আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিজয়ের মাসের আহ্বান - শত্রুদের উপর থেকে দৃষ্টি সরানোর বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরী

যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবী করছি স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে তার সুরক্ষা অনেক কঠিন - কথাটা যত কত কঠিন সত্য তা বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে আর ভাল কে বুঝবে। ১৯৭১ সালের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পরপরই বিজয়ী শক্তি বিভক্ত হয়ে পড়ে নানান কারনে। কেউ সমাজতন্ত্র চায় - কেউবা চায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র - ইত্যাদি। এদিকে পরাজিত শক্তি - বিশেষ করে রাজনীতিবিদদের অনেকে দেশের ভিতরে গা ঢাকা দেয় আর অনেকেই বিদেশে চলে যায়। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিভাজন আর পরষ্পরের বিরুদ্ধে বিবাদের কারনে দেশের মানুষ বিভক্ত হয়ে সমস্ত মনোযোগ দেয় পরষ্পরকে ঘায়েল করতে আর শত্রুরা দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।

বাংলাদেশের জন্মের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে প্রধান ছিলো মুলত মুসলিম লীগ (একাধিক উপদল), কেএসপি, পিডিপি, নেজামে ইসলাম আর জামায়াতে ইসলাম। জামায়াত ছাড়া বাকী সবগুলো দলই বাংলাদেশের বিজয় তথা নিজেদের পরাজয় মেনে নিয়ে বিভিন্ন ধারার রাজনীতিতে নিজেদের সম্পৃক্ত করে - আর দলগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। সুতরাং জামায়াত ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। কিন্তু জামায়াত আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের অস্তিত্বকে মেনে নেয়নি যদিও জামায়াতের নবীন সদস্য - শিবিরেরকর্মীদের একটা ধারনা দেওয়া হয় যে এরা বাংলাদেশেক মেনে নিয়েছে - কিন্তু শিবিরে দলীয় পতাকায় চাঁদ-তারার প্রতীক কিন্তু তা বলে না। জামায়াতকে কেন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যে হুমকী মনে করা হয় - তা বুঝার জন্যে আমারদের পিছনের ইতিহাসের দিকে একটু নজর দিতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে জামায়াতের নেতাদের একটা বিরাট অংশ পাকিস্তানে পালিয়ে যায় - যাদের মধ্যে প্রধান ছিলো গোলাম আজম। আরেকটা অংশ দেশে থেকে যায় - যারা ধীরে ধীরে দেশের ভিতরে সংগঠিত হতে থাকে। এদের নেতৃত্বে ছিলো মাওলানা আব্দুর রহীম। মাওলানা রহীমের গ্রুপ বাংলাদেশের অস্তিত্বকে মেনে নিয়ে জিয়াউর রহমানের ধর্মীয় রাজনীতির সুযোগে "ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ" নামে একটা দল তৈরী করে - যারা ১৯৭৯ এর ২য় সংসদ নির্বাচনে ২০টি আসনও পায়। এরা মুক্তিযুদ্ধের কুখ্যাত জামায়াতের ছাত্র উইং "ইসলামী ছাত্রসংঘ" যা ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর দোসর বাহিনী আল-বদর হিসাবে কাজ করেছে এবং বুদ্ধিজীবি হত্যা মিশনের সাথে জড়িত ছিলো - তাকে ইসলামী ছাত্র শিবির নামে নতুন ভাবে সংগঠিত করে।

এদিকে গোলাম আজম আর তার অংশ সৌদি আরব আর লন্ডনে বসে বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত থাকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। এরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কমিউনিজমের ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে উদ্ভুদ্ধ করন সহ বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক তৈরীতেও বাঁধা সৃষ্টি করে। ১৯৭৯ সালে জামায়াতের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে গোলাম আজম পাকিস্তানী হিসাবে টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে আসে মায়ের অসুস্থতার অজুহাতে। তৎকালীন সরকারে প্রত্যক্ষ সহযোগীয়তায় জামায়াতকে পুনরায় সংগঠিত করে। এই প্রক্রিয়া মাওলানা রহীমের গ্রুপের সাথে তাদের মতপার্থক্য হয় এবং মাওলানা রহীম গ্রুপ জামায়াতে যোগ দিতে অস্বীকার করেন এবং জামায়াতের পেট্রোডলারের কাছে তাদের রাজনীতির সমাপ্তি ঘটে।

জামায়ত শুরুতে আব্বাস আলী খানকে ভারপ্রাপ্ত আমীর বানিয়ে গোলাম আজমের নাগরিকত্বের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। এক সময় তা পেয়েও যায়। এবং জামায়াতের আমীর হিসাবে কাজ শুরু করে। এখানে যে বিষয়গুলো লক্ষ্যনীয় - জামায়াত দীর্ঘ ৩০ বছর বাংলাদেশে রাজনীতি করলেও - ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনের চাপে তাদের গঠনতন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধ কথাটি সংযোজন করে। আর মুক্তিযুদ্ধে ওদের ভুমিকা নিয়ে ক্ষমা চাওয়াতো দুরের কথা - সামান্য আলোচনাও করতে রাজী না।

ওরা চাচ্ছিলো যে - বিকৃত ইতিহাস চর্চার আড়ালে ওদের কুকর্মগুলো মানুষ ভুলে যাবে। অনেকের হয়তো জানা নেই যে - ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত বাংলাদেশের একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভি এবং রেডিওতে "পাকিস্তানী সেনা" "রাজাকার", "আলবদর" ইত্যাদি শব্দের উপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিলো। হুমায়ুন আহমেদ একটা নাটকে "তুই রাজাকার" কথাটা দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছে শব্দটা পরিচিত করেন। অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর মধ্যে থাকা পাকিস্তানপন্থী আর সিভিল প্রশাসনে থাকা আমলারা জামায়াতের পূর্নবাসনে সহযোগীতা করেছে। আর বিভক্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি পরষ্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করে এক সময় শক্তিহীন হয়ে সমযোতার নীতিতে চলে গেছে।

যার ফলে আমরা দেখেছি আওয়ামীলিগ একসময় জামায়াতকে মিত্র হিসাবে বিবেচনা করেছে। প্রবল অর্থবিত্তের মালিক এই দলটির ধূর্ত নেতারা দ্রুত এদের রং বদলিয়ে যে কোন দলের মিত্র হয়ে যেতে পারে। এরা কোন ভাবেই বাংলাদেশের মিত্র না - এদের চিনে রাখা জরুরী। (২) এখনও কি জামায়াত বাংলাদেশের জন্ম মেনে নিয়েছে? উত্তর হলো না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রের মুলনীতি বা সংবিধান ওদের কাছে অর্থহীন।

ওরা গনআন্ত্রিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে নিজেদের সংগঠিত করে এক সময় গনতন্ত্রকে হত্যা করবে। আর জামায়াত রাজনীতি করে গোপনে - মজলিশে সুরা নামক উচ্চ পর্যায়ে যে সিদ্ধান্ত হয় - তা সবাইকে মেনে নিতে হয়। সেই সিদ্ধান্ত নেবার প্রক্রিয়া কোনভাবেই স্বচ্ছ না - যা গনতান্ত্রিক রাজনীতির পরিপন্থী। গোপন রাজনীতি কোন স্বাধীন দেশে চলতে পারে না। অন্যদিকে ছাত্র শিবিরের বিষয়েও বলা যায় - প্রবল ঘৃনার আবাদ হয় ওদের রাজনীতিতে।

কাকে কিভাবে ঘুনা করতে হবে তারই চর্চা করে এরা প্রচন্ড একমুখী চিন্তার একটা সহযোগী সংগঠন তৈরী করেছে - যারা মুলত জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী নেতাদের রক্ষা করাকেই ইসলাম রক্ষা হিসাবে দেখে। ইসলামকে সামনে রেখে এই দলের নেতারা নিজেদের সম্পদ বাড়ানো ছাড়া তেমন কিছু করেনি। বিলাস বহুল জীবন যাপনকারী জামায়াতের নেতাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশে পড়াশুনা করলেও - এরা মাদ্রাসায় পড়া কোমলমতি ছেলেদের ইসলামের নামে শহীদ হতে উদ্ভুদ্ব করছে। শিবিরের তাদের শহীদের তালিকায় কোন জামায়াত নেতা বা তাদের ছেলেমেয়ে নেই - যা আছে তা হলো দরিদ্র মেধাবী ছেলেগুলা - যারা জামায়াতের অর্থে পড়াশুনা করে জামায়াতের বৃত্তেবন্দী হয়ে আছে। এদের নিজের স্বাধীন চিন্তার সুযোগও নেই।

(৩) এবার দেখা যাক যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি। জামায়াতের হিসাবে ছিলো না যে এভাবে বিচার শুরু হবে। কারন জামায়াত বিগত তিন দশকে প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছে - নেতারা সমাজের উচুস্থরে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে। তাই দেখি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী চট্রগ্রামের কসাই আলবদর নেতা মীর কাসেম আলির টিভির জন্মদিনের কেক কাটেন বর্তমান সরকারের মন্ত্রী। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে বিচার বিষয়টা খুব সহজ হবে না।

সরকারের সকল জায়গায় জামায়াত লোক রেখেছে - আর বিশেষ করে বিরোধী দলের ভিতরের ওদের পেইড এজেন্ট যে কাজ করছে তা বলাই বাহুল্য। আর আওয়ামীলীগ দল হিসাবে যে যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বিষয়ে খুব একটা আগ্রহী নয় - তা বিগত আমলেই বুঝা গেছে। গনআদালতের নেতারা শ্রদ্ধেয়া জাহানারা ইমামের অবর্তমানে নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। এমন কি নাস্তিকতা প্রসারের জন্যে ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির ব্যনারে জাহানারা ইমামের নামে পুরষ্কার দেওয়ার মতোও অদ্ভুদ ঘটনা দেখেছি। ফলাফল আওয়ামী সরকার বিষয়টা এড়িয়ে গেছে।

কিন্তু এবার যতটুকু বিচারে কাজ এগিয়েছে - তার জন্যে যতটুকু কৃতিত্ব আওয়ামীলীগ পাবে তার চাইতে অনেক বেশী পাবে নতুন প্রজন্মের ভোটাররা। এরা পরিষ্কার ভাষায় যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়ে মতামত দিয়েছে। এখন কথা হলো - বিশ্বের ইতিহাসে - এমন কি বাংলাদেশেও দেখা গেছে প্রবল গনআন্দোলনের ফসল ছিনতাই হয়ে যায়। ৯০এর কুখ্যাত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি এরশাদ এখন আওয়ামী সরকারের মিত্র আর উপ-রাষ্ট্রপতি মওদুদ বিএনপির নীতিনির্ধারক - আর ডা: মিলনের মা ছেলে হত্যার বিচারের জন্যে এখনও কাঁদছেন। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরও করনীয় ঠিক করতে হবে।

যুদ্ধারাধী বিচারের শেষ দেখার জন্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকে ঐক্যবন্ধ থাকা জরুরী। কোন রকম রাজনীতির খেলায় নিজেদের মত্ত না করে - দাঁবার গুটি না হয়ে - দৃঢ় কন্ঠে উচ্চারন করতে হবে - যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই । হতেই হবে। মিশরের তাহরির স্কোয়ারের যোদ্ধাদের মতো লক্ষ্য পুরন না করে ঘরে ফেরা মানেই সুবিধাবাদীদের জন্যে পথ ছেড়ে দেওয়া। জামায়াতের অর্থ - বিত্তের কাছে যেন যুদ্ধাপরাধের প্রক্রিয়া বিক্রি হয়ে না যায় - সেই দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

বিজয়ের মাসে আমাদের বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যেন আমাদের শত্রুদের উপর থেকে চোখ না সরাই - ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ মা বোনের সন্মানকে যে আমরা কখনও আর অবজ্ঞাকারীদের হাতে ছেড়ে না দেই। ঐক্যবদ্ধ ভাবে দেশে শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়াইএ ইম্পাত দৃঢ় অবস্থান নিতে কুন্ঠিত না হই। রাজনীতির কুটচাল যে আমাদের নতুন প্রজন্মকে আবারো দেশের ইতিহাস থেকে দুরে না রাখে - যেন নতুন প্রজন্ম জাতির শহীদরে সর্বোচ্চ সন্মান আর বীরদের নিয়ে গর্ব করাকে নিজেদের পরিচয় হিসাবে প্রকাশ করে। বিজয়ের মাসে এইটুকুই আমার আশা। সবাইকে বিজয়ের মাসের শুভেচ্ছা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.