আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সীসা নিয়ে ভাবছেন না কেন ?

মানুষ সব পারে কিন্তু একজন মানুষ সব পারেনা । জমিদারী আমলে জমিদারী বা জমিদারদের আভিজাত্য প্রকাশের জন্য তাঁরা হুক্কা নামক এক ধরনের পাইপ টানত । কিংবা বিভিন্ন সম্রাট তাদের সৌখিনতায় এই হুক্কা সেবন করত। মুখে পাইপ নিয়ে টেনে মুখের ভেতর থেকে ধোঁয়া ছাড়ত । ধারনা করা হয় এই উপমহাদেশে প্রথম মোঘল সম্রাট আকবরের পারস্য কবিরাজ আবুল ফতেহ্ জিলানী হুক্কার ডিজাইন উদ্ভাবন করেন ।

তামাক পোড়ানো ধোঁয়া পানিতে পিউরিফাই এবং ঠান্ডা করে সেবন করা শুরু হয় তখন । দেশ ও অঞ্চল ভেদে হুক্কা বিভিন্ন নামে পরিচিত । আরবীয়রা এটাকে Nargileh বলে থাকে । এছাড়াও Nargeela, Argileh, Argilee ইত্যাদি নামেও বলা হয় । উপমহাদেশে এটি হুক্কা নামে পরিচিত ।

তবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এটি ছিলুম বা ছিলিম নামে পরিচিত । আবার কোথাও গড়গড়া বা গুড়গুড়ি নামেও পরিচিত । তবে Nargileh শব্দটি পারসিয়ান শব্দ Narghile হতে উৎপত্তি । ধারনা করা হয় এটা সংস্কৃত শব্দ “নারিকিলা” এর পরিবর্তিত রূপ । অনেকে ধারনা করে থাকেন এর নামের উৎপত্তি আমাদের দেশীয় নারিকেলের হুক্কা থেকেই ।

উপমহাদেশের কথা বাদ দিলে ইউরোপ আমেরিকায় এটি Shisha নামে পরিচিত । বর্তমানে সারা বিশ্বে এই সীসার জনপ্রিয়তা অনেক । মূলত Shisha শব্দের অর্থ তামাক । অনেকে বলে থাকেন Shishe মানে কাঁচ । হুক্কার নিচে পানির জারটা কাঁচের তৈরী হয়, তাই হয়তো এটা ভাবা।

গ্রাম বাংলায় নারকেলের খোল দিয়ে হুক্কা তৈরী করা হত । কাঁঠের নলের উপর তামাক রাখার একটি কলকে থাকত । কিন্তু বিদেশী হুক্কার সাথে এই হুক্কার গঠন প্রনালীর পার্থক্য রয়েছে । তবে গঠনে পার্থক্য থাকলেও কাজ একই । শিশার গঠনে সবার ইপরে থাকে মাটি বা মার্বেলের তৈরী কল্কে যার ভিতরে থাকে তামাক এবং জলন্ত কয়লা ।

নিচে কাঁচের তৈরী পানির জার । মাঝের অংশে থাকে স্টিলের পাইপ । নিচের অংশে ধোঁয়া টানার পাইপ এবং অপর দিকে একটি নির্গমন ভাল্ব সংযুক্ত । বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যে হুক্কার ব্যবহার হত তা সময়ের সাথে সাথে বিলুপ্ত হয়ে আবার নতুন রুপে ফিরে এসেছে । একসময় এটা দিয়ে শুধু তামাক কিংবা গাঁজা খাওয়া হত ।

কিন্তু বর্তমানে এটি নতুন রুপে আবির্ভাব হয়েছে । অন্যান্য উন্নত বিশ্বে যে রকম জনপ্রিয়তা বাংলাদেশেও তার প্রভাব দেখা যাচ্ছে । তবে সমস্যা হচ্ছে এটি আর সেই পুরনো হুক্কা নয়, শুধু গঠনটাই আগের মত রয়ে গেছে আর পরিবর্তন এসেছে এর দ্রব্য সামগ্রীতে । এখন আর শুধু তামাক ব্যবহার হয়না । এর সাথে মেশানো হয় নানা ধরনের ফ্লেভার ।

বিভিন্ন ফলের নির্যাশই সীসার মূল উপাদান । আপেল, আঙ্গুর, আনারস, কলা, পেঁপে থেকে শুরু করে নানা ফলের নির্যাশে তৈরী সীসার উপাদান । এসব উপাদান শুকনো আকারে থাকে । বাংলাদেশে মূলত দুবাই থেকে এই উপাদান আসে । এসব ফলের শুকনো নির্যাশ কলকেতে ভরা হয় ।

আমাদের দেশেই বিভিন্ন জায়গায় এই সীসার জন্য ফ্লেভার পাওয়া যায় । এসব ফ্লেভারের মুল্য ও অনেক বেশি । এক প্যাকেট ফ্লেভার (তামাক) কিনে বেশ কয়েকবার ব্যবহার করা হয়ে থাকে । আমাদের দেশে বিশেষ করে ঢাকা শহরে বেশ কিছু জায়গায় এসব সীসা পাওয়া যায় । ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় গড়ে ওঠা লাউঞ্জগুলোতে সীসা খুবই সহজ লভ্য ।

রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, ধানমন্ডি, বেইলি রোড সহ বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ২০০ লাউঞ্জ রয়েছে । তবে বেশির ভাগ লাউঞ্জ রয়েছে বনানীতে । এসব লাউঞ্জে সীসা খুব সহজেই পাওয়া যায় । অনেকে মনে করেন সীসা কোন মাদক এর মত ভয়াবহ খারাপ বা ক্ষতিকর কিছু নয়। আর এই দোহাই দিয়েই নিয়মিত সীসা গ্রহন করছেন ।

অনেকে মনে করছেন সীসা সিগারেটের তুলনায় কম বিষাক্ত কিংবা এর মধ্যে কোন বিষক্রিয়া নেই । তাই হোটেল থেকে ভেলপুড়ি কিনে খাবার মত করে কিনে খাচ্ছে । কিন্তু এটা যে মোটেও সঠিক নয় তা বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ প্রমান করে দেখিয়েছেন । একটি সীসায় মোট চারটি অংশ থাকে । যথা ঃ বেজ, পাইপ, বওল আর মাউথপিস ।

বওলটাকে এলুমিনিয়ামের কভার দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় আর সেই ফয়েলের মাঝে কয়লা রাখা হয় । এর মধ্যে তামাক পুড়ে যায় আর কয়লা পুড়ে কার্বন মনো অক্সাইড হয়, যা মানুষের শ্বাস প্রশ্বাসে চরম ক্ষতি করে এমন কি মৃত্যু ও ঘটতে পারে । রয়টার্সের এক সংবাদ অনুযায়ী একটা পূর্ণ সেশনের সীসা গ্রহন এক প্যাকেট সিগারেট সেবনের মতই মারাত্বক । আবার যারা সিগারেট থেকে সীসাকে কম ক্ষতিকর বলে ভাবেন তাদের জানা উচিৎ যে সিগারেটের চেয়ে সীসায় নিকোটিনের পরিমান বেশি থাকে । সিগারেটে যেখানে ১-৩% নিকোটিন থাকে, সেখানে সীসাতে ব্যবহৃত তামাকে ২-৪% নিকোটিন থাকে ।

(সুত্রঃ ড. কেনেথ, আমেরিকা একাডেমী অফ পেডিয়াট্রিক্স এর প্রেসিডেন্ট) । ২০০৫ সালের Journal of Periontology এর সূত্র মতে, একবার পূর্ণভাবে সীসা গ্রহন করা ৬০ টি সিগারেট গ্রহন করার সমান । মূলত সীসা একজন মানুষের জন্য যতটুকু ক্ষতিকর তার চেয়ে বেশি ক্ষতিকর ঐসব লাউঞ্জে গিয়ে খাওয়াটা । কেননা লাউঞ্জগুলোতে ইদানিংকালে সীসার ভিতরে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন মাদক দ্রব্য । আর উঠতি বয়সের তরুণ তরুণীদের জন্য খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে সীসার অন্তরালে এই মাদক ।

অধিকাংশ লাউঞ্জে সীসার উপাদানের সাথে মেশানো হচ্ছে ইয়াবার গুড়া, হেরোইন ও বিভিন্ন যৌন উত্তেজক ট্যাবলেটসহ নেশাজাতীয় অনেক ট্যাবলেটের গুড়া । এছাড়াও গাঁজার বিশেষ রাসায়নিক অংশ মিশিয়ে এর উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে । খুব সহজেই একজন মানুষ এই নেশায় ডুবে যাচ্ছে । নেশার চেয়ে আরও ভয়াবহ আকার ধারন করেছে লাউঞ্জগুলোর পরিবেশ । লাউঞ্জগুলোতে যারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই তরুণ তরুণী ।

আর বেশিরভাগ তরুণ তরুণীই সেখানে অশালীন কাজে লিপ্ত হচ্ছে । ৫০০ টাকায় ক্রয় করে পাইপে একবার মুখ লাগিয়ে দীর্ঘক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকা যায় । আর নেশার তালে চলে প্রেমিক প্রেমিকাদের অশালীন কাজ । বেশিরভাগ লাউঞ্জেই দেখা যায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে পরিবেশ । আর এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অশালীন কাজ করছে তরুণ তরুণীরা ।

মূলত সীসার অন্তরালে যে মাদক রয়েছে তার কারনেই এমনটি হচ্ছে । আর একটা বিষয় তরুণ তরুণীদের মাঝে কাজ করে, আর তা হল নিশ্চিতভাবে অশালীন কাজ করতে পারা । মোদ্দা কথা একটা নিরাপদ অশালীণ কাজের জায়গায় পরিনত হয়েছে লাউঞ্জগুলো । আর এসব লাউঞ্জে যারা তাদের বেশিরভাগই ধনী পরিবারের সন্তান । তবে ইদানিংকালে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে মেয়েরাও যাচ্ছে ।

কেননা দিনে দিনে সহজলভ্য হয়ে উঠছে সীসা । সচেতনতার সময় এসেছে । প্রতিটি পরিবারের সচেতন হওয়া উচিৎ । আমরা সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবো । কিন্তু এই এগিয়ে যাওয়া মানে মাদক সেবন করা নয়, যৌনাচার করা নয় ।

যদি আধুনিকতার দোহাই দিয়ে সীসাকে গ্রহণ করা হয় কিংবা লাউঞ্জগুলোর অশালীন পরিবেশকে সাবলীল ভাবে মেনে নেওয়া হয় তাহলে শুধু তরুণ সমাজই ধ্বংস হবেনা বরং একটা সভ্যতার গতিপথ ও পরিবর্তন হবে । আর এই পরিবর্তন কোন ভালো কিছু বয়ে আনতে পারবেনা । এখানেও দেখতে পারেন  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।