আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাটের জিনোম সিকোয়েন্স: জীবন ধবংস করে ’জীবন রহস্য’ উন্মোচনের রাজনীতি



জিনোম সিকোয়েন্স বা জিন নকশা উন্মোচন করা মানে কিন্তু কোন জিনের কি কাজ তা বুঝে ফেলা নয়, নকশায় থাকা জিনগুলোর কোনটির কি কাজ অর্থাৎ কোনগুলোর কারণে পাট লম্বা/খাটো হচ্ছে, কম/বেশী পানিতে জন্মাচ্ছে কিংবা সূক্ষ/মোটা আশ তৈরী হচ্ছে সেটি জানতে গেলে আরো পরীক্ষা-নীরিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু গত ১৬ জুন সরকারী ভাবে পাটের জেনেটিক সিকোয়েন্স আবিস্কারের ঘোষণা দেয়ার সময় সেটাকে পাটের ’জীবন রহস্য উন্মোচণ’ বলে দাবী করা হয় এবং আশাবাদ ব্যাক্ত করা হয় এর মাধ্যমে ’বাংলাদেশ পাটের হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে, সোনালি আঁশ আবার তার হারানো দিন ফিরে পাবে। ’ জীবন রহস্য বা জিন নকশা যাই বলি না কেন জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন নিশ্চিত ভাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এবং যদি মুনাফাবাজী না করে, জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর চটকদার কিন্তু বিপদজনক ফাঁদে পা না দিয়ে এই জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে আরো গবেষণা করা হয়, যদি জিনোম সিকোয়েন্স এর সহায়তায় মার্কার অ্যসিস্টেড সিলেক্টিভ ব্রিডিং(এমএএস) বা ’জেনেটিক মার্কার সহায়তায় নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজনন’ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, তাহলে এর মাধ্যমে পাটের গুণগত মান আরও উন্নত করা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু এই আশাবাদের সাথে বাংলাদেশের পাটের হারিয়ে যাওয়া গৌরব পুনরুদ্ধারের কি সম্পর্ক? বাংলাদেশের পাটের গৌরব কি উন্নত জাতের পাটের অভাবে হারিয়ে গেছে যে এখন জিন নকশা আবিস্কারের সুবাদে ভালো জাতের পাটের উদ্ভাবন হলেই সেই ’হারানো’ গৌরব পুনরুদ্ধার হয়ে যাবে? তাহলে জিনোম সিকোয়েন্স আবিস্কার না করেই ভারত কি করে পাটের সুদিন এনেছে এবং ধরে রেখেছে? বাংলাদেশের পাটের দুরবস্থা বোঝার জন্য পাটের জিনোম সিকোয়েন্স নয় বরং শাসক শ্রেণীর জিনোম সিকোয়েন্স, সেই জিন নকশায় বিশ্ব ব্যাংক- আইএমএফ এর জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং এদেশের পাট খাতের উপর তার ফলাফলটা লক্ষ করা দরকার। শাসক শ্রেণীর জিন নকশায় গুটিকয়েকের স্বার্থ রক্ষা এবং সাম্রাজ্যবাদের অধীনতার কথাই লেখা আছে ফলে তাদের কাছে লাখ লাখ পাট চাষী কিংবা পাট শ্রমিকের জীবিকা কিংবা সোনালী আশের গৌরবের কোন আবেদন কোন দিনই ছিল না ফলে তারা আদমজীসহ অন্যান্য পাটকল বন্ধকরে দিয়েছে আর তার বাস্তবতা তৈরীর জন্য পাট চাষীর কাছ থেকে সময় মত ন্যায্য দামে পাট না কিনে একদিকে পাট চাষীকে পাট চাষ বিমুখ করেছে অন্যদিকে পরবর্তীতে ফড়িয়াদের কাছ থেকে সেই একই পাট বেশী দামে কিনে, যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন না করে, পাট পণ্যের দেশজ ব্যাবহারের বহুমূখীকরণ না করে এবং সর্বোপরি দুর্নীতি ও লুটপাট চালিয়ে সরকারী পাটকলগুলোকে লোকসানী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে।

আর ভারতে পাট শিল্পের বিকাশের কালে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর পরমার্শে যখন একে একে পাটকলগুলোকে বন্ধ করা হচ্ছে, বেসরকারী করণ করা হচ্ছে এবং সোনালী করমর্দন দিয়ে শ্রমিকদের বিদায় করে দেয়া হচ্ছে তখনও কিন্তু আজকের মতই সোনালী আঁশের সোনালী দিন ফিরিয়ে আনার কথাই বলা হয়েছিল! এখন জিন নকশার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে উন্নত জাতের, উচ্চ ফলনশীল, লবণাক্ততা সহ্যকারী, কমপানিতে জাগ দেয়ার উপযোগী পাট উৎপাদনের খোয়াব দেখানো হচ্ছে। পাটের জাত উন্নয়ণের চেষ্টা করা হবে ভালো কথা কিন্তু ইতোমধ্যেই যে দেশে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠগুণগত মানের পাট ফলন হয়, সেদেশের পাট চাষী কেন পাটের ন্যায্য দাম পায় না, কেন বছর বছর পাট আবাদী জমির পরিমাণ কমতে থাকে সে প্রশ্নের উত্তর না পেলে তো নতুন জাতের পাট আবিস্কার করেও কোন ফায়দা হবে না! জিনোম সিকোয়েন্স ছাড়াই বাংলাদেশের চেয়ে নিম্ন মানের পাট অপেক্ষাকৃত অনুপযোগী জমিতে ফলিয়েও তো ভারত বর্তমানে সারা দুনিয়ার মধ্যে প্রধান পাট উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। যে শাসক শ্রেণী ইতোমধ্যে বিদ্যমান পাটের গুণাগুণের সর্বোচ্চ ব্যাবহার করতে জানেনা সেই একই শাসক শ্রেণী যখন পাটের জাত আরও উন্নত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে তখন সেটা সন্দেহের ব্যাপারই বটে। জিনোম সিকোয়েন্স বিষয়ক সরকারী সংবাদ সন্মেলনে সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে বলা হয়েছে: ”লিগনিন নামক জৈব রাসায়নিক উপাদান বেশি থাকায় পাটের আঁশ মোটা হয়। ফলে তা দিয়ে শুধু দড়ি ও চট তৈরী করা যায়।

লিগনিনের পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারলে তা দিয়ে সূক্ষ সূতা তৈরী করা যাবে। ” এখন পাট দিয়ে সূতা তৈরীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হচ্ছে অথচ বিশ্ববাজারে পাটের চাহিদা না থাকা ও লোকসানের অযুহাতে আদমজী পাটকল বন্ধকরে দেয়ার বছরে (২০০২ সালে) ঘোষিত বাংলাদেশের পাটনীতিতে বলা হয়েছিল: ”এখন পর্যন্ত বিভিন্ন গবেষণা ও উন্নয়ণ কর্মকান্ডের সহায়তায় যেসব পণ্য উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে তার মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য হচ্ছে- ক) নিম্নমানের পাট ও কাঁচাপাট ব্যাবহার করে কাগজ তৈরীর পাল্প খ) পাটের কম্বল গ) কাপড় তৈরীর লক্ষে তুলা ও পাটের সংমিশ্রণে মিহি সুতা ঘ) ঘরের দরজা-জানালার ফ্রেম তৈরীর লক্ষ্যে কাঠের বিকল্প সামগ্রী ঙ) ঘরের ছাদে ব্যাবহারের জন্য সি আই সিটি এর বিকল্প হিসেবে পাট মিশ্রিত করোগেটেড শিট চ) ঘরের অন্যান্য দ্রব্যসহ আসবাবপত্র তৈরীর জন্য জুটো-প্লাস্টিক সামগ্রী ছ) মোটরগাড়ির বডি ও অভ্যন্তরের বিভিন্ন অংশ জ) নদী ও রাস্তার ভাঙন রোধ কল্পে জুট জিও-টেক্সটাইল ঝ) বিভিন্ন প্রকার ডেকোরেটিভ সামগ্রী ট) পাটের তৈরী বিভিন্ন প্রকারের কাপড়। ” তাহলে ২০০২ সালে থেকেই পাট পণ্যের যে বহুমুখী ব্যাবহারের কথা শাসক শ্রেণী জানে, পাট শিল্পে তার বাস্তবায়ন না করে, এখন জিনোম সিকোয়েন্স ব্যাবহার করে উন্নত জাতের ও বহুমুখী ব্যাবহার উপযোগী পাট নতুন করে উদ্ভাবনের ফ্যান্টাসী করার মাজেজা কি! বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সহ গোটা শিক্ষাখাতে ক্রমশ সরকারী ব্যায় সংকোচনের প্রেক্ষপটে এবং অত্যন্ত দুর্বল গবেষণাগারের সীমিত সুযোগ সুবিধা ব্যাবহার করে যে ৭২ জন বিজ্ঞানী ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ পাটের জিনোম সিকোন্সিং এর এই কাজটি করেছেন নি:সেন্দেহে তারা অভিনন্দনের দাবীদার। তাদের এই আবিস্কার দেশের সামগ্রীক উন্নয়ণের প্রয়োজনে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাটিকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। কিন্তু এ আনন্দ উদযাপনের বেলায় ভুলে গেলে চলবে না, বিজ্ঞানের যে কোন আবিস্কারের মতোই এই পাটের জিন-নকশা উন্মোচন জনগণের কতটুকু কাজে লাগবে তা নির্ভর করবে এই জিন-নকশা চূড়ান্ত বিচারে কার হাতে থাকবে, কি উদ্দেশ্যে ব্যাবহ্রত হবে তার উপর।

২০০২ সালে ধানের জিন নকশা উন্মোচনের খবর সায়েন্স সাময়িকীতে প্রকাশ হওয়ার পর বিশ্ব খাদ্য সংস্থা এক প্রতিক্রিয়ায় উল্ল্যেখ করে: ”জিন নকশার মাধ্যমে ধানের সকল জিন এবং তাদের কার্যাবলী নির্ধারণ করা সম্ভবপর হবে। ’কার্যকরী জিনোমিকস’ এর কাজই হলো এই জিন চিহ্রিত করা এবং তার কার্যনিধারণ করা। বিভিন্ন বৈচিত্রের ধানের জেনিটিক মার্কার আবিস্কার ও সিলেক্টিভ ব্রিডিং এ তা ব্যাবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন কাঙ্খিত বৈশিষ্টের উন্মেষ ঘটানো যায় বা অনাকাঙ্খিত বৈশিষ্টকে সুপ্ত করে দেয়া যায়। আবার বিভিন্ন ধারার জন্য প্রয়োজনীয় জিন চিহ্রিত করে সেগুলোর মাধ্যমে(জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে) ট্রান্সজেনিক জাতও তৈরী করা যায়। ” ধানের জিন নকশা কাজে লাগিয়ে সিলিক্টিভ ব্রিডিং কিংবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং - উভয় ধরনের গবেষণাই চলছে।

বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো দ্রুত মুনাফার লোভে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কে প্রাধান্য দিয়ে বিতর্কিত হলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনেক দেশেই জিন-নকশার সাহায্যে মার্কার অ্যাসিস্টেড সিলেক্টিভ ব্রিডিং এর মাধ্যমে বিভিন্ন ফসলের জাত উন্নয়নের চেষ্টা চলছে। যেমন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী অর্থায়নে সেদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফসল গমের জিন-নকশার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে গমের জাত উন্নয়নের জন্য ’মার্কার অ্যাসিস্টেড সিলেকশন ইন হুইট’ নামের একটি গবেষণা চলছে। আমরা মনে করি বর্তমানে বাংলাদেশে যে মানের পাট উৎপাদিত হয় শিল্প ক্ষেত্রে তার সঠিক ব্যাবহার করাটাই পাটের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনার জন্য যথেস্ট। পাটের সোনলি দিন ফিরে আসা পাটের জিনোম সিকোয়েন্স এর উপর নয় বরং শাসক শ্রেণীর জিনোম সিকোয়েন্স পরিবর্তনের উপর নির্ভর করছে। তারপরও পাটের ক্রমাগত মানোয়ন্নয়ের কাজে পাটের জিন-নকশার কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আমরা মনে করি যেহেতু জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে বাহির থেকে কৃত্রিম ভাবে জিন প্রবেশ করিয়ে উৎপাদিত জাতের ট্রান্সজেনিক লাইন অর্থাৎ জেনেটিক বৈশিষ্ট স্থির রাখা যায় না, যেহেুতু জেনেটিক দূষণের ঝুকি থেকে যায়, প্রজাতির বৈচিত্র হুমকীর মুখে পড়ে এবং বীজের অধিকার থেকে কৃষক বঞ্চিত হয়, সেহেতু যুগ যুগ ধরে ব্যাবহ্রত হয়ে আসা সিলেক্টিভ ব্রিডিং পদ্ধতিটিতে যদি পাটের জিনোম সিকোয়েন্সের সাহায্য নেয়া হয় এবং তার ফলে উৎপাদিত উন্নত বীজের মালিকানা কৃষকের হাতে থাকে এবং উৎপাদিত পাটের সর্বোচ্চ বহুমুখী ব্যাবহারের জন্য ব্যাপক শিল্পায়ন করা হয় তাহলে সেটাই প্রকৃত অর্থে জনকল্যাণ বয়ে আনবে ।

কিন্তু যদি এই পাটের জিন-নকশা রাষ্ট্রীয় বা বেসরকারী ভাবে কিংবা বহুজাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে জেনিটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর জন্য তুলে দেয়া হয়, যদি এই জিন নকশা কাজে লাগিয়ে উৎপাদিত উন্নত জাতের বীজ কৃষককে আরও বেশী বাজারের উপর নির্ভরশীল করে ফেলে, তাহলে তাতে সাময়িক ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও এবং জিন-নকশার কংকাল ও তার মালিক শ্রেণীর গায়ে বাড়তি মাংস লাগলেও চূড়ান্ত বিচারে তা কৃষক-শ্রমিকের কংকালের সংখ্যাই বাড়িয়ে তুলবে, পাটের সোনালি দিন পাট চাষী ও পাট শ্রমিকের না হয়ে গুটিকয় শাসক-শোষকের সোনালি দিনে পরিণত হবে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.