আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবন আর আমার আবছা ইচ্ছে গুলো.......।

আমাদের নতুন বাসাটা সাগরের এত কাছে যে মনে হয় হাত বাড়ালেই নোনা পানি ছুয়ে দেয়া যায়। পাম ট্রি গুলোর ফাঁক দিয়ে নোঙড় ফেলা ছোট নৌকো গুলো এত কাছে মনে হয়!! দিনের মিলিয়ে যাওয়া শেষ আলোটা আকাশের গায়ে এখনও কিছুটা ছাই রং হয়ে মেখে আছে। যেন আদুরে সাঁঝবাতি মিলিয়ে যেতে গা আলসে করছে। আমি সব ভুলে মুগ্ধ হয়ে আকাশের গায়ে চোখ রাখি। "চোখ"! আমার চোখ, নিজের চোখটাকে খুব ক্লান্ত লাগে হঠাৎ করে।

কত কিছু দেখলাম এই চোখে। পৃথিবীটা এত সুন্দর!! সারাটা পৃথিবী জুরেই অকৃত্তিম/কৃত্তিম সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। তবু অনেক কিছুই দেখা হয়নি, দেখা হয়নি পিরামিড, দেখা হয়নি রোম - যার ইতিহাস শুনলে আমার গায়ের Goose Bumps ওঠে, নৌকা বেয়ে যাওয়া হয়নি Venice এর alley গুলো দিয়ে, দেখা হয়নি Eiffel tower .............আরো কত কিছু!! হিসেব করতে গেলে জীবনের প্রায় ১০ আনাই বাকি রয়ে গেছে পৃথিবী থেকে পওয়ার......। ছাই রঙা আকশের দিকে তাকিয়ে ভাবি এখন যদি ধুপ করে মরে যাই তবে কি অনেক আফসোস থাকবে এই জন্য??? হা হা হা .....আমার মন সাথে সাথেই হেসে বলে চোখের সামনে এই অপুর্ব সৌন্দর্য দেখবার পর আর কি কোন আফসোস থাকতে পারে??? এই জীবনে বিধাতা হয়ত কখনও কখনও আমাকে পিপড়া মনে করে নিজে আমার দিকে তেমন মন দিতে পারেন নাই তবে তার অবহেলা তার মানুষেরা অনেকটাই পুষিয়ে কি দেয়নি আমাকে?? আজ পিছন ফিরে তাকালে দেখি, এই জীবনে মানুষের কাছ থেকে যে পরিমান ভালবাসা পেয়েছি তার সবটা যদি দাঁড়িপাল্লায় ফেলি পৃথিবীর সৌন্দর্যের যেটুকু আমি চোখে ধরেছি তার সাথে করে তবে না পওয়ার চাইতে পাওয়ার পাল্লাটা কি আমার ভাড়ি হবে না??? হবে! সেই পাল্লাটাই ভাড়ি হবে বেশি। কারন যা পেলাম না তা মনে ধরে রাখিনি।

রাখলে হয়ত দাঁড়িপাল্লা অন্য কথা বলত। আজ যদি ধুপ করে মুগ্ধ'র মতন মরে যাই আমার কি একটুও আফসোস হবে ??? না হবে না। অনেক অপূর্ণতার ভেতর নিজেকে এত পূর্ণ মনে হয় এমন কি নিজেকে পূর্ণ মনে হয় আমি ভুল বানানে বাংলা লিখবার পরেও । গত বছরটা সারা বছরই মৃত্যু ছাড়া খুব কম ভাল খবর পেয়েছি। এত কাছ থেকে মানুষের চলে যাওয়া দেখলাম! তাই মনে যেটুকু মৃত্যু ভয় ছিল তার পুরোটা উবে গেছে হাওয়া হয়ে।

ব্রিসবেনে আসবার পরে বন্যায় চোখের সামনে মানুষের ভেসে যাওয়া আর না ফিরে আসা দেখলাম। দেখলাম ক্লিফের কলিগ ভিকি'র চলে যাওয়া। সুস্থ মেয়েটার সাথে ডিনারে গিয়ে দুজন মিলে পুরোটা সাবার করে দিলাম। এত সুস্থ একটা মানুষ! ফোনে প্রায়ই কথা হতো ক্লিফকে অফিসে ফোন করলেই......সেই ই ফোনটা তুলতো বেশির ভাগ সময়, হাসি খুশি মিস্টি মেয়েটা। ২ মাসের মাথায় শুলাম ভিকি'র ক্যান্সার হয়েছে, আর চার মাসের মাথায় পুরো একটা সুস্থ মেয়ে সবাইকে ফেলে ধুপ করে চলে গেল।

ব্লগ থেকে ক'জন বাচ্চা ছেলে পটাপট চলে গেল কোন কথা বার্তা ছাড়াই। যেন যাবার জন্য কম্পিটিশন জুড়ে দিয়েছে একেক জন। দেশের ক'জন মুল্যবান প্রান সাথে নিয়ে চলে গেলেন তারেক মাসুদ........। আরো কত ........জাপানে....ব্রিসবেনে........দুই পরিবারের বাবা ছাড়া সবাই আগুনে পুড়ে চলে গেলেন। জীবন কত ছোট তা যেন আমাকে বার বার মনে করিয়ে দিল আমার চারপাশ.......।

কানে কানে বলে গেল "ভয় কিসের"। আসলেই তো ভয় কিসের?? আজ যদি আমি চলে যাই হয়ত কয়েকটা ফোন কল হবে, একে ওকে জানাজানি করানো হবে, আমার ফেসবুকের পাতায় খবরটা উঠবে, বন্ধুরা হয়ত কিছুক্ষন চুপ করে আমাকে ভাববে বা না ভাববে, যারা সত্যিই অনেকটা জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন তাদের বুকের ভেতর আমার জন্য তারা হয়ত আরেকটু লম্বা সময় নিয়ে আমার কথা ভাববেন........ সেটাই আমার হয়ত বড় পাওয়া হবে.....তবু আমিতো তখন কোথাও নেই জীবন আবারও বয়ে চলবে জীবনের মতন। নতুন মানুষরা আসবেন পুরনোরা চলে যাবে। এইত জীবন। আমি যে খুব পুরনো তা বলছিনা তবে যে মানুষটা মাত্র আজ এই মুহুর্তে পৃথিবীতে এলো তার চাইতে তো পুরনো ।

তার চাইতে তো আমার এই পৃথিবীকে অনেকটা বেশি দেখা হলো। এটাই বা কম কি?? নাই বা হলো নীল নদের পাড়ে হাঁটা ক্লিওপেট্রার ইতিহাস কথা মনে ভেবে, হেটেছি তো আমার গ্রামের খালটার পাশ দিয়ে ফুল কুড়িয়ে চুলে পরে, বা পা দুলিয়ে রুপসা নদির পাড়ে বসে স্টিমার যেতে দেখেছি নদি দিয়ে, যা দেখে ঐ বয়সে ভাবতাম কি অদ্ভুত ব্যপার নদি দিয়ে ট্রেন চলে আর আস্তে আস্তে তা পানির ভেতর ডুব দিয়ে অন্য দেশে চলে যায়! নদিতে এই ট্রেন চলাবার ব্যপারটা অনেক বড় হয়েও মনের ভেতর জমে ছিল। আমি শিউলি ফুল কুড়োতে কুড়োতে সেই ট্রেন দেখতাম আর ভাবতাম....মা একদিন সেই ট্রেনে চেপে আমাকে দেখতে আসবে। মা যখন আসত তখন এত অানন্দে থাকতাম যে তাকে ট্রেনটার কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে যেতাম। তবে বড় হয়ে নানুমনি কে কয়েকবার সেই ট্রেনের কথা জিজ্ঞেস করেছি, সে বুঝতে পারেনি ব্যপারটা।

খুব বড় হয়ে একবার যখন খুলনা আমাদের সেই লাল প্রাসাদের বাড়িটায় গেলাম তার ছাদ থেকে দেখলাম নদি দিয়ে স্টিমার যায়......বুঝলাম ছোট বয়সে ঐ স্টিমারটাকেই ট্রেন মনে করতাম আর স্টিমারের দুরে চলে গিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়াকে ট্রেনটাকে পানির ভেতর ডুব দিয়ে সাবমেরিন হয়ে যাওয়া মনে করতাম। আর হ্যা আমার গ্রামের বাড়ি কিন্তু খুলনা নয়। সেখানে আমার জীবনের প্রথম ২/৩ বছর কেটেছে মাত্র। আমি আজ অনেক বছর হয়ে গেলো "কাল"কের জন্য কোন প্লান করিনা। অনেকটা "দিন যায় দিন আসে" টাইপে একদিন একদিন করে বাঁচি।

তবে আবছা একটা ভাবনা মাথায় থাকে আর সেই আবছা ভাবনা কনফার্ম করি ঠিক আগমুহুর্তে। জানি অনেকেই বিরক্ত হয় এজন্য। তবু আমি আগাম প্লান করতে পারিনা এই ভেবে যে জানিনা তো কাল কি হবে। মানুষ, মানুষের মন, পরিবেশ, জীবন.......বদলে যায় কখনও কখনও দু'মুহুর্তের মাথায়। যতবার এই জীবনে আগে থেকে কোন আশা বা প্লান করেছি সববারই কস্ট ছাড়া আর কিছু পাইনি।

মানুষের মতন দ্রুত অন্য আর কিছুকে এত আকাশ পাতাল বদলে যেতে দেখিনি আমি। মানুষই বদলায় পশুপাখি বদলায় না। আমি কি পশুপাখি নাকি মানুষ?? আমি কেন বদলাই না???? অনেকেই এখনও অনেক বছর পরে দেখা হলে বলে "তুমি এখনও তেমনই আছ"। আমার কি বদলে যাওয়ার কথা ছিল? কারন আমি মানুষ? নাহ্ আমি পশুপাখি হলে পশুপাখিই থাকতে চাই, বদলে মানুষ হতে চাই না। আমার এই পশুপাখির জীবনে এখনও আমি আমার জন্মদিন এলে মা'কে ভাবি, অকারন খুশিতে মেতে থেকে আমার পৃথিবীতে আসাবার দিনটাকে এনজয় করি।

ভাল লাগে কেউ "শুভ জন্মদিন" বলে ফুল এনে হাতে দিলে। ঢাকা যাবো হয়ত এ মাসের মাঝামাঝি। এটাও আমার সেই আবছা ভবিষ্যত ভাবনা বা প্লানের মতন রয়ে গেছে এখনও। কনফার্ম করতে পারব শুধু তিন দিন আগে যেদিন টিকেট করব। আমার আবছা ভাবনা গুলো যদি সত্যি হয় তবে জীবনের প্রথম বারের মতন আমার জন্মদিন কাটাব আমার মা'র সাথে এবছর।

হা হা হা মা'কে সেদিন এস এম এস করে জিজ্ঞেস করলাম - "Ma this will be for the first time i am gonna spend my birthday with you.....does that scare you off ha ha ha". সরল মা'টা আমার হিউমার বোঝে না । শুধু তাই না যদি সত্যি এই ঢাকা যাবার আবছা ইচ্ছেটা পূরন হয় তবে বই মেলা, বই কেনা, মেলায় আড্ডা, চিংড়ির মাথা ভাজি খাওয়া...... আরো কতগুলো আবছা ইচ্ছে যে পূরন করা হবে!!! জানি লেখাটা লম্বা হয়ে যাচ্ছে....লম্বা লেখা পড়বার মতন সময় বা ধৈর্য কারোই নেই। মুল কথা যদি ধুপ করে আমিও মুগ্ধ'র মতন চলে না যাই, তবে এই মাসের মাঝ বরাবর বা মাসের শেষের দিকে ঢাকার মাটিতে আমার পা রাখবার আবছা ইচ্ছেটা খুবই প্রবল। আর সেই সাথে আমার ব্লগের বন্ধু, শত্রু ( যদি কেউ থাকেনও) সবার সাথেই দেখা করবার, আড্ডা দেবার একটা আবছা ইচ্ছে মনে আছে যদি তাদের মনেও একই ইচ্ছে থাকে । সত্যিকারের ট্রেন চেপে সিলেট যাবার ইচ্ছে পৃথিবীর আরো কিছু সৌন্দর্যকে ছোচার মতন এই দু'চোখে ধরে রাখবার জন্য।

মায়াবতীর কোলে মাথা রেখে গল্প শুনবার প্রবল ইচ্ছেটাও সেই সুযোগে সরে আসা। বলাতো যায় না কখন এই "জীবন"টা ফাকি দেয় (যদিও আফসোস নেই তাতে)। যারা আপনারা দেশে আছেন সবাইকে দেখবার আবছা ইচ্ছে, আশা, প্লান, ভাবনা....যাই বলুন না কেন তাই নিয়ে আমার আজ থেকে ঘুম গোনা শুরু হবে.... আর ১৬ বা ১৭ ঘুম বাকি ...... শেষ আপডেট ২। ০২। ১২ - যে মানুষটা আমাকে আমার দাদির পরে সব চাইতে বেশি ভালাবাসা দিয়েছে, যার শিক্ষায় আমি আমার জীবনের সারাটা পথ চলেছি......এখনও চলছি সেই মানুষটা গতরাতে চলে গেল.......আমার জন্য সে আর ১৭ টা ঘুম অপেক্ষা করতে পারল না।

আমার বড় ফুফু......যার কথা আমার অনেক লেখায় অনেক সময় এসেছে...। বাংলার প্রফেসর, প্রক্তন এম পি - জান্নাতুল ফেরদৌস, আমার ফুফু.......খুব ছোট বেলায় ফুফু আমার কস্ট হলে বুকে হাত মালিশ করে বলত, "যার বাপ/মা থেকেও নাই তার কি কাঁদলে হবে বাবা, ঘুমাও ঘুমালে রাত পোহালে সব কস্ট চলে যাবে। " যাদুকরি ভাসিলিসা'র মত করে সে বলত, তাই আজো আমি কস্ট হলে ঘুমিয়ে পরি..........যাদুকরি ভাসিলিসা - এখন আমার ঘুম আসে না কেন??  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.