আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেঘের জন্য

প্রথমে আমার একটি ছোট্ট অভিজ্ঞতার কথা বলে নিই। নার্সারিতে পড়ি আমি তখন। ভাইয়া তখন পংকজ উদাসের একটা নতুন ক্যাসেট কিনেছিল। সারা দিন রাত ঐ ক্যাসেট বাজাত বাসায়। এমনই এক সময়ে আমার এক মামাতো বোনের প্রথম জন্মদিনে আমরা সবাই দাওয়াত পেলাম।

সবাই খুব সেজেগুজে প্রস্তুত হচ্ছিলাম জন্মদিনের দাওয়াত খেতে যেতে। আম্মার সাজতে এত দেরি হচ্ছিল! আম্মা সাজতে দেরি করছে দেখে ঐ ক্যাসেট বাজিয়ে গান শুনতে শুরু করে দিল ভাইয়া, ‘’থোরি থোরি পিয়া কারো’’। অবশেষে আম্মার সাজা শেষ হলো, ভাইয়ার ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ হল। আমরা দাওয়াত খেতে রওনা দিলাম। মামার বাড়িতে গিয়ে দেখি, বেশ ঘটা করে আয়োজন করা হয়েছে।

এত মানুষের ভীড় ভাল না লাগলেও কেক কাটা আর খাবার ব্যাপারটা আমার ভালই লাগল। খাওয়া দাওয়া আর বিদায় পর্ব শেষে বাসায় রওনা দিলাম রাতে। হঠাৎ, বনানীর শুনশান রাস্তায় আমাদের বেবি ট্যাক্সির পথ রোধ করে দাঁড়ালো একটা প্রাইভেট কার। পিস্তল হাতে বেড়িয়ে এলো ৪/৫ জন যুবক। আমি চুপচাপ আমার মামার কোলে বসে আছি।

আমার মা কোন কথা না বলে তার গয়না খুলে দিয়ে দিল। যেন অনেকটা সেধে সেধেই দিয়ে দিল। কাজ সেরে ওরা চলে গেল, ঠিক যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই। তারপর অনেক কিছুই হল, থানা পুলিশ। কিন্তু আমার মায়ের শখের গয়নার কোন হদিস পাওয়া যায় নি।

গয়না গাটির মূল্য আমার ছোট্ট মাথায় আসত না (এখনো যে খুব আসে তা নয়। )। মাত্র কয়েক মিনিটে আমার কাছে মনে হল, আমরা অনেক গরিব হয়ে গেছি। আমার বাবাকে অনেক অসহায় আর দূর্বল দেখাচ্ছিল। আম্মা কাঁদছিল।

আম্মার সাথে সাথে আমিও কাঁদতাম, আমার ছোট্ট গোলাপি রুমালটার জন্য। ওটাতে আমার নাম লেখা ছিল! ওটা যে আমার কত দামি একটা জিনিস সেটা কেউই বুঝবে না। কয়েকটা দিন বাসায় একটা আশ্চর্য শীতল অবস্থা চলতে লাগল। সব কিছু দেখে শুনে আমিও দুষ্টুমি করা ভুলে গিয়েছিলাম। ভাইয়া আর তার নতুন কেনা পংকজ উদাসের ক্যাসেটটা বাজায় না।

যেন খুব আপন কেউ মারা গেছে। অথচ ছিনতাইকারীর দল আমাদের কারো গায়ে একটা আঁচড়ও দেয় নি। এক সময় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সবাই নিজের নিজের কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আম্মা আবার আমাকে দেখাশোনা, রান্না বান্না, ঘরের কাজ কর্ম ঠিক ঠাক মত করতে শুরু করলেন।

ভাইয়া স্কুলে যেতে শুরু করল। (কিন্তু ঐ ক্যাসেটটা আর বাজাতো না। ) আমি! সারাক্ষণ একটা অজানা ভয় এসে আমাকে ঘিরে রাখত। দিন দিন এই ভয় আরো বাড়তে লাগলো। মনে হত, এই বুঝি চলে এল ডাকাতের দল! এই বুঝি আমাকে মেরে ফেলল! চিৎকার করে কেঁদে উঠলে, সবাই ছুটে এসে আমাকে ধরত।

সবাই জানতে চাইত, কী হয়েছে, কী হয়েছে? আমি ঠিক মত কিছুই বলতে পারতাম না। কখনো বলতাম ভূত, কখনো বলতাম ডাকাতের কথা। আমাকে সবাই বোঝাত, কিচ্ছু হয় নি, কিছুই হয় নি। কিন্তু আমি তো জানতাম, একা থাকলেই ওরা চলে আসতে পারে পিস্তল নিয়ে! আস্তে আস্তে সেইসব ভয়ংকর স্মৃতিও ফিকে হয়ে আসে। কিন্তু এখনো যখন শুনি পংকজ উদাসের সেই গানগুলো কোথাও বাজছে, বুকের ভেতরটা ধরাস করে উঠে।

গানের মেলোডি আমাকে কী যেন একটা খুব হারানোর কষ্ট মনে করিয়ে দেয়। এবার বলি মেঘের কথা। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান। একদিন আগেও আমি ওকে চিনতাম না, জানতাম না। এখন খবর মাধ্যমগুলোর কল্যাণে আমিও আর সবার মত ওর কথা জেনেছি।

আরো জেনেছি, ওকেও কেউ পিস্তল দেখিয়ে গুলি করবে বলে ভয় দেখিয়েছে। সকালে পাশের ঘরে যেয়ে ও বাবা-মায়ের রক্ত মাখা মৃতদেহ দেখেছে। আমি ভাবছি, এই বাচ্চাটা কতটুকু মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছে সে কথা। এরই মধ্যে ওকে নানা রকম প্রশ্নের উত্তর দিতে হচ্ছে। সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে কখনো কখনো চুপ করে থাকছে ও।

সব প্রশ্ন হয়ত ও বুঝতেও পারছে না! এত প্রশ্ন শুনে (সাথে মানসিক আঘাত) অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা ও ভুলেও যেতে পারে। ( কিছুদিন আগে এমন একটি খবর প্রথম আলোতে পড়েছিলাম আমি। Click This Link ) আরো অনেক কিছুই হতে পারে। আমার মনে হয় শিশুটিকে এখন কোন সাইক্রিয়াস্টিসের তত্ত্বাবধানে রাখা উচিত।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।