আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান

মনের মহাজন খুঁজে ফিরি.... এম. মিজানুর রহমান সোহেল নারীর মুক্তিযুদ্ধ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নারীসমাজকে আমাদের দেখতে হবে, জানতে হবে আন্তরিকভাবে। প্রথমত বুঝতে হবে যে ব্যাপক নারী নিগৃহীত হয়েছে যুদ্ধের সময় দেশের সর্বত্র, শুধু নারী হিসেবেই। এও নারীদের এক ধরনের যুদ্ধ, তার শরীরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ—সেটা বুঝতে সময় লেগেছে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার। মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধার মতোই নারী আত্মোৎসর্গ করেছে, সেটা বুঝতেও সময় লেগেছে সবার। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর, খুলনা, ঈশ্বরদী, পাবনা, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ময়মনসিংহসহ সব জেলায় নারীসমাজের প্রতিবাদী সভা ও মিছিল হয়েছিল।

আওয়ামী লীগের মহিলা শাখা, ন্যাপ, পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নারী সদস্যরা আন্দোলনে নারীসমাজকে নেতৃত্ব দেন। ঘরে ঘরে মায়েরা, মেয়েরা, বোনেরা, স্ত্রীরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। নারী দেখলো- মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর স্বাধীন রাষ্ট্রে সে এক অপবিত্র সত্তা, যদিও বঙ্গবন্ধু সরকার তাঁদের বীরাঙ্গনা উপাধিতে ভূষিত করেছিলো। কিন্তু সমাজ সংস্কারের গন্ডিটা পেরোনো যায়নি। এই প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালে নিউইয়র্ক পোস্টে প্রকাশিত হওয়া লস এঞ্জেলস টাইমসের সমন্বিত সংবাদ সংস্থার একটি প্রতিবেদনে পাওয়া যায়-“সনাতনী গ্রামীণ বাঙালি সমাজে, যেখানে নারীরা আবৃত জীবনযাপন করে, ধর্ষণের শিকার নারীরা প্রায়শই হয়ে যায় সমাজচ্যুত”।

অতএব পরিস্থিতি অনুমেয়। কিন্তু সমস্যা হলো, যখন নারীর অবদানকে অস্বীকার করা হচ্ছে; যখন ভাবা হচ্ছে- এইটা কালো দিক, একে লুকিয়ে ফেলো। তখন নারীর আর সব অবদানকে খাটো করে দেখার প্রয়াশ পাওয়া যাচ্ছে, আর পুরুষতান্ত্রিক দেশে এটা খেজুরের গুড়ের মতো। কিন্তু এটা কেউ মানতে নারাজ যে- ধর্ষণের কারণে নারীর লজ্জিত হবার কিছুই নেই, কারণ তিনি অপরাধী নন, অপরাধী হলো সে-ই পশু, যে ধর্ষক। অতএব একাত্তরের নারীদের নির্যাতনের কাহিনিকে যারা বলেন লজ্জার, যারা বলেন, ‘ত্রিশ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা’ বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করা হয়; তারা আসলে বুঝতেই চান না যে- জোরপূর্বক সম্ভ্রমহানিটা লজ্জার, কারণ সেটি অপরাধ; তাই এ লজ্জা পাকিস্তানি বাহিনীর; মোটেই বাঙালি নারীর নয়।

মুক্তিযুদ্ধের নারী: এমন গর্ব দ্বিতীয়টি নেই মুক্তিযুদ্ধ পর্যায় থেকে আলোচনা শুরু করলেও, নারীর গর্বিত অবদান আছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেও। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটেই এ আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখবো। উনসত্তরের গণ-আন্দোলনে ও অভ্যুত্থানে এদেশের নারী সমাজ সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। ১৯৬৯ সালের ১৯ জানুয়ারি গণ-আন্দোলনের মিছিলে লাঠিচার্জ করে পুলিশ। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান।

শিবপুর গ্রামের বাড়ি থেকে আসাদের মা ছাত্রনেতাদের কাছে বাণী পাঠালেন-“আমার আসাদের মৃত্যু হয়নি। আমার আসাদ বলতো ‘মা আগামী দশ বছরের মধ্যে এই মাতৃভূমি নূতন জীবন পাবে। আমার আসাদের এই স্বপ্ন তোমারা সার্থক করো” এবার আপনারা বলেন, আসাদের মা কি মুক্তিযোদ্ধা নন? ১৯৬৯ সালেই চট্টগ্রামে কালো দিবস পালন করেন নারী শিক্ষার্থীরা। বিশাল মিছিল করেন তাঁরা। জেএম সেন হলের নারী শিক্ষার্থীরা সভা করেন খালেদা খানমের নেতৃত্বে।

বক্তব্য রাখেন তাসমিন আরা, রাশেদা খানম, হান্নানা বেগম, মমতাজ বেগম, নাজমা আরা বেগম, রওশন আরা বেগম, শিরিন কামাল প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে নারী বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে সেদিনের রেসকোর্স ছিলো উত্তাল, নিবিড় স্বপ্নের সাতকাহনে পূর্ণ। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘সেই সব দিন’ বইয়ে লিখেছেন-“.. ..এই সভায় অসংখ্য মহিলা এসেছেন বাঁশের লাঠি নিয়ে। বহুলোক এসেছেন তীর ধনুক নিয়ে যেনো যুদ্ধ আসন্ন। দেখা গেলো মেয়েদের ভিড়ে একজন অশিক্ষিত মেয়ে মনোয়ারা বিবি নিজের রচিত গান গাইছে: মরি হায় হায়, দুঃখের সীমা নাই, সোনার বাংলা শ্মশান হইলো, পরান ফাইডা যায়।

দেশাত্মবোধক ভাটিয়ালী গানও শোনায় মনোয়ারা বিবি। ” বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণেও তিনি নারীর কথা উল্লেখ করেছেন। সেই আহবানে ছিলো আবেগ ও অঙ্গীকার। তিনি বলেন-“আমি আগেই বলে দিয়েছি কোনো গোল টেবিল বৈঠক হবে না,.. ..যারা আমার মা বোনের কোল শূন্য করেছে, তাদের সাথে বসবো আমি গোল টেবিল বৈঠকে? যদি একটি গুলি চলে, তাহলে বাঙলার ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো.. ..” ঐতিহাসিক সে ভাষণে বঙ্গবন্ধু নারীসমাজের সংগ্রামী অংশ গ্রহণের স্বীকৃতি দিয়ে প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের ভূমিকাকে দৃশ্যমান করে তোলেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগরিক সমাজের অর্ধাঙশ নারী গণ-আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের সময় সার্বিক ভূমিকা পালনে সক্রিয় ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু তাদেরকে প্রথম এই আহবান জানান।

মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশ গ্রহণ বিষয়ক লেখা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশ গ্রহণ নিয়ে হাতে গোনা কয়েকটি গ্রন্থে কয়েকটি সূত্র পাওয়া যায়। মালেকা বেগমের লেখা ‘একাত্তরের নারী’গ্রন্থে উল্লেখ আছে-“সিরাজগঞ্জের মনিকা মতিন, টাঙ্গাইলের শুকরী বেগম, জামেলা বেগম, মাজেদা বেগম সরল ভাষায় বলেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় জনসংখ্যার অর্ধেক ছিলো নারী। অর্থাৎ তিন কোটি চুয়াত্তর লক্ষ নারী ছিলো মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীরা খবর আদান-প্রদান করতো। রাডার যেমন ভিতরে ও বাইরের শত্রুদের খবর দেয়, আমাদের নারীরা সে-ই ভূমিকায় কাজ করেছেন.. ..” ।

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে নারীদের ভাবনা, সাহস, কর্মকান্ড বিষয়ে অনেক তথ্য ছড়িয়ে আছে নানা জনের লেখায়। সেসব থেকে উদ্বৃত করলে বোঝা যাবে মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদানের কথা। সত্যেন সেন ছোট্ট মেয়ে মিলি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। ছাত্র ইউনিয়নের সভা, মিছিল, শ্লোগানে যোগ দিতো। ছাত্রী দলে প্যারেড করে আসছিলো।

বাসার বাধা পেলেও বাধা মানেনি। আমাকে সে বলতো এবারকার স্বাধীনতা সংগ্রামে শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও এগিয়ে যাবে। এ বাড়ির (ঢাকার নারিন্দার) আর কোনো মেয়ে এভাবে ভাবতেও পারে না। ভাবার মতো দুঃসাহস তাদের নেই। বারবার সে আমায় প্রশ্ন করতো- ‘দাদা, ওরা তো আক্রমণ করেছে, আমরা কি এখনো প্রতিরোধ করবো না? কেমন করে প্রতিরোধ করবো? আমাদের হাতে যে অস্ত্র নেই?’।

স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে পুলিশের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে পলাতক অবস্থায় যে পরিবারে ছিলাম সেখানে বৌমার রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়া বাঁচতেই পারতাম না। স্বাধীনতার পর নতুন অধ্যায়ে সে-ই বৌমাদের কথা ভুলেই বসেছিলাম। নেমকহারামী আর কাকে বলে?” (রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘রক্তাক্ত বাংলা’, ঢাকা, মুক্তধারা, ১৯৭১-১৯৮৯। পৃষ্ঠা: ৫২, ১৭৮, ২১৩)। সরদার ফজলুল করিম একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ তার অমোঘ উচ্চারিত দাবি, ‘ইতিহাস কথা কয়’, ‘ইতিহাসকে কথা বলতে দাও’।

কিন্তু সে দাবি পূরণে অনীহা ও অনিচ্ছা যেনো ক্রমান্বয়ে দূরতিক্রম্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি লোকই কোনো না কোনোভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে জড়িত ছিলেন। গ্রামে গ্রামে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বহু ঘটনার উদ্ভব হয়েছে। বহু বীরত্ব গাঁথা বিশ্বাসঘাতকতা, ত্যাগ, অত্যাচার, নিপীড়ণের কাহিনী স্তরে স্তরে গড়ে উঠেছে। এর পরিমাণ অনুধাবন করা কঠিন।

(সরদার ফজলুল করিম, রুমীর আম্মাও অন্যান্য প্রবন্ধ, ঢাকা, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ১৯৮৯, পৃষ্ঠা ১৬৫-১৬৮)। বাসন্তী গুহঠাকুরতা মুক্তিযুদ্ধে মেয়েদের অংশ গ্রহণ মানে মেয়েদের সাহস (বাসন্তী গুহঠাকুরতা, একাত্তরের স্মৃতি, ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ১৯৯১)। আনিসুজ্জামান রাজনৈতিক ছাত্র সঙগঠনের পাশাপশি মহিলা সমাবেশ মিছিলে যুক্ত হলো চট্টগ্রাম বান্ধবী সঙঘ, মহিলা পরিষদ, মহিলা আওয়ামী লীগ। জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ’৭১-এ বড়ো বড়ো সমাবেশ হলো (আনিসুজ্জামান, আমার একাত্তর, ঢাকা সাহিত্য প্রকাশ, ২০০১। পৃষ্ঠা: ২৭)।

এম আর আখতার মুকুল এটা অত্যন্ত দুঃথজনক যে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের নারী সমাজের অবদানের মূল্যায়ন আজ পর্যন্ত হয়নি। অথচ বাস্তবে তাদেন সহযোগিতা অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গৃহবধূরা যেভাবে নিজেদের আহার পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দান করেছিলেন সে সব ঘটনা অন্তত মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ থাকার কথা। .. ..(ফরিদা আখতার সম্পাদিত, মহিলা মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা, নারীগ্রন্থ, ১৯৯১। পৃষ্ঠা: ৪৪-৪৬)।

ঢাকায় নারী মুক্তিযোদ্ধা এপ্রিলের শেষের দিকে ঢাকায় প্রতিরোধের ভিত্তিগুলো গড়ে উঠতে থাকে। অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন, অধ্যাপক জয়নুল আবেদীন, অধ্যাপক বোরহানউদ্দিনখান জাহাঙ্গীর, মুনতাসীর মামুনসহ অনেকের চেষ্টায় একটি দল কৈরি হয়, যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা এবং শহিদ পরিবারকে সহায়তা করতেন। বেবী মওদুদ সাহায্য করতেন এইসব কাজে। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকার সেক্টর দুই এর মুক্তিযোদ্ধাদের কতোগুলো পরিবারের মেয়েরা ঢাকার ভিতরে নানা কাজে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। একটি পরিবারের তিন বোন আসমা, রেশমা ও সায়মার লেখা থেকে জানা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধারা যখন ঢাকায় আসতো তাদের স্টেনগান, এক্সপ্লোসিভ ও গ্রেনেডগুলো গোপনে সঙরক্ষণ করতো তারা তিন বোন।

অপারেশনে যাবার পূর্ব-মুহূর্তে সেই অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের হাতে তুলে দিতো তাঁরা। মুক্তিযোদ্ধা আলম, শাহাদাৎ চৌধুরী, ফতেহ আলী, জিয়া প্রমুখ ঠিক করলো মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি বিষয়ে ঢাকাবাসীদের জানাবেন তাঁরা। সে জন্য ১৪ আগস্ট ১৯৭১ সালে বাঙলাদেশের পতাকা উড়াবার কর্মসূচী নেয়া হয়। তিন বোন সে-ই অনুযায়ী জুলাই এর ২১ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত ২০০ পতাকা সেলাই করে। এইটা কি মুক্তিযুদ্ধ না! চট্টগ্রামে নারী মুক্তিযোদ্ধা চট্টগ্রামে ‘মহিলা মুক্তিযোদ্ধা স্বেচ্চাসেবক বাহিনী’ গড়ে তুলেছিলেন ডাক্তার নুরূন্নাহার জহুর।

দেশের ভেতরে এ রকম সঙগঠিত কাজের ক্ষেত্রে ছিলো নানা সমস্যা। এ বিষয়ে বিস্তারিত বলবো না- কারণ বেগম মুশতারী শফী বিষয়টি নিয়ে একটি চমৎকার সুখপাঠ্য বই লিখেছেন; নাম ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’। বইটি পড়ার অনুরোধ রইলো। সিলেটে নারী মুক্তিযোদ্ধা সিলেটের চা বাগানের চা-নারী শ্রমিকরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন সশস্ত্র হয়েই। চা শ্রমিকদের মধ্যে প্রথম কলেজ পড়ুয়া (১৯৬৭) দুজন ছাত্রী- তৃপ্তি বুনারজি ও সন্ধ্যারাণী বসাক যুদ্ধ করেছেন লক্ষ্মীছড়া চা বাগানে।

দেশেই ছিলেন, বাগানেই ছিলেন মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে। এখন তাঁরা সরকারি কর্মচারী। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের জবানবন্দীতে লেখা বিভিন্ন জায়গায় নারীদের অংশ গ্রহণের কথা এসেছে। বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে। মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবিব লিখেছেন-‘মুক্তিযোদ্ধা রবিউল যখন আহত হন তখন গ্রামের গৃহবধূরা সহায়তা করার জন্যে এগিয়ে এসেছিলেন।

যদিও গৃহস্বামীরা দরোজায় দাঁড়িয়ে ইতঃস্তত করছিলেন”। একাত্তরে নারী নির্যাতনের ধরণ একাত্তরের নারী নির্যাতনের ধরণ নিয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণা হয়েছে। তবে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে নির্যাতনের ধরণ, প্রকৃতি, সংখ্যা, ব্যাপকতা, কাল প্রভৃতির আলোকে গবেষণা সাজিয়েছেন ডা. এম এ হাসান। তার আলোকেই নিচের আলোচনাটুকু। স্পট রেপ পঁচিশ ও ছাব্বিশে মার্চের গণহত্যার পরপরই পাকিরা বিভিন্ন শহরে, সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, স্বাধীনতার পক্ষের বাঙালি- বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িগুলোতে ব্যাপক হানা দেয়।

এ পর্যায়ে তারা কাউকে হত্যা করে, অনেককে বেঁধে নিয়ে যায়। পুরুষদের নির্যাতন করার পর কোনো কোনো স্থান থেকে নারীদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কোনো কোনো পরিবারে মা-মেয়ে ও অন্যান্য নারীদের তাদের বাড়িতেই নির্যাতন করে। এ সময় যৌন নির্যাতনের চেয়ে হত্যার প্রবণতাই ছিলো বেশি। এর কয়েকদিন পর এরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। ধ্বংস-হত্যা আর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

নারী ধর্ষণের ভয়ঙ্কর নজির সৃষ্টি করে ইতিহাসের বুকে। এ ধরণের স্পট রেপ প্রক্রিয়া শুরু হয় এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের শেষ দিক থেকে। এই ধর্ষণ প্রক্রিয়া আমাদের বিজয় লাভের পূর্ব- পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। এসব ধর্ষণের ক্ষেত্রে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা প্রতি বাড়িতে দু’তিন জন ছিলো। স্পট গণধর্ষণ যেখানেই পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী প্রতিরোধের সম্মুখিন হয়েছে কিঙবা মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতি আঁচ করতে পেরেছে বা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে- সেসব স্থান বা তার আশেপাশের বহু এলাকায় তারা তাদের ধ্বংসলীলা চালিয়েছে।

এক একটা এলাকা ঘেরাও করেছে, শক্ত সমর্থ পুরুষদের বন্দী করেছে এবং তাঁদের সম্মুখেই এক একটা ভিটায় বা এক একটা ঘরে অনেকগুলো নারীকে জড়ো করে পুরো বাহিনী মিলে ধর্ষণ করেছে। এ ধরণের এক একটি গণধর্ষণে আট দশজন থেকে প্রায় একশ’ জন পাক সেনা পর্যন্ত অংশ নিয়েছে। এই ধর্ষণের তান্ডবতা পুরো নয় মাস ধরেই চলেছে। নাটোরের ছাতনী গ্রামে গণহত্যা চালানোর পর পাকিস্তানিরা এরকম একটি ভয়ঙ্কর গণধর্ষণ চালায়। এটি কেবল একটি উদাহরণ।

এরকম হাজার হাজার উদাহরণ ইতিহাস ঘাঁটলেই চোখে পড়বে। সেনাঘাঁটি ও ক্যাম্পে বন্দী নারীদের ধর্ষণ কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের একটি উপন্যাস আছে। ‘নেকড়ে অরণ্য’। পাকিস্তানি ক্যাম্পে কীভাবে নির্যাতন করেছে শুয়োরের বাচ্চারা, আর সেই নির্যাতনের প্রকট দৃশ্য দেখে কী স্বাভাবিক আত্মতৃপ্তিতে মজেছিলো এ দেশীয় রাজাকাররা- তার চাবুক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। যুদ্ধের পুরো নয় মাস পাকিস্তানিরা বিভিন্ন বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, বিভিন্ন যাত্রী ছাউনী, রেলস্টেশন, বাসস্টেশনসহ সারা বাঙলার বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে আনে নারীদের এবং তাদের বন্দী করে রাখে সেনাক্যাম্পে।

এসব কাজে রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতা ছিলো সবচেয়ে বেশি। ক্যাম্পে বন্দী করে নির্যাতনের জন্য সাধারণত রাজাকাররাই নারীদের তুলে আনতো বা বিভিন্ন জায়গায় পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে যেতো। এসব নির্যাতন ক্যাম্পে নারীরা কখনো একদিন, একাধিক দিন, কখনো বা মাসের পর মাস ধর্ষিত হয়েছেন। শেষ দিকে পাকিস্তানিরা এই বীরাঙ্গনাদের অধিকাংশদেরই হত্যা করে। যৌনদাসী যুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি সৈন্যরা- পাকিস্তানি পতাকার মিলিটারি জিপে এসে বাঙালি নারীদের উপর কী পাশবিক নির্যাতন করেছে, তা বোঝার জন্যে নির্যাতনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করতে হয়।

সেনাঘাঁটি বা ক্যাম্পে বন্দী নির্যাতিতা নারীদের মধ্য থেকেই সাধারণত যৌনদাসী নির্বাচন করা হতো। এদের নির্যাতন করতো উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। ক্যাম্পের বদল হলে, এই নারীদেরও সেনারা সঙ্গে করে নিয়ে যেতো। এরকম যৌনদাসীর শিকার হয়েছেন হবিগঞ্জের লস্করপুর চা বাগানের অনেক শ্রমিক। ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে এবং বিজয়ের পর অসংখ্য নারীকে পাওয়া যায় পাকিস্তানি ক্যাম্পে ও বাঙ্কারে।

পাকিস্তানি সৈন্যদের নিষ্ঠুরতা এবং অমানবিকতার ধরণ পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের ধরণ সকল সভ্যতা বিবর্জিত মানুষের আচরণের চেয়েও নিকৃষ্ট ছিলো। তাদের কোনো কোনো আচরণ ছিলো ভয়ঙ্কর বিকারগ্রস্থ। এই বিকারগ্রস্থতা এতোটাই বেশিমাত্রায় ছিলো যে- মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এদের সাইকোপ্যাথ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা যায়। অসংখ্য পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসার একের পর এক অসহায় নারীকে সবার সামনে বিবস্ত্র করে নিষ্ঠুর যৌন নির্যাতনে রক্তাক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি; তারা এইসব নারীর পায়ুপথ ছিন্নভিন্ন করে তাদের সকল বর্জ্য ও যৌনাঙ্গ নারীদের মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অল্প বয়সী নারীরা যখন বিভৎস যন্ত্রণায় কাতরিয়েছে, তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা বেয়নেটের খোঁচায় ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে তাদের যোনীপথ।

পাকিস্তানিদের যৌন বিকৃতি, মনোবিকার ও নিষ্ঠুরতা এতোটা ভয়ঙ্কর ছিলো যে তাদের অনেককে সাইকোপ্যাথিক পারসোনালিটি হিসেবে গণ্য করে তাদের অপরাধকে আচরণ বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় করা উচিত। তারা যুদ্ধে যতোই পরাভূত এবং পরিবার ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছিলো, ততোই তারা নিষ্ঠুর যৌন নির্যাতক, বিকারগ্রস্থ ও ধর্ষকামী হয়ে উঠছিলো। তারা নিষ্ঠুর নিপীড়নের মাধ্যমে ভুলতে চাচ্ছিলো পরাজয়ের গ্লানি। পরবর্তীতে আচরণগত বিচ্যুতির ব্যাখ্যা ও কৈফিয়ত দিতে গিয়ে জেনারেল নিয়াজি নিজেদের নির্দোষ জাহির করে বলে- `..…..The psychopath is one whose conduct is satisfactory to himself and to no one else.’ (G.D.Partridge). তবে নিয়াজি যতোই শাক দিয়ে মাছ ঢাকুক- পাকিস্তানিদের চারিত্রিক ও আচরণগত বিকারের পেছনে নিষ্ঠুর অবদমনেচ্ছা, জাতিগত প্রেরণা ও অসহিষ্ণুতা অত্যন্ত শক্তভাবে কাজ করেছে। পাকিস্তানিদের এই মনোবিকৃতির ব্যাখ্যা প্রদান করা যায় এই ভাবে-‘The attainment of sexual gratification through the infliction of bodily or mental pain on others by physical or verbal means.. ..In a broader, nonsexual sense, sadism refers to any type of cruelty or extreme aggression. [The Curse of Virtue and the Blessing of Vice, Marquis de Sade (1740-1814)]. পাকিস্তানি সৈন্যদের এ জঘন্য মনেবৃত্তির কারণে সারা বাংলাদেশ হয়ে উঠেছিলো চিৎকারের ভাগাড়, নারীদের সেখানে ভয়ানক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।

এতোটা ভয়াবহ, বিকৃত মানসিকতা সম্পন্ন বিভৎস নির্যাতন পৃথিবীর আর কোথাও হয়নি- সভ্যতা আর কোনো দিন এমন বিভৎসতা দেখেনি। একাত্তরে ধর্ষিত ও নির্যাতিত নারীদের নিয়ে ডাব্লিউসিএফএফসি’র গবেষণা ১। ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা : সাড়ে চার লাখেরও বেশি ক. দেশের অভ্যন্তরে: দুই লাখ দুই হাজার পাঁচশত সাতাশ জন খ. শরণার্থীদের মধ্যে: এক লাখ একত্রিশ হাজার দুইশত পঞ্চাশ জন (মার্চ-আগস্ট, ১৯৭১) ২। নির্যাতিত নারীদের ধর্ম ক. মুসলমান: ৫৬.৫০% খ. হিন্দু: ৪১.৪৪% গ. খ্রিস্টান ও অন্যান্য: ২.০৬% ৩। নির্যাতিতা নারীদের বৈবাহিক পরিসংখ্যান ক. বিবাহিত: ৬৬.৫০% এর চেয়ে বেশি খ. অবিবাহিত: ৩৩.৫০% এর চেয়ে কম গ. হিন্দু অবিবাহিত/কুমারী: ৪৪% এর চেয়ে কম ঘ. যৌনদাসী, কমফোর্ট গার্ল (সেনাক্যাম্পে নির্যাতিতা নারীদের নাম) ও সন্তানসম্ভবা অধিকাঙশ বীরাঙ্গনাই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত।

অধিকাঙশ যুদ্ধশিশুর মায়েরাও ছিলেন তা-ই। ৪। নির্যাতনের ধরণ ক. স্পট ধর্ষণ ও স্পট গণ-ধর্ষণ: ৭০% খ. ক্যাম্পে রেখে নির্যাতন: ১৮% গ. অন্যান্য অবস্থায় নির্যাতন: ১২% ৫। নির্যাতন পরবর্তী সময়ে নারীদের শারীরিক-স্বাস্থ্য সমস্যা ক. শ্বেতস্রাব: ৮০% এর চেয়ে বেশি (কয়েকমাসব্যাপী) খ. তলপেটে ব্যাথা: ৬৬% এর চেয়ে বেশি (কয়েকমাসব্যাপী) গ. রক্তস্রাব: ৩৪% এর চেয়ে বেশি (কয়েকমাসব্যাপী) ঘ. মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তস্রাব (মেনোরেজিয়া): ২০% এর চেয়েও বেশি (দীর্ঘকালব্যাপী) ঙ. ব্যাথাযুক্ত মাসিক (ডিসমেনোরিয়া): ৫০% এর চেয়েও বেশি (দীর্ঘকালব্যাপী) ৬। নির্যাতন পরবর্তী সময়ে নারীদের মানসিক-স্বাস্থ্য সমস্যা ক. বিষাদগ্রস্ততা: ৮০% এর চেয়েও বেশি খ. মাথা ব্যথা, অস্থিরতা, নৈরাশ্য ইত্যাদি: ৮০% এর চেয়েও বেশি গ. গ্লানিতে ভোগা: ৯০% এর চেয়েও বেশি ঘ. দুঃস্বপ্ন দেখেছেন: ৯০% এর চেয়েও বেশি ঙ. মনসম্পর্কিত দৈহিক রোগ: ৮০% এর চেয়েও বেশি ৭।

স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন নির্যাতনের স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন রয়েছে শতকরা ৭ ভাগেরও কম নারীর। (ডাব্লিউসিএফএফসি ল্যাবে পরীক্ষিত) ৮। নির্যাতন পরবর্তী দৃশ্যপট ক. স্বামী কর্তৃক লাঞ্ছিত বা পরিত্যক্ত: ৭% এর কম খ. আত্মীয় বা পরিজন দ্বারা লাঞ্ছিত: ৯০% এর বেশি গ. গ্রামের নির্যাতিতা নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামীর সহানুভূতি পেয়েছেন ঘ. শহর অঞ্চলের নির্যাতিত নারীরা অপেক্ষাকৃত কম সাপোর্ট পেয়েছেন ঙ. গ্রামাঞ্চলে নির্যাতিতা নারীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সবকিছু জানিয়ে বিয়ে দিতে হয়েছে। চ. বিবাহিত নারীরা খুব কম ক্ষেত্রেই স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছেন। এখানে একাত্তরের নারী নির্যাতনের একটি ক্ষুদ্র অংশ তুলে ধরা হলো।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এদেশের মানুষের উপর আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে যে ভয়াবহ নির্যাতন করেছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে, সভ্যতার ইতিহাসে এক কালিমা। তবুও গোল্ডফিশের মেমোরি- এখনও পাকিস্তানের স্তবে মজে থাকি। স্টেডিয়ামেই প্রমাণ মেলে হীনমন্যতার। লেখক : এম. মিজনুর রহমান সোহেল সম্পাদক ফ্রাইডে ঢাকা টাইমস E-mail : ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.