আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মালোপাড়ার বলরাম হাড়ি এবং তাঁর জীবনদর্শন

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ যেয়েও আছে থেকেও নাই/তেমনই তুমি আর আমি রে । বলরাম হাড়ি ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল উচ্চবর্ণের পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষনের বিরুদ্ধে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সনদ ঘোষনা করা হয়। সেই মেহেরপুরেরই এক নিম্নবর্গের শূদ্র পুরুষ তুমুল রুখে দাঁড়িয়েছিলেন উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শাসনশোষনের বিরুদ্ধে।

সময়টা উনিশ শতক। আজকের মেহেরপুর জেলাটি ছিল তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের নদীয়া জেলায়। মেহেরপুর জেলার বুক চিরে বইছে ভৈরব নদী। জেলা সদরটি ছোট। পশ্চিমদিকের মালোপাড়া।

সেখানে কয়েক ঘর অন্ত্যজ শ্রেণির বাস। তারা অধিকাংশই জাতে হাড়ি। হাড়িদের পেশা ছিল শুয়োর চরানো, কবিরাজী ওষুধ বিক্রি, লাঠিয়ালগিরি কিংবা দারোয়ানী। ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দ। মালোপাড়ায় গোবিন্দ হাড়ি এবং গৌরমণির ঘরে জন্মালেন এক শিশু; যে শিশুটি কালক্রমে বাংলার লোকধর্মের অন্যতম পুরোধা হয়ে উঠেছিল।

শিশুর নাম রাখা হয় বলরাম হাড়ি। জন্মসূত্রে অন্ত্যজ বলেই আজন্ম ব্রাহ্মণ্য শোষন দেখেছে। তাই তাঁর স্পর্শকাতর মনে জন্ম নিয়েছিল প্রচন্ড ব্রাহ্মণ বিদ্বেষ। বলরাম হাড়ির ব্রাহ্মণ-বিদ্বেষ সম্বন্ধে নানা কথা প্রচলিত রয়েছে। যেমন একদা আশ্বিন মাসে ভৈরব নদীতে ব্রাহ্মণরা পিতৃপুরুষের নাম তর্পন করছিলেন ।

হঠাৎ তারা দেখেন এক তরুণ বুকজলে দাঁড়িয়ে তর্পন করছে। দেখে অন্ত্যজ বলেই মনে হয়। একজন ব্রাহ্মণ নাক সিটকে বললেন, আরে, এ যে মালোপাড়ার বলরাম হাড়ি! কী স্পর্ধা! কি রে বলা, তোরাও কি আজকাল আমাদের মত পিতৃতর্পন করছিস নাকি? বলরাম হাড়ি বললেন, আজ্ঞে না ঠাকুরমশাই, আমি আমার শাকের ক্ষেতে জলসেচ করছি। বলিস কি? এখান থেকে জল তোর জমিতে যাচ্ছে কি করে? আকাশ দিয়ে নাকি? আপনাদের তর্পনের জল কি করে পিতৃপুরুষের কাছে যাচ্ছে? আকাশ দিয়ে? এই হল বলরাম হাড়ির মেধা, ব্যঙ্গ এবং ব্রাহ্মণবিদ্বেষের নিদর্শন! পেশায় বলরাম হাড়ি ছিলেন মেহেরপুরের ধনী পদ্মলোচন মল্লিকের দারোয়ান। একরাতে মল্লিকদের গৃহদেবতার সমস্ত অলংকার চুরি হয়ে গেল।

সন্দেহ করা হল বলরামকে । তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে প্রচন্ড প্রহার করা হল। তারপর তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। এই হল নিম্নবর্গের ওপর অত্যাচারের স্বরূপ। তদন্ত নেই, প্রমানাদি নেই, সন্দেহ হলেই বেধড়ক পিটুনি আর গলাধাক্কা ... আমরা গ্রাম থেকে উৎখাত হওয়া বিপন্ন বলরাম হাড়ির মনের করুণ অবস্থা কল্পনা করতে পারি ... মালোপাড়ার বলরাম হাড়ির মানবিক চেতনা ছিল উচ্চাঙ্গের।

যার ফলে অপমানিত বলরাম হাড়ি পথে পথে ঘুরেও চোরডাকাত কিংবা নৈরাশ্যবাদী হননি, হয়েছেন সাধক ... বেশ কয়েক বছর পর বলরাম হাড়ি মালোপাড়ায় ফিরে এলেন। আগের সেই মানুষটি অনেক বদলে গেছেন। পরনে সিদ্ধাই সাধুর বেশ। ভৈরব নদীর ধারে নির্মান করলেন সাধনকুটির। বলরাম হাড়ির সাধন সঙ্গিনী হলেন ব্রহ্ম মালোনী নামে এক নারী।

ইতিমধ্যে অলংকার চোর ধরা পড়েছিল বলে অনুতপ্ত মল্লিক পরিবার বলরামকে অর্থ আর জমি দিলেন। মালোপাড়ায় নির্মান করলেন হাড়িরামের মন্দির। কে এই হাড়িরাম? সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি। তার আগে বলি যে, দলে দলে কৈবর্ত, বেদে, বাগদি এবং নমঃশূদ্ররা এসে বলরাম হাড়ির কাছে আশ্রয় নিলেন। এরা সবাই ব্রাহ্মণদের দ্বারা শোষিত ।

বলরাম হাড়ি এখন তাদের মুর্শিদ। তৈরি হল এক নতুন ধর্মমত আর বিশ্বাস। যে বিশ্বাসকে বলা হল: 'বলা হাড়ির মত'। হাজার বিশেক ভক্তশিষ্য জমে গেল বলরাম হাড়ির। এদের বলা হল: বলরামী।

বলরামী সম্প্রদায়ের কোনও বিশেষ ধর্মীয় চিহ্ন বা বেশবাস ছিল না। এদের অনেকেই ছিলেন ভিক্ষাজীবী। ঠাকুর দেবতার নাম তারা কখনও উচ্চারণ করত না। বাংলার অন্যান্য লোকধর্মের অনুসারীরা অবতারতত্ত্ব মানলেও বলরামীরা মানতেন না। এঁদের সবচে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল ব্রাহ্মণবিদ্বেষ।

তার কারণ আছে। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে বাংলায় শূদ্রশ্রেণির নানা দিক থেকে অসহায় হয়ে পড়েছিল। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ছিল না। এ র ওপর মড়ার উপর খরার ঘায়ের মতো উচ্চবর্ণের দমনপীড়ন তো ছিলই । বলরাম হাড়ি অন্ত্যজ-শূদ্রদের বাঁচার জন্য একটা জায়গা তৈরি করেছিলেন।

সংকীর্ণ শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে বাঁচা নয়, উদার মানবতা নিয়ে সহজ করে বাঁচা। মূর্তিপূজা,অপদেবতা পূজা, অকারণ তীর্থভ্রমন,দেবদ্বিজে বিশ্বাস, শাস্ত্র নির্ভরতা ও আচার সর্বস্বতার বিরুদ্ধে এঁর অস্ত্র ছিল জাতিভেদহীন সমন্বয় এবং নতুন মানবতাবাদী সহজ ধর্মবিশ্বাস। (দ্র: সুধীর চক্রবর্তী; গভীর নির্জন পথে ) বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বলরাম হাড়ির জীবনদর্শনের গভীর সাদৃশ্য লক্ষ করি। বঙ্গ বন্ধু যেমন উচ্চবর্ণের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শোষিত বাঙালির কাছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন discourse উত্থাপন করেছিলেন। বলরাম হাড়িও অনুরূপ ভাবে উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বজগতের অন্ত্যজ বয়ান উত্থাপন করেছিলেন।

সেই বয়ানের স্বরূপই এই পোস্টের বিষয়। ভৈরব নদীর পাড়ে সাধনকুটিরের আঙিনায় বসে ভক্তশিষ্যদের কাছে বলরাম নিজেকে বলেছিলেন: ‘আমি হাড়িরাম’। অবশ্য হাড়ি বলতে কোনও 'জাতি' বুইঝ না। যিনি হাড়ের স্রষ্টা তিনিই হাড়ি। হাড় মানে কাঠামো, তাতে চামড়ার ছাউনি।

এই পর্যায়ে আমাদের বাউল মামুন নদীয়ার একটি গান মনে পড়ে যায়: ত্রিবেনীর শূন্যতে বেঁধেছে ঘররূপে/ রূপকাষ্ঠের ছাউনি দিয়া রে ... হাড়ের কাঠামোর ভিতরে রয়েছে ‘বল’ অর্থাৎ রক্ত। এই হল মানবদেহ। যে মানবদেহের মধ্যে রয়েছে হাড্ডি, মণি, মগজ, গোস্ত, পোস্ত। সব মিলিয়ে আঠারো মোকাম। বলরামীরা যে কারণে গান বেঁধেছে- হাড় হাড্ডি মণি মগজ গোস্ত পোস্ত গোড়তালি ।

এই আঠারো মোকাম ছেপে আছেন আবার বলরামচন্দ্র হাড়ি। যাই হোক। ভক্তেরা বলরাম হাড়িকে প্রশ্ন করেছিল-পৃথিবী কোথা থেকে এল? উত্তরে তিনি বলেছেন, ক্ষয় থেকে। কী ভাবে? আদিকালে কিছুই ছিল না। আমি আমার শরীরের ক্ষয় করে এই পৃথিবী সৃষ্টি করি।

সেইজন্য এর নাম ক্ষিতি। ক্ষয়, ক্ষিতি ও ক্ষেত্র একই পদার্থ। আমি কৃতদার গড়নদার হাড়ি। অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঘর প্রস্তুত করে সে যেমন ঘরামী সেইরূপ আমি হাড়ের সৃষ্টি করেছি বলে আমার নাম হাড়ি। বলরামীরা আজও বিশ্বাস করে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের জন্ম হাড়িরামের হাতে, অর্থাৎ মালোপাড়ার বলরাম হাড়ি ।

এই বিশ্বাসের ভিতর ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে বিতৃষ্ণা সহজে বোঝা যায়। সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি -এই চার যুগের আগে ছিল দিব্যযুগ। সেই সময়ে হাড়িরামের জন্ম। তার মানে সব অবতারের আগে তিনি। বলরামীরা যে কারণে গান বেঁধেছে- দিব্যযুগ যে হাড়িরাম/ মেহেরপুরে তার নিত্যধাম।

বলা হাড়ি ত্রেতাযুগের রামচন্দ্র বা দ্বাপর যুগের বলরামের অবতার বলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন নি। নিজেকে বসিয়েছেন এ সবের ঊর্ধ্বে। নিজের নাম দিয়েছেন “রামদীন”। রামদীনের পরিচয় দিয়ে বলরামীরা গান বেঁধেছে- ‘রা’ শব্দে পৃথিবী বোঝায়। ‘ম’ শব্দে জীবের আশ্রয়।

‘দীন’ শব্দে দীপ্তাকার হয় নামটি স্মরণ করলে তার। বলাহাড়িরা রামদীনকে ডাকে। কেননা, তিনিই কারিকর। বলরামীরা মানুষভজনে বিশ্বাসী। কেননা, মানুষ কারিকর-এর সৃষ্টি, অর্থাৎ হাড়িরামের সৃষ্টি; ঈশ্বরের নয় ।

সংসারে থেকে এ ধর্মের সাধনা করতে হয়। বলরামীরা বিশ্বাস করেন, হাড়িরাম যেমন আঠারো তত্ত্ব দিয়ে মানবদেহ গঠন করেছেন, তেমনই সেই দেহ চালাচ্ছেনও তিনি। বাংলার অন্য উপধর্মের সঙ্গে বলরামীদের তেমন মিল নেই। গুরুবাদের এঁরা বিশ্বাস করেন না। এঁরা ব্রাত্য।

এঁরা মন্ত্রহীন। এঁদের সহজিয়া বৈষ্ণবদের মতো স্তরভিত্তিক সাধনমার্গ এদের নেই। এঁরা নারীসঙ্গী নিয়ে কায়াসাধন করে না। এ ধর্মে বিকৃতি কম। গুরুবাদ নেই বলে ভক্তের ওপর শোষন নেই।

বলরামীদের আচরণবিধি খুব সহজ সরল। বলরামী সম্প্রদায়ে উচ্চবর্ণের কেউ নেই, থাকারও কথাও নয়। নিম্নবর্ণের হিন্দু অন্ত্যজ ব্রাত্য আর দলছুট মুসলমান মিলে সৃষ্ট বলরামীসমাজ । মুসলমান থেকে যাঁরা বলরামী হয়েছেন তাঁরা হাড়িরামকে বলেন- ‘হাড়িআল্লা’। বলরামীদের গদি নেই, খাজনা নেই, আখড়া নেই, আসন নেই।

বাংলাদেশের মেহেরপুর ছাড়াও বলরামীদের আরেক কেন্দ্র পশ্চিম বাংলায় নদীয়া জেলার তেহট্ট থানার নিশ্চিন্তপুর। সেখানে সিদ্ধপীঠ বেলতলায় হাড়িরামের খড়মজোড়া আছে। তাতে আজও নিত্য তেলজল দেয় ভক্তশিষ্যরা। উনিশ শতকে উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন এক জাতবিরোধী ধর্মের স্মৃতিস্বরূপ মেহেরপুরের সদর উপজেলার পশ্চিমে মালোপাড়াটি আজও আছে; আছে মল্লিকবাড়ি, হাড়িরামের মন্দির। , যেমন আজও উচ্চকোটির পাকিস্তানকে বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করে অটল দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ... তথ্যসূত্র: সুধীর চক্রবর্তী; গভীর নির্জন পথে বাংলাপিডিয়া Click This Link ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।