ছিলাম। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।