আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বোঝা

আমি যা বিশ্বাস করি না... তা বলতেও পারি না! সফিক এহসান (১৩ ডিসেম্বর ২০০৫ইং) সকাল থেকেই প্রচন্ড উত্তেজনা অনুভব করছিলো প্রত্যয়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে উত্তেজনাটা আরও বেড়ে যাচ্ছিলো। আজ একটু আগে ভাগেই ঘুম থেকে উঠেছে সে। সেভ হয়ে অনেক সময় নিয়ে সাবান দিয়ে গোসল করেছে; চুলে শ্যাম্পু করেছে। গতকাল লন্ড্রি থেকে ধুয়ে আনা স্ত্রি করা ধবধবে শাদা শার্টটা গায়ে দিয়ে অনেক দিন পর একটু দামি পারফিউম নিলো।

গলায় অত্যন্ত যতœ সহকারে একটা টাই পড়লো। তারপর চুলগুলো ঠিক করে আয়নায় একবার নিজেকে দেখলো। অনেক দিন পর নিজেকে আয়নায় এতো খুটিয়ে দেখছে সে। শেষবার কবে দেখেছিলো মনে পড়ছে না। গলার টাইটা আরেকটু নাড়াচাড়া করে সন্তুষ্ট হয়ে চোখ নামালো।

কাগজ পত্রগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা তা ভালো করে আরেকবার দেখে নিলো। এটা তার ছোটবেলার স্বভাব- কোন জরুরি কাজে যাওয়ার সময় কেবলই মনে হয়, কী জানি কী নেয়নি; কী জানি কী বাদ পড়লো! সবশেষে টেবিল থেকে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটারটা; শার্টের বুক পকেটে ভাঁজ করে রাখতে গিয়েও থেমে গেল। এক মুহূর্ত সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা চুমু খেলো সবুজ খামটায়। তারপর পকেটে রেখে বেরিয়ে আসলো ঘর থেকে। এই একটা কাগজ তার জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ! তার তিন বছরের বেকার জীবনের ইতি টেনেছে এই কাগজটি।

পরিবারের একজন টহরসঢ়ড়ৎঃবহঃ চবৎংড়হ- কে মুহূর্তের মধ্যে ওসঢ়ড়ৎঃবহঃ ঢ়বৎংড়হ-এ রূপান্তরিত করেছে। অবশ্য বাড়ির কেউই সুসংবাদটা এখনও শোনেনি। সেদিন ইন্টারভিয়্যুর পরই অ্যাপয়েনমেন্ট লেটারটা হাতে পেয়েও মানিব্যাগে পর্যাপ্ত ‘মানির’ অভাবে মিষ্টি কেনা হয়নি। এজন্য প্রত্যয় বাড়ির কাউকে খবরটা এখনও জানায়নি। সবাইকে সারপ্রাইজ দেবে ভেবে অনেক কষ্টে বুকের ভেতর চেপে রেখেছিলো।

আজ সন্ধ্যায় অনেক মিষ্টি কিনে এনে সবাইকে চমকে দেবে- এরকম একটা প্ল্যানও আগে থেকেই করে রেখেছে। নাস্তার টেবিলে এসে প্রত্যয় দেখলো- সবার নাস্তাই প্রায় শেষের দিকে। অনেক দিন আগে এবাড়িতে একসাথে বসে সকালের নাস্তা করার একটা রেওয়াজ ছিলো। কিন্তু আজকাল সে নিয়ম কেউ মানে না। যে যার মত খেয়ে চলে যায়; কেউ কারও জন্যে অপেক্ষা করে না।

প্রত্যয়ের জন্যে তো প্রশ্নই উঠে না। একটা বেকার ছেলের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত ফর্মালিটি দেখানোর সময় কারও হাতে নেই। প্রত্যয় সেটা খুব ভাল ভাবেই বোঝে; নিরবে মেনেও নেয়। আজ নাস্তার টেবিলে বড় ভাবি, মা আর প্রত্যয়ের বড় ভাই (বাবার অবর্তমানে বাড়ির বর্তমান কর্তা) খোরশেদ সাহেবকে পাওয়া গেল। ছোট বোনটা বোধ হয় কলেজে চলে গেছে।

প্রত্যয়কে দেখে খোরশেদ সাহেব ইংরেজি পত্রিকার পাতা থেকে চোখ নামিয়ে বললেন: এতো সাজগোজ করে কোথায় যাচ্ছিস? কোথাও ইন্টারভিয়্যু আছে নাকি? প্রত্যয় চট করে একবার তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। খোরশেদ সাহেব উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন: গত সপ্তায়ও না কি একটা দিলি। সেটার কী খবর? প্রত্যয় একথার জবাবেও মুচকি হাসলো। খোরশেদ সাহেব এ প্রশ্নেরও কোন উত্তর আশা করলেন না। এই প্রশ্ন দু’টি তিনি কখনো উত্তরের আশায় করেন না।

গত তিন বছরে তিনি কম করে হলেও চল্লিশবার এই প্রশ্ন দুটি করেছেন। অবশ্য ‘মুচকি হাসির’ জবাব এই প্রথম পেলেন। তবে ওকে আর না ঘাটিয়ে হাত ঘড়িটায় নজর বুলিয়ে নিরবে উঠে চলে গেলেন। খোরশেদ সাহেব তাঁর শ্বশুরসাহেবের বৌদলতে বেশ ভাল একটা চাকরি করেন। উপরি আয়ও আছে বেশ ভালই।

অফিসের বড় সাহেবের মত হাবভাবটা বাড়িতেও বজায় রাখেন। বাড়ির সবাইও তাকে সেভাবেই সমীহ করে চলে। প্রত্যয় খেতে শুরু করলো। বড় ভাবি রুটি চিবাতে চিবাতে বলল: আজ আসার সময় বাজার করে এনো তো। প্রত্যয় হাসি মুখে বলল: আজ তো পারব না ভাবি; আজ একটু কাজ আছে।

ভাবি বিরক্ত কণ্ঠে বলল: ঘরের একটা কাজের কথা বললেই তোমার অন্য কাজ পড়ে যায় না? : সরি ভাবি; আজকে সত্যিই আমার একটু কাজ আছে। ভাবি আর কোন কথা না বলে কেবল মুখ বাকালো। খাবার টেবিলে আর কারও সাথে তার কোন কথা হলো না। সাধারণতঃ হয়ও না। প্রত্যয় তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে বড় ভাইয়ের অনুকরনে হাত ঘড়িটা দেখে নিরবে উঠে চলে যাচ্ছিলো।

হঠাৎ দরজায় দাড়িয়ে এক মুহূর্ত কি যেন ভাবলো। তারপর ফিরে এসে মাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। মা কোন দোয়া আশির্বাদ না করে কেবল গম্ভীর স্বরে বললেন: খাবার সময় সালাম করতে নেই। আজকাল এরকম পরিস্থিতিতে প্রত্যয়কে দোয়া করতে ভুলে যান তিনি। গত তিন বছরে বহু বার দোয়া করেও যখন ফল হয়নি তখন, তিনি ধরেই নিয়েছেন যে তার এই দোয়া কোনদিন বিধাতার অত উচু কানে পৌছবে না।

তাই ঐ ফর্মালিটিটুকু আর ইদানিং দেখানো হয় না। বেকার ছেলেকে এতো ফর্মালিটি দেখিয়ে লাভ কী? মাকে সালাম করে প্রত্যয় একটু দাঁড়ালো। খাবার ঘরেই বাবার একটা বাধানো ছবি টাঙ্গানো আছে। প্রত্যয় সেদিকে কয়েক সেকেন্ড শ্রদ্ধার সাথে তাকিয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। আজ বাবা বেঁচে থাকলে কত খুশিই না হতেন! বাইরের রৌদ্রোজ্জ্বল সকালের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল তার।

কেন যেন আজকের সকালটাকে পৃথিবীর সুন্দরতম সকাল মনে হচ্ছে। চারদিকে এতো বর্ণচ্ছটা, এতো লোকের ভিড় আগে যেন ছিলো না। সে নিজেও ব্যস্ততম মানুষের ভিড়ে মিশে গেল। বাস স্ট্যান্ডে এসে খানিকটা ইতস্তত করে শেষ পর্যন্ত লোকাল বাসে না উঠে একটা এসি বাসের টিকেট কাটলো। বাসে জানালার পাশের একটা সিটে বসল।

বাসে উঠলেই সে সব সময় জানালার পাশে বসার চেষ্টা করে। গাড়ি চলার সময় জানালা দিয়ে জোরে বাতাস এসে চুল এলোমেলো করে দিয়ে যায়। খুব ভাল লাগে তার। তাছাড়া জানালার পাশে বসলে অনেক কিছু দেখা যায়। অনেকটা সকালে চায়ের টেবিলে বসে নাস্তা খেতে খেতে পেপারের হেড লাইনে চোখ বুলানোর মত! গত কয়েক বছরে রাজধানির কত উন্নতিই না হয়েছে! আগে কখনো এভাবে খেয়াল করেনি।

অথচ তার নিজের জীবন এ ক’দিন কী নিরামিষই না ছিলো! গুরুত্বহীন, বোঝার মত একটা জীবন। যেখানে ছিলো সবার অবহেলা, অবজ্ঞা, আর অপরাধী সুলভ মনোভাব। অথচ আর বার ঘণ্টার মধ্যেই সব বদলে যাবে! ভাবতেই প্রচন্ড হাসি পেল তার। ইচ্ছে করছে প্রাণ খুলে খানিকক্ষণ হাসতে। কিন্তু অযথা শব্দ করে হাসলে বাসের লোকেরা তাকে পাগল ভেবে এই বাস থেকে নামিয়ে পাবনাগামী কোন বাসে তুলে দিতে পারে।

একথা ভেবে প্রাণ খুলে হাসা হলো না। তবে বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিলো সে। অফিস আওয়ার হওয়ায় গাড়িটা একটু পরপরই জ্যামে পড়ছে। আগে জ্যামে পড়লে ভীষণ বিরক্তি লাগতো। আজকে এটাও ভাল লাগছে তার।

চারদিকে গাড়ি আর গাড়ি; মাঝখানে একটা এসি বাসের জানালায় বসে আছে সে। সে আর তার পকেটের সবুজ খামে ভরা অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার। কি অপূর্ব দৃশ্য! প্রত্যয় আকাশের দিকে তাকায়। মেঘহীন ঝকঝকে নীল আকাশটাকেও আজ অপার্থিব সুন্দর লাগছে। কোথায় যেন শুনেছিলো- “যদি কখনো তুমি কোন কারণে হীনমন্যতায় ভুগো, কিংবা খুব মন খারাপ লাগে- তাহলে খোলা আকাশের দিকে তাকিও।

দেখবে মহূর্তের মধ্যে তোমার সকল হীনমন্যতা দূর হয়ে যাবে; মন ভাল হয়ে যাবে। তখন মনে হবে- পৃথিবীতে তুমিই সবচেয়ে সুখি, সবচেয়ে উদার মনের মানুষ!” আজ অবশ্য প্রত্যয়ের মন খারাপ না। বরং অতিরিক্ত আনন্দিত। এতোটাই আনন্দিত যে, অনন্দটা শেয়ার করার কাউকে পাচ্ছে না। প্রত্যয় আনন্দটা শেয়ার করছে দিগন্তহীন আকাশের সাথে।

আর জ্যামে আটকে পড়া গাড়িগুলোর সাথে! *** *** *** প্রত্যয় ফুটপাত ধরে হাঁটছিলো। প্রচন্ড গরম লাগছে তার। ঘামে শার্টটা ভিজে গেছে। শরীরের ছায়া মাটিতে পড়ছে না। তার মানে বেলা বারটার কাছাকাছি।

কিন্তু এসব কিছুই খেয়াল করছে না সে। চারপাশে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। সবকিছু কেমন যেন ধুসর লাগছে। সকালের সেই রৌদ্রোজ্জ্বল আলোর বর্ণচ্ছটাও ছাই বর্ণের লাগছে। কান দুটোও যেন ঝাঁ ঝাঁ করছে।

অফিসের ম্যানেজারের কথাগুলোই কানে বাজছে কেবল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না- তার জায়গায় অন্য একজনকে নেয়া হয়েছে। তার সবুজ খামে ভরা অ্যাপয়েনমেন্ট লেটারটা এক মুহূর্তের মধ্যেই অকেজো হয়ে গেছে মাত্র একটা ফোনের প্রভাবে! তারপর থেকেই কান দু'টো ঝাঁ ঝাঁ করছে। কিছুই কানে ঢুকছে না, কিছুই দেখতে পাচ্ছে না ভাল করে। সব কিছুই কেবল অস্পষ্ট আর ঘোলাটে লাগছে।

সেজন্যেই হয়তো খেয়াল করেনি কখন ফুটপাত থেকে হাইওয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করেছে সে। পেছন থেকে ট্রাকের বিকট হর্ণও কানে যায়নি তার। মাত্র এক মুহূর্ত পরেই তার রক্তাক্ত দেহটা পড়ে থাকতে দেখা গেল চকচকে মসৃণ হাইওয়েতে। কয়েক সেকেন্ডেই চারদিক থেকে অনেক লোকের ভিড় জমে গেল; অনেক কোলাহল হলো। কিন্তু সেসব কিছুই কানে শুনলো না, দেখতে পেল না প্রত্যয়।

একগাদা রক্ত-মাংসের বোঝার মত পড়ে রইল কেবল। যে কিনা কিছুক্ষণ আগেও বোঝাই ছিলো। তফাৎ এটুকুই- আগে ছিলো সমাজের বোঝা; আর এখন ওজনে বোঝা! ----------০---------- [উৎসর্গঃ যারা বেকার এবং যারা বেকার নন; সবার জন্য শুভ কামনা] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।