আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কারো ভাষায কুটির শিল্পের রানী, কারো কাছে দিন বদলের সারথী, কারো কাছে মানুষ গড়ার কারগির

কারো ভাষায কুটির শিল্পের রানী, কারো কাছে দিন বদলের সারথী, কারো কাছে পথ প্রর্দশক, কারো বা কাছে ছোট শিল্পের বড মানুষ কিন্তু আমার দৃষ্টিতে তিনি মানুষ গডার কারিগর। বাংলাদেশের কুটির শিল্প আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা, সমাজ উন্নয়নকর্মী, জাহানারা কটেজ ইন্ড্রাটিজ এর প্রতিষ্ঠাতা জাহান আরা বেগম। নারীদের ক্ষমতায়িত করার লক্ষে কুটির শিল্পের কাজ শুরু করে পরবর্তীতে এ শিল্পকে তিনি নিয়ে গেছেন বিশ্বের দরবারে। দেশের কুটির শিল্পের বিকাশ ও অগ্রগতিতে তাঁর অসামান্য অবদান সর্বজন স্বীকৃত। কুমিল্লা শহরের গাংচর এলাকায় জন্মগ্রহণকারী এই মহয়সী নারী ২০১০ সালে ১৭ জানুয়ারী মানবতার তরে অর্পিত দায়িত্ব পালণ শেষে ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেন।

জাহান আরা বেগম বলতেন, মানুষকে শক্তিশালী করতে কর্ম শেখানো এবং কর্মের বিস্তারে জন্য প্রতিষ্ঠান গডা প্রয়োাজন। আর এই বিশ্বাসকে ধারণ করে তিনি নিরন্তর কাজ করেছেন দুঃস্থ ও অসহায় মানুষ বিশেষ করে নারীদের জীবনকে সাজাতে। অনেক দুঃস্থ ও অসহায় নারীদের হাতকে তিনি পরিণত করেছেন কর্মম শক্তিশালী হাতে। জাহানারা কটেজ ইন্ড্রাটিজ নামটি শুনে শিল্প প্রতিষ্ঠান মনে হলেও, মূলত এই প্রতিষ্ঠানে মানুষদের কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান করা হয়। টাকার অংকে এই প্রতিষ্ঠানের মূলধণ স্বল্প হলেও, এই শিল্প প্রতিষ্ঠানের মানব সম্পদ লক্ষ কোটিতে।

হাজার হাজার নারী ও পুরুষকে তিনি কর্মক্ষম করেছেন। গড়ে দিয়েছেন জীবন ধারনের পথ। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষ মরে যায, মানুষের কর্ম ধ্বংস হয় না। দেশীয় উপকরণকে যথাযথ সম্পদে রূপান্তরে তাঁর ছিল সিদ্ধ হাত। একটি বাশের ১২ইঞ্চি টুকরা হতে তিনি ৬ টি স্কেল, গ্লাস প্লেট এবং টুথপিক তৈরি করতে পারতেন।

সম্পদের যথাযথ ব্যবহারে এ ধরনের অনেক যাদু তিনি শিখিয়েছেন তার অগুনিত শিার্থীদের। তিনি বিশ্বাস করতেন অর্থ কোন ব্যাপার নয, প্রয়োজন শুধু চিন্তা, ইচ্ছা ও কাজের মনোবল। জাহান আরা বেগমের মতে, নারীদের অগ্রগতির জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। তবে সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য শিক্ষা নয় বরং নিজকে আলোকিত করে এমন ধরনের শিক্ষা প্রয়োজন। যে শিক্ষা নারীকে আত্মবিশ্বাসী করে, সে ধরনের কর্মমুখী শিক্ষা।

নারীর বিকাশের জন্য সমাজ, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। পর্দানশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও, তাঁর সমাজ তার কাজে কখনো বাধা হযনি। পিতা মৌলভী নাসির উদ্দিন ও মাতা সুলতানা রেজিয়া বেগমের সহযোগিতায় কিশোরী বযসে তিনি বাডীতে গড়ে তোলেন মেয়েদের শিক্ষালয়। বাডী বাডী গিয়ে মেয়েদের পিতামাতাদের উদ্বুদ্ধ করতেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে। কোন কোন পিতা-মাতা বাডীর কাজের জন্য মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চাইতেন না।

সে সকল মেয়েদের বাডীতে গিয়ে তিনি নিজে বাডীর কাজ করতেন, যাতে মায়েরা তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠান। কোন কাজকেই তিনি ছোট মনে করতেন না। ছোট বড সকল কাজেই তিনি সক্রিযভাবে এগিয়ে যেতেন। যাতে অন্য মানুষও কাজের প্রতি উৎসাহী হন। কাজ শেখার প্রতি ছিল তাঁর অফুরন্ত আগ্রহ, কাজ শেখার জন্য ছুটে গেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

অনেক মানুষকে বিভিন্ন কাজ করে দিয়েছেন নতুন একটি কাজ শেখার জন্য। নির্মাণের নেশায় নিজের হাতে বাডীর মসজিদের দেয়ালের ইট গেথেছেন। নিজের বাডীর ও স্কুলের দেযাল গডতে নিজেও কাজ করেছেন একজন নির্মাণ শ্রমিকের মতো। আজীবন কাজ করেও কাজের নেশা থামেনি। অসুস্থ হয়েও হুইল চেযারে বসে মেয়েদের কাজ শিখিয়েছেন।

বার্ধক্য ও অসুস্থ্যতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, মানুষ গডার এই কারিগর মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি মেয়েদের কাজ শিখিয়েছেন। তিনি বলতেন আমি শারিরীকভাবে অসুস্থ্য কিন্তু আমার মন ও চিন্তা অসুস্থ্য নয়। আমি মানুষের জন্য চিন্তা করতে পারি। তিনি বলতেন নেতিবাচক নয় বরং ইতিবাচক ও দিকনির্দেশনামূলকভাবে মানুষের কাজের সর্ম্পকে আলোচনা করা উচিত। স্বশিক্ষায় শিক্ষিত এই মহীয়সী নারী প্রতিষ্ঠান ও কর্মমুখী শিার বিস্তারে কাজ করেছেন অবিরামভাবে।

গড়ে তুলেছেন জাহানারা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয, জাহানারা কটেজ ইন্ডাষ্টিজ, মনির কটেজ ইন্ডাষ্টিজ এবং ট্রেনিং সেন্টার, আড্ডা ওমেন্স ইন্ডাষ্ট্রিযাল স্কুল, বজ্রপুর মহিলা সমবায় সমিতি লিঃ, কুমিল্লা সদর (দঃ) কেন্দ্রীয সমবায় সমিতি লিঃ, জাহানারা ফিমেল এডাল্ট স্কুল এন্ড হ্যান্ডিক্রাফটস ট্রেনিং সেন্টার (জাফাস্ট্রাক)এর মতো অনেক প্রতিষ্ঠান। এ সকল প্রতিষ্ঠান গড়তে ও এগিয়ে নিতে স্বামী মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম মিযাজী ও জাহান আরা বেগমের ভাই-বোনদের অনুপ্রেরণা, একনিষ্টভাবে ছাযার মতো সক্রিয সহযোগিতা যা একটি অনুকরণীয ও শিক্ষামূলক দৃষ্টান্ত। তিনি সকলের মাঝে শক্তিকে অনুধাবন করতে পারতেন এবং সেই শক্তিকে সম্মিলিত করে সম্পদের রূপান্তরের যাদু জানতেন। সমাজ ও দেশের এত কাজের পরও পারিবারিক লোকজনের জীবনকে সাজাতেও তার ছিল অকান্ত চেষ্টা। তিনি পরিবারের প্রতি মানুষদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে নিরলসভাবে কাজ করেছেন।

তাঁর চিন্তা ও আর্দশকে ছড়িয়েদিতে কাজ করেছেন। পরিবারের ছোট বড প্রতিটি মানুষের কাছে এ কারণেই তিনি ছিলেন প্রিয়। তিনি বলতেন পরিবারের লোকজন মধ্যে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ জরুরি। খাবার টেবিল, পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলো এ ধরনের যোগাযোগ বৃদ্ধিতে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করেছে। তিনি বলতেন বড়দের উচিত ছোটের পারিবারিক ও সামাজিক রীতিনীতি শিখতে ও জানাতে সহযোগিতা করা।

কারো কারো দায়িত্ব নেযা উচিত পরিবারের লোকজনের মধ্যে যোগযোগ ও বন্ধনকে অব্যাহত রাখতে। মানুষের মাঝে ভুল হবেই সে কারণে লোকজনকে দূরে ঢেলে না দিয়ে অব্যাহত চেষ্টা করা উচিত, যাতে এ মানুষগন নিজের ভুল উপলব্ধি করে নিজের পায়ে দাডাতে পারে। জাহানারা বেগমের বলতেন, আমি মানুষের জন্য কাজ করি, পুরস্কার আমার কাম্য নয়। তথাপিও রাষ্ট্র, সামাজিক প্রতিষ্ঠানও তাঁকে সম্মানিত করেছে। কুটির শিল্পের বিকাশ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও পুর্নবাসনের অসামান্য অবদানের স্বীকৃত স্বরূপ ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রীয় সর্ব্বোচ সম্মাননা স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন।

এছাডাও তিনি ১৯৬২সালের রানী এলিজাবেথ গর্ভনর স্বর্ণপদক, ১৯৭৭ সালে কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ন পদক, ১৯৮২সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ সমবায়ী পুরুস্কার, ১৯৮৫ সালে শ্রেষ্ঠ মহিলা পুরুস্কার, ১৯৯৮সালে শ্রেষ্ঠ সমাজসেবী পদক, ২০০০ সালে অনন্যা শীর্ষ পদক, ২০০০ সালে রোটারি পদক, ২০০১ রোটারি মিলেনিয়াম পদক, ২০০৭ জাতীয় কন্যা শিশু এ্যাডভোকেসি ফোরাম এর সম্মাননা এবং পল্লী উন্নয়নে শ্রেষ্ঠ কর্ম হিসেবে বার্ড সম্মাননা ২০০৯ পদকসহ অসংখ্য জাতীয় ও আন্তজার্তিক পুরস্কার লাভ করেন। সমাজসেবী ও নারী সংগঠক হিসেবে তিনি জীবনে প্রায় ১২৬ টি পদক লাভ করেন। দুঃস্থ ও অসহায় মানুষ বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থান, শিক্ষা বিস্তার তার অসমান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৮সালে জাহানারা বেগম”সাদা মনের মানুষ” সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। এতগুলো সম্মাননা তিনি গ্রহণ করেছেন নীরবে। এ সম্মাননা তাঁকে করেছে বিনম্র।

প্রতিটি মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ব্যস্ত নিজের জীবন গোছাতে। কিছু মানুষ রয়েছে, যারা আজীবন কাজ করেন অন্যের জীবন গোছাতে ও সাজাতে। তাদের কারণে বিকাশ ঘটে সমাজ, সাংস্কৃতির। এত বড় মনের অধিকারী হয়েও কিভাবে এত সাধারণ মানুষ হন? জাহানারা বেগমের মতো মানুষগণ কিভাবে বিত্ত-বৈভবের মোহ ছেড়ে মানুষের জন্য কাজ করেন? মানুষের এত অনুরাগ, অভিমান, অনুযোগের পরও মানুষের জন্য কিভাবে কাজ কারণে আন্তরিকভাবে? কিভাবে জীবনকে মানুষের জন্য বিলিয়ে দিতে অফুরন্তশক্তি পান? মানুষের কল্যাণে কোন সেই শক্তিকে ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন? মানব জীবনে এই গুঢ় রহস্য জানেন বলেই তিনি বড় মাপের মানুষ। হতে পারেন মানুষ গড়ার কারিগর।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.