আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘুরে এলাম নাফাখুম - ২

তুই ভালো থাকিস, আমি সুন্দর থাকবো ঘুরে এলাম নাফাখুম - ১ বি, ডি, আর দের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে গেলাম রেমাক্রি বাজারে, রাতের খাবার খেলাম (এটা আসলে ছিল রাতের খাবারের আগে একটা ওয়ার্ম আপ) আর কিনে নিয়ে আসলাম ছাগলের সমান সাইজের (একটু কি বেশি বলে ফেলছি??) একটা মোরগ, চাল, ডাল, তেল, মশলা আর লাকড়ি; হাড়ি পাতিল ধার করলাম বাজার থেকে। ইট দিয়ে চুলা বানিয়ে শুর হল রান্নার আয়োজন। টিম লীডার ছিল পাচক শুকান্ত আর তার সহকারী জয়নুল ভাই ও ফুড ডিপার্টমেন্ট এর ২ মন্ত্রী এহসান ভাই, শাকিল ভাই। (টপ সিক্রেটঃ রান্নার ছবিতে আমরা বাকি যারা ছিলাম তারা শুধু ছবি তোলার জন্য পোজ দিসি)। এই টূরের সবচেয়ে কন্সিস্টেন্ট সাগর ভাই তখন শুকনা খাবার নিয়ে প্রস্তুত।

আর আমরা বাকি সবাই রুমে ডুকে ৫ মিনিটের মধ্যে ঘুম। রান্না শেষ করে শুকান্ত ভাই এসে আমাদের ডেকে তুললো, আগেই কলা পাতা নিয়ে এসেছিলাম সেই পাতায় গরম গরম খিচুরী আর মোরগের মাংস, সাথে পাচক শুকান্ত স্পেশাল পিয়াজ মরিচের ভর্তা। ঘরের বাইরে খোলা বারান্দায় জথুবথু হয়ে বসে শীতের মধ্যে কাপতে কাপতে কলা পাতায় খিচুরি আর মাংস, খিচুরী থেকে যত ধোয়া বের হচ্ছে তার চেয়ে বেশি ধোয়া বের হচ্ছে আমাদের নিঃশ্বাসের সাথে। পরিমানে একটু কম হলেও মনে হচ্ছিল অমৃতের কাছাকাছি কিছু একটা খাচ্ছি (কাছাকাছি না বলে অমৃত ই বলতে চেয়েছিলাম, তাতে শুকান্ত ভাই আবার বেশি ফূলে যেতে পারে এই জন্য বললাম না)। এরপর ৩ জন ৩ জন করে ২ বিছানায় আর ৪ জন ফ্লোরে......... ঘুম............ আজকে আর কারো নাসিকা গর্জন আমাদের কাবু করতে পারলোনা, কিন্তু যে কাবু করলো তার কাছে ফিকরি ভাই আর রুবেল ছাড়া বাকি সবাই ধরা খাইছি।

পাহাড়ের ওপর শীত এতোটাই বেশী যে শীত কমানোর জন্য ঘুমানোর আগে মাতিয়ার ভাই একটা ধানী মরিচ কাচা চিবিয়ে খেয়ে নিছে। আমি শুয়েছি একটা টি-শার্ট, তার ওপরে লেদারের জ্যাকেট পরে। পিঠের নিচে একটা কম্বল, ওপরে একটা কম্বল, হাতে হাত মোজা, পায়ে পা মোজা, মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ শুধু চোখ ২ টায় কোনো কাপড় নাই। শীতে কাপতে কাপতে যখন ভোর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল দেখি সবার-ই একি অবস্থা, সবাই জেগে আছে, বিস্ময়কর রকম ব্যাতিক্রম শুধু মি. রেমাক্রি (ফিকরি ভাই) আর ডোবার। সূর্যী মামা উঠার আগেই আমরা উঠে গেলাম, বলা উচিত উঠতে বাধ্য হলাম।

আর ও কিছুক্ষন সময় পার করে আমি আর শাকিল ভাই বাইরে গেলাম কালকের অবশিষ্ট লাকড়ি দিয়ে আগুন ধরানোর জন্য। বৃথা চেষ্ঠা, প্রতিবার আগুন ধরাতে যদি ৫ মিনিট লাগে, তো আগুন নিভে যেতে লাগে ২ মিনিট, নিজেদের কেমন বেকুব বেকুব মনে হচ্ছিল। শীতের সকাল, ২ হাত ২ দিকে টানটান করে দাড়ালে নিজের হাত-ই ঠিকমত দেখা যায় না, এরি মধ্যে আমাদের বের হতে হচ্ছে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পড়ে। হাত এবং পায়ের আঙ্গুল গুলোতে কোনো সাড়া নাই, নাক দিয়ে ধোয়া বেরুচ্ছে ইটের ভাটার চিমনির মতো তারি মাঝে শুরু হল পাহাড়ী পথ ধরে আমাদের পথ চলা এবং ২০ মিনিট যাবার আগেই মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে এলো সাঙ্গু নদী। বরফ শীতল পানি বললে বরফ কে অপমান করা হবে, পানি এতোটাই শীতল।

নদী পার হয়ে আমাদের পুরো টীম শুরু করলো দৌড়, তাতে লাভ হলো ২ টা, আমরা অনেক তাড়াতাড়ি পৌছে গেলাম, আর শীতের হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেলাম। ২ ঘন্টার পথ আমরা পার হয়ে এলাম মাত্র ১ ঘন্টা ২০ মিনিটে। পাহাড়ি পথটা কুয়াশায় একটু পিচ্ছিল হয়ে ছিল, একটু যে রিস্ক ছিলনা তা বলবোনা, কিন্তু শীত আর নাফাখুম দেখার উত্তেজনায় রিস্ক-এর কথা কারো মাথায়-ই আসে নাই। যাবার পথে আমাদের সাঙ্গু পার হতে হয়েছে মোট ৪ বার। পানি ছিল কোমর পর্যন্ত তাই সাতরাতে না হলে-ও অর্ধ শুকনা আর অর্ধ ভেজা অবস্থায় সারাটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।

একজায়গায় নদীর মাঝখান পর্যন্ত পানি কম তারপর হঠাৎ করেই খাদ থাকায় মাঝ নদী থেকে নদীর অপর পাড় পর্যন্ত একটা বাশের সাকো বানানো। নদীর মাঝে কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে বাশের সাকো তে উঠতে হয়, যেই সাকোতে আবার ধরার জন্য কোনো হাতল নাই। একটু একটু করে পা টিপে টিপে কয়েকজন পার হবার পর সাকোতে উঠলো সাগর ভাই। । সাকোতে উঠার পর থেকেই কাপতে শুরু করা সাগর ভাইকে সবাই বেশ উৎকন্ঠা দিয়ে দেখছে আর উপদেশ দিচ্ছে, সাকোর মাঝামাঝি যাবার পর পর-ই ছলাৎ করে একটা আওয়াজ এবং সাগর ভাই পানিতে।

নাফাখুম......... গর্জন দিয়ে দূর থেকেই জানিয়ে দিচ্ছিল আমি আছি আমার ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। গেলাম, দেখলাম এবং মূগ্ধ হলাম ......... উচ্চতা খুব বেশি না, ২০- ২৫ ফিট হবে, শীত কাল হওয়াতে নদীতে পানি-ও কম, সাঙ্গু আসতে আসতে হঠাৎ করেই সামনে কিছু না পেয়ে মনে হলো হোচট খেয়ে নিচে পড়ে গেলো আর নিচে গিয়ে পাথরে বাড়ি খেয়ে করতে শুরু করলো হিংস্র গর্জন। এই অল্প পানিতে-ই এত শব্দ হচ্ছিল যে নাফাখুম এর পাড়ে দাঁড়িয়ে পাশের জনকে কিছু বলতে হলেও আমাদের বলতে হচ্ছিল গলার স্বর উচুঁ করে............... যদি বর্ষা কালে আসতে পারতাম !!! নাফাখুম এর পাশে ছিলাম প্রায় ঘন্টা ২ এর মতো, সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছবি তুলছি, গল্প করছি হঠাৎ করে আবার ও ছলাৎ... ... ... নাফাখুম এর ঠিক মুখে জয়নুল ভাই এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফ দিয়ে পার হতে নিয়েছিল, পাথরের উপরের শেওলার সাথে ভিজা পা এর স্পর্শ হবার সাথে সাথে জয়নুল ভাই এর পা গেল টেকনাফের দিকে আর মাথা তেতুলিয়ার দিকে। পাশ থেকে শুকান্ত ভাই সাথে সাথে হাত ধরে ফেলায় এ যাত্রা খরচা হবার হাত থেকে জয়নুল ভাই বেচে গেল-ও (আল্লাহ মহান) পড়ন্ত পানির সাথে জয়নুল ভাই এর এক পাটি জুতা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। ফেরার আগে পাথরে পা দিয়ে আরেকটা ছলাৎ এবং ২য় বারের মতো সাগর ভাই পানিতে।

ফেরার পথে জয়নুল ভাই আরো ৩ বার পড়লো, উনার রাশিতে আজকে মনে হয় দুষ্টচক্র চলতেছে। ফেরার সময় আর আগের পথে না গিয়ে সাঙ্গু-র পাড় ধরে চলে আসলাম সাঙ্গু-র মূলস্রোতের সাথে যেখানে এসে নাফাখুম এর ধারা মিশেছে সেখানে। জায়গাটার নাম নাফামুখ, মূলস্রোতের সাথে মেশার ঠিক আগে এখানে ৭-৮ টা সিড়ির মতো আছে, খড়স্রোতা পানি এখানে এসে ধাপে ধাপে নিচে নেমে মিশে যাচ্ছে মূল নদীতে। নদীতে পানি কম হওয়াতে জামা কাপড় খুলে এখানেই গোসল করতে বসে গেলাম। সবাই হাফপ্যান্ট বা থ্রী-কোয়ার্টার পরলে-ও আমাদের ডোবার পানিতে নেমে গেল আন্ডারওয়্যার পরে, সাঙ্গুর হীমশীতল পানি মাত্র ৩০ মিনিটেই আমাদের গত দুইদিনের ক্লান্তি সাথে করে নিয়ে গেল, আর দিয়ে গেল রাক্ষুসে ক্ষুধা।

গোসল শেষ করে দুপুরের খাবার খেয়ে ১ টার মধ্যে আমরা নদী-র পাড়ে এবং যা দেখলাম তাতে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা। আমাদের নৌকা (যেটা পুরাতন)-র একপাশে টেনিস বলের সমান একটা ফুটা, মাঝিরা ইট দিয়ে তার উপরে বালির বস্তা বসিয়ে কোনোরকমে নৌকাটাকে এখন-ও টিকিয়ে রেখেছে। এই নৌকা থেকে চাপ কমানোর জন্য এহসান ভাই চলে গেল মাতিয়ার ভাই দের নৌকায়। ৪ জন - ৬ জন করে ২ নৌকায় বসে রওয়ানা দিলাম থানচির দিকে এবং পার করলাম সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ৫ টা ঘন্টা। আসার সময় এসেছি নদীর উজানে এখন যাচ্ছি ভাটার দিকে, যে পথ আসতে লেগেছে ৯ ঘন্টা, সেই পথ পাড়ি দেব মাত্র ৫ ঘন্টায়।

যাত্রার শুরুটা হল অলস ভাবে, কিছুক্ষন আসার পরেই একে একে আসতে থাকলো বাক আর খাড়া ঢাল। পানির তীব্র স্রোতের সাথে নৌকা উপর থেকে নীচে ছিটকে পড়ে আর নৌকা গুড়িয়ে যাবার শঙ্কা-র সাথে সাথে ছিটকে আসা পানিকে আমরা ভিজতে থাকি। বড়পাথর আসার কিছু আগে... সামনে ঢাল, পাথরের মাঝ দিয়ে সরু রাস্তা, পানির তীব্র স্রোত পাথরে এসে বাড়ি খেয়ে ছিটকে নীচে পড়ছে এরি মাঝ দিয়ে যাবার সময় মাতিয়ার ভাই দের নৌকা সামান্য ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে আর তাতেই পাথরে ছিটকানো পানি ২ পাশ দিয়ে নৌকায় উঠে নৌকা অর্ধেক ডুবে যায়। ব্যালান্স হারানোর সাথে সাথে সামনের মাঝি কাত হয়ে পানিতে ছলাৎ আর পিছনের মাঝি লাফ দিয়ে পানিতে নেমে নৌকা পিছন থেকে টেনে ধরে কোনরকমে নৌকা একপাশে সাইড করে থামায়। ততক্ষনে সবার তল্পি-তল্পা পানিতে ভিজে একাকার আর চোখ-মুখ সাদা হয়ে গিয়েছে।

থানচি থেকে রেমাক্রি পর্যন্ত সাঙ্গু-র বৈশিষ্ঠ্য হচ্ছে যে জায়গায় পানি বেশি সেখানে পানি পুকুরের মত শান্ত, আর যেখানে নদী খাড়া নেমেছে সেখানে পানি কম (সবসময় না শুধু শীত কালে)। কেউ ডুবে মারা যাবে না, কিন্তু পাথুরে নদী হওয়াতে হাত পা কেটে যাওয়াটা বাধ্যতামূলক এমন কি ভেঙ্গে-ও যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় ভয় হচ্ছে এই এলাকায় নৌকা চলে সারাদিনে ৬ / ৭ টা, আর যে নৌকাগুলা আসে তাও থাকে লোক বোঝাই। অন্য কোনো নৌকা পেতে হলে কোনো এক মাঝিকে বলে দিতে হবে সে গিয়ে অন্য কোনো মাঝিকে পাঠাবে তারপর আমরা যাব, ২ দিনের ব্যাপার। আর এই ২ দিন আমাদের কাটাতে হবে নদীর পাড়ে, পাহাড়ের পাদদেশে, ঠান্ডা আর কোনো খাবার ছাড়া।

বড়পাথর আসার সাথে সাথে আমরা নৌকা থেকে নিচে নেমে গেলাম, যে পথে আসার সময়-ই নৌকাতে চড়ার সাহস পাইনি, সেই পথে নামার সময় নৌকাতে চড়বে এরকম পাগল বা মাথা খারাপ আমাদের সাথে একজন ও ছিলো না। নাফাখুম থেকে আসার সময় এহসান ভাই এর পা মচকে যায়, সেই মচকানো পা নিয়েও এহসান ভাই এই বিশাল বিশাল পাথর ডিঙ্গিয়ে আসতে লাগলো। বড় পাথর থেকে রওয়ানা দিয়ে আমাদের নৌকা মাতিয়ার ভাইদের নৌকা থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়, তিনটার দিকে তিন্দু পার হয়ে চারটায় পাদ্মঝিরি এসে ২০ মিনিট কাটানোর পর মাতিয়ার ভাই দের নৌকা আসতে দেখা গেল। এই পুরোটা পথ আমাদের আসতে হয়েছে পানি সেচতে সেচতে এবং এবার ও সাগর ভাই পানি সেচার প্রধান হিসেবে আর আমি ও শুকান্ত ভাই সহকারী হিসেবে পানি সেচে গেলাম। এই সময় টুকর মধ্যে কমপক্ষে ১০ বার আমাদের নৌকা উল্টাতে উল্টাতে বেচে গেছে।

২ টা ঢাল পাড় হতে হয়েছে যেখানে পানি সোজা ছুটে এসে পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে ৯০ ডিগ্রী বাক নিয়ে আরো খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে। সময় মতো নৌকার নাক ঘুরানো না গেলে সোজা গিয়ে বাড়ি খেতে হবে পাথুরে দেয়ালে, স্রোত দিয়ে নামতে নামতে যদি পথ থেকে সরে যায় তাহলে পানির নিচে ডুবে থাকা পাথরে বাড়ি খেয়ে নৌকা যাবে ভেঙ্গে, আর এই পথে যদি নৌকা থামানোর চেষ্টা করে তাহলে সাথে সাথে নৌকা উলটে যাবে। কত বার যে নৌকার তলা আর পাশ পাথরের সাথে বাড়ি খেয়েছে তার কোনো হিসাব নাই, আর প্রতিবার বাড়ি খাবার সময় মনে হয় এই বুঝি নৌকা ফেটে গেল। ঢাল গুলোতে এসে মাঝিরা নৌকার ২ পাশে লগি দিয়ে খোচা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে নৌকার ঠিক আশে পাশে কোনো ডুবোপাথর আছে কিনা? একটা ঢাল পার হতে গিয়ে আমাদের এক মাঝি-র লগি পাথরের খাজে আটকে হাত থেকে গেল ফসকে। স্রোতের সাথে আমাদের নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে আর মাঝির লগি নদীর মাঝখানে সোজা হয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এরপর আবার স্রোতের উলটা দিকে গিয়ে লগি নিয়ে আসতে হয়েছে। ঠিক তার পরের ঢালটাতেই আমাদের সামনের মাঝি ঠিকমতো খেয়াল না করে নৌকা তুলে দিয়েছে এক পাথরের ঊপরে, পাথরটা নৌকার সামনে থেকে ঘষা খেতে খেতে মাঝখান পর্যন্ত আসতে আসতে আমাদের নৌকা পানি থেকে ফুট খানেক উপরে উঠে গেছে। কয়েক সেকেন্ড এর জন্য দেখলাম আমাদের নৌকা পাথরের উপরে ঝুলে আছে আর নদীর তীব্র স্রোত যাচ্ছে আমাদের নৌকার তলা থেকে ১/১.৫ ফুট নিচ দিয়ে, তারপর-ই সবাই একসাথে পানিতে লাফ। সবাই মিলে নৌকা টেনে একপাশে নিয়ে হেটে হেটে ঢাল টা পার হয়ে তারপর আবার নৌকাতে উঠি। এছাড়া ও আরো কত যে ছোট খাটো বিপদ পার হয়ে আসতে হয়েছে তার কোনো হিসাব নাই, এবং আমাদের অন্য নৌকাটার ও একি পথ দিয়ে এক-ই রকম সংগ্রাম করে আসতে হয়েছে।

পদ্মঝিরি থেকে ঘন্টাখানেক পথ এ পানি অনেক বেশি, এখানে ডুবো পাথরে বাড়ি খাবার কোনো সম্ভাবনা নাই বলে এইপথটুকুতে ইঞ্চিনের নৌকা চলে, এই রকম একটা নৌকার সাথে আমাদের নৌকা ২ টা বেধে আমরা ইঞ্চিনের নৌকাতে চড়ে রওয়ানা দিলাম। রেমাক্রি থেকে রওয়ানা দিয়ে এই প্রথম আমরা ক্যামেরা বের করলাম এবং সবার মুখের রঙ ফ্যাকাশে থেকে স্বাভাবীক হয়ে আসতে শুরু করেছে। আধাঘন্টা পরেই এক ঘাটে এসে ইঞ্চিনের নৌকা থেকে নেমে আমাদের নৌকায় উঠতে হলো, আর মাত্র ১ ঘন্টার পথ বাকি। নদী এখানে অনেক বেশী শান্ত, বিপদ পার করে এসেছি চিন্তা করে একটু হাফ ছাড়ার আগে-ই আবার শুরু হয়ে গেলো। এতদিন শুধু টেলিভিশনে-ই বোট র‌্যাফটিং দেখে এসেছি, এখানে এসে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম এর মজা কত?? অবশেষে যখন থানচি এসে নামলাম ক্লান্ত, বিধস্ত সবাই প্রথমেই যা করলাম তা হল সুস্থ ভাবে ফিরে আসার খুশিতে কোলাকোলি।

রাতে থাকার জায়গা মিললো পাহাড়ের চূড়ায় এক দোতলা রেষ্ট হাউজের নীচ তলায়। এত ক্লান্ত শরীরে এই পাহাড়ে উঠার সময় মনে হচ্ছিল এরচেয়ে নাফাখুম যেতে কষ্ট কম ছিল। যে রুমে আমরা উঠলাম সেখানে ফ্লোর জুড়ে একটা ওয়েল ক্লথ পাতা এবং আর কোনো কিছু নাই। ভেজা কাপড় চোপড় নিয়ে একটু কষ্ট করে-ই রাত টা পার করতে হল। পরদিন সকাল ৮ টায় প্রথম বাস বান্দরবানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে।

ফেরি দিয়ে সাঙ্গু পার হবার সময় আবার ছলাৎ... ... না, এবার সাগর ভাই পড়ে নাই, তার পাশের ৮/১০ বছরের এক ছেলে নৌকা থেকে পানিতে পড়ে গেছে। নৌকা থেকে পড়ে যাওয়াতে নৌকা ভারসাম্য হারিয়ে কেপে উঠাতে লোকজন শুরু করলো পিচ্চিকে গালি গালাজ, আর এদিকে এই শীতের মধ্যে জ্যাকেট পড়া অবস্থায় পানিতে পড়ে কোন রকমে সাতরিয়ে পাড়ে উঠে পিচ্চি রাগে ফুলতেছিল আর কাদতে ছিল। নদী পাড় হয়ে সাগর ভাই বলে "ছেলেটা আমার জন্য পানিতে পড়ে গেল"। - "কেন, আপনি কি করছেন" ? - "নৌকায় উঠে ভারসাম্য রাখার জন্য আমি ছেলেটার ঘাড়ে ধরেছিলাম, আর তাতেই ছেলেটা পড়ে গেল"। নাফাখুম এর ঊত্তেজনা এখানে-ই শেষ, এরপর বান্দরবান এসে কিছু ঘুরাঘুরি আর ঢাকায় ফিরে আসা।

নাফাখুম এসে আমরা খরচা করে গেলাম ফিকরি ভাই এর জ্যাকেট ও ক্যাপ, এহসান ভাই এর কানটুপি ও গামছা, শুকান্ত ভাই এর কানটুপি, আমার হাত মোজা ও একটা হাফ প্যান্ট আর সাথে করে নিয়ে আসলাম সারা জীবন মনে রাখার মত কিছু স্মৃতি। কিছু জরুরী তথ্যঃ -ঢাকা থেকে বান্দরবান যায় হানিফ, শ্যামলী, ইঊনিক পরিবহনের বাস। ভাড়া ৩৫০ টাকা। - বান্দরবান শহর থেকে দিনে ২/৩ টা বাস থানচি-র উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়, ভাড়া ১৭০ টাকা। - চান্দের গাড়ী নিয়ে গেলে ভাড়া পড়বে ৩০০০ - ৫০০০ টাকা।

- থানচি থাকার জন্য সরকারী রেষ্ট হাউজ এ ভাড়া পরবে ৬০০-১০০০ টাকা। -রেষ্ট হাউজ ছাড়া ও থাকার ব্যাবস্থা আছে। - থানচি থেকে রেমাক্রি পর্যন্ত নৌকা ভাড়া ৩৫০০-৫০০০ টাকা, একেক নৌকায় যাওয়া যায় ৫-৭ জন। -রেমাক্রি যেতে সময় লাগবে ৭-৯ ঘন্টা, তাই সকাল সকাল রওয়ানা দেয়াটাই ভালো, দেরী হয়ে গেলে তিন্দু তে রাত কাটানো যাবে, থাকার হোটেল আছে। -রেমাক্রি বাজারে পৌছে-এ বি,ডি,আর ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হবে।

- রেমাক্রিতে থাকার রেষ্ট হাউজের এক রুমে থাকা যাবে ১০-১২ জন, ভাড়া ৫০০ টাকা। - নাফাখুম যেতে গাইড নিতে হবে, দিতে হবে ৩০০-৫০০ টাকা। - জরুরী ঔষধ পত্র সাথে করে নিয়ে যাওয়া উচিত। - মোবাইল নাম্বারঃ ওহাইনু মার্মা (রেমাক্রি রেস্ট হাউজের কেয়ারটেকার এর ছেলে) ঃ ০১৫৫৭ ১৯৬৪৪৭ সালাউদ্দীন (থানচি বাজার) ঃ ০১৫৫২ ৪৬৮৫৯৫ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.