আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জামাতী বিচারপতি আব্দুর রউফের মিথ্যাচার ও তার আইনী জবাবঃ১

আমার এই ব্লগের কোনো লেখা বা লেখার কোনো অংশ আমার লিখিত অনুমতি ছাড়া যে কোনো প্রকার মিডিয়াতেই প্রকাশ করা যাবেনা। যদি তা করা হয়, তাহলে আমি আইনগত এবং অবস্থাভেদে ব্লগের আইন/প্রসিজিওর অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিতে বাধ্য হব আপনারা জানেন যে বর্তমানে বাংলাদেশে শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে জামাত, বি এন পি এবং তাদের দোসর বিভিন্ন রকম করে, বিভিন্ন উপায়ে জান-প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করবার চেষ্টা করছেন যে বাংলাদেশে শুরু হওয়া এই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল অসাড় এবং আন্তর্জাতিক না। এটা নাকি একটা প্রহসন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, ইত্যাদ... ইত্যাদি... আমি এইসব নানাবিধ প্রশ্নের আইনী উত্তর দেয়া শুরু করেছি সম্প্রতি। সেই সূত্র ধরেই আজ জামাতি বিচারপতি আব্দুর রউফ এর মিথ্যাচার এর আইনী উটর দেবার চেষ্টা করব। এখানে একটা কথা উল্লেখ্য যে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার যে “কোলাবরেটর (বিশেষ ট্রাইবুনাল) আদেশ-১৯৭২” জারি করেছিলেন , সে সময় আমাদের এই বিচারপতি রউফ সাহেব দালালদের পক্ষের আইনজীবি ছিলেন ।

উপরের ভিডিওটিতেই তিনি তা স্পষ্ট করে বলেছেন । এখানে বিচারপতি রউফকে এক্টুখানি বুঝে নেবার ব্যাপার রয়েছে । তিনি গত ১৬ ই এপ্রিল ২০১০ সালে “দি ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রটেকশন অব হিউম্যান রাইটস (এনএফপিএইচআর)” এর উদ্যোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ওপর আয়োজিত সম্মেলনে যা বলেছেন- ভদ্রলোক প্রথমে হাইকোর্ট “ঘরের কাছে নিয়ে যাওয়া” নিয়ে অদ্ভুত সব মন্তব্য করলেন । “মুরগীর ঠ্যাঙ্গ ভাঙ্গা” নিয়ে তার ইচ্ছেমত কিছু থিওরী কপচালেন । মজার ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে , একটা আইন বা সিস্টেমের খারাপ দিকগুলোই যেন এই সাবেক বিচারপতির মূল কন্সার্ন ।

একটি আইন ব্যাবস্থার পজিটিভ দিক গুলো নিয়ে এই পৌড় সাবেক বিচারপতি একটি কথাও না বলে , তার কি কি নেগেটিভ দিক গুলো আছে সেটি তিনি “মুরগীর ঠ্যাঙ্গ” থিওরী দিয়ে বুঝাবার কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন । বিচারপতি রউফ তার বক্তব্যের শেষ দিকে এসে যেই কথাগুলো বললেন তা শুনে আমি আসলেই চমকিত হয়েছি । আগে দেখে নিন, কি বলছেন এই সাবেক বিচারপতি- “... percent advisers কিংবা Draftsman without having the sufficient experience so far the bangladesh is concerned, they have started doing things, taking some sorts of help from outside the Bnagladesh” তিনি সেইসাথে এও মন্তব্য করেছেন যে , “ বাংলাদেশের বাইরে থেকে কিছু এনে সেটাকে তাল খাওয়ানোর জন্য , মেলানোর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে যা জাতির জন্য অত্যন্ত দূর্ভাগ্য এবং জাতির জন্য অত্যন্ত খারাপ জিনিস” (ঠিক এই পর্যায়ে প্রচন্ড করতালি সমগ্র হল জুড়ে । দর্শকরা সবাই আনন্দে ফেটে পড়ছেন ) আমার আশ্চর্য লাগে । এই একই মঞ্চে এই আপিলেট ডিভিশানের সাবেক বিচারপতির সকল সঙ্গী-সাথীরা মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন এই বলে যে , “বিচার হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের” , এবং আরো বলছে যে, “ নাম দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল , কই কোনো ইন্ট্যারন্যাশ্নাল আইনের ছিটে ফোঁটাও তো দেখি না এই আইনে !!” এসব বলে মাঠ কাঁপাচ্ছেন , সেমিনার কাঁপাচ্ছেন ।

অথচ এই একই মঞ্চে বিচারপতি রউফের “আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী” বক্তব্য শুনে সবাই তালি দিচ্ছেন !!!! যিনি নিজের মুখে স্বীকার করছেন যে , দেশের বাইরে কোনো বিচার ব্যাবস্থাকে অনুসরণ করা বা তার আদলে আইন বানানো দেশের জন্য দূর্ভাগ্য জনক, সেখানে তার কলিগরা যখন “আন্তর্জাতিক মানের” কথা বলেন , আমরা সাধারণ জনগণ তখন গালে হাত দিয়েই কেবল ভাবি । আমাদের তখন বুঝতে কষ্ট হয় যে , এটি ঠিক কোন পাগলের মেলা বসেছে ?? এরা কি বাসা থেকে ঠিক করে আসেনি যে, কে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলবে ? দর্শকদের কথা বাদই দিলাম । এরা রউফের আন্তর্জাতিকতার বিরুদ্ধচারণেও খুশি আবার আন্তর্জাতিক মানে ১৯৭৩ সালের আইন প্রণয়নের প্রস্তাবেও খুশি । আসলেই এখানে কতজন বুঝে বগল বাজালেন , তা আমার বোধগম্য হয়নি । এবার বিচারপতি রউফের উক্ত বক্তব্যের রেশ ধরে কয়েকটি কথা বলা যাক ।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাটিতে ঘটে যাওয়া গনহত্যার বিচার ও দোষীদের শাস্তি প্রণয়নে আমরা তো বাদই প্রকৃতপক্ষে পুরো বিশ্ববাসীর সামনে যেই উদাহরণটি দন্ডায়মান ছিলো , তা হচ্ছে , “ নুরেম্বার্গ ট্রায়াল” । ১৯৪৫ সালের নভেম্বরের ২০ তারিখে শুরু হওয়া জার্মানীর নুরেম্বার্গ শহরে ২য় বিশ্বযুদ্ধে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছিলো ইন্টারন্যশ্নাল মিলিটারি ট্রাইবুনালের মাধ্যমে । সে সময় আমাদের সামনে ১৯৪৬ সালে হয়ে যাওয়া “টোকিও ট্রায়াল” , ইসরাইলে হওয়া “এডলফ আইকম্যানের ট্রায়াল”, ইত্যাদি ট্রায়াল গুলোও ছিলো সে সময়ে International Crimes (Tribunals) Act-1973 প্রণয়নে বড় সহায়ক উদাহরণ কিংবা গাইড । যেহেতু উল্লেখিত আইনটি প্রণীত হয়েছিলো দেশী-বিদেশী যুদ্ধাপরাধীদের আইনের কাঠগড়ায় তাদের ঘৃণ্য অপরাধের বিচার করার জন্য, সে কারন বশত খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানের করাটাই ছিলো মূল লক্ষ্য। আরেকটি প্রাসংগিক ব্যাপার মাথায় রাখা উচিত যে , সে সময় পাকিস্তানী ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া বাংলাদেশ সরকার করছিলো ।

সুতরাং সে সময় এমন একটি আইন বাংলাদেশে জরুরী ছিলো যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে ও বিচারের প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় । বিশ্ব নেতৃবৃন্দ থেকে কোনো রকমের বিরূপ প্রতিক্রিয়া যাতে না হয় , এবং একটি স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু বিচারের জন্যই এই আইনটি প্রণীত হয়েছিলো । একটা কথা তো এখন সবাই জানে যে , যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও যে ক্রাইটেরিয়া গুলো যুদ্ধাপরাধীকে তার কৃতকর্মগুলো নির্দেশ করে তা এখন আন্তর্জাতিক । মানে সকল দেশেই মোটামুটি একই রকম করে আইনটি প্রণীত হয় । হয়ত দেশ ভেদে কিছুটা পরিবর্তন সাধিত হয় , কিন্তু মূল সুরটা এক ও অভিন্ন ।

genocide , Crime against Huminity, War Crime এই শব্দগুলোর ব্যখ্যা ও ধারনা এখন সার্বজনীন । নেদারল্যান্ডে যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত স্থাপিত হয়েছে সেখানে গ্রহন করা হয়েছে ১৯৯৮ সালে প্রণীত Rome Statute . এই Rome Statute ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১১০ টি দেশ তাদের নিজেদের দেশে র‌্যাটিফাই করেছে । যার মানে হলো , আন্তর্জাতিক আদালতে এই প্রসঙ্গত কোনো মামলা হলে , সেই দেশ Rome Statute মেনে চলতে বাধ্য । শুধু তাই নয় , ৯-ই ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালের জাতিসঙ্ঘের সাধারন পরিষদের অধিবেশনে Conventiona on the prevention and punishment of the crime of genocide শীর্ষক একটি রেগুলেশন পাশ হয় । এই রেগুলেশনের ২৬০(৩) ধারার সাব অনুচ্ছেদ ২ এ হত্যা ছাড়াও আরো কিছু কর্মকান্ডকে গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা হবে ।

এই লিঙ্কে গিয়ে দয়া করে দেখুন । এবং ৩ ধারার ৫ উপধারায় খুব স্পষ্টাক্ষরে লিখিত রয়েছে যে, এই উল্লেখিত অপরাধ সমূহের প্রতি যিনি সমর্থন জানিয়েছেন , তিনিও যুদ্ধাপরাধী । একই ধারার ৭ অনুচ্ছেদে বিবৃত হয়েছে যে , এই ধরনের অপরাধসমূহ কোনো ভাবেই রাজনৈতিক অপরাধ বলে পরিগণিত হবে না । আর আন্তর্জাতিকতার বিরুদ্ধে বিচারপতি রউফ যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন আর ওই একই সেমিনারে অন্য সবাই যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছেন তা সামনা সামনি দেখতে পেয়ে আমি বিষ্মিত । এখন প্রশ্ন হচ্ছে , এরা চায় কি ? একদল বলছে “কলা ছিলে দাও” ওই একই দলের অন্য কয়েকজন বলছেন “কলা বুঁজে দাও” ।

এমতবস্থায় করণীয় কি হতে পারে সরকারের ? আগেই বলেছি , যে , বিচারপতি রউফ এই আন্তর্জাতিক আইনের উপাদান মানতে নারাজ অথচ এই সেমিনারেই তার বন্ধুরা আন্তর্জাতিক আইনের চিত্রায়ন দেখতে চাইছেন ১৯৭৩ সালের প্রণীত আইনে । কি আদ্ভুত বিরুদ্ধচারন ও মতদ্বৈততা !!! বিচারপতি রউফের কাছে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে , তিনি বাংলাদেশী আইনের এই বিরুদ্ধচারণ ঠিক কোন অর্থে করছেন ? বৃটিশ ঔপনিবেশিকদের করে যাওয়া শত বছরের আইন-কানুন আমাদের সমগ্র আইন ব্যাবস্থায় ছাপ দিয়ে আছে । ১৯৭৩ সালের আইনে বর্ণিত যে সাক্ষ্য আইন ১৮৭২, এর কথা বলা হয়েছে , সেটি কাদের প্রণীত আইন মাননীয় বিচারপতি ? দয়া করে উত্তর দিবেন কি ? আপ্নারা যখন এপিলেট ডিভিশানে কিংবা হাইকোর্ট ডিভিশানে মামলার রায় প্রদান করেন , তখন শত শত বিদেশী মামলার রেফারেন্স দিয়ে রায় দেন । আর একটি যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশে যুদ্ধাপরাধের মত সম্পূর্ণ একটি নতুন অপরাধ ( দেশীয় ধারনায়) প্রণয়ন করতে গেলে , কোনো রেফারেন্স ছাড়াই কিংবা বিশ্ব আইন অনুসরণ করা ছাড়াই আইন প্রণয়ন হয়ে যাবে মাননীয় বিচারপতি ? এই আপনার বিবেচনা ? এই আপনি ছিলেন আপিলেট ডিভিশানের বিচারপতি ? আপনার কাছে বাংলাদেশের মানুষ আদৌ ন্যায় বিচার পেয়েছে কি না , তা ভেবেই আমি শিহরিত হচ্ছি । আপনি আপনার বক্তৃতায় আনলেন কলাবরেটর আইনের প্রসঙ্গ ।

এবং বললেন যে , ১৯৭২ সালে আপনি কোনো একজন দালালের পক্ষে তার জামিন চাইতে গিয়েছিলেন । যদিও আপনি তা পাননি । আপনি উদাহরণ হিসেবে যা বললেন , তা নিতান্তুই হাস্যকর এবং সাধারন মানুষের মনে বিভ্রান্ত ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয় । আপনি উদাহরণ হিসেবে যা বললেন , তা হলো , “একজন ব্যাক্তি রান্না ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াচ্ছে আবার বৈঠক খানায় খাওয়াচ্ছে পাক বাহিনীদের আপ্যায়ন করছে । তেমন এক ব্যাক্তিকে কি করে দালাল ডাকা যায় ?” অবশ্য দালালদের আইঞ্জীবি হিসেবে তাদের রিপ্রেযেন্ট করেছেন আপনি , আমি অবাক হই নি আপনার এহেন কথায় ।

তবে খারাপ লাগে এই ভেবে যে , আপনি আইনটি না পড়েই কি কোর্টে গিয়েছিলেন? চলবে... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।