আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জালিয়াত সম্রাট!

দু:খিত, আপনি যে ব্লগটি ভিজিট করছেন, তার ব্লগার বর্তমানে ব্যস্ত আছে। অনুগ্রহ করে কিছু দিন পর আবার ভিজিট করুন। ধন্যবাদ বসন্তের সন্ধ্যা। প্যারিসে বসে সেদিনের কাগজটায় চোখ বোলাচ্ছেন ভিক্টর। অলসভাবে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে এককোণে ছোট্ট একটি খবরে আটকে গেল তাঁর চোখ_৩৫ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ায় খুব দ্রুত আইফেল টাওয়ারের সংস্কার প্রয়োজন।

অথচ দৈত্যাকারের এই স্থাপনা নিয়ে শ্বেতহস্তী পোষার মতো ঝামেলায় পড়েছে সরকার। পুরো টাওয়ারটি রং করাতেই যেখানে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টানাটানি পড়ে যায়, সেখানে সংস্কার করা তো রীতিমতো দুঃস্বপ্ন! পত্রিকাটি মন্তব্য করেছিল, সরকার হয়তো টাওয়ারটি ভেঙে ফেলতে পারলেই ঢের খুশি হতো। সংবাদটি পড়ে চোখ চকচক করে উঠল ভিক্টরের। এমন একটা দাঁও মারার আশায়ই তো প্যারিসে এসেছেন তিনি! ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন ব্যালকনিতে। ওই তো, আলো ঝলমলে টাওয়ারটা দম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরে।

ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট গুঁজে পোড়খাওয়া মগজে দ্রুত কিছু হিসাব-নিকাশ করে ফেললেন। জীবনের সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললেন তখনই। পরদিন সকালে সাগরেদ ড্যান কলিন্সের সহায়তায় ফরাসি মন্ত্রণালয়ের কিছু জাল কাগজ তৈরি করে ফেললেন ভিক্টর। নতুন পরিচয়_পোস্ট ও টেলিগ্রাফ বিভাগের উপপরিচালক। পুরনো ধাতব মালের ব্যবসা করেন, শহরের এমন ছয়জন শীর্ষ ব্যবসায়ীকে দাপ্তরিক সিল সেঁটে চিঠি পাঠালেন ভিক্টর_একটি বড়সড় সরকারি চুক্তি করার জন্য হোটেল ডি ক্রিলিয়নে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাঁদের।

এমন আমন্ত্রণ রক্ষা না করার কোনো কারণ নেই। তাই পরদিন দেখা গেল, হোটেলের জেল্লাদার কক্ষে রুদ্ধদ্বার সভায় বসেছেন তাঁরা। প্রথমেই কথার জাদুতে ব্যবসায়ীদের বশ করে ফেললেন ভিক্টর। জানানো হলো, সুনাম ও সততার জন্যই অন্যদের বাদ দিয়ে তাঁদের বাছাই করেছে সরকার। তার পরই মওকা বুঝে আসল বোমাটা ফাটালেন ভিক্টর।

বললেন, আইফেল টাওয়ার বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফরাসি সরকার! উপযুক্ত দাম দিলে অতি দ্রুত ব্যবসায়ীদের হাতে তা হস্তান্তর করা হবে। সাত হাজার টন লোহার এই 'জঞ্জাল' কেনার সুযোগ হারাতে চাইবে কেবল বোকারা! দারুণ লাভের আশায় আগ-পিছ ভেবে দেখলেন না কেউই। ভাড়া করা লিমুজিনে করে টাওয়ারটা ওদের ঘুরিয়ে আনা হলো। সব কিছু এত পরিকল্পনামাফিক হলো যে বিন্দুমাত্র সন্দেহও কারো মনে উঁকি দিল না। তবে শহরবাসীর গর্ব আইফেল টাওয়ার ভেঙে ফেললে জনগণ ফুঁসে উঠতে পারে_এই বলে ব্যবসায়ীদের মুখও বন্ধ করে রাখতে বলা হলো।

চার দিনের মাথায় পড়িমরি করে দরপত্র জমা দিলেন ছয়জন। সেগুলো খুলে পর্যন্ত দেখলেন না লুসটিগ। সবচেয়ে বেশি দাম কে দিচ্ছে, সে ব্যাপারেও কোনো আগ্রহ নেই তাঁর! সবার আচরণ পরখ করে সেদিনের সভায়ই বলির পাঁঠা নির্ধারণ করে রেখেছেন তিনি_আন্দ্রে পয়সন। টাওয়ার ঘুরিয়ে দেখানোর সময় তাঁকে অতি উৎসাহী মনে হচ্ছিল। অন্যদের চেয়ে তাঁর ব্যবসাটাও একটু ছোট।

রাতারাতি বড় ব্যবসায়ীদের কাতারে চলে আসার ইচ্ছাও তাঁকে লোভী করে তুলেছিল। সেই লোভের ফাঁদে পা দিয়েই নিজের সর্বনাশ করে বসলেন তিনি। পয়সনের স্ত্রী কিন্তু খানিকটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। সব কাজকর্মে কেমন যেন রাখঢাক। তা ছাড়া এত তাড়াতাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার পাঁয়তারা মোটেও ভালো ঠেকছিল না তাঁর কাছে।

এ সব কিছুই হাওয়ায় উড়িয়ে দিল লুসটিগের পরবর্তী সভা। ইনিয়েবিনিয়ে তিনি সরকারি চাকুরের দুঃখের কথা বলতে লাগলেন_দেশের জন্য এত করেও নিজের জীবনটা উপভোগ করতে পারছেন না। আন্দ্রে পয়সন বুঝে গেলেন, আসলে কী বলতে চাইছেন ভিক্টর। সরকারি সম্পত্তি বেচার আড়ালে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করছেন তিনি। কাজ হাসিলের জন্য ভিক্টরকে খুশি করতে কোনোই সমস্যা ছিল না পয়সনের! আইফেল টাওয়ার বিক্রির টাকার সঙ্গে ঘুষের অর্থ নিয়ে প্যারিস থেকে পাততাড়ি গোটালেন ভিক্টর-কলিন্স।

টাকাভর্তি বিশাল এক স্যুটকেস নিয়ে উঠে পড়লেন ভিয়েনাগামী ট্রেনে। পয়সন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁরা পগার পার। অস্ট্রিয়ায় বসে প্রতিদিন নজর রাখতেন প্যারিসের সংবাদপত্রে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পুলিশের কাছে যাননি হতভাগা পয়সন। হয়তো ঘুষ দেওয়ায় নিজেই অপরাধবোধে ভুগছিলেন কিংবা নিজের বোকামির জন্য ছিলেন ভারি লজ্জিত।

পয়সনের এই চেপে যাওয়ায় ভিক্টর দ্বিতীয়বারের মতো কৌশল খাটানোর সুযোগ পেয়ে গেলেন। এক মাস পর ভিক্টরকে আবার দেখা গেল প্যারিসের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে। ইতিমধ্যেই আরো ছয় ব্যবসায়ীর সামনে মুলো ঝুলিয়েছেন। দ্বিতীয়বার টাওয়ারটা প্রায় বিক্রি হয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু এবার ভুল মানুষকে টোপ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ভিক্টর।

বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে ফাঁস করে দেন গোটা ব্যাপারটি। সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশিত হলো তাঁর কীর্তি। কিন্তু ভিক্টরকে ধরা অত সোজা নয়! কলিন্সকে সঙ্গে করে তিনি গা ঢাকা দিলেন কিছুদিনের জন্য। গল্পের মতো বলে যাওয়া এই ঘটনাটি কোনো রুদ্ধশ্বাস সিনেমার কাহিনী নয়। ১৯২৫ সালে ফ্রান্সে ঘটেছিল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তোলা এই জোচ্চুরির ঘটনা, যার নায়ক ভিক্টর লুসটিগের জীবন গল্প-কাহিনীর মতোই বর্ণাঢ্য।

কে এই লুসটিগ ১৮৯০ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় জন্ম ভিক্টর লুসটিগের। জীবন শুরু করেছিলেন পানিতে ভেসে ভেসে। আটলান্টিকের বুকে ভেসে চলা বিলাসবহুল জাহাজে পোকার-বিলিয়ার্ড ঘরের কর্মী হিসেবে কাজ করতেন। তখনই নিকি আর্নস্টেইনের মতো পেশাদার জুয়াড়ির সঙ্গে পরিচয়। ওভাবেই জীবন কেটে যেতে পারত।

বাদ সাধল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জাহাজের চাকরি হারিয়ে কিছুদিন এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে তখন জোর হাওয়া বইছে। ভাগ্য পরীক্ষার জন্য ওদিকে যাওয়ার চিন্তাই প্রথমে মাথায় এল। শুরু হলো ভিক্টরের বর্ণাঢ্য জালিয়াতজীবন।

টাকার মেশিন ভিক্টর লুসটিগের খুব প্রিয় একটি কৌশল ছিল রুমানিয়ান বঙ্ ট্রিক। জাল টাকা প্রস্তুতকারকদের কাছে তিনি বিক্রি করতেন টাকার মেশিন। নিউ ইয়র্ক শহরে পরিচিত একটি দোকান ছিল। ফরমায়েশ দিলে তারা খুব সুন্দর কাঠের বাঙ্ তৈরি করে দিতে পারত। বাঙ্রে গায়ে একটা গোপন কুঠুরি থাকত, যার একপাশে বসানো হতো পিতলের নব ও ডায়াল।

কয়েকটা বাঙ্ পকেটে পুরে ঘুরে বেড়াতেন ক্রেতার খোঁজে। জুতসই কাউকে পেলে তার সামনেই পরখ করে দেখাতেন যন্ত্রের গুণাগুণ। একটা ১০০ ডলারের কাগুজে মুদ্রা যন্ত্রে বসিয়ে নব ঘুরিয়ে ভালোমতো আটকে দিতেন। ডায়ালে ঘোরানো হতো মনগড়া পাসওয়ার্ড। তারপর বলতেন, বাঙ্রে গোপন রাসায়নিকে ডুবিয়ে প্রতিলিপি তৈরি করতে খানিকটা সময় লাগবে।

ঠিক ছয় ঘণ্টা পর যন্ত্র থেকে বের হওয়া টাকা দেখে জাল সন্দেহ করার কোনো উপায় ছিল না। মুগ্ধ বিস্ময়ে ছোট বাঙ্টার কারিকুরি দেখতেন ক্রেতারা। হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতেন তৈরি হওয়া টাকা। বিশ্বাস আরো পোক্ত করতে লুসটিগ তাঁকে নিয়ে যেতেন পাশের কোনো ব্যাংকে। ব্যাংকও দেখে আসল বলেই রায় দিত।

হতবাক ক্রেতা একেকটা যন্ত্র কিনে নিতেন ৩০ হাজার ডলার দিয়ে। টাকা পকেটে ভরে হাওয়া হয়ে যেতেন লুসটিগ। পরের ১২ ঘণ্টায় মাত্র দুটি মুদ্রা তৈরি করেই যন্ত্র বিকল হয়ে যেত। আসলে তিনটি আসল ১০০ ডলারের মুদ্রাই রাখা হতো যন্ত্রে। যতক্ষণে বোকা ক্রেতারা আসল ব্যাপারটি বুঝত, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

এই টাকার মেশিন দিয়ে এক পুলিশকেও আহাম্মক বানিয়েছিলেন ভিক্টর। ছোট এক অপরাধে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওকলাহোমার শেরিফকে বাঙ্টি দেখিয়ে অবাক করে দেন তিনি। মুক্তির বিনিময়ে তিনি সেটি ওই শেরিফকে উপহার দিয়েছিলেন। ভিক্টরের ভাঁওতাবাজি বুঝতে পেরে মনে মনে ফুঁসছিলেন শেরিফ। আট মাস পর দুর্ভাগ্যক্রমে শিকাগোতে তাঁর সামনেই পড়ে গেলেন ভিক্টর।

রাগে অন্ধ শেরিফ পিস্তল ঠেকালেন ভিক্টরের মাথায়। জীবন বাঁচাতে আবারও জালিয়াতির আশ্রয় নিলেন ভিক্টর। নির্দোষ চেহারা করে বললেন, নিশ্চয়ই ভুলভাল নব ঘুরিয়েছেন শেরিফ। তা না হলে যন্ত্র বিগড়ানোর কোনো কারণই নেই। দুঃখ প্রকাশ করে পকেটে থাকা ১০ হাজার ডলারও শেরিফের হাতে তুলে দিলেন।

হতভম্ব শেরিফকে শিকাগোতে রেখে চম্পট দিলেন ভিক্টর। আইফেলকাণ্ডের পর কুখ্যাতি জগৎজুড়ে ছড়িয়ে পড়লেও নামে-বেনামে চালবাজি করতেই থাকলেন ভিক্টর। যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ স্মাগলার আল কাপোন পর্যন্ত তাঁর কৌশলে বোকা বনে গিয়েছিলেন। অজস্রবার তাঁকে নিয়ে লেখালেখি হয়েছে পত্রিকায়। কিন্তু বারবারই ভিক্টর লুসটিগ রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তাঁর গল্পের মতো জীবন নিয়ে ১৯৬১ সালে বই লিখেছেন ফ্লয়েড মিলার ও জেমস জনসন_'দ্য ম্যান হু সোলড আইফেল টাওয়ার'। রেডিও প্রাহা তাঁর ব্যাপারে বলেছিল, 'ভাগ্যিস লোকটা সুযোগ পায়নি। পেলে একদিন পৃথিবীটাও বিক্রি করে দিত। ' প্রতারক হলেও ভিক্টরের তীক্ষ্ন বুদ্ধির কথা একবাক্যে মেনে নেন সবাই। কথার জালে মানুষকে বন্দি করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর।

পাঁচটি ভাষায় কথা বলতে পারতেন অনর্গল। পুঁজি ছিল তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণশক্তি। ১৯৩৫ সালের ১০ মে অজ্ঞাত এক ফোনকলের সূত্র ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন লুসটিগ। বিচারের আগের দিন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ২৭ দিন পর ফের ধরা পড়েন পেনসিলভানিয়ার পিটসবার্গে। বিচারে ২০ বছরের নির্বাসন দেওয়া হয় আলকাত্রাজ দ্বীপে।

১৯৪৭ সালে সেখানেই মারা যান নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে। ডেথ সার্টিফিকেটে তাঁর নাম লেখা_রবার্ট মিলার। পেশা? শিক্ষানবিশ সেলসম্যান! সূত্র: কালেরকন্ঠ  ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.