আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনাহুত- শেষপর্ব



প্রথম পর্ব সেদিন রাতে ইদওয়ান হোস্টেলে তার সাথেই ছিলো। শেষরাতের আঁধারে, কিছু বুঝে উঠার আগেই, তারা দুজনে নিজেদের আবিষ্কার করলো একদল সিকিউরিটি এন্ড্রোরয়েডের জিম্মায়। কিভাবে, কখন, তাদের দরজা বন্ধ রুমে ঢুকেছে, পজিশন নিয়েছে; কিচ্ছু বলতে পারবেনা তারা। পারার কথাও না। যান্ত্রিক প্রশাসনের কোন কাজে খুঁত থাকেনা।

উমনার ঘুম ভাঙালো ইদওয়ানই। "উঠো, আমাদের নিতে এসেছে। "- ইদওয়ানের গলার স্বর একেবারেই ভাবলেশহীন; যেন এটা প্রতিদিনকার রুটিন! উমনা ধরমর করে উঠে বসেছিলো। চারদিকে ঘিরে থাকা ছায়াগুলির দিকে বোকার মতো কতোক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। তারপর ইদওয়ানের মুখের দিকে তাকালো।

তাকে এরকম শান্ত সে কখনো দেখেনি। "কেন? কি হয়েছে? এরা কারা? আমাদের কোথায় নিতে .....। ?" দু সেকেন্ডের একটা তীক্ষ্ণ এলার্ম বেজে উঠলো ওর কথা শেষ হবার আগেই। সংকেতটির অর্থ পরিষ্কার। এই সময়ে কথা বলা অপরাধ হিসাবে গন্য হবে।

আইনের এই ধারাটা ছোটবেলা থেকেই বারবার জানানো হয়েছে তাদের। এরপর ভাববার আর অবকাশ পেলোনা সে। সংক্ষিপ্ত সময়ে, ক্ষীপ্র গতিতে তাদের দুজনকে তুলে নেয়া হলো সামরিক যান এ। ভ্যানে উঠার আগে একবার মুখ ফিরে হোস্টেলের দিকে তাকালো উমনা। কেনো যেন মনে হলো, এখানে আর তার ফিরে আসা হবে না।

পরবর্তী তিনটি দিন যেন দীর্ঘ তিনটি বছর! একের পর এক টেস্ট; স্ক্যানিং, এক ভঙ্গীতে বসে থেখে পর্যবেক্ষণের ক্যামেরার নীচে ঘন্টার পর ঘন্টার পর অপেক্ষা। "কি করেছি আমি? আমার অপরাধ কি?" অনেক বারই সে জানতে চেয়েছিলো তার তদারককারী এন্ড্রোদের কাছে। নিস্ফল প্রচেষ্টা। প্রতিবার গ্যাপ দিয়ে দিয়ে বেজে উঠেছে সতর্কমূলক এলার্ম। উমনার যেকোন কিছু জানার অধিকার স্থগিত করা হয়েছে নিঃসন্দেহে! কিন্তু কেন? প্রশ্নটা ইদওয়ানকেই করলো সে।

যদিও গত তিনদিন তাকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা অবধি ছিলনা। নিজের চাইতে তার কথাই বেশী ভেবেছে উমনা। আর ভেবেছে টিশকুর কথা। তিনদিন ক্রমাগত অশান্ত ভাবে নাড়াচাড়া করে গেছে সে। উমনা অসহায়ের মতো কেবল হাত বুলিয়ে শান্তনা দেবার চেষ্টা করে গেছে।

তার মন ঠিকই বুঝতে পারছিল টিশকুটা কতোটা হতচকিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু তিনদিন পর ইদওয়ান তার সামনে এসে যখন দাড়ালো, বিস্ময়ের ধাক্কায় তার উৎকন্ঠা কোথায় যেন চাপা পড়ে গেলো! একপলক তার দিকে তাকিয়েই উমনা বুঝতে পারলো, ইদওয়ান সম্পর্কে তার এতোদিনের জানায় অনেক কমতি আছে। এন্ড্রো গার্ডদের সশস্ত্র প্রহরায় ইদোয়ান এর পরণে 'গ্রীন পিস রেবেল'দের সবুজ রঙের ইউনিফর্ম। ওরা তাদের দুজনকে একলা ছেড়ে চলে গেলো সেলের বাহিরে। "কিন্তু কেন ইদওয়ান?" উমনার মুখটা বুকের ভেতরে চেপে ধরে আরো দৃঢ় ভাবে তাকে নিজের দিকে টানলো ইদওয়ান।

"উমু, আমি একদিন তোমাকে সব জানাতাম, কিন্তু......" ইদওয়ানের কন্ঠে কি ক্ষীণ একটা অপরাধবোধের সুর? প্রশ্নটা আবার করলো উমনা। " উমনা, কিছু কথা, তোমাকে আমি- আগে কখনো বলিনি। আমি বিদ্রোহীদের ২৭ নং সেক্টরের দায়িত্বে ছিলাম.....। " বিস্ময়ের ধাক্কায় উমনা কষ্ট পেতেও যেন ভুলে গেছে। একে একে তার সব প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেল সে।

"গ্রীন পিস রেবেল'দের সবচেয়ে বেশী সক্রিয় দলটার সাথেই ইদওয়ান জড়িত। ষে আছে রিসার্চ সংক্রান্ত কাজে। বেশ কিছু দিন ধরেই তারা কাজ করছিলো যোদ্ধাদের কিভাবে আরো বেশী উন্নত ও প্রশিক্ষিত করা যায় - এটার উপর। প্রচলিত কোন প্রশিক্ষিণই আজকাল আর পেরে উঠছিলো না দক্ষ প্রশাসনের কলা কৌশলের সাথে। তাদের রিসার্চের মুল বিষয় ছিল কিভাবে পরের প্রজন্মকে জন্মের সূচনা থেকেই যোদ্ধা হিসাবে গড়ে তোলা যায়।

ইদওয়ানের জিন সংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে তারা আগ্রহী হয়ে উঠে। এর মাধ্যমে ভ্রুণ অবস্থাতেই শিশুর মস্তিষ্কের বেড়ে উঠাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় দেখে, এটাকেই তারা সম্ভাবনাময় দেখতে পায়। টিশকু'র কেস টা পরীক্ষামুলক হিসাবে তারা পর্যবেক্ষন করছিলো। এটায় সফল হলে তারা পরবর্তীতে ব্যাপক ভাবে এই পদ্ধতির প্রয়োগের চিন্তা ভাবনা করছিলো। কিন্তু এর ভেতরেই প্রশাসনের নজরবন্দি হয়ে তারা অবশেষে বন্দি হলো।

উমনার নিজেকে এতোটা অসহায় আগে কখনো মনে হয়নি। ইদওয়ানকে সে চিনতেই পারছিলো না! এই কি তার সেই ভালোবাসার মানুষ?! এতোটা অচেনা?। একজন নিষ্ঠুর হৃদয় বিদ্রোহী!! যে নিজের সন্তানকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছে?! ইদওয়ান তাকে ভাবনা চিন্তার খুব একটা সময় দিলোনা। প্রশাসন তাকে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছে; তারাও ইদোয়ানের গবেষণা নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। তদের ইচ্ছা, ভ্রুণের বেড়ে উঠাকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরাপুরি প্রশাসনমুখী একটা ভবিষ্যত প্রজন্ম সৃষ্টি করা।

এর জন্য তারা তাদের দুজনের শাস্তি মওকুফ তো করবেই; সেই সাথে ভবিষ্যতে তাদের নিরাপত্তা, কেরিয়ার আর সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের সব রকম ব্যবস্থা করার আশ্বাস ও দিয়েছে। " তাহলে, তুমি কি এখন চাও আমরা তাদের কথামতো কাজ করবো? টিশকুকে নিয়ে ওরা যা ইচ্ছা তাই করবে?" -উমনা গলার স্বর মৃত মানুষের মতো অনুভূতিহীন। " নাহ উমু!" ইদোয়ানের গলা কেঁপে গেলো যেন একটু!" কখনোই না! আমি ওদেরকে সাহায্যের কথা বলেছি কেবল মাত্র তোমার সাথে দেখা করে সব খুলে বলবো বলে। আমার আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই। আমি জানি আমার পরিনতি কি হবে, সেটা মেনে নিতে রাজী আছি।

কিন্তু তোমার বিরুদ্ধে ওরা কোন অভিযোগ দাড়া করাতে পারবে না। তোমাকে ছেড়ে দিতেই হবে। কিন্তু ওরা টিশকুকে ছাড়বে না। যেকোন মূল্যে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ওকে গিনিপিগ বানাবে। ওরা আমার রিসার্চের পুরো সিস্টেমটা জেনে নিতে চাইবে ওকে ব্যবহার করে! কিন্তু তোমার হাতে এখনো সময় আছে।

আইনি প্রতিরক্ষার কারণে এখনো তোমার উপর ওরা জোর খাটাতে পারবে না। তুমি চাইলে এখনও ওদেরকে থামাতে পারো। " অক্ষমতার অসহায় আক্ষেপে তার কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছিলো যেন। অন্যদিকে তাকিয়ে প্রায় ফিসফিস করে সে বলে গেলো কথা কটি- "টিশকুকে বাঁচিয়ে দাও উমু। এই নিষ্ঠুর, অমানবিক প্রশাসনের হাত থেকে ওকে বাঁচাও।

ওকে পৃথিবীতে এনো না প্লিজ....। " অনুনয়ের মতো শুনালো শেষ কথাকটি। উমনার চোখের দিকে তাকানোর সাহস বা ক্ষমতা ছিল না তার। পাথরের মুর্তির মতো স্থির হয়ে থাকলো উমনা। তার বিশ্বাস হতে চাইছিলো না নিজের কান কে; কি বলছে ইদওয়ান এসব? তার টিশকুকে?! তাকে পৃথিবীতে আনবেনা মানে?! সেতো তার অংশই; এতোটা দিন ধরে সে তো তার পৃথিবীতেই আছে! রুম থেকে যখন এন্ড্রোরা ইদওয়ানকে নিয়ে যাচ্ছিলো সে ফিরেও তাকালো না।

সব অনুভুতিই হারিয়ে ফেলেছে যেন। তার মাথার ভেতরে কেবল একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল টিশকু। প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসে যখন তাকে জানালো তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ খাড়া করতে জাচ্ছেনা তারা তখনও সে বিস্মিত হলোনা। এটাই যেন হবার ছিল। ইদওয়ানের কথা জানতে চেয়েছিলো।

বিস্তারিত কিছু জানাতে অস্বীকার করলো, শুধু জানানো হলো, তার সে নাগরিক অধিকার রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে; সে অন্তরীণ আছে এখন। উমনা জানে এই অন্তরীন অবস্থা চলতে পারে অনন্তকালের জন্য। কারো কিচ্ছু করার নেই। ট্র্যাকিং মড্যিউলটা ওরা দিয়ে গেছে। টিশকুর সাথে আবারও যোগাযোগ করা শুরু করেছে উমনা।

তিনটা দিন কোন খোঁজ খবর না পেয়ে, সে বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছিলো তথ্যের দিক থেকে। অনেক কিছু আবার নতুন করে বোঝাতে হলো। এর ভেতরে ভেতড়েই দুদিন উমনা পরে প্রথমবারের মতো টের পেলো, কিছু একটা বদলে গেছে; আগের মতো করে যোগাযোগ হচ্ছেনা। টিশকু অনেক বেশী অস্থির হয়ে থাকছে। সাধারণত মড্যিউল অন থাকলে টিশকুর নাড়াচাড়া কিছুটা বাড়ে।

অন্য সময় স্থির, চুপচাপই থাকে। কিন্তু এই এখানে আসার পর কেমন যেন বদলে বদলে যাচ্ছে সবকিছু। কারণটা ধরতে পারলো আরো সপ্তাহ দুই পরে! ওরা টিশকুর সাথে যোগাযোগ করছে! তাহলে কি আরো কম্যিউনিকেশন মড্যিউল বানিয়েছে ওরা?! কিন্তু সেটা তো ইদওয়ানের সাহায্য ছাড়া অসম্ভব। তার অর্থ, তারা তার মড্যিউলটাই ট্রেস করছে, সেটা দিয়েই যোগাযোগ করছে টিশকুর সাথে। নিশ্চিত হবার জন্য উমনা টিশকুর কিছু রেসপন্স এনালাইসিস করলো।

যা ভেবেছিলো তাই! তারা টিশকুকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছে! অস্থির বোধ করলো উমনা। তার এখন কি করা উচিত?! রাতভর ভেবে সে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলো। টিশকুর কথা আলো-আঁধার বলে কিছু ছিলনা তার উপলব্ধিতে। একটু একটু করে যখন বেড়ে উঠছিলো নিজের অজান্তেই; হঠাৎ সব নিয়ম নীতির বাইরে তাকে জাগিয়ে তোলা হলো। সময়ের আগেই সচেতন হবার কারণেই বোধহয় শুরুতে কিছুটা অস্থিরতা কাজ করছিলো তার ভেতর।

কিন্তু মায়ের সাথে শারীরিক যোগাযোগটা তাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়ে রাখলো সবসময়। একটু একটু করে নিজের ভেতরে প্রোথিত স্মৃতিগুলি জেগে উঠলো তার। ব্যক্তিত্য তৈরী হতে শুরু করলো সময়ের অনেক আগেই। কিন্তু ছন্দপতন হলো হঠাৎ। একটানা তিন দিন এভাবে যোগাযোগের বাইরে থাকেনি সে কখনো।

আবার ভ্রুণ অবস্থায় ফিরে যাবার চিন্তা তাকে অস্থির করে তুললো। শারীরিক যোগাযোগের উপরে নির্ভরশীলতা কমে যাওয়ায় সেটাও স্বস্তি দিতে পারছিলো না তাকে। মড্যিউল আবার চালু হলেও ভয়টা একেবারে গেলোনা তার ভেতর থেকে। ঠিক সেময়, অন্য পক্ষ বার্তা পাঠানো শুরু করলো তার কাছে। এরা একেবারেই অন্যরকম।

তার পিতা মাতার মতো নয়। তাদের ভাষা অনেক পরিণত, ভাবনা অনেক ভিন্ন, তারা তাকে দ্রুত তথ্য দিতে শুরু করলো অজানা সব বিষয়ের। অন্যরকমের ক্ষমতা অনুভব করতে শুরু করলো সে। অতিমানবীয় এক চরিত্রের ছায়া গড়ে উঠতে শুরু করলো তার ভেতরে দ্রুত। দুটি পরস্পর বিরোধী চরিত্র ক্রমাগত অন্তর্দ্বন্দের সূচনা করলো।

এসময় আবারও ছন্দপতন! সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো বাহির থেকে। আতংকে দিশেহারা হয়ে পড়লো ভ্রুনটি। মায়ের শরীরের স্পর্শকেই আবার খুঁজে ফিরতে লাগলো সে। বেশ কিছু ঘন্টার অসহনীয় প্রতীক্ষার পর আচমকা নতুন এক ধরণের অনুভুতির সাথে পরিচয় ঘটলো তার। প্রথমে উৎসুক হয়ে আগ্রহী হয়ে উঠলেও একটু পর অনুভুতির তীব্রতা ছাঁপিয়ে উঠলো তার পূর্বে অর্জিত সব স্মৃতিকে।

টিশকু উপলব্ধি করলো, একটু একটু করে সে বিলীন হয়ে যাচ্ছে এই অচেনা অনুভুতির ভেতরে; গ্রাস করে ফেলছে তার পুরো সত্তাকে। টিশকুর জানা ছিলোনা এই অচেনা অনুভুতিকে মানুষ মৃত্যুযন্ত্রণা হিসাবে জানে। অপারেশন থিয়েটারের টেবিলে শুয়ে এন্যেসথেসিয়ার প্রভাব শুরুর আগে, উমনা তখনো শেষবারের মতো নিজের ভেতরে তার টিশকুর উপস্থিতিটা অনুভব করছিলো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।